আপনি যদি লেখক হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই এটা বুঝে থাকবেন লেখকেরা অন্যের উপদেশ অনুযায়ী তেমন চলতে পারেন না। নিজের ইচ্ছানুযায়ী চলাটাও টাফ হয়ে দাঁড়ায় যখন একটি গল্প-কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকে, তার চরিত্ররা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যখন চলতে শুরু করে। তাই, লেখকদের জন্য উপদেশ অনেকটাই অর্থহীন, এবং কখনো অন্যের উপদেশ শুনবেন না এই উপদেশ সম্ভবত তাদের প্রিয় উপদেশ।
তাহলে এই লেখাটি কেন তৈরী করছি? ইনটেন্ট উপদেশ জানানো নয়, নিজে উপদেশ দেয়া তো নয়ই। বরং, অন্য লেখকেরা উপদেশ দেয়ার মোড়কে লেখালেখি নিয়ে কীভাবে ভেবেছেন তা জানাটা আমার কাছে দারুণ লাগে। আমি পৃথিবীর সব গ্রেট লেখকদের ব্যাপারে আগ্রহী। তারা কীভাবে লিখেছেন, কীভাবে ভেবেছেন, কীভাবে অভ্যাস তৈরি করেছেন ও ভেঙেছেন -এগুলির ব্যাপারে। এর মানে এই না হুবহু তা অনুকরণ করতে হবে আমার বা অন্যান্য লেখকদের। মূলত গ্রেট (এবং ফালতু) লেখকদের বক্তব্য ও চিন্তা থেকে আমরা পেতে পারি ইনসাইট। তাদের অনেক চিন্তা আমাদের চিন্তার সাথে মিলে যেতে পারে, মিলে যেতে পারে লেখালেখির বা পড়ার অনেক অভ্যাসও। অথবা আমাদের ভেতরে থাকা অস্পষ্ট কোন ধারণা দিশা পেতে পারে তাদের অন্তঃর্দৃষ্টির সাহায্যে।
তারা যেহেতু আমাদের লাইনেরই লোক, এবং এই লাইনে তারা দীর্ঘদিন কাজ করে লাভ করেছেন অভিজ্ঞতা তাই তাদের ইনসাইট, তাদের ভাবনা একই লাইনে কাজ করতে, লাইনটিকে আরো ভালো করে বুঝতে সাহায্য করতে পারবে আমাদের, এমনটাই মনে হয় আমার। সেই থেকে মূলত লেখাটি তৈরী করার ইচ্ছা। এবং তাহলে শিরোনামে লেখকদের জন্য উপদেশ কেন? সোজা কথায় যাতে লেখকেরা আগ্রহী হন তাই, মূলত এখানে আছে লেখকদের জন্য ইনসাইট।
চরিত্র নির্মান বিষয়েঃ
চরিত্র নির্মান বিষয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা হলো, লেখকদের উচিত মানুষ তৈরী করা। জীবন্ত পিপল। চরিত্র নয়। চরিত্র তৈরী করলে তা হবে ক্যারিকেচারের মতো।
সমারসেট মমের উক্তি হলো এ বিষয়ে, আপনি আপনার চরিত্রদের ব্যাপারে কখনোই যথেষ্ট জানতে পারবেন না। অর্থাৎ, তারা আপনার জানাশোনার বাইরেও অনেক কিছু করে বা ভেবে থাকতে পারে। এজন্য দেখা যায় কখনো কোন ক্রিটিক উপন্যাস বা গল্পের কোন চরিত্রের এমন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন তা লেখক নিজেও ভাবেন নি।
আন্দ্রে জিদের কথা হলো, বাজে ঔপন্যাসিকেরা চরিত্র তৈরী করে, তাদের দিয়ে কথা বলায়। আর সত্যিকার ঔপন্যাসিকেরা চরিত্রদের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের কথা শুনেন। তাদের চেনার আগেই তিনি তাদের ভয়েস শুনতে পান।
সো কলড বাস্তবের লোকদের মতো আমার তৈরী চরিত্রগুলি আমার কাছে বাস্তব। এই কারণে কখনো আমি একাকীত্ব অনুভব করি না। সব সময়ই আমার সঙ্গে লোক আছে। উইলিয়াম এস বারোগস এভাবেই ভাবতেন তার চরিত্র নিয়ে।
বারনাবি কনরাড নিজের চরিত্রগুলিকে চেনার একটা উপায়ের কথা বলেছেন। আপনি কীভাবে আপনার চরিত্রগুলিকে আরো ভালোভাবে চিনবেন? ভাবুন যে ঝগড়ার সময় তারা কীরূপ ব্যবহার করবে।
বইয়ের রিভিউ পড়বেন কি?
এ ব্যাপারে ওয়াকার পার্সির কথা হলো, বইয়ের রিভিউ পড়ে কোন লাভই নেই আপনার। যদি অতি প্রশংসামূলক হয় তাহলে আপনার অস্বস্থি হবে, অর্থহীনতার বোধে আক্রান্ত হবেন। আর রিভিউ যদি খারাপ হয়, তখন মনে হবে ধরা খেয়ে গেলাম। কোন পক্ষেই লাভ নাই, কোন অনুভূতিই ভালো নয়।
কথোপকথন বিষয়েঃ
লেখায় ডায়লগ বা কথোপকথন কখন দিতে হবে, কখন দিতে হবে না তারো নিয়ম আছে। প্রথমদিকে যখন কেউ লেখা শুরু করেন তখন এসব নিয়ে ভাবেনই না। কিন্তু যখন লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন তখন তার চরিত্রসমূহের কথোপকথনের নিয়ম, বা কখন কী কথা বলবে তারা ইত্যাদি নিয়েও ভাবতে হয়।
এলিজাবেথ বাওয়েনের ৭ রুল এখানে গুরুত্বপূর্ন হিসেবে ধরা যেতে পারে।
১। কথোপকথন হবে বিস্তারিত।
২। পাঠককে গল্প বা চরিত্র সম্পর্কে আরো কিছু জানাবে। কাহিনী বিষয়ে তার আগের জানাতে কিছু যোগ করবে।
৩। সাধারণ বাস্তবের কথাবার্তায় হাই হ্যালো জাতীয় রুটিন কথাবার্তা বাদ যাবে।
৪। সাধারণ বাস্তব কথাবার্তার পুনঃউক্তি বাদ যাবে, এবং স্বতঃস্ফূর্ত হবে।
৫। কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৬। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও যে কথা বলছে তার সম্পর্কে কিছু জানাবে।
৭। কাহিনীর মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক তুলে ধরবে।
অর্থাৎ, এইসব নিয়ম হিসাবে নিলে দেখা যাচ্ছে হুবহু বাস্তবের মতো কথোপকথন হবে না উপন্যাস বা গল্পে। আবার নিয়ম জানার পর, মানার পর আর্টিস্টিক ক্রিয়েটিভিটির দরকারে নিয়ম বদলে দেয়া যায়।
নিরোৎসাহঃ
আমি আসলে তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করতে চাই না। তাদের নিচে রাখা এবং নিশ্চুপ করে দেয়াই আমার নিয়ম। নতুন অভিনেত্রীদের ব্যাপারে তারা কি উৎসাহ দেয়? দেয় না। আপনি চাইবেন না এক ইয়াং অভিনেত্রী আসুক আর আপনাকে পেছনে ফেলে দিক।
এই সত্যভাষণ করেছেন জন আপডাইক।
অন্য সব শিল্পীদের মত লেখকেরা তৈরী হয় না, জন্ম নেয়। যেসব তরুণেরা লেখতে চায় বলতো, স্যামুয়েল বাটলার তাদের বলতেন অনেক দেরী হয়ে গেছে বৎস। টেইলর ক্যাডওয়েলের এই মন্তব্য।
ফে ওয়েলডন বলেছেন, আপনি কখনো লেখক হিসেবে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। সব সময় একটা অসন্তুষ্টতা থাকবে।
নিতে শেখাঃ
হেনরিখ হাইনের কথায়, শিল্পে ষষ্ট একটি কমান্ডম্যান্ট আছে। একজন কবির জন্য দরকারী হলো যা তার দরকারী মনে হয় নিজের কাজের জন্য সেসব থেকে নিতে পারার ক্ষমতা অর্জন।
এখানে হাইনে বিভিন্ন জায়গা থেকে নিতে উৎসাহীত করেন।
প্লটঃ
গল্পের প্রথম পাতায় আপনি যদি বলেন দেয়ালে একটি বন্দুক ঝুলে আছে, তাহলে সেটা যেন পরে ব্যবহার হয়। আন্তন চেখভ এমন মনে করতেন।
পদ্বতিঃ
আপনাকে বাইরে যেতে হবে না। নিজের রুমে বসে থাকুন। কিছুই করতে হবে না, কেবল নিরবে বসে থাকুন। পৃথিবী তার সমস্ত ভাঁজ খুলবে একেরপর এক, আপনার সামনে। তার অন্য কোন গত্যন্তর নেই। তাকে এটা করতেই হবে। সে আপনার পায়ের কাছে মুখোশহীন ভাবে লুটিয়ে পড়বে। ফ্রাঞ্জ কাফকা এটা মনে করতেন।
আবার অনেক লেখক লেখালেখির জন্য ভ্রমণকে উৎসাহীত করেছেন। যেমন, মার্ক টুয়েন। এছাড়া মুজতবা আলী মনে করতেন খালি ভ্রমণ নয় সেই ভ্রমণের ডেপথ বা গভীরতাও থাকতে হবে। অর্থাৎ, ছোটখাটো অনেক জিনিস পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
হেনরি মিলারের অন রাইটিং এ আমি লেখালেখি নিয়ে সেরা উপদেশটি পাই, সেটা হলোঃ আপনাকে এক মিলিয়ন ওয়ার্ড লিখে ফেলতে হবে লেখক হিসেবে নিজের ভাষাটা খুঁজে পাবার জন্য কেবল। প্যাট্রিক ম্যাকগ্রা’র মত এই।
ই বি হোয়াইটের মতে বেস্ট রাইটিং হচ্ছে রি-রাইটিং।
রুলঃ
স্টেনডাল এর কথায়, আমি কেবল লেখালেখির একটা রুলই দেখি, তা হলো স্পষ্টতা (টু বি ক্লিয়ার)। সমারসেট মম মনে করতেন লেখকদের জন্য একটি ভালো রুল হলো অতি ব্যাখ্যা করবেন না। ডেভিড ল্যাম্বাথও একই সহজতার কথা বলেন। তিনি বলেন সবচাইতে সহজ যে শব্দ দিয়ে ভাবটা প্রকাশ করা যায় তা ব্যবহার করতে। তিনি বলেন এটা লেখার তো বটেই, কথা বলারও সেরা রুল। ব্রাটান্ড রাসেলও গদ্য থ্রি ম্যাক্সিমের মধ্যে প্রথমটাতে রাখেন, যেখানে ছোট শব্দে কাজ হবে, সেখানে কখনোই বড় শব্দ ব্যবহার করবেন না। বঙ্কিমও যেমন বলেছিলেন রচনার শিল্পগুণে, অল্প কথায় কাজ হইলে বেশী কথার প্রয়োজন কী।
সহজতার পরে, চমৎকার একটি কথায় আমরা যেতে পারি, যা বলেছেন ট্রুমান কাপোতে। তার মতে লেখালেখিতেও চিত্র শিল্পের মত বা মিউজিকের মত বিভিন্ন পার্সপেক্টিভে, লাইট শেইডের ব্যাপার আছে। আপনি এগুলি জেনে জন্ম নিয়ে থাকলে ভালো। আর তা না হলে এগুলি শিখুন ও প্রয়োজনমত বদলান।
এরপরে আরেকটি রুল, হান্টার এস থম্পসনের কথায়, লেখক, সাংবাদিক বা অন্য ধরণের শব্দবাজদের জন্য একটা পুরাতন নিয়ম আছে, তা হলো, আপনি যদি নিজের লেখা থেকে চুরি করা শুরু করেন তাহলে মারাত্মক সমস্যা। এবং এটি মনে হয় সত্যি।
অর্থাৎ, এখানে তিনি বুঝালেন এক্ষেত্রে আপনার লেখায় একই জিনিসই ঘুরপাক খাবে, একই ঘটনা ফিরে ফিরে আসবে। তখন তা হবে বিরক্তিকর।
আর ওয়াল্ট হুইটম্যানের কথায়, প্রতিরোধ করুন বেশী, মানুন অল্প।
এই পরামর্শ বা উপদেশাবলী কোথায় পেলেন, নাকি বানিয়ে বলছেন?
লেখকদের পরামর্শ, উপদেশ ইত্যাদি নানাবিদ বিষয়ে কুওট বা বানী সংগ্রহমূলক একটি বই, এডভাইজ টু রাইটার। এটি সংগ্রাহক বা সম্পাদক জন উইনোকুর নামক একজন লেখক। সেখান থেকেই উপরোক্ত কথাগুলি পেয়েছি, এবং ইংরাজি থেকে বাংলা করেছি।