গদ্য পরম্পরাঃ বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষা

গদ্যের ভাষা কেমন হবে এ নিয়ে যে বিতর্ক প্রচলিত আছে মৃদুমন্দভাবে তাতে মূল পয়েন্টসমূহ হচ্ছে, একদল এলিট ব্রাহ্মন্যবাদী, এরা চায় আরবী ফার্সি খেদাইয়া একটা সংস্কৃতমূলক বাংলা গদ্যভাষা, আরেকদল এর কাউন্টার দিতে গিয়া আরবী-ফার্সি শব্দ জোর আনয়নের মাধ্যমে একটা মুসলমান আশরফি ভাষা তৈরী করতে চায়। এই দুইটা ছিল প্রধান দুই ধারা। দুইটাই প্রচণ্ড মতাদর্শবাদী।

এরপর আধুনিক কালে ভাষাতে সত্যিকার স্বাধীনতা খুঁজতে ব্রতী হইলেন লেখকেরা। মতাদর্শবাদের চাইতে সাহিত্য ও ভাব ব্যঞ্জনা সৃষ্টিই যেখানে হলো সেই স্বাধীনতা নেয়ার মূল প্রেরণা।

এই ধারায় কথ্য ভাষার অনেক শব্দ ঢুকল সাহিত্য ভাষায়, ব্যাকরণের নিয়ম টিয়ম না মানা হইল, এবং নানাভাবে ভাবরে, অনুভূতিরে ও চিন্তারে ঠিকঠাক প্রকাশের চেষ্টা করা হইতে লাগল।

সব ভাষাই হচ্ছে মানুষের অন্তঃস্থ ভাবের দূর্বল অনুবাদ। মানুষ চিন্তা করে ভাষায়। তাই গদ্যভাষায় স্বাধীনতাটা খুবই দরকারী একটা বিষয়, এবং এতেই এর সৌন্দর্য বিদ্যমান।

বাংলা ভাষাটি সমৃদ্ধ হয়েছে নানা ভাষার শব্দে। এখানে ইংরাজি, পর্তুগিজ, আরবি, ফার্সী নানা জাতের শব্দ আছে। আর জীবন্ত ভাষার প্রকৃতিই হইল মানুষের মুখে মুখে বদলে যাওয়া। প্রতিটা মানুষ জন্ম থেকে বড় হইতে হইতে কিছু শব্দ ভিন্ন ভাবে উচ্চারণ করে, এই হলো ভাষা বদলের এক শুরু।

আর সাহিত্যিকের বা লেখকের কাজ তো কেবল গল্প কবিতা লেখা না। এখানে স্মরন করা যায় কমলকুমার মজুমদারের কথা, তিনি একবার বলেছিলেন, ‘গল্পর একটা ঘটনা থাকে, কিন্তু ঘটনা ইজ নো গল্প।’ লেখক ভাষা নিয়ে কাজ করেন। ভাষার মাধ্যমে যেহেতু তিনি তার গল্পটা বলেন, তাই ভাষারে তিনি কোন ফর্মে ও কীভাবে উপস্থাপন করতেছেন তা গুরুত্বপূর্ন বিষয়।

এক্ষেত্রে তিনি ভাষার যেকোন পরিবর্তন করতে পারেন, অন্যদের কাছে তার জোর করে করা মনে হইলেও। কারণ যে কবিতা তিনি লেখতেছেন, যে গল্প তিনি লেখতেছেন অর্থাৎ তার সৃষ্টিশীল কাজটিই একটি জোর করে করা কাজ। শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা বাস্তবের বিরুদ্ধে জোর করে এক নতুন বাস্তবতা তৈরী করতে চায়।

ভাষা যেহেতু খুবই রাজনৈতিক একটি বিষয়, তাই লেখকের মতাদর্শও থাকতে পারে তার ভাষা ব্যবহারে। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শ যখন মূল হয়ে দেখা দেয়, লেখকের কাজরে শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে তখন তার কাজটি রাজনৈতিক প্রোপাগাণ্ডা হয়, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করলে করতে পারে। শিল্পের জন্য এটি হানিকরই।

এছাড়াও, আরেকটি ভাষাভিত্তিক সমস্যা হচ্ছে দুই প্রজাতির অল্পবুদ্ধি লেখকদের মধ্যে।

এদের মধ্যে এক প্রজাতি লেখার ভাষারে ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করে তুলতে চান। এটি বেশ সাম্প্রতিক কালে যেমন প্রাচীনকালেও হয়ত ছিল, এবং এর জন্য ইংরাজি, ফার্সি, উর্দু ইত্যাদি শব্দের অতি ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ নয় বরং অর্থ অর্থ ভাব সৃষ্টির প্রয়াস নেন এনারা। দুর্বোধ্যতা ও জটিলতার মাধ্যমে এরা এক ধরণের পাণ্ডিত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান অল্পবুদ্ধি পাঠকদের কাছে। ফ্রেডারিক নীৎসের কথা এখানে স্মরন করা যায়, তিনি এ সমস্ত লেখকদের নিয়েই বলেছিলেন, “Those who know they are profound strive for clarity, those who would like to seem profound to the crowd strive for obscurity”

বড় প্রাচীন দার্শনিক হিরাক্লিটাসের উক্তিও এখানে স্মরণযোগ্য, The prophet’s voice possessed of god  requires no ornament, no sweetening of tone,  but carries over a thousand years.

দ্বিতীয় প্রজাতির লেখকেরা পপুলিস্ট। এরা বুঝতেই পারেন না বা জানেন না সাহিত্যে ভাষার গুরুত্ব। তারা জন চাহিদা মাথায় রেখে গল্প তৈরী করতে যান, এবং ফলে তাদের সাহিত্য ভাষা হয় ক্লিশে, নতুনত্বহীন এবং ঠুনকো, তাদের সাহিত্যকর্মের মতই।

এই সব ভাষাজনিত সমস্যা ও তার বাস্তবতা বুঝতে হলে একজন লেখককে ভাষা বিতর্কের চাইতে বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষাটি মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা দরকারী। শুরু থেকে ভাষাটি কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, বা একেকজন লেখক কীভাবে ভাষাটি ব্যবহার করেছেন তা যত বেশী দেখা যায় ততো ভালো। এর সাথে সাথে পুরনো পুঁথিসাহিত্যের ভাষা, গানের ভাষা ইত্যাদি। মোটকথা, লেখকের ভাষা বিষয়ে মনযোগী থাকাটা দরকারী।

গদ্য পরম্পরা বইতে আদি যুগ থেকে বিংশ শতাব্দীর সাতের দশক পর্যন্ত ৪৮৫ জন লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক শ্রেষ্ট গদ্য লেখার অংশ রয়েছে। এটি সংকলিত করেছেন ফাদার দ্যতিয়েন। ফাদার পল দ্যতিয়েন বেলজিয়ামে জন্ম নেয়া জেজুইট সম্প্রদায়ভুক্ত একজন খ্রিস্ট সন্ন্যাসী। তিনি কলকাতায় যান ১৯৪৯ সালে, এবং বাংলা ভাষা রপ্ত করেন ভালোভাবে। বাংলায় তিনি গুরুত্বপূর্ন লেখালেখি করেছেন, এবং গদ্য পরম্পরা বইটি তার আরেকটি কৌতুহল উদ্দীপক কাজ যা লেখকদের খুবই উপকারে আসতে পারে।

আন্তোনিও দো রোজারিও- মানুয়েল দা আসসুম্পসাও এর লেখা থেকে শুরু করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা সংকলিত আছে বইটিতে, এক পাতা করে।

ভাষাবিদ সুনীতিকুমারের লেখাটি ভাষা নিয়েই। তিনি লিখেছেন,

“বাঙলা ভাষা এখন সমস্ত বাঙলা দেশ জুড়ে বিদ্যমান রয়েছে, এর অস্তিত্ব একটা অতি বাস্তব সত্য। আমরা এই ভাষায় কথাবার্তা কইছি, লিখছি, এর জীবন্ত মূর্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের এই বাঙলা ভাষার রূপ কিন্তু ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নয়। যাকে আশ্রয় করে, ভাষা সেই মানুষের ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রকাশ পায়; কাজেই যত মানুষ, তত বিচিত্ররূপে একই ভাষার প্রকাশ।”

  • বাঙলা ভাষা-আর বাঙালী জাতের গোড়ার কথা (১৯২৬)

সুনীতিকুমারের এই লেখার মতো অন্যান্য লেখকদের লেখা আছে গল্প উপন্যাসের এক পাতা বা সাহিত্য সমাজ ভাষা নিয়ে প্রবন্ধ থেকে এক পাতা, এমন করে।

যেমন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাঃ

আমাদের এখানে সাহিত্য করতে আসা অধিকাংশ হালকা লেখক ও গদ্য ভাষা নিয়ে কথা বলা লেখকদের ক্ষেত্রে এক সমস্যা হলো তারা আগেকার গদ্য পড়তে অনাগ্রহী, বা ঐসময় তাদের নেই।

এইসব লেখকদের লেখা পড়া, বা নাম জানাই অনেকের পক্ষে কঠিন। দ্যতিয়েনের বইয়ের কল্যাণে সহজেই তা সম্ভব হচ্ছে। এক বইয়ে ৪৮৫ জন গদ্যলেখকের গদ্য পড়া মানে বাংলা গদ্য বিষয়ে বুঝতে শেখার ভালো শুরু বলা যেতে পারে। এখানে এমন লেখকও আছেন যার কেবল দুটি মাত্র গদ্যরচনার কথা জানা যায়, তিনি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লেখাঃ

তাছাড়াও, এইসব লেখাগুলি থেকে একজন ব্যক্তি পুরো লেখাটি পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। এর সম্ভাবনা প্রবল। এক্ষেত্রে এই বইটি একটি বই সাজেশনের বই হিসেবে কাজ করবে সার্থকভাবেই।

বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে কলকাতার গাঙচিল। আগে ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করেছি অনন্য প্রকাশন।