গেইম থিওরিঃ বরবাদ চৌধুরী’র বাঁচা মরার স্ট্র্যাটেজিক লড়াই

কল্পনা করুন আমরা এমন এক শাসনের আয়ত্ত্বে আছি যেখানে ভয়ংকর অপরাধীদের দ্বীপান্তরে নির্বাসন করা হয়। কারণ মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। আমাদের রাজ্যে তিনজন ভয়ংকর অপরাধী ধৃত হয়েছে। তারা হলো,

ফরিদুল্লাহ মজহার
কলিমুল্লাহ খান

বরবাদ চৌধুরী

আমাদের রাজা সাহেব আইন অনুযায়ী ঠিক করলেন এদের নব্য আবিষ্কৃত নীল হায়েনা দ্বীপে নির্বাসন করবেন। তাদের সেই দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হলো। এই দ্বীপ একটি মারাত্মক হিংস্র দ্বীপ, যেখানে রিসোর্স এতো কম যে মাত্র একজন টিকে থাকতে পারবে।

আমাদের অপরাধীদের মধ্যে ফরিদুল্লাহ মজহার সবচাইতে বেশি ভয়ংকর। তার হাতের টিপ ভয়ংকর, গুলি ছুঁড়লে মিস হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। ১০০ ভাগ ক্ষেত্রেই সে লক্ষ্যে হিট করতে পারে। তাই সে দুধর্ষ মজহার নামে পরিচিত ছিল। তার রয়েছে এক অন্ধ ভক্তকূল, যারা তাকে পীরের মর্যাদা দেয়। ভক্তদের কথা মতে দুধর্ষ মজহার চোখ বন্ধ করে গুলি ছুঁড়েও লক্ষ্যে হিট করতে পারে। এমনই ক্ষমতা তার। মহাভারতের কর্ণের মতো।

এরপর আছে কলিমুল্লাহ খান। তার হাতের টিপ ফরিদুল্লাহর মতো না হলেও, খারাপ না। সে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে। ১০০ টা গুলি করলে ৭০ টা তার টার্গেটে পড়বেই। সে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেরা সেরা গানফাইটার, আমেরিকান ওয়াইল্ড ওয়েস্ট বা বুনো পশ্চিমের ভয়ংকর ও নিখুঁত কাওবয়দের গুলি ছোঁড়ার টেকনিক সম্পর্কে স্টাডি করেছে, এবং সেগুলি অনুসরণ করে, এবং ব্যাখ্যা করতে করতে গুলি ছুঁড়ে। অনেকে মনে করেন অন্যদের টেকনিক অতিরিক্ত ফলো করায় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের টেকনিক বের করতে না পারায় কলিমুল্লাহ লক্ষ্যে হিট করতে ব্যর্থ হয় ৩০ ভাগ সময়ে।

তিন নাম্বারে আছে বরবাদ চৌধুরী। অপরাধী হিসেবে সে এতো ঝানু হয় নি এখনো। কিন্তু কয়েকটি অপরাধ করে ফেলেছে। তার হাতের টিপ খারাপই বলা যায়। ১০০ টা গুলি ছুড়লে ৩০ টা সে লক্ষ্যে আঘাত করতে পারে, বাকি ৭০ টাই মিস করে।

নীল হায়েনা দ্বীপে এই তিনজন তো বেঁচে থাকতে পারবে না। একজন বাঁচবে ও বাকি দুইজনকে মরতে হবে।

এইজন্য তারা একটি ডুয়েল ফাইটের আয়োজন করল। কারণ এছাড়া কোন উপায় নেই। ডুয়েলই সমাধান। ম্যান এর সমস্যা ম্যানলি ওয়েতেই সমাধান হোক।

ডুয়েলের নিয়ম ঠিক হলো নির্দিষ্ট দূরত্বে ফরিদুল্লাহ, কলিমুল্লাহ ও বরবাদ দাঁড়াবে। তারপর তারা প্রথমে একজন গুলি ছুঁড়বে। সে যেকোন একজনকে লক্ষ্য করতে পারে।

এরপর আসবে পরের জনের পালা।

এভাবে একজন বেঁচে থাকা না পর্যন্ত ডুয়েল চলবে। তিনজন ক্রমান্বয়ে সুযোগ পাবে।

যেহেতু বরবাদ কম দক্ষ তাই অন্য দুজন তাকে প্রথমে সুযোগ দিল। সে প্রথমে গুলি ছুঁড়বে।

এরপর গুলি ছুঁড়বে কলিমুল্লাহ, এরপর ফরিদুল্লাহ।

এখন স্বাভাবিক হিসাবে মনে হবে আপনার, ফরিদুল্লাহ যেহেতু বেশি ভালো গুলি ছোঁড়ার ক্ষেত্রে তাই তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি।

প্রথম গুলি ছোঁড়ার সুযোগ পেল বরবাদ।

স্ট্র্যাটেজিক্যালি বিষয়টা দেখতে হলে, দেখতে হবে বরবাদের এখানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু এবং কীভাবে সে স্ট্র্যাটেজি কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।

বরবাদের যেহেতু হাতের টিপ খারাপ তাই সে টিকে থাকবে না, তা স্বাভাবিক ভাবে মনে হয়। এবং অবশ্যই সে মারা পড়বে যদি স্ট্র্যাটেজিক্যালি পদক্ষেপ না নেয়।

দেখা যাক বরবাদের কাছে কী কী অপশন আছে।

অপশন একঃ সে ফরিদুল্লাহ মজহারকে গুলি করতে পারে। সে যদি মজহারকে মেরেও ফেলে, পরের টার্নে কলিমুল্লাহ তাকে মেরে ফেলবে। ৭০% নিশ্চিত।

অপশন দুইঃ সে কলিমুল্লাহ খানকে গুলি করতে পারে। এক্ষেত্রে পরের টার্নে মজহার তাকে মেরে ফেলবে, তা ১০০ ভাগ নিশ্চিত।

প্রথম অপশনে ক্ষতি সম্ভাবনা একটু কম তাই এই দুই অপশনের মধ্যে তুলনামূলক ভালো অপশন প্রথমটা। কিন্তু এটি বরবাদের টিকে থাকার উপায় হতে পারে না।

তাহলে, কী হতে পারে বরবাদের জন্য টিকে থাকার সেরা স্ট্র্যাটেজি?

দি আর্ট অব স্ট্র্যাটেজিঃ এ গেইম থিয়োরিস্ট’স গাইড টু বিজনেস এন্ড লাইফ বইতে এর লেখক অভিনাশ দীক্ষিত ও ব্যারী নেইলবাফ দেখিয়ে দেন, এখানে গেইম থিওরি অনুযায়ী বরবাদের জন্য  সবচাইতে ভালো স্ট্র্যাটেজি হবে প্রথম গুলিটা বাতাসে ছুঁড়ে দেয়া।

বরবাদ এটি করলে তার গুলিটি বরবাদ হবে ঠিক আছে, কিন্তু তাকে কেউ গুলি করবে না।

এরপরের টার্নে কলিমুল্লাহ অবশ্যই গুলি করবে ফরিদুল্লাহ মজহারকে। কারণ ফরিদুল্লাহকে না মারলে পরের টার্নে ফরিদুল্লাহ ১০০ ভাগ নিশ্চয়তার সাথে কলিমুল্লাহকে মারতে পারবে। মজহারকে বাঁচিয়ে রাখা কলিমের জনয় ১০০ ভাগ মৃত্যু নিয়ে আসবে, অন্যদিকে বরবাদকে বাঁচিয়ে রাখা ৩০ ভাগ মৃত্যু সম্ভাবনা নিয়ে আসবে। অবশ্যই কলিম কম ঝুঁকি নিতে চাইবে।

কলিমুল্লাহ যখন ফরিদুল্লাহকে গুলি করবে তখন এর লক্ষ্যে হিট করার সম্ভাবনা ৭০ ভাগ। তা একেবারে কম নয়।

কলিম ফরিদকে মেরে ফেললে পরের টার্নে বরবাদ কলিমকে গুলি করার সুযোগ পাবে। তা অনেক ভালো সুযোগ বেঁচে থাকার জন্য।

অন্যদিকে কলিম যদি ফরিদকে মারতে না পারে, গুলি যদি মিস করে, তাহলে পরের টার্নে ফরিদ অবশ্যই মারবে কলিমকে। তখন আবার আসবে বরবাদের সুযোগ। সে তখন ফরিদ মজহারকে গুলি করার সুযোগ পাবে।

অর্থাৎ, এখানে প্রথম গুলিটা বাতাসে ছুঁড়ে বরবাদ তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে তুললো।

বরবাদ এখানে বেশি শক্তিশালীদের যুদ্ধ করার জায়গা করে দিয়েছে, এবং নিজের দূর্বলতার সুবিধা নিয়েছে। অনেক সময় বেশি শক্তিশালীরা যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে পড়লে কম শক্তিশালীরা এর সুবিধা নিয়ে নিতে পারে।

ফরিদুল্লাহ মজহার এর এখানে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা সবচাইতে কম ছিল সব ক্ষেত্রেই। কারণ সে বেশি শিক্তিশালী। বেশি শক্তি সব সময় টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ বেশি শক্তিশালী সব সময়ই মূল টার্গেট হিসেবে থাকে সবার।

ফরিদুল্লাহ কেবল টিকে থাকতে পারতো, তার সম্ভাবনা বাড়ত, যদি সে ইগোতে আক্রান্ত না হয়ে তার চাইতে কম শক্তির দুইজনকে আগে গুলি করার সুযোগ না দিত। এটি করে সে একটি সুবিধা ছেড়ে দিয়েছে। শক্তিশালী হলেই সুবিধা ছেড়ে দিতে হবে এমন কোন কথা নেই।

বরবাদ চৌধুরী যদিও একটি  স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করে নিজের টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু সব চাইতে ভালো হতো তার জন্য যদি সে কোনভাবে এই ফাইট এড়িয়ে যেতে পারতো।

বরবাদ কখনোই তার সুযোগ বাড়াতে পারতো না, যদি সে নিজের সীমাবদ্বতা সম্পর্কে সচেতন না হতো। সে ত্রিশ পার্সেন্ট সময়ে লক্ষ্যে হিট করতে পারে, অন্যেরা  বেশি পারে, এই তথ্য সে মাথায় রেখেছে। সে নিজের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেখে নি। ৩০% ক্ষমতাকে ৮০% ধরে নিলে সে প্রথমেই গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করতো, ও মারা পড়ত।