মার্কাস ঔরেলিয়াস না এপিকটেটাসের সাথে আমাদের মিলে বেশী?

অনেক কিছুকেই আসলে ফিলোসফি বলে। ফিলোসফির বিস্তর বিষয় আশয়ের মধ্যে, একজন ব্যক্তি কীভাবে মিনিংফুল জীবন যাপন করবেন এটিও গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেই ধারার একটি চিন্তাধারা রয়েছে স্টোয়িক দর্শনে।

স্টোয়িক দর্শন নিয়ে আমি আগে এই সাইটে লিখেছি। ওয়েবে লেখা হাইপার টেক্সট। এখানে লিংক দ্বারা অন্য লেখা যুক্ত করা যায়। ফলে পুনরায় আবার ঐ লেখা লেখতে হয় না নতুন লেখাটিতে। প্রিন্টের লেখায় এই সুবিধা নেই। লেখা একই হলেও মাধ্যমের এই ভিন্নতাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১। স্টোয়িক দর্শন কী

২। স্টোয়িকদের জন্য ভার্চ্যু

৩। মার্কাস ঔরেলিয়াসের কিছু চিন্তা

স্টোয়িক দর্শন বিষয়ক আমার আগের ভূমিকামূলক লেখাগুলি পড়ার পরে এই লেখা পড়া শুরু করতে পারলে ভালো। স্টোয়িক দর্শন সম্পর্কে ধারণা থাকলে সেটি না করলেও হবে। তবে এই লেখা পড়ে বুঝার জন্য ঐগুলি পড়তেই হবে এমন কোন বিষয় নয়।

হেলেনিস্টিক পিরিয়ডে অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের সময় সক্রেটিসের ফিলোসফির উপর ভিত্তি করে তিনটি ফিলোসফি বিস্তার লাভ করে। সুখবাদ বা এপিকিউরিয়ানিজম। স্কেপটিসিজম।  তিন এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্টোয়িসিজম।

স্টোয়িসিজমে সক্রেটিস এরিস্টটলদের মতোই ভার্চ্যুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। একজন মানুষের কিছু মোরাল অবস্থান থাকবে। তার জীবনও এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ না।

আধুনিক কালে, আপনি বা আমি কীভাবে স্টোয়িসিজম ধারণ করে উপকার পেতে পারি, সেটা নিয়েই এই লেখা।

স্টোয়িসিজম সকল সময়েই ছিল ব্যবহারিক ফিলোসফি। অর্থাৎ, কাজে বা প্রয়োগের বিষয়। বিভিন্ন সময়ের স্টোয়িক দার্শনিকেরা তার সময়ে কীভাবে এর মূলনীতি প্রয়োগ করা যায় বা কেন এগুলি মেনে চলা দরকারী এ নিয়ে বলেছেন। সেই ধারাবাহীকতায় আমিও আমার সময়ে কীভাবে স্টোয়িসিজম জীবনে প্রয়োগ করা যায়, ও কেন দরকারী তা, সে বিষয়ে মত প্রকাশ করছি।

স্টোয়িসিজমের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ দুই দার্শনিক, এপিকটেটাস ও মার্কাস ঔরেলিয়াস।

এপিকটেটাস ছিলেন দাস। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্টোয়িক দার্শনিক।

মার্কাস ঔরেলিয়াস ছিলেন বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধিপতি।  ঔরেলিয়াসের সাথে খুব সম্ভবত এপিকটেটাসের কখনো দেখা হয় নি। তার বয়স যখন ১৪ তখন এপিকটেটাস মারা যান। কিন্তু তার চিন্তায় এপিকটেটাসের প্রভাব ছিল অত্যধিক। তিনি নানা সূত্রে এপিকটেটাসের লেকচারের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।

এই ফিলোসফি একজন দাস ও একজন সম্রাট দুইজনের জন্যই কাজের, বা যে কেউ এতে অংশ নিতে পারেন।

স্টোয়িসিজম বলতে অনেকে ভুলভাবে মনে করেন আবেগহীনতা। আসলে তা নয়। মানুষের কিছু সুন্দর আবেগ রয়েছে। প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি। এগুলি দরকারী।

কিন্তু আবেগ দ্বারা ছিনতাই হতে চাওয়া কাজের কথা নয়।

মানুষের র‍্যাশনালিটি, বা বিচারবোধ তাকে উতকর্ষ দিয়েছে মানুষ হিসেবে। যেকোন অবস্থাতে এই বিচারবোধের প্রয়োগ প্রথমত জরুরী।

স্টোয়িসিজমকে একলাইনে বলতে গেলে বলা যায়, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেগুলি নিয়ে চিন্তা করা, কাজ করা। যেগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নাই সেসব নিয়ে হতাশ না হওয়া।

আমরা যখন স্টোয়িসিজম নিয়ে ভাবি, মনে হয় এতো দুঃখের ফিলোসফি। যে দর্শন বলে সুখভোগের চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে। মোরাল লাইফই আকাঙ্খিত, সুখ নয়।  তখন আমাদের মনে হয়, হয়ত জীবনে প্রতিকূল অবস্থায় পড়া লোকেরা এই দর্শন দিয়ে শান্তি পায়।

অর্থাৎ, আমরা দুঃখের দর্শন ভাবি স্টোয়িসিজমকে।

কিন্তু মার্কাস ঔরেলিয়াসের কথা আমরা ভুলে যাই। ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যে তিনি ছিলেন তার সময়ে অদ্বিতীয়। এবং প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাস্তবতা এখন মার্কাস ঔরেলিয়াসের সাথে মিলে বেশী, যদি প্রতিকূলতায় পড়লে আমরা দুখী মন নিয়ে এপিকটেটাসের মত নিজেকে ভেবে স্টোয়িসিজমকে দেখি।

এপিকটেটাস ছিলেন একজন দাস, বিকলাঙ্গ, এবং মহান দার্শনিক।  তার মতো বলতে বুঝাচ্ছি প্রতিকূল অবস্থায় থাকা।

মার্কার ঔরেলিয়াসের যে ক্ষমতা ছিল, তার অনেক ক্ষমতাই এখন আমার আপনার আছে। অনেক ক্ষেত্রে বেশিই আছে। কারণ মানুষের সমাজ উন্নত হয়েছে, এখানে ক্যাপিটালিজমের সু প্রভাব আছে, আছে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির অবদান।

এখন আপনার কাছে মোবাইল আছে। এটি নিয়ে প্রচুর তথ্য আপনি পেতে পারেন।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রচুর মানুষের সাথে কানেক্টেড থাকতে পারেন। প্রচুর মানুষ মানে প্রচুর স্বার্থপর ও খারাপ মানুষ আপনি পাবেন।

সম্রাট মার্কাস ঔরেলিয়াস যেমন তার বই লিখেছিলেন ডায়রির মত। নিজের সাথে নিজের কথা বলা। তিনি এগুলি প্রকাশের জন্য লিখেন নি। যেহেতু তিনি চিন্তাশীল লোক ছিলেন, স্টোয়িক দার্শনিক ছিলেন তাই মানুষের স্বার্থপরতা ও শঠতা তিনি ধরতে পারতেন। এগুলির অর্থহীনতা তাকে কষ্ট দিত। যে সবাই কোন না কোন স্বার্থে তার কাছে আসছে।

কীভাবে এগুলির সাথে ডিল করতে হয়, এসব নিয়েই তিনি লিখেছেন। নিজে একাকী ছিলেন। কারো সাথে মিশতে পারতেন না। কারণ তার যে চিন্তার লেভেল, তার যে ভার্চুয়াস লাইফের আকাঙ্খা, তা কমন পিপলদের বুঝার বাইরে ছিল।

সম্রাট হিসেবে রয়েছিলেন দায়িত্বের জন্য। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি চলে গেলে তার খারাপ একজনই আসবে। সেটি তিনি হতে দিতে পারেন না।

তো, আমরা যখন ইন্টারনেটের কল্যাণে বৃহত্তর মানব সমাজের সাথে কানেক্টেড হচ্ছি, তখন দেখতে পাচ্ছি মানুষের প্রকৃতিকে। একেকজন একেক স্বার্থ নিয়ে আছে, যাদের অনেকেরটাই কু-স্বার্থ। মানে আপনার ক্ষতি করে তার লাভটা নিয়ে নেয়া।

এইসব এতো নয়েজের ভেতরে থেকে আমরা কীভাবে হতাশ না হয়ে নিজের কাজটা করে যাব? মানুষকে রাইট রং, ভার্চ্যুয়াস লাইফ ইত্যাদি সম্পর্কে বুঝানো, তার নিজেও সেই যাত্রায় অবিচল থাকা, অবশ্যই নিজের মানবিক ভুলত্রুটি সহ। এর জন্য স্টোয়িসিজম বা ঔরেলিয়াসের চিন্তা দরকারী।

আমরা একেকজন ঔরেলিয়াসের মতো বাস্তবতাতেই আছি।

অর্থ সম্পদ ঔরেলিয়াসের বেশি ছিল। আমাদের কম। কিন্তু সুবিধাদি বেশি।

ধরেন, মার্কাস ঔরেলিয়াস চাইলে পৃথিবীর নানা জাতের মেয়েদের নিয়ে হারেম বানাতে পারতেন। তাদের সাথে দিনরাত সেক্স করতে পারতেন। রোমান সম্রাটরা, আর দুনিয়াব্যাপি নানাবিদ সম্রাটরা এগুলিই করে গেছেন।

কিন্তু তিনি তা করেন নি। কারণ তার কাছে ওগুলির কোন মূল্য ছিল না। তার মোরাল ভ্যালু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

আপনার সাথে এর মিল কী? আপনি হারেম বানাতে পারবেন না। কিন্তু পর্ন সাইট ব্যবহার করে ভিডিও দেখতে পারবেন। প্রযুক্তি আপনাকে এই সুযোগ দিয়েছে, যেটা প্রাচীনকালে রাজা বাদশাহদের কেবল ছিল।

তো, আপনি করবেন কী না, বা কতটুকু করবেন, এটি আপনার নিয়ন্ত্রণে।

এটি উদাহরণ। আমি কারো যৌনতা বিষয়ক এসব ব্যক্তিগত হার্মলেস (নিজের বা অন্যের প্রতি) জিনিসে আপত্তি জানানোর মত মারাত্মক ফ্যাসিবাদী অবস্থানে যেতে চাই না।

বাট, পয়েন্ট এখানে হলো, নিয়ন্ত্রণটা আপনার কাছে আপনি আপনার সময় কীভাবে ব্যয় করবেন।

স্টোয়িসিজমের চিন্তা আপনি জীবনে প্রয়োগ করবেন স্টোয়িক হবার জন্য নয়।  মানে এই লেভেল, এটা অত দরকারী না। মূল জায়গা হচ্ছে, আপনার কাজে লাগলো কি না।

এপিকটেটাস যখন তার ছাত্রদের স্টোয়িসিজম শিক্ষা দিতেন, তখন এটাই বলতেন, ডু নট এক্সপ্লেইন ইওর ফিলোসফি, এমবডি ইট। অর্থাৎ, তোমার ফিলোসফিকে ধারণ করো, অহেতুক এ নিয়ে বাক বিতণ্ডা নয়।

আমাদের লাইফে কন্ট্রোলের বাইরে থাকা অনেক জিনিস আছে, যেগুলা নিয়ে মানুষ হতাশ থাকে। দুঃখী হয়।

যেমন, আমাদের বাবা মা আমরা নির্বাচন করি না। জন্মের আগে আমরা জানি না যে আমাদের বাবা মা কেমন হবে। আমাদের এই সুযোগও থাকে না কোন ধরণের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে, কোন ধরণের মানুষের মাঝে জন্ম নিব।

ফলে, অনেকের মা বাবাই হয়ে থাকেন জাস্ট প্লেইন এন্ড সিম্পল ইডিওট। কেউ কেউ আরো বাজে, এবিউজিব। ভালো প্যারেন্টিং সম্পর্কে আইডিয়াই নেই।

ফলে, অনেক খারাপ জিনিস তারা সন্তানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। বড় হতে হতে, ঐসব খারাপ মানুষের মধ্যে থাকতে থাকতে, অনেকের ভেতরই ঐ সব বাজে জিনিস গ্রো করতে পারে।

বা একটা সময়ে ব্যক্তি বিষন্ন হয়ে উঠেন। তার মনে হয় এই দূর্ভাগ্য কেন তার হলো।

কিন্তু এই জিনিস, অর্থাৎ ভাগ্য এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটি নিয়ে স্যাড হবার, হতাশ হবার কিছু নেই। সবচাইতে ভালো পন্থা হলো এর ভেতর দিয়েই যেতে হবে। মার্কাস ঔরেলিয়াস তার নিজের জন্যই লিখেছিলেন, যদি পেইন সহ্য করতে পারো তাহলে অভিযোগ করবে না, আর সহ্যের বাইরে হলে তো সেটি তোমাকেই শেষ করে দিয়ে নিজেই শেষ হবে, তাই স্বেক্ষেত্রেও অভিযোগের কিছু নেই।

এখানে অভিযোগ বলতে আমার কিছু নেই, আমি দূর্ভাগ্যবান, আমার লাইফ খারাপ বা নিজের অবস্থান নিয়ে হা হুতাশ।

এপিকটেটাস যেমন, দাস হলে ভালো দাস হও। যাকে বলে আমর ফাতি বা সব কিছুকে গ্রহণ করার মানসিকতা। একইভাবে ঔরেলিয়াস যখন সম্রাট হলেন তার ইচ্ছা ছিল ফিলোসফি নিয়ে লেখবেন পড়বেন। কিন্তু তিনি তার ভাগ্যকে মেনে নিলেন।  সম্রাটের দায়িত্বটাও পালন করলেন।

আমাদের লাইফে আমরা যা চাই সব সময় ঠিক তা পাই না। আবার সে জিনিস পাওয়াটাই যে খুব সুখকর হতো তাও মনে হয় না আমার। যাইহোক, ধরি সুখকর হতো। কিন্তু এই যে আমরা পাই না নানা কারণে, যার অনেকগুলাই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এইসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কারণগুলি নিয়ে হতাশ বা স্যাড হওয়া যাবে না।

স্টোয়িক চিন্তার বা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউডাইমোনিয়া। এর অর্থ এরকম হয়, একটা গুড লাইফ যা সর্বোচ্চ ফুলফিলমেন্ট বা হ্যাপিনেস আনে সেটা অর্জন করা।

এর জন্য ভার্চুয়াস লাইফ লিড করতে হবে। কারণ যেগুলি সাময়িক সুখ দেয় কিন্তু নট ভার্চ্যুয়াস এদের কিছু খারাপ প্রভাব আছে।

স্টোয়িক চার কার্ডিনাল ভার্চ্যু হলো,

এক উইজডম বা প্রুডেন্স। পরিণামদর্শীতা। ভালো বিচারবুদ্ধি ও কমন সেন্সের ব্যবহার।

দুই ন্যায় বা ফেয়ারনেস। সকল সময় ফেয়ার অবস্থানে থাকা।

তিন কারেজ অর্থাৎ সৎসাহস।

চার আত্ম নিয়ন্ত্রণ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বা আর্ট অর্জন করা। আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে অডিসিয়াসের একটি গল্প আছে

এগুলির মাধ্যমে ইউডাইমোনিয়া অর্জন সম্ভব।

স্টোয়িকরা যেসব তীব্রভাবে  ত্যাগ করতে বলেন, সেগুলির মধ্যে আছে,

ফলি মানে মূর্খতা। র‍্যাশনাল না থাকা।

অন্যায়।

কাপুরুষতা।

ইনডালজেন্স বা মন যা চায় তা করে বেড়ানো।

কিছু জিনিসের প্রতি নিরাবেগ থাকতে হবে, যেমন, লাইফ, হেলথ, ওয়েলথ, প্রবার্টি, প্লেজার, পেইন, খ্যাতি।  এগুলি ভালোও না মন্দও না, মাঝামাঝি এমন।

তবে এই জিনিসগুলি অবজ্ঞা করে যেতে হবে এমন নয়। এগুলিকে মাঝামাঝি রাখা হয়েছে, কারণ ভার্চ্যুর চাইতে এগুলি ছোট স্টোয়িসিজমে। বা ইউডাইমোনিয়া অর্জনের ক্ষেত্রে।