মানুষ কেন দান করে?

দি গ্রেটেস্ট মোরাল দার্শনিক পিটার সিংগার ১৯৭২ সালে যখন ‘ফেমিন, এফ্লুয়েন্স এন্ড মোরালিটি’ প্রবন্ধটি লিখেন, এবং মানুষকে একটি নৈতিক অস্বস্থির মধ্যে ফেলে দেন, তখন তার মধ্যে বাংলাদেশের চিন্তা ছিল। এটা একটা ইন্টারেস্টিং জিনিসই একজন বাংলাদেশীর জন্য। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মানুষের অসহায় অবস্থা, দূর্ভিক্ষ দেখেই বুদ্ধিমান পিটার সিংগার তার বিখ্যাত থট এক্সপেরিমেন্টটি আনয়ন করেন।

তিনি লেখেন, ধরা যাক আপনার সামনে একটি পুকুরে ছোট একটি শিশু ডুবে মারা যাচ্ছে। আর কেউ নেই ধারে কাছে। আপনি কী করবেন? অবশ্যই আপনি বলবেন আপনি তাকে বাঁচাবেন।

কারণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যদি দেখেন এটা অনৈতিক হবে আপনার জন্য।

সিংগার এটাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলেন, এবার দেখুন অনুন্নত দেশগুলিতে না খেতে পেয়ে কত শিশু মারা যাচ্ছে। আপনার সামর্থ্য আছে তাদের মুখে খাবার দিয়ে তাদের বাঁচানোর। কিন্তু ঐ পুকুরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। তারা একেবারে আপনার চোখের সামনে মারা যাচ্ছে না, তাই তাদের মৃত্যুর নৈতিক দায় আপনি এড়াতে পারেন না।

বলা বাহুল্য, এটি একটি বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস কয়েক দশক পরে সিংগারকে উল্লেখ করে দুনিয়ার সবচাইতে বিতর্কিত নৈতিক দার্শনিক রূপে।

সিংগার মানুষের কাছে নৈতিকতা ডিমান্ড করেন, তার সহজ কিন্তু তীব্র যুক্তির সাহায্যে, তা মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু এই মানুষেরা প্রচুর দান করেন। ইলিফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন বইতে অর্থনীতিবিদ রবিন হ্যানসন যে ডেটা উল্লেখ করেন, সে অনুসারে প্রতি ১০ জন আমেরিকানের মধ্যে ৯ জনই দান করেছেন ২০১৪ সালে। এর পরিমাণ ৩৫৯ বিলিয়ন, আমেরিকার মোট জিডিপির ২%!

হোল্ডেন কারনোফস্কি এবং এলি হ্যাজেনফিল্ড নামে দু’জন হেজ ফান্ড এনালিস্টের একটা মুভমেন্ট আছে, যেটি পিটার সিংগারের চিন্তার উপর ভর করে শুরু। একে বলে ইফেক্টিভ অলট্রুইজম। অর্থাৎ, কেউ একজন যখন টাকা দান করবেন তার টাকার যাতে ম্যাক্সিমাম আউটপুট আসে, এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

২০০৬ সালে কারনোফস্কি ও হ্যাজেনফিল্ড নিজেরা দান করতে গিয়ে একটি সমস্যায় পড়েন। তারা চ্যারিটিগুলির কাছে জানতে চান তাদের টাকা দিয়ে কী করা হবে। কীভাবে এগুলি কাজে লাগবে। ফাইনানশিয়াল এনালিস্ট হিসেবে তাদের চাওয়া ছিল ডেটা। কারণ ডেটা এনালাইসিস করলেই আসলে বুঝা যাবে টাকাগুলি কীভাবে অন্য মানুষের উপকার করছে।

কিন্তু তারা চ্যারিটিগুলির কাছ থেকে কোন সদুত্তর পান নি। চ্যারিটি সংস্থাগুলি তাদের পর্যাপ্ত ডেটা দিতে পারে নি, অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে, এনালিস্টদ্বয় বুঝতে পারলেন, তাদের কাছেই এমন কোন ডেটা নেই।

কারনোফস্কি ও হ্যাজেনফিল্ড গিভ ওয়েল নামক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। সেখানে তারা তাদের রিসার্চ জ্ঞাণ ব্যবহার করে কোন কোন চ্যারিটিতে দান করলে দানের পরিমাণের উপর সবচাইতে বেশী উপকার আসে তথা রিটার্ন অন ডোনেশন আসে তার বের করেন।

সেই লিস্ট অনুসারে সবচাইতে কার্যকরী হলো, (এপ্রিল, ২০২০)

১। ম্যালেরিয়া কনসোর্টিয়াম। সাব সাহারান আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।

১। এগেইনস্ট ম্যালেরিয়া ফাউন্ডেশন। যারা সাব সাহারান এলাকায় মশারী দেয়।

৩। হেলেন কেলার ইন্টারনেশনাল। সাব সাহারান আফ্রিকায় ভিটামিন সাপ্লেমেন্ট দিয়ে শিশু মৃত্যুহার কমাতে কাজ করে।

লজিক্যালি, এরা যেহেতু বেশি কার্যকরী তাই এদের বেশি ডোনেশন পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয় না। কারণ মানুষ ইমোশন থেকে দান করে, এবং শুনতে খারাপ লাগলেও, ডোনেশনে অন্যের উপকার করার চাইতে স্বার্থপর কিছু কারণ থাকে মানুষের।

আপনি ম্যালেরিয়া ফাউন্ডেশনে মাসে কিছু টাকা দিবেন, মান্থলি ডোনেশন অন করে রাখলেন। মাসে মাসে টাকা কেটে নিল। কেউ জানলো কি?

না।

ফলে সমাজের কাছে আপনি একজন দানবীর বা দাতা হিসেবে নিজেকে দেখাতে পারলেন না।

রবিন হ্যানসন ও কেভিন সিমলারের বই ইলফেন্ট ইন দ্য ব্রেইন মানুষের আচরণের গোপন উদ্দেশ্য বিষয়ে একটা ব্যাখ্যামূলক বই। সেখানে তারা দানের পেছনে অর্থনীতিবিদ জেমস আদ্রিওনির ওয়ার্ম গ্লো থিওরির কথা বলেছেন। ঐ থিওরি মতে মানুষ দান করে অংশত সাইকোলজিক্যালি নিজের ভালো অনুভবের জন্য। যে আমি দাতা, দান করে উপকার করছি। এই কারণে এক জায়গায় দেবার চাইতে তারা ছোট ছোট অংশে নানা জায়গায় দিতে চায়। ইভেন যাকাতের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় নিয়মে একজনকে দেয়ার কথা থাকলেও মানুষ নানা জায়গায় দেয়। কারণ যত বেশি জায়গায় দিবে, যত বেশিজনরে দিবে তত বেশি তার ঐ সাইকোলজিক্যাল ভালো লাগার অনুভবটা আসবে।

হ্যানসন ও সিমলার মানুষের দানের ৫ টি কারণের কথা বলেছেন, এগুলিই মানুষকে দানে উদ্বুদ্ধ করে।

১। ভিজিবিলিটিঃ মানুষ সবার সামনে দান করতে চায়। দেখিয়ে দান করতে চায়। এর প্রমাণ আপনারা ফেইসবুকে দেখেন। ধর্মীয় ক্লিয়ার নিষেধমূলক নিয়ম থাকলেও (হাদীস), ইসলাম ধর্মের মানুষকেও আপনারা দেখবেন ভিডিও করে, বা ছবি তুলে দান করছেন। এই ভিজিবিলিটির প্রভাব তাই খুবই তীব্র। রিসার্চে দেখা গেছে কিছু জিনিস, যেগুলি এর তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে,

যখন দান তোলার জন্য দ্বারে দ্বারে সলিসিটররা যান, তখন দু’জন সলিসিটর হলে মানুষ বেশি দান করতে উদ্বুদ্ধ হয়।

একজন সলিসিটর হলে, সলিসিটর যদি আই কন্টাক্ট করে তখন বেশি দেয় লোকজন।

সিলিসিটররা যদি তাদের দানের অংকটা দেখতে পায়, তখনো তারা বেশি দান করে।

এমনকী, একটি চোখের ছবি থাকলেও লোকে দান করে বেশি।

চ্যারিটি সংস্থাগুলি মানুষের এই সাইকোলজিক্যাল প্রবণতার কথা জানে। তাই তারা দাতাদের কথা প্রচার করতে চায়। আমাদের এখানে মসজিদ মাদ্রাসায় ওয়াজে যারা টাকা তুলেন তারাও জানেন। এজন্য কে কত টাকা দিছেন সর্বসমক্ষে তা বলা হয়।

ফেইসবুকে ব্লাড ডোনারদের জন্য ব্যাজ আছে। আই এম এ ব্লাড ডোনার। এছাড়া ডোনেশন তোলার ইভেন্টে, ফেইসবুক দেখায় অমুক অমুক দান করেছেন। এটা শেয়ারেরও সুযোগ থাকে। এমনকী আপনি যে দান তুলতেছেন এটাও শেয়ার করতে পারবেন। অর্থাৎ ফেইসবুক দেখিয়ে দান করা বা ভিজিবিলিটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।

এতে দানের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু ইফেক্টিভনেস কতোটা বেড়েছে তা গুরুতর ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

এনোনিমাস বা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দান খুবই কম হয়। রিসার্চ মতে, পাবলিক ডোনেশনের মাত্র ১%।  এমনকী যারা নাম প্রকাশ না করে দান করেন তারাও তাদের স্ত্রী বা বন্ধুদের কাছে এর গল্প করেন।

চ্যারিটিরা অনেক সময় প্যাকেজ করে। যেমন ১০০০ টাকা দিলে বন্ধু। ২০০০ দিলে স্পন্সর। ১০০০০ দিলে বাপ মা। লিটারালি বাংলাদেশের একটা সংস্থা এরকম সুযোগ দিয়েছিল মানুষকে কিছু শিশুর পড়ালেখার খরচের দায় ভার নিয়ে বাবা মা হবার। ফেইসবুকে তারা প্রকাশ করতো যে, অমুকের ছেলে এই করেছে। দান করে হওয়া বাবা মা’রা এটা প্রচার করতেন।

২। পিয়ার প্রেসারঃ

সামাজিক চাপ। বন্ধু, পরিচিতদের চাপ, বা দান নিতে আসা সলিসিটরের চাপ।

পিয়ার প্রেশার কেবল দানের ক্ষেত্রে না, মানুষের চিন্তা, রাজনীতি এবং প্রচুর খারাপ কাজের সাথে জড়িত।

এই সম্পর্কে লেখাঃ কেন আমরা জানার ভাণ করি।

৩। প্রক্সিমিটিঃ

মানুষ তার আশপাশের মানুষকেই দান করতে পছন্দ করে। আমেরিকান মোট ডোনেশনের খুব কম পরিমাণ, মাত্র ১৩% বাইরে যায়।

৪। রিলেটিভিলিটিঃ

যখন মানুষ কারো সাথে রিলেট করতে পারে, তখন দান বেশি হয়। এজন্য গ্রুপের চাইতে কোন একক ব্যক্তি, তার গল্প, স্ট্রাগল ইত্যাদি মানুষকে ইমোশনালি বেশি হিট করে। ও সে দান করতে আগ্রহী হয়। ইকোনমিস্ট থমাস শিলিং ১৯৬৮ সালে এটি নিয়ে কাজ করেন। এর নাম দেয়া হয় আইডেন্টিফায়েবল ভিক্টিম ইফেক্ট। নানা ক্ষেত্রে এটি কাজ করে। স্টালিন যখন বলেছিলেন, একজনের মৃত্যু ট্রাজেডি কিন্তু মিলিয়নের মৃত্যু পরিসংখ্যান, তখন তিনি মানুষের এই প্রবণতাই বুঝাতে চেয়েছেন।

৫। মেটিং মোটিভঃ

প্রাণী হিসেবে মানুষের মেটিং মোটিভ বা যৌন সঙ্গী আকর্ষণ মূলক একটা মোটিভ প্রায় কাজেই থাকে। দান এর বাইরে নয়। সুন্দরী মেয়েরা দেখতে থাকলে পুরুষেরা বেশি দান করে, এটা দেখা গেছে গবেষণায়। সলিসিটর সুন্দরী হলে মানুষ, বিশেষত পুরুষেরা বেশি দেয়।

রোমান্টিক পার্টনার আকর্ষণের জন্য, নিজেকে ভালো দেখাতে দান একটি ভালো সিগনালিং মাধ্যম। এইজন্য ফেইসবুকের মত জায়গা, যেটি আসলে মেটিং সিগনালিং এর ওপেন ক্ষেত্র, সেখানের দানের ছবি বেশি দেখা যায়।

১৫/১৬ শতকের ভারতীয় যৌন গ্রন্থ আনাগা রাংগাতে কন্যাদানের জন্য সুপুত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় দান ও চ্যারিটির কথাও আছে। বলা হয়ে থাকে কামসূত্রের মতো এই গ্রন্থ, যেটি লিখেছিলেন এক কবি কলিঙ্গের ব্রাহ্মণসন্তান কল্যাণ মল্ল, লোদি বংশের সম্রাট লাদ খানের সম্মানে।

স্যার বার্টনের অনুবাদে,

When choosing a son-in-law, the following characteristics should be aimed at: He must come from a large family, which has never known sin and poverty. He must be young, handsome, wealthy, brave and influential; diligent in business, moderate in enjoying riches, sweet of speech, well versed in discharging his own dudes, known to the world as a mine of virtues, steadfast in mind, and a treasury of mercy, who gives alms and makes charities as far as his means permit. Such a man is described by celebrated poets as a fit person to whom the daughter should be given in marriage.

এটি প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের ভালো চরিত্রের প্রকাশক হিসেবে প্রচলিত ছিল। এছাড়াও, যে দিচ্ছে, মানে তার আরো আছে। ফলে এটি সম্পদেরও সিগনাল দেয়।

না দেখিয়ে দিলে, তথা লুকিয়ে দিলে তো সমাজ বুঝতে পারবে না এই ব্যক্তি দিচ্ছেন। বুঝতে পারবে না তার ভবিষ্যত বউ ও শ্বশুর শ্বাশুড়ি।

উপসংহারঃ

দান বিষয়ে উপরের যে আলোচনা এটি বিশ্বের দানের বাস্তবতা। বেশিরভাগ সময়েই মানুষের ভালো কাজের পেছনে অন্য একটি উদ্দেশ্য থাকে। যেটাকে হ্যানসল ও সিমলার বলেন ইলিফ্যান্ট ইন দ্য ব্রেইন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ নিজেই তার গল্পকে বিশ্বাস করে, অর্থাৎ সে প্রথম হিপোক্রিসিটা করে নিজের সাথে।

দানের ক্ষেত্রে লজিক্যাল যে অবস্থান, আপনি যদি চান মানুষের উপকার হোক আপনার টাকায়, তাহলে সর্বোচ্চ উপকার যেভাবে হয় সেটি নিশ্চিত করুন। যেহেতু ওটাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য।

কিন্তু এটা আসলে একমাত্র উদ্দেশ্য না থাকার কারণে, সবচাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হয়ে উঠার জন্য দান অন্যভাবে দেয়া হয়। ফলে দানের একটা উৎসব চলে।

কিছু এথিক্যাল সমস্যাও আছে। যেমন পাড়ার একজন লোক চাল ডাল দিবেন গরীব লোকদের। তিনি ক্যামেরা করে তা ফেইসবুকে দিবেন। একজন লোকের ঘরে খাবার নেই, আবার সে ক্যামেরাতেও উঠতে চায় না। তার একটা আত্মসম্মান আছে। যা থাকা স্বাভাবিক, এবং খুব ক্রুয়েল ভাবে সামান্য কিছু টাকা হলেই মানুষ বেমালুম ভুলে যায় গরীবেরও আত্মসম্মান থাকতে পারে।

যাইহোক, এখন লোকটি যদি ক্যামেরায় উঠতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে সে জিনিস পাবে না। কারণ ততক্ষণে অন্যদের দেয়া হয়ে যাবে। ফলে সে বাধ্য ক্যামেরায় উঠতে। এবং তার অন্য কোন উপায় নেই।

লজিক্যালি, আপনি যদি সব গরীবকে জিজ্ঞেস করেন আপনাদের দুই অপশন দেয়া হলো, কোনটা নিবেন,

১। আপনাদের চাল ডাল দেয়া হবে, ক্যামেরা করা হবে না

২। আপনার চাল ডাল দেয়া হবে ও ক্যামেরা করে ফেসবুকে দেয়া হবে। প্রচুর লোক দেখবে আপনারা নিচ্ছেন।

এই স্বাধীনতা দেয়া হলে বেশিরভাগেই অপশন এক বেছে নিবে। কারণ সে চায় নিজের দারিদ্রের প্রদর্শনী করতে? তার কাছে এগুলা নেয়া তো সুখের কিছু না।

কিন্তু এই স্বাধীনতা তারে দেয়া হয় নি। অর্থাৎ এথিক্যালি ফ্রি কনসেন্টের সুযোগ তার নেই। এজন্য এটি অনৈতিক হয়।