গালিবের দিন

১৯ শতকের শুরু থেকেই মোগল সাম্রাজের যায় যায় দশা। যেই মোগল সাম্রাজ্য এক সময় বিশাল ছিল। এই বহুদূরে বাংলায় আইসাও তারা হানা দিয়া গেছেন, জয় কইরা গেছেন। সেই তাকতওয়ালা সাম্রাজ্যও ১৮ শতক থেকে ইরানিদের, আফগানদের, মারাঠাদের শট খাইতে খাইতে এত ছোট হইছে যে, তাদের আছে খালি দিল্লীর লালকেল্লা, আর সম্রাটের টাইটেল। এইটা দুনিয়ার পুরান ইতিহাস বা পুরান শিক্ষাই যে, যাহার উত্থান হয়, তাহার পতনও হয়।

মির্জা আসাদুল্লা খান গালিবের জন্ম, কাগজে কলমে ১৭৯৭ সালে। আগ্রার এক তুর্কিশ লাইনের ফ্যামিলিতে জন্ম নিছিলেন তিনি। বয়স ৫ থাকতে তার বাপ মারা যান। চাচা নসরুল্লা বেগ তারে লালন পালনের ভার নেন। নসরুল্লা কাজ করতেন মোগল সেনাবাহিনীতে, আর ১৮০৩ সালে যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্মিতে।

গালিব অল্প বয়েস থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৮ বছরে বাইর করেন কবিতার বই। তিনি আকৃষ্ট হন ক্লাসিক ধারার ফারসি কবিতায়। তার কবিতার ভাষা দূর্বোধ্য ও অর্থহীন হিসাবে সমালোচিত হইত। যদিও উর্দুতে লেখালেখিরে তিনি অত লাইক করতেন না, কিন্তু আইরনিক্যালি এইগুলাই তারে খ্যাতি আইনা দেয়। তার ফার্সি কবিতাগুলি ওইরকম সমাদর পায় নাই।

গালিবের এই যে বড় হইবার একটা আকাঙ্খা ছোটকাল থেকে ছিল, এইটার সাইকোএনালিসিস করলে তার বাপের মারা যাওয়া ও চাইল্ডহুড ট্রমার ব্যাপারটা আনা যাইতে পারে। (যেটা নিয়া আমি লেখছিলাম।)

গালিবের শিষ্য আলতাফ হোসেইন হালি তার জীবন নিয়া যেই বই লেখছেন, ইংরাজিতে যার নাম গালিবের স্মৃতির প্রতি, সেই বই-ই গালিব বিষয়ে নানা ঘটনার সবচাইতে ভালো উৎস। হালি গালিবের লাইফের যেইসব চমকপ্রদ গল্পগুলি লেইখা গেছেন তার কিছু কিছু আপনারা হয়ত পড়ছেন। পুরা বইটা বাংলায় অনুবাদ হইছে কি না জানি না।

কলম্বিয়া প্রেস থেকে বের হওয়া গালিবের সিলেক্টেড কবিতার বইতে একটা সুন্দর ভূমিকা আছে। সেইখানে গালিবের লাইফ, এবং তার লাইফের কিছু গল্প দেখা যায়। এছাড়া, এ থাউজ্যান্ড ইয়ারনিংস নামে উর্দু সাহিত্য নিয়া যে বইটা আছে, সেইখানে গালিব নিয়া হালির একটা লেখাই আছে।

গালিব ইসলামের মূল রীতিনীতির কিছুই মানতেন না। যেমন নামায পড়তেন না, রোজাও রাখতেন না। মদ খাইতেন। কিন্তু আল্লার প্রতি তার বিশ্বাস ছিল আর নবী এবং তার পরিবারের প্রতি ছিল দরদ।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ হইলে গালিব অসুবিধায় পড়েন। বিদ্রোহীরা দিল্লী দখল কইরা বাহাদুর শাহরে সম্রাট বইলা যে হম্বি তম্বি করেন, পরে ব্রিটিশ সরকার আইসা গণহারে বাঁশ দিতে থাকে। মুসলিমদের দায়ী করতে থাকে এই বিদ্রোহের জন্যে। অনেক লোকই তখন মারা যান। গালিবের শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব।

গালিবরেও নেন কর্ণেল ব্রাউন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

গালিব তুর্কিশ স্টাইলের পাগড়ী পইরা যান কর্নেলের কাছে। কর্নেল এই অদ্ভুত পোষাকে বিস্মিত হইয়া ভাঙা উর্দুতে জিগান, আপনে কি মুসলিম?

গালিব উত্তর দেন, হাফ।

কর্নেল কন, হাফ মানে?

গালিব বলেন, আমি মদ খাই কিন্তু শুয়ার খাই না।

শুইনা কর্নেল হাসলেন।

গালিব মদ খাইতেন। একবার এক লোক তারে কড়া আপত্তি জানাইয়া বলতেছিল,  মদুরীর প্রার্থনা কবুল হয় না।

গালিব উত্তরে কন, ফেরেন্ড, যার মদ আছে সে প্রার্থনা করবে কোন দুঃখে?

গালিব সাধারণত মদ খাইতেন রাইতে,  ঘুমানোর আগে। তার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক করা আছিল, তিনি নিজে ঠিক করছিলেন। তার ম্যানেজারের মত যে লোক ছিল, তার দায়িত্ব ছিল যদি তিনি আরো চান তাইলে তারে যেন কখনোই চাবি দেয়া না হয়। (পুরা অডিসিয়াসের মত ব্যাপার এইখানে।)

মদ খাইতে খাইতে কবিতা লেখতেন। গলায় যে শালের মত জিনিস পইরা থাকতেন, একটা বাক্য  মনে মনে লেখার পর ওইটাতে এক গিট দিতেন। এইভাবে আট দশ গিট হইলে ঘুমাইতেন। সকালে ঘুম থেকে উইঠা ঐ গিট গুলা খুলতে খুলতে লাইনগুলা মনে করতেন। আর সেইগুলা তখন লেখতেন।

(লেখার ক্ষেত্রে এইটা একটা তরিকাই বটে। চলতে ফিরতে অনেক গল্পের আইডিয়া মিলে। কিন্তু এইগুলা যদি দেখা যায় ভুলা যায় না, বার ফিইরা আসতে থাকে তখনই লেইখা ফেলতে হয়।)

আরেকটা ঘটনা হালি উল্লেখ করেন। তখন গালিব শেষ বয়সে পৌছাইছেন। এক লোকের বিরুদ্ধে কী কারণে জানি মামলা করছিলেন তিনি।

এরপরেই মানুষজন গালিবের উপর খেইপা যায়। খেইপা তারা নানা রকম চিঠি পাঠাইতে থাকে গালি গালাজ কইরা। তারা লেখত,  গালিব একটা নাফরমান, নামায পড়ে না, রোজা রাখে না, ধর্ম মানে না, মদ খায়। প্রতিদিন এইরকম চিঠি আসত গালিবের কাছে। নাম পরিচয়হীন এইসব চিঠিতে গালি থাকতো।

বর্তমানে হইলে এই জিনিস গালিব ফেইসবুক ইনবক্সে পাইতেন হয়ত।

তো গালিব এমনিতেই তখন হতাশ থাকতেন। আর এইগুলা তারে আরো হতাশ কইরা তুললো। চিঠি পোস্টম্যান নিয়া আসতে দেখলেই তিনি বিব্রত হইয়া উঠতেন।

হালি তখন একটু দূরে ছিলেন গালিবের থেকে কিছুদিন।  তিনি এইসব চিঠি যে নিয়মিত আসতেছে, তা জানতেনও না। হালি বলতেছেন যে, ঐ সময় তার নিজের মধ্যে ধর্ম নিয়া একটা আত্ম-তুষ্টিমূলক গর্ব আইসা যায়, আর তিনি গালিবের প্রতি একটা ভুল কইরা ফেলেন। হালি লেখতেছেন, ‘আমি তখন মনে করতাম আল্লার দুনিয়ার এই সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে কেবল মুসলিমেরা, আর মুসলিমদের ৭৩ ধারার মধ্যে কেবল হানাফিরা, আর হানাফিদের মধ্যে কেবল যারা ঠিকমতো নামায ও রোজা পড়তেছে, কেবলমাত্র তারাই আল্লার অনুগ্রহ পাবে ও ক্ষমা পাইয়া যাবে বেহেশতে – মানে আল্লার ক্ষমার দুনিয়া রানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের চাইতেও ছোট, যেইখানে নানা ধর্ম ও মতের লোকেরা শান্তিতেই একত্রে বাস করতে পারেন।‘

হালি যে ভুলটা করছিলেন বইলা তিনি লেখতেছেন, সেটা হইল, তিনি গালিবরে একটা দীর্ঘ লেকচার লেইখা দেন। কারণ ততোদিনে গালিব কানে আর শুনেন না। হালি লেখছিলেন মুসলমানের জন্য নামায পড়া কেন দরকারী ও বাধ্যতামূলক। কেমনে দাঁড়াইয়া না পারলে বইসা বা ইশারা দিয়া, পানি নিয়া না পারলে মাটি দিয়া হাত মুইছা ইত্যাদি বিস্তারিত। মানে গালিবরে নামায পড়াইতে তার নসিহত।

গালিব পড়লেন।

তিনি চিঠিটারে ভালোভাবে নিতে পারলেন না। কারণ এমনিতেই এই শেষ বয়সে আইসা তার লাইফস্টাইল ও তারে নিয়া লোকজন গালি গালাজ করতেছে প্রতিনিয়ত। এরই মধ্যে হালির মত শিষ্যের কাছ থেকে এই জিনিস গালিব আশা করেন নাই।

গালিব বলেন, আমি জিন্দেগিতে নামায পড়ি নাই, রোজা রাখি নাই বা কোন ভালো কাজও করি নাই। সারাজীবন অনর্থ কইরা কাটাইয়া দিছি। আর বাঁচব অল্প কিছুদিন। তো তুমি কি ভাবো এই কিছুদিন নামায পড়লে আমার জিন্দেগির খারাপ কাজগুলা মাফ হইয়া যাবে? আমি মইরা গেলে আমার আত্মীয় ও পরিচিতরা যেন আমারে কালো কাপড়ে মুখ বাইন্ধা,  দড়ি দিয়া পা বাইন্ধা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরায়, যেন দিল্লীর বাজারে নিয়া ঘুরাইয়া মানুষরে দেখায়, তারপর যেন শহরের বাইরে নিয়া ফালাইয়া রাখে, কাউয়া শকুন আর কুত্তাদের জন্য, অবশ্য এইগুলাও আমার মত লোকরে খায় কি না কে জানে। যাক, আমার পাপ এতোই যে, আমি এর চাইতেও বেশি খারাপ জিনিসের যোগ্য। যদিও আল্লার একত্মে আমি বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে আল্লা ছাড়া আর কোন ইলাহ নাই। এই সমস্ত কিছু আল্লার, এমনকী আমি যেই কথা বলতেছি বা লেখছি সেইগুলাও।

হালি তার ভুল বুঝতে পারেন।

ওইদিনই গালিব খাইতেছেন যখন তখন আরেক চিঠি আসে। পোস্টম্যানের কাছে চিঠি নিতে নিতে গালিব বলতেছিলেন এই আরেকটা আইলো মনে হয়। তিনি চিঠি হালির হাতে দিলেন পড়তে। হালি খুইলা দেখেন গালি গালাজ। তিনি পড়তে চাইতেছিলেন না।

গালিব জিজ্ঞেস করলেন, কে এইটা? কী লেখছে?

হালি তো কিছু বলেন না।

গালিব হালির হাত থেইকা চিঠি নিতে নিতে বললেন, মনে তো হইতেছে তোমার কোন আধ্যাত্মিক  শিষ্য…

তিনি চিঠি নিয়া আগা গোড়া পড়লেন।

চিঠির এক পর্যায়ে ঐ লোক গালিবের মা তুলে গালিগালাজ করছিল।

গালিব পড়তে পড়তে হাসলেন আর বললেন, এই হালায় তো ইডিয়ট, মানুষরে কেমনে অপমান করতে হয় সেইটাই যায় না। কোন লোক যদি বুড়া হয় তারে অপমান করতে তার মেয়ে তুইলা গাইল দিতে হয়। মধ্যবয়স্ক হইলে বউ তুইলা। আর ইয়াং হইলে মা তুইলা। এই বকচুদ এইটাও জানে না। আমি ৭২ বছরের বুড়া, আমারে গাইল দিতেছে মা তুইলা। এর চাইতে বড় বকচুদ আর কই পাবো!

মির্জা গালিব (ডিসেম্বর ২৭, ১৭৯৭ – ১৫ ফেব্রু, ১৮৬৯)

 আরেকটা গল্প দিয়া শেষ করি।

গালিব তখন বাহাদুর শাহের দরবারে যান। বাহাদুর শাহের আসল নাম ছিল সিরাজ উদ দিন। উর্দু কবিতা লেখেন বাহাদুর শাহ জাফর, এইগুলা ঠিক কইরা দেন গালিব। আর সভায় কবিতা পড়েন।

কবিতা পড়তে গিয়া গালিব বাহাদুর শাহরে যেমন প্রশংসা করতেন, তেমনি নিজের প্রশংসা করতেন।

একদিন লেখলেন, রাজা বাহাদুর শাহ নিজাম উদ দিন আউলিয়ার সমান পবিত্রতা আর আধ্যাত্মিকতায় , আর গালিব আমির খসরুর সমান।

সভায় এই কবিতা যখন বললেন তখন বিতর্ক উঠল, এই দুইয়ের মাঝে মিল কী। বিখ্যাত পীর নিজাম উদ দিন আউলিয়ার সাথে ফার্সি সেরা কবি আমির খসরু, কেমনে কী! মিলাইতে তো একটা মিলের জায়গা থাকতে হয়। আপত্তিকারকেরা আপত্তি পেশ করলেন।

গালিব সাথে সাথে কবিতা বানাইলেন,

মিলে দো মুর্শিদো কো কুদরাত-এ হাক সে দো তালিব

নিজাম উদ দিন কো খসরু, সিরাজ উদ দিন কো গালিব

Two holy guides; two suppliants. In this God’s power we see.

Nizam-ud-Din had Khusrau: Siraj-ud-Din has me.

গালিবের আরেক বয়ান,

baitha hai jo ki saaya e deevaar e yaar mein

farmaan-rava e kishvar e hindostaan hai

He who sits in the shade of his beloved’s wall

Is lord and king of all the realm of Hindustan.

আপন প্রিয়ার ছায়ায় যাহার হইছে প্রিয় বসার স্থান

ওই মুহুর্তে সেই তো রাজা, তাহার পুরা হিন্দুস্থান