মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » কুলনাশা পিরিত ও পদ্মাবতী বিষয়ে দার্শনিক কথাবার্তা

কুলনাশা পিরিত ও পদ্মাবতী বিষয়ে দার্শনিক কথাবার্তা

বাউল গানে উপস্থিত প্রেম দেখলে দেখতে পাবেন সেই প্রেমগল্পের এক বিরাট জায়গা হচ্ছে কুল তথা বংশ। আব্দুল করিম যেমন বলেন কুলনাশা পিরীতের নেশায় কুলমান গেছে বা আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছইও না গো সজনী। এমন আরো অনেক অনেক গানে কুল ও কুলহারানোর কথা আসছে প্রেমের বর্ননায়। প্রেমের বলি হয় কুল।

বাউল গান বিশাল লোকসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। এইসব গান থেকে সমাজের আদি ও অকৃত্রিম চরিত্র অনেক সময় বুঝা যায়, এক্ষনে কুলনাশা পিরীতের চরিত্র বুঝার চেষ্টায় আমার এই প্রচেষ্টা।

প্রেম কখন প্রেমের গল্প হইয়া উঠে তা ভাবার বিষয়। সব প্রেমই প্রেমের গল্প হয় না। কোন এক মধ্যবিত্ত কুলওয়ালা বা তথাকথিত ভালো বংশজাত ছেলে আরেক ভালো বংশজাত মেয়ের প্রেমে পড়ল, তাদের বিয়ে হইয়া গেল বা হইল না। তারা দুইজন প্রেম পরবর্তী ঘর বানল, দুইজন একসাথে বা আলাদা আলাদা। এই প্রেমটি আসলে প্রেমের গল্প হয় না। কারণ এখানে কুলনাশ হয় নাই।

কোন প্রেমের প্রেমের গল্প হইয়া উঠার এক প্রধান জিনিসই হচ্ছে কুলনাশ হতে হবে। বা পতন হতে হবে। কোন একজনের পতন হইলেই হবে।

নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্বে বিধৃত আছে- বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে নট নামে এক আলাদা বর্ণ এর লোকদের কথা আছে।  বাঙালী সমাজের এক ধরনের নিচু জাতের লোক ছিল যারা নাচ গানার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত, নীহাররঞ্জন বলেছেন সম্ভবত এরাই উক্ত দুই পুরাণ বর্নিত নটবর্ণ।

নীহাররঞ্জন আরো বলেন, ডোম্বি ও অন্যান্য নীচ জাতিয়া মহিলারা নাচা গানা করতেন বলে তাদের নৈতিক বন্ধন বেশ শিথিল ছিল, এবং তাহাদের মায়ায় পড়িতেন উচ্চকোটির পুরুষপুঙ্গবেরা।

পদ্মাবতী ফিল্মের একটি দৃশ্য

নট-নটিদের খুব ভালো চোখে দেখা হইত না সে সমাজে, এবং এখনো নটি শব্দটি শক্তিশালী গালি হিসাবে লোক সমাজে প্রচলিত। সম্প্রতি ইন্ডিয়ায় পদ্মাবতী ফিল্ম নিয়া বিতর্ক চলমান। পদ্মাবতীর পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানশালী নাকী ফিল্মে আলাউদ্দিন খিলজি ও রানী পদ্মাবতীর লীলাখেলা দেখাইছেন, এ অজুহাতে তার উপর ক্ষীপ্ত রাজপুত করনি সেনা। ফিল্মের সেই লীলাদৃশ্য নাকী আবার আলাউদ্দিন খিলজির কল্পনায়। করনি সেনা গত জানুয়ারী মাসে বানশালীকে হালকা চড় থাপ্পরও দিছেন এই ওছিলায়। এবার তাদের লক্ষ্য ফিলিম মুক্তি বন্ধ করে দেয়া।

এই ফিল্ম নিয়ে আলোচনায় আসছিলেন করনি সেনার নেতা লোকেন্দ্র সিং, যার উচ্চতা ছয় ফুট চার ইঞ্চি। এবিপি চ্যানেলে তিনজন উপস্থাপিকার সাথে আলোচনায় একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়, তারা কেন দীপিকা পাড়ুকোনের নাক কাটার কথা বলছেন।

লোকেন্দ্র উত্তরে নানা কথার পরে দীপিকারে বলেন নাচনেওয়ালি বা নর্তকী।

উপস্থাপিকারা ক্ষুব্দ প্রতিবাদে বলেন, নাচনেওয়ালি মানে, এসব কী কন!

লোকেন্দ্র অসাধারণ এক এক্সপ্রেশনে বলেন, আরে নর্তকীরে নর্তকী বলব না তো কী বলব। যারে পয়সা দিয়া নাচানি হয় সে ত নর্তকীই।

উপস্থাপিকারা বলেন, এসব কী কন, কালাকার বলবেন কালাকার, দীপিকা একজন কালাকার।

এই প্রসঙ্গ এখানে আনলাম নাচনেওয়ালী বা নর্তকী বিষয়ে উপমহাদেশীয় ধারণা বুঝাইতে। সম্ভবত এটা আর্য ধারনা। আর্য সংস্কৃতিতে নাকী নাচা গানা নাই। এর প্রভাবে বাঙালী সংস্কৃতিতেও নাই। ওই নীচ জাতীয়া ডোম্বি নটিরা ছাড়া আর নৃত্য নাই।

ফিলিম পদ্মাবতী নিয়া রাজপুত করনি সেনার আপত্তির আরেক জায়গা হইল ফিল্মে রানীর স্বল্পবসনা নাচা গানা দেখানি হইছে। রানীর কথিত এক পরবর্তী প্রজন্ম, রাজবংশের এক সদস্য, যার নামও পদ্মিনী বা পদ্মাবতী, তিনি বলছিলেন, আমাদের ফ্যামিলির লোকের নাচ বাইরের লোকে দেখতে পারত না, এখন সবাই দেখবে, ছি ছি!

মেবারের কালচারে নাকী রাজার সামনেই কেবল রানী নাচতেন, আর কেহ সেই নাচ দেখতে পাইত না। ফিল্মের পক্ষ থেকে বলা হইতেছে ফিল্মেও রানী রাজার সামনেই নাচছেন, আর কেউ দেখে নাই।

এটা আমার কাছে মজার লাগল, কারণ রানীর নাচ তো আমরা বেবাক দর্শক সম্প্রদায় দেখতে পাব। আমার কাছে এটা জনতার এক রিভেঞ্জ মনে হইল। কারণ রাজারা আগেকার দিনে মাইয়া ধইরা নিয়া নাচাইত, হেরেমে বন্দী কইরা রাখত। আমরা শুনি যে প্রাচীন ভগ্ন রাজপ্রাসাদে গেলে এখনো নাকী সেইসব দুঃখিনী বন্দিনীদের নূপুরের শব্দ শোনা যায়, রাত্রি নিশিকালে।

নিজেদের পরিবারের মেয়েদের ইজ্জ্বত নিয়া রাজারা অনেক সচেতন ছিল, যাতে কুলনাশ না হয়। মোগলরা তাদের বইনদের বিয়া না দিয়া হেরেমের দায়িত্ব দিয়া রাখত। কারণ বিয়া দিলে রাজ্যের ভাগীদার বাড়বে। সেই সব রাজমহিলাদের রূপ লাবণ্যের কথা শুইনা কখনো কখনো কোন দুঃসাহসী প্রেমিক যুবক মৃত্যু হাতে নিয়া প্রবেশ করত হেরেম প্রাসাদে। রাজমহিলার সাথে প্রেম শুরু হইত তার। রাজার কানে খবর যাইতে দেরী হইত না। রাজা তখন বইনরে বা মাইয়ারে কিছু বলতেন না। খালি কয়েকদিনের মধ্যেই দুঃসাহসী প্রেমিকটি খুন হইয়া গুম হইয়া যাইত অবেলায়। গুম আগেও ছিল, এখন যেমন আছে। কেহ জানতে পারত না সেই দুঃসাহসী প্রেমিক ও তার প্রেমেরো কাহিনী।

এখন সেই রাজ রাজড়াদের কেচ্ছা নিয়া ফিল্ম বানাইয়া লোকে তাদের মেয়েছেলেদের নাচা গানা দেখতে পারে। টেকনোলজির উন্নতির কারণে সাধারণ লোকের কাছে আসিয়াছে এই সুযোগ। বেশ একটা দার্শনিক ও শৈল্পিক রিভেঞ্জ। কারণ ফিল্মে সত্যিকার অর্থে তো ক্ষতি হইতেছে না কারো, কালাকারেরা অভিনয় কইরা যাচ্ছেন মাত্র। এঅ প্রতিশোধ বাস্তবে হচ্ছে না, কল্পনায় হচ্ছে এমন বলবেন কেউ। কিন্তু দেখেন কী যে বাস্তব আর কী ফ্যান্টাসী, তা নির্ধারণ অত সোজা না। তা হইলে কি কাল্পনিক কলাচিত্রে কাল্পনিক রানীর অভিনয় নিয়া, নাচা গানা নিয়া এত বিতর্ক, দৌড়ঝাঁপ, মারামারি, কোর্ট কাছারি হইত, আমাদের প্রতিবেশী দেশে?

যাক এসব কথা, কুলনাশে পুনরায় ফিরে আসি। বাঙালী উচ্চকোটির পুরুষেরা নীচ জাতিয়া ডোম্বি নটিদের মায়াজালে আবদ্ধ হইতেন, প্রথম দর্শনে প্রেমও হইতে পারে [যদিও সাইন্টিফিক্যালি প্রথম দর্শনের প্রেম হইল কামাবেগ, প্রেমাবেগ নয়], তারা পাগলপারা হইতেন ও জাতিধর্ম সব ছেঁড়েছুঁড়ে ধাওয়া করতেন প্রেমের পানে। এই প্রেমটিই প্রেমের গল্প হইয়া উঠত, কারণ এখানে কুলনাশ হয়েছে।

ইউসুফ জুলেখার গল্প যেমন আমরা শুনে থাকি, ক’দিন আগে টিভিতে সিরিয়াল দেখাইল, সেখানেও একই, জুলেখা রানী ছিলেন আর ইউসুফ দাস একজন। রোমিও এন্ড জুলিয়েটে হইল বিরোধযুক্ত দুই পরিবার। এমন ক্ষেত্রে নিজ কুলের বিরোধী কুলে প্রেম করলে কুলনাশ নয়।

বাংলা ফিল্মেও এমন একটা ছদ্ম কুলনাশ দেখানি হইছে। দেখা যাইত লাট সাহেবের মাইয়া প্রেমে পড়ছেন মটর মেকানিকের। ঘাত প্রতিঘাতের পরে শেষে জানা যায় এই মটর মেকানিক পোলা আসলে লাট সাহেবের বাল্যবন্ধুর পোলা, আর লাট সাহেব ঐ বাল্যবন্ধুর পাঁচ হাজার টাকা নিয়া ব্যবসা কইরাই আজ লাট সাহেব হইছে। এইসব ক্ষেত্রে কুলনাশটা ছদ্ম কুলনাশ। কারণ পুরা ফিল্মে আমরা একটা কুলনাশের আবহ পাইতে থাকলেই শেষের দিকে দেখতে পাই কুল তো নাশ হয় নাই। যেমন দেখা যায় বেদের মেয়ে জোছনা জাতীয় ফিল্মে। রাজার পোলা বেদের মাইয়ার প্রেমে পইড়া ঘরছাড়া, কুলনাশের টেনশনে দর্শক অস্থির। কিন্তু শেষে দেখা যায় বেদের মাইয়া আসলে বেদের মাইয়া নয়, উজির খান সাহেবের মাইয়া, যারে কাটছিল কালনাগিনী সর্পে, পরে ভাসাইয়া দেয়া হইছিল কলাগাছের ভেলায়, তা খুইজা পায় বেদের সর্দার মফিজ। অর্থাৎ, শ্রেণীরে ব্যালেন্স কইরা দেন পরিচালক-গল্পকার যাতে দর্শকদের মধ্যে কুলনাশের বেদনা না থাকে শেষে।

যতই মানুষ প্রেমরে পরিবার ভিন্ন জিনিস মনে করুক না কেন, প্রেমকে প্রেমের গল্প হইয়া উঠার জন্য পরিবার বা কুলই আসল। কুলনাশই এখানে মূলকথা, বেদনা।

1 thought on “কুলনাশা পিরিত ও পদ্মাবতী বিষয়ে দার্শনিক কথাবার্তা”

  1. এমন প্রেমের টেস্ট আমিও একটু পাইছিলাম। বিপ্লবটা হয় নাই শুধু নায়িকার কূল নাশের ভয়ে । যাই হোক, আর্য সংস্কৃতিতে নাচ নাই, অবাক হবার কথা । গান বাজনা সবই আছে

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং