হুমায়ূন আহমেদের “পাপ”

ধুমায়ূন আহমেদ

বাংলাদেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য এই দেশের নব উত্থিত মিডলক্লাসের চরিত্র বুঝার এক ভালো উপায়। কারণ তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এই সমস্ত মানুষের কাছে, এবং আর কোন লেখক এই ক্লাসের কাছে এমন গ্রহণযোগ্যতা কখনো পান নি।

আজিজ সাহেবের পাপ নামে একটা নাটক আছে হুমায়ূন আহমেদের। এর গল্প এমন, একজন চাকরি করা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত লোক একদিন তার দুই বাচ্চারে নিয়ে পার্কে গেছেন। তারা আইসক্রিম খাবে। ভদ্রলোক আইসক্রিম কিনে দিলেন। ঐ সময় পার্কে একজন গরীব শিশু ছিল। সে আইসক্রিমের খোসা নিয়ে খেলো। ভদ্রলোক দেখলেন, কিন্তু তখন কিছু বললেন না।

তিনি বাচ্চাদের নিয়ে যখন বের হবেন, তখন তার মনে হলো আবার বিষয়টা। তার মনে হলো তিনি একটি বড় পাপ করে ফেলেছেন। কারণ ওই মেয়েকে তিনি আইসক্রিম কিনে দিতে পারতেন।

কিন্তু তার পিচ্চি ছেলে বলল, না সে খোসাই খাক।

কিন্তু ভদ্রলোক শুনলেন না। তিনি পার্কে গিয়ে মেয়েরে খুজলেন। পেলেন না।

এরপর থেকে তার অশান্তি হতে থাকে। তিনি মেয়েটিকে দেখতে থাকেন নানা সময়ে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান। ইত্যাদি।

হুমায়ূন আজিজ সাহেবের পাপের সমাধান দিয়েছেন এইভাবে যে, একদিন পার্কে গিয়ে তিনি মেয়েটিকে পান। আইসক্রিম কিনে দেন। কিন্তু তখন আবার আরেক গরীব ছেলে খোসা নিয়ে খায়।

আজিজ সাহেব দেখেন। তার খারাপ লাগে।

কিন্তু, এখানে সমস্যা হলো, তিনি এখন কী করবেন? তিনি সবাইকে আইসক্রিম কিনে দিতে পারবেন? বা প্রথমবারে ওই বাচ্চা মেয়েটিকে আইসক্রিম কিনে দিলে কি আজিজ সাহেব (এবং তার দর্শকেরা) বুঝতে পারতেন যে, এরকম আইসক্রিম না খেতে পাওয়া বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও আছেন ধরায়?

ঐ পথশিশু মেয়েটিকে আজিজ সাহেব তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন নিজের মেয়ের মত লালন করবেন।

গল্পটা শেষ এখানে।

নাটকে পাপ বিষয়ে আজিজ সাহেব যেভাবে ফিল করেছেন, তার শালা, বউ বা ছেলেমেয়ে এভাবে ফীল করে নি। বরং তার শালা উদ্ভট কাজকর্ম করেছে। এফডিসি থেকে মৌলানা ভাড়া করে এনেছে তওবা পড়াতে।

এগুলি হাস্যরস আনার জন্য করা হয়েছে আবার এগুলির মাধ্যমে হুমায়ূন দেখাতে চান অন্যরা কেমন এই জিনিসটা ফীল করতে পারছে না।

ফলে, যে অঙ্গীকার (তোমাকে নিজের মেয়ের মত লালন করব) করে আজিজ সাহেব মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন বাসায়, তা কি তিনি পালন করতে পারবেন? যেখানে তার চারপাশের সমাজ জিনিসটাকে এভাবে দেখছেই না।

হুমায়ূনের পাপ বিষয়ক চিন্তার কেন্দ্র ধরা যায় তার এই কথাটি, যেটি আমি তার অন্য লেখায় পেয়েছিলাম,  সূত্র এখন মনে নেই। তিনি লিখেছিলেন, অনেক মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায় রাতে, কিন্তু আমাদের খারাপ লাগে না, কারণ আমরা তাকে জিজ্ঞেস করি না সে খেয়েছে কি না।

এই জিনিসটা আজিজ সাহেবের পাপ নাটকের গল্পেও আছে। আজিজ সাহেব এবং নাটকের অডিয়েন্সেরা, জানেন যে, এমন অনেক গরীব মানুষেরা আছে। যারা ফুটপাতে থাকে। আইসক্রিম খেতে পারে না। ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁজে, ইত্যাদি।

জানা স্বত্ত্বেও এটাতে তার খারাপ লাগে না। সে আইসক্রিম খায়, দামী ফুডের ছবি দেয়। বিলাশী জীবন যাপন করে।

কিন্তু যখন সরাসরি ঐ জিনিসটার সম্মুখীন হয়, তখন আজিজ সাহেবের মত কারো কারো এরকম অপরাধবোধ চলে আসে। হুমায়ূন নাটকে এটা উল্লেখ করতে ভুলেন নি যে আজিজ সাহেব খুব সৎ ছিলেন, এবং তার এই অপরাধবোধের ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছে সবাই।

জিজেক ফেটিশিস্ট ডিজাবোয়ালের যে মডেল দেন তা এরকম, “আমি জানি, কিন্তু আমি জানতে চাই না যে আমি জানি, তাই আমি জানি না।“

মানুষের লাইফে এইরকম ডিজাবোয়াল কাজ করে, যখন আমাদের কমিউনিটির বাইরে কারো অধিকারকে আমাদের অধিকারের মত দেখি না। তাদেরকে আমরা যখন ভিন্নভাবে দেখি, তখন একটা রিপ্রেশন আমাদের ভেতর কাজ করে। একটা অস্বীকার, এবং তাকে দেখেও না দেখা।

আমাদের খাবার বস্তু হিসেবে যেসব প্রাণী আসছে, তাদের প্রতি কীরূপ আচরণ করা হয়েছে, কিংবা যে চা শ্রমিকের শ্রমে উৎপাদিত চা আমাদের আড্ডার সঙ্গী হয়ে আছে, ঐসমস্ত শ্রমিক তাদের অধিকার পেয়েছেন কি না, বেসিক মানবাধিকার আমাদের মতো, এসব অস্বস্তিকর প্রশ্ন আমরা রিপ্রেস করে যাই।

আজিজ সাহেবের পাপ গল্পে আজিজ সাহেবও এটা করেছেন, কিন্তু এক সময়ে একটা ঘটনায় তার একটু সহমর্মীতা জেগে উঠে।

আজিজ সাহেব এই ঘটনার পরে কিন্তু ভাবেন নি, আরো কতো ছেলেমেয়েরা আছে গরীব। তারা কেন বেসিক অধিকার পাচ্ছে না, এ নিয়ে তার একটা কথাও নেই। তার কেবল ওই একটি মেয়ের কথাই মনে হয়েছে, এবং কেবল মনে হয়েছে আইসক্রিম খেতে তিনি দিতে পারেন নি। ফলে, আজিজ সাহেবের এই যে অনুভূতি মেয়েটিকে দেখে, এটাকে তার ব্যক্তিগত সহমর্মীতা হিসেবে দেখা যায়, তার নিজের আত্মসম্মানের উপর আঘাত। সামগ্রিক কোন ন্যায়নীতিবোধ তার ভেতর জাগে নি।

ফলে, এটি আরেক ধরণের রিপ্রেশন আজিজ সাহেবের, আরেক ধরণের ফেটিশিস্ট ডিজাবোয়াল। কারণ মূল যে পাপ ছিল আজিজ সাহেবদের, তারা নিজেদের ভালো লাইফের জন্য, অন্য আরো অনেকে লাইফে অধিকার পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, তা না দেখে একটা নৈতিক কম্প্রোমাইজ করে চলেছেন, তাকে অস্বীকারই করা হয়েছে এখানে।

আর শেষে সমাধান দিলেন হুমায়ূন, স্বস্তি আনয়নের জন্য দর্শকের মনে, যে মেয়েটি একটা ঘর পেল। এখন আজিজ সাহেবের মেয়ে হিসেবে বড় হবে।

এইখানে আরেকটি গরীব ছেলেকে খোসা খেতে দেখিয়ে হুমায়ূন এটাও দেখাতে চাইলেন খোসা খাওয়া ছেলেমেয়েরা আরো রয়ে গেছে।

কিন্তু ওইভাবে তিনি সমাপ্ত করতে পারেন নি নাটককে। করতে পারলে এটি ভালো নাটক হতে পারতো, অন্তত গল্পের দিক থেকে।

তিনি স্বস্তিদায়ক একটা সমাধানেই হাঁটলেন, আমার ধারণা এটি হলো টেলিভিশন দর্শকদের উহ্য চাপ থেকে। জিনিসটা ব্যবসাসফল তো হতে হবে। হায়, আরেক ফেটিশিস্ট ডিজাবোয়াল!

এবং সমাধানটি ভয়ংকর সমস্যাজনক। এরকম একটা মেয়েকে, যার বুঝার বয়েস হয় নি, তাকে এক স্বাক্ষাতে আইসক্রিম খাইয়ে ঘরে নিয়ে আসা কোন সমাধান নয়। মিডলক্লাস এতে (দরিদ্রকে দয়া করুণা দেখানো) খুশি হলেও এটা সমস্যাজনক, কারণ এইভাবেই এরকম মেয়েদের ধরে নিয়ে পাচার করা হয়।