প্রধানমন্ত্রীর মাছ ধরা, মাছের সুখ ও বড়শী বিষয়ে

ছবির অর্থ 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুইটা ছবি ভাইরাল হইছে। একটাতে তিনি বড়শি দিয়া মাছ মারতেছেন, আরেকটাতে সেলাই করতেছেন। এর আগেও তিনি রানতেছেন এমন ছবি ভাইরাল হইছিল। 

এইসব ছবিগুলাই আওয়ামীলীগের সমর্থকেরা দেখতেছেন প্রধানমন্ত্রীর মানবিক রূপ। আবার আওয়ামীলীগ বিরোধী বা যারা বর্তমান সরকারের শাসনকে নানা কারণে অপছন্দ করতেছেন, তারা দেখতেছেন ক্রুয়েল রূপ। ক্রুয়েল এক ছল। 

ঠিক যেন ম্যাকায়াভেলিয়ান। ইতালিয়ান এই পলিটিক্যাল থিংকার রাষ্ট্রনায়কদের এমন ছল করতে বলে গেছিলেন, বিশেষত ধার্মিকতা বিষয়ে। লোকদের সামনে দেখাইতে হবে যে আপনে ধার্মিক, তাতে জনসমর্থন মিলবে। 

একই ছবিতে যে দুই দল মানুষ ভিন্ন ছবি দেখে, এই পয়েন্ট বুঝার মত। মানুষ তার চিন্তার সাপেক্ষে, পূর্বধারনার সাপেক্ষে জিনিসরে দেখে ও জাজ করে। এইভাবে আমরা, অনেক জিনিসরে ভুল বিচার করি। সে যেটা না তা ভাইবা বসে থাকি। 

তাইলে, থিংকারের কাজ কি এখানে, বা একজন সচেতন লোকের? তিনি কি এই দুই ছবি দেখবেন না? 

থিংকারের কাজ হইল, তিনি এক চিত্রে দুই ছবি যে দুই দল দেখতেছে, তা সম্পর্কে সচেতন থাকা, এবং কেন তারা একই জিনিশে কেউ দেখে ফুল আর কেউ দেখে বিষের কাঁটা তা বুঝার চেষ্টা করা। আর যে চিত্র আছে উপস্থিত, তারে বাস্তবতা ও কনটেক্সট এর সাপেক্ষে বিচার করা। 

এখন, প্রধানমন্ত্রীর এই ছবিটাই, মাছেরা যদি দেখে, তাদের কেমন লাগবে? মানবিক লাগবে না এটা নিশ্চিত বলা যায়। 

মাছের জীবন 

কীসে আমরা বুঝব বড়শীতে আটকানো মাছের সুখ হয় না দুঃখ হয়? আমরা তো মাছ না। বা উত্তরাধুনিক চিন্তক কেউ আইসা বলতে পারেন, মাছেরা কি বলছে তারা কী চায়? তারা হয়ত বড়শীতেই আটকা পরতে চায়, হইতে পারে না কি এটাই তাদের এইম ইন লাইফ? জীবনের সাধনা। ফলত, আপনে কে জাজ করার ওই বড়শীতে আটকানো মাছের কষ্ট হইতেছে? 

এইটা এক  দার্শনিক প্রশ্ন। প্রাচীন চৈনিক দার্শনিকেরাও ভাবছেন এই বিষয়ে। চৈনিক দর্শনে মাছের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেইজেরা মাছের রূপকে অনেক কথা বলে গেছেন। 

একবার তাওইস্ট দর্শনের মহা সেইজ চুয়াং জি (জুয়াং জি) এবং হুই জু একটা সেতুর উপরে দাঁড়াইয়া নিচের পানি দেখতেছিলেন। সেখানে মাছেরা ছিল। 

চুয়াং জি বললেন, দেখ, মাছেরা কেমন নাচানাচি করতেছে। এরেই বলে মাছের সুখ! 

হুই জু বললেন, আপনে তো  মাছ না, মাছ না হইয়া কীভাবে বুঝবেন কীসে তাদের সুখ? 

চুয়াং জি বললেন, এবং তুমি তো আমি না, তাইলে তুমি কেমনে বুঝলা যে, আমি মাছের সুখ বুঝি না? 

হুই জু বললেন, তাইলে, আমি যদি আপনে না হইয়া জানতে না পারি, আপনে মাছের সুখ বুঝেন কি না, তাইলে তো আপনেও মাছ না হইয়া কীসে মাছের সুখ বুঝতে পারেন না, তাই না? 

চুয়াং জি বললেন, তাইলে চলো, তোমার প্রথম পয়েন্টে যাই। তুমি আমারে জিজ্ঞাস করলা, মাছের সুখ আমি কেমনে বুঝি। তোমার এই প্রশ্নেই তো বুঝায় যে, মাছের সুখ আমি বুঝি। বুঝি এই সেতুর উপরে খাড়াইয়া আমার অনুভূতির উপর ভর করে। 

তো, মাছের দুঃখ আমরা বুঝি আমাদের নিজেদের দুঃখের উপর ভর করে। চুয়াং জি যেভাবে মাছের সুখ বুঝতে পারছিলেন তার নিজের সুখের ভিত্তিতে। 

আরেকটা জায়গা, বৈজ্ঞানিক পদ্বতি, যেটা পরীক্ষা নিরীক্ষা নির্ভর জ্ঞান। সেইখান থেকে আমরা জানি মাছের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র আছে, ফলে তারা কষ্ট পায়। 

একই ভাবে সাব অল্টার্ন বা অন্য যেকোন মানুষের  সামাজিক সমস্যা ও পেইন বুঝতে আমাদের তাদের জায়গায় গিয়া সব সময় বসতে হয় না। 

বড়শীর অর্থ 

বড়শী হইলেন মাছ ধরার ফাঁদ। জুয়াং জি লেখারেও এইরকম ফাঁদ এর রূপকে কল্পনা করছিলেন। তার কথা ছিল। মাছ ধরার পরে আপনে বড়শীর কথা ভুলে যাইতে পারেন। 

তেমনি, লেখা হইল চিন্তা বা আইডিয়ার বাহন। লেখার মধ্যে থাকা আইডিয়া বা চিন্তারে আপনে নিতে পারলেন, গুরুর বক্তিমার অর্থ বুঝতে পারলে, মূল বক্তিমা বা লেখাটা ভুলে যাইতে পারেন। কারণ মূল জিনিশ অর্থাৎ মাছটা আপনে ধইরা ফেলছেন। মাছ ধইরা ফেলার পর ফাঁদ তথা লেখা বা বক্তিমা ফালাইয়া দিতে পারেন। 

এইজন্যই, একটা জেন গল্পে বই পুড়ানোর কথা ছিল। কারণ বই, লেখা বা বক্তিমা তার মূল কাজ তথা যে অর্থ বা ইনসাইট দিতে চায়, আপনে তা নিতে পারলেই হইল। এরপর এরে, আলাদা ভক্তি করার দরকার নাই, তাওইস্টেরা এমনই ভাবেন। 

সম্ভবত, বই বা লেখা বা বক্তিমা বিষয়ে মানুষের যে প্রবণতা, তারা মূল জিনিশ তথা অর্থ না বুঝে জিনিসটারে পূজার বস্তু বানাইয়া ফেলে, সেই সমস্যা প্রাচীন, এবং তাওইস্টেরা এর সমাধান করতে চাইছেন। অর্থ না বুঝে বেহুদা ফাঁদরে পূজা, ভুয়া।