আহমদ শরীফ বাংলাদেশের একজন পণ্ডিত, চিন্তক ও সাহিত্য সমালোচক। এই লেখায় তার স্বাক্ষাতকারমূলক বই আলাপচারী আহমদ শরীফ যেটি আবুল আহসান চৌধুরীর নেয়া, এবং প্রবন্ধের বই কালিক ভাবনা থেকে তার কিছু কথা তুলে ধরেছি। শেষে আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে আহমদ শরীফের মন্তব্য ও আহমদ শরীফ সম্পর্কে রাজ্জাকের মন্তব্য যুক্ত করেছি।
”পরাজিত শত্রুকে লাঞ্চিত করতে নেই। ক্ষমা করতে হয়। এরপরে তো সে নিজের লজ্জায় নিজেই গেল। তারপরে পীড়ন করাটা অমানবিক। আমি সেটা চিরকালই ধরে রেখেছি। আমি কখনো কারো প্রতি ভিকটিমাইজেশন যাকে বলে সেটা কখনো করি নি। কখখনো করি নি। আমি নিন্দা করে শেষ করে দেই, কথায় কথায় আমি অসংখ্য মানুষকে ‘হারামজাদা’ ডাকি, ওতেই আমার রাগ-গোস্বা চলে যায়।”
– ডক্টর আহমদ শরীফের সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আবুল আহসান চৌধুরী।
এই যে শাড়ি পরার লোক সৃষ্টি হয়েছে, পয়সা দিয়ে ফুল কেনার লোক সৃষ্টি হয়েছে, তোমরা গরিবের জাত- যে অবস্থায় তোমরা ছিলে- দুই হাজার বছরের পুরানো কথা, নিম্নবর্গের মানুষ থেকে তোমরা হয়েছ- তোমরা এইরকম গরীবই ছিলে। দুখানা শাড়ি দেওয়ার ক্ষমতাই মানুষের ছিল না গেরস্থ ঘরের। সেখানে এখন তোমরা গেরস্থগিরি ছেড়ে উঠতি বুর্জোয়া সোসাইটি গড়ে তুলেছ। কাজেই এখন তোমার স্ত্রীর, তোমার মায়ের, তোমার বোনের জন্যে পাঁচটা-সাতটা-দশটা শাড়ি দরকার হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রকমের বিভিন্ন দামের বিভিন্ন চমকের দরকার। সে কারণে তুমি তুলা এনে টেক্সটাইল মিলগুলো চালু করো নি। কাজেই ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি আসে। এটা ডিম্যান্ড এন্ড সাপ্লাইয়ের কথা।
– ডক্টর আহমদ শরীফ, আবুল আহসান চৌধুরীর সাথে কথাবার্তা (১৯৯৪)।
‘যে ভোগেচ্ছু অথচ কর্মকুণ্ঠ, তার জীবিকার্জনের দুটো পথ-ভিক্ষা ও চৌর্য। বাঙালীর এই কাঙালপনার পরিচয় রয়েছে তার স্ব-সৃষ্ট উপদেবতা-অপদেবতা কল্পনায় ও তুকতাক, জাদু-টোনা, মন্ত্র-তন্ত্র-কবচ-মাদুলি প্রীতিতে। আপাতসুখ ও আত্মরতি তাকে করেছে স্বার্থপর, ধূর্ত ও লোভী। তাই সে যৌথ কর্মে অসমর্থ। তার বুদ্ধি ধূর্ততায়, তার সংকল্প উচ্ছ্বাসে, তার প্রয়াস স্বার্থে অবসিত। কালো পিঁপড়ের মতো সে নিঃসঙ্গ সুযোগসন্ধানী। এসব নিশ্চিতই বাঙালীর স্থায়ী কলঙ্কের কথা।’
– ডক্টর আহমদ শরীফ। কালিক ভাবনা।
তৃতীয় বিশ্বের যে সার্বভৌমত্ব সেটা নিতান্ত একটা কথার কথা- ঠুনকো ব্যাপার। ঐ যে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের মত। স্বাধীন কুচবিহার রাজ্যের মতো। মহারাজ শ্রীশ্রী শ্রীল শ্রীযুক্ত- এগুলো কথার কথা সব যেমন, ঠিক আমাদের তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতাও সে-রকম। আমাদের স্বাধীনতাই বা কী, সার্বভৌমত্বই বা কী! ওরা কান ধরে উঠায়-বসায়, সরকার হয়েছে মুৎসুদ্দি সরকার।
– ডক্টর আহমদ শরীফ। আবুল আহসান চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎকারে।
‘বাঙালী চরিত্র সম্বন্ধে বিদেশীদের ধারণাও কখনো ভালো ছিল না। মিথ্যা কথন, ভীরুতা, মামলা-প্রিয়তা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি বাঙালী চরিত্রে ছিল সুলভ।’
‘বাঙালী ভোগলিপ্সু কিন্তু কর্মকুণ্ঠ। বৈরাগ্য-প্রবণ জৈন-বৌদ্ধ-বৈষ্ণব মতবাদ বাঙালী চিত্তে কর্মকুণ্ঠা আরো প্রবল করেছে। এমন মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি বা চৌর্ববৃত্তি অবলম্বন করে। বাঙালীচরিত্রে যে একদিকে মিথ্যাভাষণ, প্রবঞ্চনা, চৌর্য, ছদ্মবৈরাগ্যভাব, চাতুর্য, সুবিধাবাদ এবং সুযোগসন্ধান, তোয়াজ ও তদ্বির-প্রবণতা প্রভৃতির প্রাবল্য এবং আত্মসমমানবোধের অভাব, অন্যদিকে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে যে দেবানুগ্রহজীবিতা রয়েছে, তা ঐ কর্মকুণ্ঠারই প্রসূন।’
– ডক্টর আহমদ শরীফ। কালিক ভাবনা।
“এইখানে আমার বইয়ের সমালোচনা দেখেছো কখনো? কারণ আমি কাউকে বলি না, করে না। এক-একজনের বই বের হয়- যেখানেই খোলো সেখানেই সেটার পরিচয়। এমনকী আমাদের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও, তার ছাত্রটাত্র আছে, দশ বারো জনকে বলে দেয়, বই বেরোলেই তারা লিখে দেয়।”
– ডক্টর আহমদ শরীফ। সাক্ষাৎকার। গ্রহণ করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী।
“শরীফ ত্যারাবাঁকা কথা বেশ কয়। কিন্তু এক সময় তা কাম করছে। হি ডিড মেনি থিংস।”
– আহমদ শরীফ সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক। যদ্যপি আমার গুরু, ছফা।
“রাজ্জাক সাহেব মুসলিম লীগ মানসিকতার লোক, তিনি যাদের পছন্দ করেন তাঁদের উপকার করার জন্য তিনি আইন কানুন ভেঙ্গে কাজ করতে চান, আশ্রিত বাৎসল্য প্রদর্শনে তার কোনো সংযম নেই।”
– আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে আহমদ শরীফ। আবুল কাসেম ফজলুল হক।