মুরাদুল ইসলাম » গল্প » সূফীদের গল্প

সূফীদের গল্প

এক

হাসান বসরী, বুজুর্গ সাধু ব্যক্তি, একবার বলছিলেন আমি চারজন ব্যক্তির কথায় বিস্মিত হইছি লাইফে।

একজন হইল এক মদ্যপ, আরেকজন এক লম্পট, আরেকজন এক শিশু, আরেকজন এক নারী।

লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, হাসান, আপনে এতো জ্ঞানী ব্যক্তি! কেমনে এইরকম চারজন ব্যক্তির বানী আপনার মনে লাগলো?

হাসান বললেন, একবার এক মদ্যপ ব্যক্তি মাতাল হয়ে যাইতেছিল পিচ্ছিল রাস্তা দিয়া। সে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। আমি তারে বললাম, দেইখা যাও, পড়ে যাইবা।

লোকটা আমারে বললো, ও হাসান! তুমি যে এতো সতর্ক হইয়া আল্লার রাস্তায় হাঁটতেছ, তাও কি নিশ্চিত যে পড়বা না? আমি যদি পইড়া যাই এই কাদামাটিতে তাইলে আর কিইবা ক্ষতি হবে, কিন্তু তুমি যদি আত্মগর্বে মগ্ন হইয়া পইড়া যাও একবার, জিন্দেগীর সকল ভালো কর্মও তো কাজে আসবে না, ভাবছো কি একবার?

এই কথাগুলি আমার হৃদয়ে লাগলো।

এরপর আরেকদিন আমি এক লম্পট জুয়ারী লোকরে দেখলাম। আমার পাশ দিয়া যাইতেছিল। আমি আমার কাপড় তার গায়ে লাগবে দেইখা কাপড় গুটাইয়া নিলাম কিছু।

সে তখন বলে উঠল, ও হাসান! আল্লার বান্দা, কেন নিজের কাপড় এত গুটাইয়া নেও আমার গায়ে লাগবে বইলা, ভুইলা গেছো কি কেবলমাত্র সর্বশক্তির আধার আল্লাহই জানেন তোমার আমার শেষ পরিণতি কী হবে।

আরেকবার আমি দেখলাম এক বাচ্চা ছেলে একটা জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়া আসতেছে। আমি তারে জিজ্ঞেস করলাম, এই প্রদীপের আলো পাইলা কই থেকে?

শিশুটা আমার দিকে তাকাইয়া প্রদীপে ফু দিয়া আগুন নিভাইয়া দিল। এরপর বলল, ও হাসান, আমারে বলো, আলো এখন কই গেল, আমি তোমারে বলব কই থেকে আনছিলাম আমি।

আরেকবার এক নারী তার মুখ উন্মুক্ত করে আমার কাছে আসলো। সে তার স্বামীর সাথে ঝগড়া করে আসছিল। আইসাই তার অভিযোগ জানাইতে লাগলো।

আমি তারে বললাম, আগে তোমার মুখ ঢাকো। তারপর বলো।

নারী উত্তর দিল, ও হাসান! আমি এতোই উত্তেজিত ছিলাম যে মনেই ছিল না মুখ ঢাকি নাই। আপনে না বললে হয়ত এইভাবেই বাজারে চলে যাইতাম। কিন্তু আপনে এতো বুজুর্গ ব্যক্তি, আল্লাহর লগে এতো সম্পর্ক আপনার, তাইলে কি আপনার চোখ এইরকম সংযত হওয়া উচিত ছিল না যে, আমার মুখ ঢাকা না খোলা তা সে লক্ষ করবে না?

তার কথা আমার হৃদয়ে বাঁধলো গিয়া।

দুই

একবার হযরত বায়েজীদ বোস্তামির কাছে এক লোক আইলো। আইসা বললো, বায়েজিদ আপনে কোথায় যাইতেছেন?

আমি বললাম, মক্কায় যাইতেছি। কাবা ঘর তওয়াফ করব।

লোক বলল, কতো টাকা আছে আপনার?

আমি বললাম, দুইশত স্বর্ণমুদ্রা।

লোক বলল, আমারে দিয়া দেও এই টাকা। আর আমার চাইরপাশেই সাত চক্কর দিয়া দেও। আমারে করা এই দান কাবা ঘর তওয়াফের চাইতে বেশি নেকী নিয়া আসবে।

বায়েজিদ তারে টাকা দিয়া দিলেন।

ওই বছর তিনি হজ্জ্বে যাইতে পারেন নাই।

                                                                           তিন                            

একদিন বায়েজিদের মনে হইল তিনি বোধহয় সবচাইতে সেরা সূফী। কিন্তু এর পর পরই তার মনে হইত লাগলো এইটা তো ঠিক চিন্তা না। বায়েজিদের অনুশোচনা হইল। তিনি সাথে সাথে গেলেন খোরাসানের উষর মরুতে। গিয়া তিনি এক জায়গায় বইসা পড়লেন। আর বললেন, ও আল্লাহ, আমি এইখান থেকে নড়বো না আর, যতক্ষণ না তুমি আমার কাছে এমন এক লোকরে পাঠাইয়া দেও, যিনি আমারে দেখাইবেন আমি আসলে কী।

তিন দিন তিন রাত বায়েজিদ সেই মরুভূমিতে বইসা থাকলেন। বালুর মধ্যে।

চারদিনের দিন, রাইতে উটে চইড়া আসলেন এক বিস্ময়কর লোক।

তিনি আইসা বায়েজিদের সামনে থামলেন, আর বায়েজিদের দিকে তাকাইয়া বললেন, এইটা সন্দেহাতীত যে, চোখের পলকে আমি ওই বোস্তমের গ্রাম, তার লোকসকল এবং তার সম্পদাদিসহ খাইয়া ফেলতে পারি…

অতঃপর  একটু থাইমা বললেন,  আর খাইয়া ফেলতে পারি বায়েজিদরেও।

এই কথায় বায়েজিদ ডরাইয়া গেলেন। তিনি লোকটারে জিজ্ঞেস করলেন, কই থেকে আসছেন আপনে?

লোক বললেন, ও বায়েজিদ! তুমি যখন এইখানে বইসা আছো, এই সময়ে আমি তিন হাজার মাইল ঘুইরা আসছি। বায়েজিদ, ভালো থাইকো, আর নিজের হৃদয়রে বাইন্ধা রাইখো বে লাইনে যাইতে দিও না, কখনো ভুইল না রাস্তা। তা নইলে বিপদ।

চার

একবার বায়েজিদ রাইতে গেছেন গোরস্থানে, কবর জিয়ারত করতে। গিয়া দেখেন এক ইয়াং পোলা বাদ্যযন্ত্র বাজাইতেছে।

বায়েজিদ গিয়া তারে বারণ করলেন।

পোলাটা রাইগা গিয়া তার বাদ্যযন্ত্র দিয়া আঘাত করলো বায়েজিদের মাথায়। বাদ্যযন্ত্র ভাইঙ্গা গেলো।

বায়েজিদ ফিরা আসলেন।

পরদিন তিনি কিছু মিষ্টান্ন আর টাকা পাঠাইয়া দিলেন ঐ পোলারে। সাথে একটা চিঠি, কাইল আমার মাথায় বাড়ি মাইরা তোমার বাদ্যযন্ত্র ভাইঙ্গা গেছে। এইজন্য কিছু টাকা পাঠাইলাম। সাথে কিছু মিষ্ঠান্ন। যাতে এই খারাপ ঘটনাটা তোমার মনে না থাকে।

এইগুলা পাইয়া পোলা ছুইটা আসলো বায়েজিদের বাসায়। আইসা মাফ চাইল।

পাঁচ

একবার বায়েজিদ তার কিছু বন্ধুর সাথে নামায পড়তেছিলেন। নামায শেষ হইলে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, বায়েজিদ তুমি মিয়া কিছু করো না। ব্যবসাপাতিও না। কারো কাছে হাতও পাতো না। তাইলে তুমি চলো কেমনে?

বায়েজিদ বন্ধুরে বললেন, একটু ওয়েট করো।

বন্ধু বললেন, ক্যান?

বায়েজিদ বললেন, আমি আবার নামায পইড়া নেই।

বন্ধু বললেন, আরে একটু আগে না পড়লা?

বায়েজিদ বললেন, যে জানে না চলায় কেয় বা রিজিকের মালিক কে, তার সাথে পড়লে নামায হয় না।

ছয়

একবার বুজুর্গ হাতিম আসাম বললেন, শেষ বিচারের দিন পাপী বান্দাদের জন্য যারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে না, তারা আমার শিষ্য না।

বায়েজিদ এই কথা শোনার পর বললেন, তারাই আমার শিষ্য কেবল, যারা শেষ বিচারের দিন দোজখের দরজায় দাঁড়াইয়া পাপীদের রক্ষা কইরা যাবে, ও দরকার পড়লে দোজখের ভিত্রে গিয়াও তাদের বাঁচাইয়া আনবে।

সাত

৪০ বছর তপস্যা কইরা একদিন রাইতে বায়েজিদ বোস্তামি স্বপ্নে দেখলেন আল্লাহর সিংহাসনের বাইরের ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া তিনি। সারাজীবন যার তপস্যা করছেন তার কাছাকাছি আইসা বায়েজিদের গা কাঁপতে লাগলো। তিনি চিৎকার কইরা বললেন, আমারে ভিতরে যাইতে দাও। 

একটা স্বর ভাইসা আসলো, ও বায়েজিদ, থামো। তোমার এখনো একটা মাটির পাত্র আছে আর গাত্রাবরণ আছে। এইগুলা নিয়া তো তুমি ভিত্রে যাইতে পারবা না।

বায়েজিদ সাথে সাথে তার ভাঙ্গা মাটির পাত্র আর গাত্রাবরণ ছুইড়া ফেললেন।

স্বর তখন বললো, বায়েজিদ, তারা জানে না তাদের গিয়া জানাও। তাদের গিয়া বলো, আমি বায়েজিদ চল্লিশ বছর তপস্যা করছি। তাও আল্লার কাছে যাইতে পারি নাই কারণ একটা মাটির ভাঙ্গা পাত্র আর পুরাণ পোষাক ছিল বইলা। আর তোমরা দুনিয়াতে এতো দুনিয়াদারী করা, এতো কিছুর মালিক হইয়া আল্লারে পাইতে চাও?

আট

একদিন বায়েজিদ রাস্তা দিয়া হাইটা যাইতেছেন। তার পিছু পিছু পদচিহ্ন ধইরা যাইতেছিল এক ইয়াং পোলা।

এক পর্যায়ে পোলাটা বলল, ও বায়েজিদ, আপনার পোষাকের একটা অংশ ছিইড়া আমারে দেন। যাতে আপনার আশীর্বাদ আমার লগে থাকে।

বায়েজিদ বললেন, হে ইয়াং পোলা, তুমি ভুল বুঝতেছ। পোষাক কেন আমার গাত্র চামড়া খুইলা দিলেও কোন কাজে আসবে না যদি না তুমি বায়েজিদের কাজরে অনুসরণ কইরা কাজ করো।

নয়

এক সূফী আধ্যাত্মিক গুরু আছিলেন, নাম শাকরান। শাকরানের যখন ইয়াং বয়েস, তখন তিনি নীল নদের পাড়ে খেয়া পাড় করতেন। লোকদের অন্য পাড়ে নিয়া যাইতেন।

একদিন একজন সূফী ফকির আইলেন তার নৌকায়।

তার পরনে পুরান এক পোষাক। গলায় ঝুলতেছেন চামড়ার এক পানির পাত্র। আর হাতে লাটি।

তিনি আইসা বললেন, তুমি আমারে পাড় করবা আল্লাহর দয়ায়?

শাকরান বললেন, করব।

ফকির বললেন, আর আমার এক আখেরি নিয়ত আছে, ওইটা কি পূরণ করবা আল্লাহর দয়ায়?

শাকরান বললেন, অবশ্যই করব।

তিনি নৌকায় উঠলেন। নৌকা বাইতে বাইতে একটা নির্জন জায়গায় একটা গাছের নিকটে থামাইতে বললেন ফকির। তারপর তিনি সেই গাছের নিচে তিনি নাইমা গেলেন। আর বললেন, এখন চইলা যাও। তুমি আমার কথা এখন ভুইলা যাইবা। কিন্তু কাল দুপুরে আবার তোমার মনে হইব আমার কথা। তখন তুমি আবার এইখানে আসবা।

তখন তুমি এই গাছের নিচে গেলে আমারে দেখবা। মইরা পইড়া আছি। তুমি জানাযা কইরা আমারে কবর দিবা।

এরপর আবার পোষাক, পানির পাত্র আর লাটি নিয়া যাইবা ঐপাড়ে।

যে ব্যক্তি প্রথম এইগুলা চাইবে, তারে দিয়া দিবা।

শাকরান সম্মত হইলেন।

সত্যি সত্যি তিনি ঐখান থেকে আসার পর সব বেমালুম ভুইলা গেলেন। কিন্তু পরদিন দুপুরে আবার সব মনে পড়ল।

তিনি আবার নৌকা দিয়া আসলেন গাছের কাছে। আইসা দরবেশরে মৃত অবস্থায় দেখলেন। হাসি হাসি মুখে, প্রশান্তিতে তিনি যেন ঘুমাইতেছেন।

শাকরান জানাযা পইড়া তারে কবর দিলেন। এরপর তার জিনিসপাতি নিয়া গেলেন ঐ পাড়ে।

গিয়া দেখলেন শহরের সবচাইতে লম্পট আর বাজে লোকটা দাঁড়াইয়া আছে। শাকরান এরে চিনতেন। ভাড়ায় গান গায়। মদ্যপ ও বাজে। তার পোষাক আশাক উগ্র, হাতে মেন্দির রঙ আর মুখ দেইখাই বুঝা যাইতেছে কাল সারা রাত মাতলামি করছে কোন জায়গায়।

শাকরানরে দেইখা সে বলল, আমারে ঐগুলি দাও?

শাকরান অবাক হইয়া জিজ্ঞেস করলেন, কোনগুলি?

লোকটা বলল, যেইগুলা আমার উপর অর্পিত হইছে। ওই ফকিরের পোষাক, পানির পাত্র বা লাটি।

শাকরানের মন খারাপ হইল। তবুও তিনি নৌকা থেকে ঐগুলা বাইর কইরা দিলেন লোকটারে।

লোকটা তার কাপড় চোপর খুইলা এইগুলি পইরা নিল। গলায় ঝুলাইল পানির পাত্র। এরপর হাঁটা দিল।

শাকরান তারে থামাইয়া বললেন, আল্লার দোহাই, আমারে বইলা যাও এর কাহিনীটা কী?

লোকটা বলল, আমারে তো চিনো তুমি। আমি একজন বাজে লোক। কালও একটা বিয়াতে গান গাইয়া, মদ খাইয়া টাল হইয়া ঘুমাইছিলাম। ঐ ঘুমেই স্বপ্নে দেখলাম, একজন আমারে বলতেছেন, আল্লাহ আইজ দুনিয়া থেকে একজন তপস্যীরে তুইলা নিছেন। দুনিয়াতে তার কাজের দায়িত্ব পড়ছে তোমার উপরে। তুমি কাইল নদীর পাড়ে যাইবা। নৌকা পাড়াপাড় করা যুবকের কাছে চাইবা ফকিরের পানির পাত্র, পোষাক আর লাটি। এবং এইগুলা নিয়া তার মতো লাইফ লিড করতে থাকবা।

এই গল্প বইলা লোকটা চইলা গেল।

শাকরানের খারাপ লাগলো। তিনি কান্নাকাটি করলেন। আল্লাহ আমি কি এতোই খারাপ যে, একজন সাধুর দায়িত্ব আমার উপর পড়লো না, পড়লো ওই লোকের উপরে!

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন শাকরান। একটা স্বর বলতেছে, শাকরান! ও শাকরান!

তুমি কেন শোক করতেছ আমি আমার এক গোনাগার বান্দারে অনুতাপের সুযোগ দিছি বইলা?

এইটা তো আমার উপহার, তাই না শাকরান? আমি আমার যে বান্দারে ইচ্ছা, তারেই দিব। কিন্তু তার মানে তো এইটা না যে, যেসব বান্দা আমারে খোজে তাদের আমি ভুইলা গেছি।

শাকরান! ও শাকরান!

শাকরানের ঘুম ভাইঙ্গা গেল। তিনি তার বাজে উচ্চাকাঙ্খার জন্য মাফ চাইতে লাগলেন।

দশ

জালালউদ্দিন রুমি সূফী কবিদের মধ্যে সেরা আছিলেন পারস্যে। তার সমসাময়িক আরেকজন বড় সূফি কবি তখন শেখ সাদী।

একবার সিরাজের যুবরাজ শেখ সাদীরে বললেন পারস্যের সবচাইতে সেরা কবিতাটা পাঠাইতে।

শেখ সাদী পাঠাইলেন জালালউদ্দিন রুমীর মসনবীর একটা কবিতা।

এগারো

ইবনে সিনার ক্ষেত্রে, তার বাপ আছিলেন ট্যাক্স কালেক্টর। সেই হিসাবে শিক্ষার অনেক সুযোগ পাইছিলেন তিনি। তার লজিং মাস্টর ছিলেন ফিলোসফার আন-নাতিলি। তার কাছে তিনি লজিকবিদ্যা, ইউক্লিড আর টলেমির জ্যোতিবিজ্ঞান বিষয়ক ধারণাগুলি শিখেন।

এরপর ন্যাচারাল সাইন্স, আধ্যাত্মিকতা, এবং অন্যান্য বিজ্ঞানে মনোনিবেশ করেন। এর পরে আগ্রহী হন মেডিকেল সাইন্সে।

একবার ইয়াং বয়েসে এরিস্টটলের মেটাফিজিক্স পড়তে গিয়া তিনি দেখলেন এই বই কঠিন। পইড়া কিছু বুঝা যায় না।

আমাদের সুখী পাঠকেরা যেমন হইয়া থাকেন, কঠিন লাগলেই তারা ছাইড়া দেন, ইবনে সিনা এমন ছিলেন না। তিনি বার বার এইটা পড়তে লাগলেন। প্রায় চল্লিশবার শেষ করলেন। শেষে এমন অবস্থা হইল যে, তার মুখস্ত হইয়া গেছে বই, কিন্তু তিনি কিছু বুঝেন নাই।

এই না বুঝায় অস্থির হইয়া উঠলেন তিনি।

একদিন যোহরের নামাযের পরে গেলেন বইয়ের দোকানে। ওইখানে তার বন্ধুরে পাইলেন। বন্ধুর হাতে একটা বই ছিল। উনি বললেন, এই বইটা খুবই ভালো।

ইবনে সিনা বইটা হাতে নিয়া দেখলেন। কিন্তু তার মনে হইল এই বই তার জন্য না।

বন্ধু তারে বললেন, এই বই তুমি কিনা নেও। এর মালিকের টাকা দরকার। মাত্র তিন দিরহামে বেঁচতেছে।

অগত্যা ইবনে সিনা বইটা নিয়া নিলেন।

বইটা ছিল আল ফারাবির এরিস্টটলের মেটাফিজিক্সের উপর ভাষ্য। বইটা পড়তে গিয়া ইবনে সিনা দেখলেন এইরকম কিছুই আসলে তিনি খুজতেছিলেন। এই বই পড়তে পড়তেই তিনি এরিস্টটলের মেটাফিজিক্স বুঝতে পারলেন। এতো খুশি হইলেন ইবনে সিনা যে পরদিন আল্লার নামে গরীবদের দান খয়রাত করলেন।

বারো

ইবনে সিনার তখন খ্যাতি হইছে ডাক্তারিরে। বোখারার সুলতান ইবনে মানসুর অসুস্থ হইছিলেন, তিনি ইবনে সিনারে ডাকাইয়া নিলেন। তার চিকিৎসায় মানসুর সুস্থ হইয়া উঠলেন।

আল মানসুরের বিরাট লাইব্রেরী ছিল। সেইখানে নানা ধরণের জ্ঞান বিজ্ঞানের বই। ইবনে সিনা সেইখানে পড়ার সু্যোগ পাইলেন।

এইখানেই তিনি প্রাচীনদের জ্ঞান বিজ্ঞান আয়ত্ত্ব করা শুরু করেন।

কিছুকাল পরেই এই লাইব্রেরীতে আগুন লাগে আর সব পুইড়া যায়।

তখন একমাত্র ব্যক্তি থাকেন ইবনে সিনা, যিনি ঐসব বইয়ের জ্ঞান সবচাইতে ভালোভাবে জানতেন।

কেউ কেউ এইটা বলছেন তখন, ইবনে সিনাই আগুন দিছিলেন লাইব্রেরীতে। যাতে জ্ঞানের রাজ্যের একমাত্র দখলদার তিনি থাকেন।

তেরো

ইব্রাহিম বিন আদম আছিলেন বলখের রাজা। এমনিতে আল্লাহর নাম নিয়াই তিনি দিনযাপন করতেছিলেন। একদিন রাইতে ঘুমাইয়া আছেন, শুনতে পাইলেন ছাদে কে জানি হাঁটে।

ইব্রাহিম বললেন, কে তুমি? কেউ হাঁটো নাকি ছাদে আমার? কী করো এইখানে?

একটা লোক বলল, মহামান্য, আমি আমার উট হারাইয়া ফেলছি, তাই খুজতেছি।

ইব্রাহিম বললেন, তুমি বোকা নাকি? ছাদে কি হারানো উট পাইবা, এতো গর্দভি চিন্তা কেমনে করো?

লোক বলল, হুজুর, এতো আরাম আয়েশের মধ্যে থাইকা আপনে আল্লাহরে পাওয়ার আশা করতে পারলে, ছাদে উট খুইজা পাবার আশা করা কি বড় ভুল হয়? কোনটা বেশি গর্দভী আশা?

ইব্রাহিমের মাথা ঘুইরা গেল এই উত্তরে।

তিনি সারারাত ইবাদতে কাটাইলেন।

পরদিন সকালে যথারীতি গিয়া সিংহাসনে বসলেন। আশপাশে লোক লস্কর, প্রাচূর্য। দরবার চলতেছে। এর মাঝে হঠাত ইব্রাহিম একটা মহিমান্বিত লোকরে দেখলেন, যিনি উইঠা তার দিকে আসতেছেন। আর কেউ তারে দেখতেছিল না।

কাছাকাছি আসলে ইব্রাহিম তারে জিজ্ঞেস করলেন, আপনে কে? কারে খুজেন এইখানে?

লোক বললেন, আমি একজন আগুন্তুক। এই মুসাফিরখানায় থাকতে চাই।

ইব্রাহিম বললেন, এইটা তো কোন মুসাফিরখানা না। এইটা আমার বাড়ি, রাজপ্রাসাদ।

লোক বললেন, তোমার আগে এইটা কার ছিল?

ইব্রাহিম বললেন, আমার বাপের।

লোক বললেন, এর আগে?

ইব্রাহিম বললেন, আমার দাদার।

লোক  বললেন, তোমার এইসব পূর্বপুরুষেরা কই এখন?

ইব্রাহিম উত্তর দিলেন, উনারা নাই, মইরা গেছেন।

লোক বললেন, তাইলে তো এইটা মুসাফিরখানাই। যেইখানে পুরান অতিথিরা নয়া অতিথির কাছে ছাইড়া দিয়া যায় মালিকানা।

এই কথা বইলাই আগুন্তুক যাইতে শুরু করলেন।

ইব্রাহিম দৌড়াইয়া গিয়া তারে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর নামে থামেন, আর আমারে বলেন আপনে কে? আমার অন্তরে এই আগুন জ্বালাইল কে?

আগুন্তুক বললেন, আমি খিজির, ও ইব্রাহিম। তোমার জাইগা উঠার সময় এখন।

এরপর তিনি বাতাসে মিলাইয়া গেলেন।

ইব্রাহিম বিমর্ষ হইয়া উঠলেন। দুনিয়াবি বাহুল্যতার প্রতি তার সব আকর্ষণ চলে গেলো।

পরদিন সকালে পাহাড়ী এলাকায় শিকারে গেছেন ইব্রাহিম। যাইতে যাইতে তিনি শুনলেন একটা স্বর তারে বলতেছে, ও ইব্রাহিম, তুমি এইজন্য দুনিয়াতে আসো নাই।

ইব্রাহিম চারদিকে দেখলেন। কাউরে পাইলেন না।

আরেকটু আগাইলে তিনি আবার শুনলেন। ও ইব্রাহিম, এইসব করার জন্য তুমি দুনিয়াতে আসো নাই।

ইব্রাহিম হঠাত চিল্লাইয়া উঠলেন, এই যদি হয় মহান আল্লাহর আদেশ, তাইলে আমি বান্দা তা মানতে প্রস্তুত।

ইব্রাহিম সাথে সাথে একজন মেষপালকের পোষাক পইরা নিলেন। আর একজন ঘুইরা বেড়ানো দরবেশের জীবন গ্রহণ করলেন।

2 thoughts on “সূফীদের গল্প”

  1. মাশাল্লাহ! আমাগো বুজুর্গরা, ওলি-আল্লাহ’রা, মজজুব ফকির’রা কত সুন্দর কিসসার প্যাটার্নে’ই নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা দিয়া গেছেন। এগুলা থেইকা কিছু আমরার জবানে আপনে হাজির করলেন।
    শুকর গুজার থাকলাম।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং