বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজের দিকে যাত্রা 

বর্তমান বাংলাদেশের সবচাইতে বিখ্যাত নায়ক শাকিব খান আমেরিকায় স্থায়ী হচ্ছেন। এই প্রবণতা আছে, দেশের মানুষেরা উন্নত দেশে স্থায়ী হতে চান। যেমন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান সহ আরও অনেক ব্যক্তি, যারা বাংলাদেশেই বড় সফলতা পেয়েছেন, তারা আমেরিকায় গ্রিন কার্ড নিয়ে রাখছেন।  

সাধারণ মধ্যবিত্তের বিদেশে স্থায়ী হওয়া এবং শাকিব খানের মত বিখ্যাত, তার জায়গায় সবচাইতে সফল ফিল্ম স্টারের বিদেশে স্থায়ী হতে চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। 

একজন ব্যক্তি তার সুযোগ থাকলে যেকোন দেশে স্থায়ী আবাস গড়তে পারেন, এতে আপত্তির জায়গা নাই। এই লেখার বিষয় কারণটা নিয়ে চিন্তা করা। কেন এইরকম সফল ব্যক্তিরাও বিদেশে আবাস গড়তে চাচ্ছেন? এবং যেহেতু এইরকম সফল ব্যক্তিরাও বিদেশে স্থায়ী হতে চাচ্ছেন, তাই এটা অনুমেয় যে, এদেশে যারই সুযোগ আছে সে বিদেশে স্থায়ী হবার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না। 

এর কারণ সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। 

বাংলাদেশ একটা গ্রাম্য সমাজের দিকে যাত্রা করেছে গণতান্ত্রিক সমাজ বাদ দিয়ে। দেশ এখন আওয়ামীলীগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রিক। কারো কোন বড় সমস্যা হলে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। অনেক এমন ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নায়িকা পরিমনি লাইভে এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়েছিলেন, এবং নায়িকা মাহিয়া মাহি হজ্ব থেকে দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার কথা বলেছিলেন। বিচার চাইতে হলে মানুষেরা শেখ হাসিনার কাছে বিচার দেন ফেসবুকে। 

গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি ন্যায়বিচার। গণতান্ত্রিক সমাজে বিচারের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান থাকে, আইন, আদালত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সমস্যায় মানুষ তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। কিন্তু গ্রাম্য সমাজে গ্রামের কর্তাব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ ছাড়া কোন বিচার হয় না। কারণ গ্রাম সমাজে এই ধারণা প্রচলিত থাকে যতোই আইন কানুন থাকুক, সব চলে পাওয়ারফুল কর্তাব্যক্তির ইশারায়। 

বাংলাদেশে একজন মানুষ কখন বিচার পাবে? 

বিচার পেতে হলে, বা তার মামলাকে গ্রহণ করাতে হলেও ক্ষমতাসীনের  সাথে তার সম্পর্ক থাকা জরুরী। সে নিজে ক্ষমতাসীনের কেউ হলে বা তার আত্মীয় পরিচিত কেউ ক্ষমতাসীন দলের নেতা হলে, তার পক্ষে বিচার পাওয়া সম্ভব। 

এবং দুইজন ক্ষমতাসীন দলের নেতার পরিচিত ব্যক্তিরা পারস্পারিক বিরোধে বিচার চাইতে গেলে, বেশি ক্ষমতাশালী নেতার পরিচিত জনেরই বিচারে সুবিধা পাবার সম্ভাবনা বেশি। 

গ্রাম্য কর্তার কাছের লোকজন, পক্ষের লোকজন, ও লেঠেলদেরই বিচার, শাসন। 

এমতাবস্থায়, দেশের সবচাইতে সফল ব্যক্তিরাও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ দেখবেন না। কারণ তারা জানেন বাঘের উপরে টাগ থাকে। কোন ঝামেলায় পড়লে, সেই ঝামেলায় তার বিপক্ষ বড় নেতার কেউ হলে, নাকানিচুবানি খেতে হতে পারে। 

গ্রাম্য সমাজে স্বীকৃত সিভিল সোসাইটি বলতে কিছু থাকে না। বিপক্ষে কথা বললে মুরুব্বীরও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। মুরুব্বীর ক্ষমতাবান হতে অর্থবিত্তে শক্তিশালী হতে হয়, এবং কর্তাব্যক্তির সাথে থাকতে হয়। 

বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির বিনাশ হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের হেনস্থা, আক্রমণ, এবং মানুষ দেখেছে ডক্টর ইউনুসের মত সফল এবং বিশ্বব্যক্তিত্বকেও নাজেহাল হতে হয়েছে সরকারের রোষানলে পড়ে। 

মানুষ এখানে জানে, সরকারের রোষানলে পড়লে, কত আইন বের হবে তাকে ধরার জন্য। 

একটা দেশকে মানুষ তার স্থায়ী আবাস করতে গেলে বিচার করে এখানে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ও নিজের নিরাপত্তা কেমন আছে, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা কেমন ও নিজের অর্জিত সম্পদ সে ভোগ করতে পারবে কি না। বর্তমান বাংলাদেশে এই সুযোগ নেই বা কমছে। 

অনেকে সাম্প্রদায়িক ভাবে চিন্তা করেন কেন হিন্দু আমলা বা সরকারী কর্মকর্তারা অবসরের পর ভারতে বাড়ি কিনেন। তারা যদি মোট হিন্দু মুসলমান সরকারী কর্মকর্তার অবসরের পর বিদেশে বাড়ি করার প্রবণতার দিকে নজর দেন, তাহলে হিন্দু কর্মকর্তাদের ভারতে বাড়ি করাকে সাম্প্রদায়িক মনে হবে না। 

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এর সুফল মানুষ সামগ্রিক ভাবে ভোগ করতে পারে নি। রাস্তাঘাট স্কুল কলেজ স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সামগ্রিক জায়গায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছাপ পড়ে নি, যেভাবে পড়ার কথা ছিল। এর কারণ গ্রাম্য সমাজের দিকে যাত্রা এবং  যারা নীতি নির্ধারক, আমলা আছেন, এদের কোন স্কিন নাই সিদ্ধান্তে। তারাও নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিদেশে স্থায়ী করছেন। ফলে, বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য এক সাময়িক আবাসস্থল, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নতি করে বেটার দেশে পরিজন নিয়ে মুভ করতে হয়। 

এইধরণের  সমাজ বাংলাদেশে কীভাবে হলো বা হচ্ছে? 

সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বিস্তারিত হয়েছে পলিটিক্যালি কনস্ট্যান্ট আদারাইজেশনের মাধ্যমে। রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে ভাগ বিভাজন মেরিটোক্রেসির জায়গা বিনাশ করে দিয়েছে। 

আমরা ও তারার ভাগ বিভাজন করতে করতে, এমন তীব্র অবস্থায় নেয়া হচ্ছে যে, কেবল আমরাই থাকব। আমরাই বাংলাদেশ। 

এই আইডোলজির আয়রনি হলো, যারা নিজেদের আমরা মনে করছে, তাদের ভেতরেও আবার আমরা তারার ভাগ বিভাজন হতে থাকবে। এটা একটা বিষাক্ত প্রক্রিয়া, চলতেই থাকবে।