মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » পৃথিবীতে উল্কা আঘাতের সম্ভাব্যতা কি শূন্য?

পৃথিবীতে উল্কা আঘাতের সম্ভাব্যতা কি শূন্য?

নেটফ্লিক্সে কমেডি স্যাটায়ার ফিল্ম ডোন্ট লুক আপে দেখানো হইছে যে একটা ধূমকেতু পৃথিবীতে এসে আঘাত করতেছে, এবং এই বিষয়ে পলিটিশিয়ানরা সিরিয়াস না।

এই ধরণের ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ড পৃথিবীকে আঘাত করার সম্ভাবনা কেমন?

একেবারেই শূন্য নয়।

বাক্যের শ্রুতিগুণের কারণে অনেক কথা সমাজে প্রচলিত হয় এবং একসময় ধ্রুবসত্য বলে গৃহীত হয়। যেমন অর্থই সকল অনর্থের মূল। বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।

দুইটা কথাই ধ্রুব সত্য হবার যোগ্যতা রাখে না, কিন্তু শুনতে শুনতে মানুষ এগুলিরে ধ্রুব হিসেবে মেনে নিয়েছে।

এগুলি বলে কেউ স্বান্তনা পায়, কেউ এগুলিতে আশ্রয় নেয় চারপাশে ঘটতে থাকা জিনিশের দ্রুত ব্যাখ্যার জন্য, যাতে ভালো লাগে এই ভেবে যে, সে বুঝতে পেরেছে কেন এসব হচ্ছে।

পরিবেশ বিপর্জয়ের জন্য সাইন্স দায়ী এমন আহাম্মকী কথা বাদ দিলেও, যদি ধরে নেই কেউ বলছে প্রযুক্তি দায়ী পরিবেশ দূষণের জন্য এবং মানুষের ক্ষতির জন্য, এবং এভাবেই মানুষ দুনিয়া ধ্বংস করবে, যে দুনিয়া আগে ছিল সবুজ শ্যামল, জসীম উদ্দিনের গ্রাম বাংলা, তাহলেও গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা থাকে।

প্রযুক্তির অনেক অপরিকল্পিত ব্যবহার, বিগ মানির মূণাফাকেন্দ্রিক তৎপরতা অনেক দূষণের জন্য দায়ী, ক্ষতির জন্য দায়ী, এগুলি মেনে নিয়েও বলা যায়, ওই অবস্থান “সবুজ শ্যামল দুনিয়া ছিল, ওইটা থাকলেই দূর্বিপাকের আশংকা ছিল না” এটা ভুল। পৃথিবী নামক গ্রহে নানা সময়ে প্রকৃতি উদ্ভট ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। যখন মানুষ ছিল না তখনো। এবং এইরকম ঘটনার সম্ভাব্যতা এখনো “শূন্য” নয়।

যেমন ৬০০০ বছর আগে সাহারা মরুভূমি সবুজ ছিল, আজ মরুভূমি। ঐ সময় কি বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি দিয়ে মানুষ দূষণ করেছিল?

পরিবেষ দূষণ অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট, কিন্তু এটারে একমাত্র ভিলেন হিসেবে দেখা, বিজ্ঞান প্রযুক্তিরে ভিলেন হিসেবে দেখা, তথা মানুষরেই ভিলেন হিসেবে দেখা হচ্ছে অরিজিনাল সিনের ধারণার মত। মানুষ আসছে দুনিয়ায়, পাপ করে আসছে, পাপ করে যাচ্ছে, ফলে পাপের শাস্তি সে পাবে, দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে তাদেরই পাপে।

কিন্তু কথা হল, মানুষ আসার আগেও দুনিয়া ওলট পালট হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।

এই যে কভিড ক্রাইসিস, মানুষ আমলে নেয় নি এরকম হতে পারে এসব কথাবার্তা, যখন অনেক আগে থেকে অনেক বিজ্ঞ মানুষেরা বলে আসছিলেন। এর সম্ভাব্যতা কম ছিল, কিন্তু হয়েছে। একইভাবে ব্ল্যাক ডেথ, স্প্যানিশ ফ্লু এগুলিও হয়েছিল। উল্কাপিণ্ড পৃথিবীকে আঘাত করতে পারে, সুপার ভলকানোর অগ্নুৎপাতে অবস্থা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে, হাই ফ্রিকোয়েন্সি ভূমিকম্পে দুনিয়া পুরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, সোলার ঝড়ে (সূর্য থেকে হাই এনার্জি রেডিয়েশন, কারিংটন ইভেন্ট ১৮৫৯) যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে, এবং হঠাত করে আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে দিন দুনিয়া বদলে যেতে পারে। এইসব শূন্য সম্ভাব্যতার না, এবং ইতিহাসে এদের সবগুলাই নানা সময়ে ঘটেছে। এদের বলে ফ্যাট টেইল ইভেন্টস।

অনুমান করা হয়েছে, ১০০০০ বারে একবার ২ কিলোমিটার সাইজের এক উল্কাপিণ্ড দুনিয়াতে আঘাত করতে পারে, আগামী ১০০ বছরে। ন্যাচার ম্যাগাজিনে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, ১৯৯৪ সালে। এইরকম এক আঘাতে পৃথিবীর প্রচুর মানুষ মারা যাবে। এটা বন্যায় বা প্লেন ক্র্যাশে এই সময়ের মধ্যে যত মানুষ মারা যাবে অনুমান, তার চাইতে বেশি। অর্থাৎ ঘটার সম্ভাব্যতা অনেক কম হলে ঘটলে প্রভাব অনেক বেশি হবে।

ঘটনা আরো ইন্টারেস্টিং হয়, যদি আরও বড় উল্কা আঘাত করে। যেমন ১০ কিলোমিটার সাইজের। এরকম এক উল্কা ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীকে আঘাত করেছিল, আর তখন এতদঞ্চলের ৯৯.৯৯৯৯% জীবিত প্রাণ মারা যায়, এবং ৭৫ প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কার্বন সাইকেল বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতি বছরে এরকম উল্কা আঘাতের সম্ভাব্যতা শূন্য নয়, একশো মিলিয়নে এক। খুব কম কিন্তু ঘটলে এর প্রভাব মারাত্মক। এই ধরণের ঘটনা, সম্ভাব্যতার ভাষায় ফ্যাট টেইল।

আনসার্টেইনটি ও ফ্যাট টেইল রিস্ক সম্পর্কে ধারণা থাকলে আপনি বুঝতে পারেন যে, জসীম উদ্দিনের গ্রাম বাংলায় থাকলেও প্রকৃতির খাম খেয়াল থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না কারো।

এই প্রসঙ্গটা এই কারণে না যে পরিবেশ দূষণ নিয়ে মানুষ সচেতন হবে না। হবে, কারণ “একদিন তো মরেই যাব” এখানে পয়েন্ট না, সম্ভাব্যতার হিসাবে এক্সট্রিম ফলাফলযুক্ত ইভেন্টের সম্ভাব্যতা অনেক কম। প্রসঙ্গটা এই কারণে যে, এই জিনিশের অস্তিত্ব আছে এটা বলা, এবং দুনিয়া বহুবার এমনিতেই ভয়ানক ভাবে মারা খাইছে, কোন দোষ করা ছাড়াই, সেই সত্য তুলে ধরা। এবং বুদ্ধিমানদের একটা চিন্তার টুল সরবরাহ করা, আনসার্টেইনটি ও রিস্ক বিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্রে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং