চুরাশি সিদ্ধের কাহিনী: গুরু সরহপা’র মহাসিদ্ধি লাভের ঘটনা

চুরাশি সিদ্ধের কাহিনী, বাংলার নিজস্ব অবৌদ্ধ দার্শনিক বলে পরিচিত, এই মহাসিদ্ধরা ৭৫০ থেকে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে জীবিত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের কাহিনী একাদশ বা দ্বাদশ শতকে রচিত সংস্কৃত ভাষায়, উত্তর ভারত থেকে, এর সম্ভবত একমাত্র টিকে থাকা ভার্সন মিলে তিব্বতী অনুবাদে, সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন অলকা চট্টোপাধ্যায়। নিচে উল্লিখিত হলো গুরু সরহপার বিবরণ –

আমাদের চুরাশিসিদ্ধের এক মহাসিদ্ধ সরহপা মদ খাইতেন বলে ব্রাহ্মণেরা অখুশি ছিলেন।

তারা রাজার কাছে গিয়া বিচার দিলেন, মহারাজ, আপনি একজন ধর্ম পরায়ণ রাজা। আপনার রাজ্যে পনের হাজার নগরের মুখ্য সরহপা মদ পান করেন। তারে দেশে থাকতে দেয়া কি সঙ্গত হয়?

রাজা সরহপারে ডাকলেন, তারে বললেন, আপনি ব্রাহ্মণ, মদ্যপান করা কি ঠিক হয় আপনার?

সরহপা বললেন, আমি মদ্যপ নই। সবাইরে ডাকেন, আমি প্রমাণ করে দেব।

রাজা সবাইরে ডাকলেন। সমবেত লোকসকলের সামনে সরহপা ফুটন্ত ঘি আনালেন। বললেন, আমি এই ঘিতে হাত দিব, যদি হাত পুড়ে তাহলে আমি মদ্যপ, যদি না পুড়ে তাহলে মদ্যপ নই।

সরহপা হাত দিলেন। হাত পুড়ল না।

ব্রাহ্মণেরা মানতে নারাজ।

এবার সরহপা গরম গলিত তামা আনালেন। বললেন, আমি এগুলি খেয়ে ফেলব, যদি মদ্যপ না হই, আমার কিছু হবে না।

তিনি গলিত তামা খেয়ে ফেললেন। কিছুই হলো না তার।

তাও ব্রাহ্মণেরা বললেন, ইনি মদ্যপ।

সরহপা বললেন, তাহলে আমি জলে প্রবেশ করব। যদি ডুবে যাই তাহলে আমি মদ্যপ, না ডুবি তাহলে মদ্যপ নই।

সরহপা জলে প্রবেশ করলেন। সাথে দুইজন ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণেরা ডুবে গেলেন। সরহ ডুবলেন না।

এতেও ব্রাহ্মণেরা মানলেন না।

অতঃপর সরহ বললেন, আনো তুলাদণ্ড। আমি ভারী হলে মদ্যপ নই।

এক বড় দাঁড়িপাল্লা আনা হলো, একদিকে সরহপা অন্যদিকে তিন মানুষ সমান পাথর রাখা হলো। সরহপা ভারী হলেন।

এই পর্যন্ত দেখে রাজা বললেন, যার এইরূপ ক্ষমতা আছে, তিনি মদ্যপান করলেই বা কী! গুরু, আপনি আমাদের আশীর্বাদ করুন।

সরহপা রাজাকে এবং অন্যান্যদের উপদেশ দিলেন।

এরপর পনের বছরের এক পাচিকা মেয়েকে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন সাধনায়।

জঙ্গলে তিনি সাধনা করতেন আর স্ত্রী খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতেন।

একদিন সরহপা মূলার তরকারি খেতে চাইলেন।

স্ত্রী মহিষের দুধ ও মূলা দিয়ে তরকারি রান্না করে গিয়ে দেখেন সরহপা সাধনায় মগ্ন হয়ে আছেন। খাবার দিতে পারলেন না।

সরহপার ধ্যান ভাঙলো বারো বছর পরে।

ধ্যান ভেঙ্গে তিনি স্ত্রীকে বললেন, আমার মূলার তরকারি কোথায়?

স্ত্রী বললেন, আমি তো রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তুমি সাধনায়। বারো বছর ধ্যানমগ্ন ছিলে। এখন বসন্তকালে মূলা কোথায় পাব?

সরহ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি বললেন, তপস্যার জন্য আমি চললাম পর্বতে।

স্ত্রী বললেন, দেহকে নির্জনে রাখলেই কী নির্জনতা হয়? চিন্তাকে লক্ষণ ও বিকল্প থেকে মুক্ত করলেই প্রকৃত নির্জনতা আসে। তুমি বারো বছর ধ্যান করলে, তাও মূলার চিন্তার মত সামান্য চিন্তাও ত্যাগ করতে পারলে না। তোমার পর্বতে গিয়ে কি লাভ?

এই কথা শুনে সরহ প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারলেন।

তিনি পরম সিদ্ধি লাভ করলেন।