সত্যজিৎ রায়ের আগুন্তুক কী চেয়েছিলেন

আদিবাসী নিয়া আমার চিন্তাটা আসলো সত্যজিৎ রায়ের আগুন্তুক ফিল্ম দেখে। বাঙালী জিনিয়াস সত্যজিৎ এর এই ফিল্মটা আমার ভালো লাগছে, প্রথমেই বলে নেই। তার জন অরণ্যে ফিল্ম দেখছিলাম, ওইটাও ভালো লাগছে। মানে তিনি যেই স্টাইলে ফিল্ম বানান তা আমার পছন্দের। এই জায়গায় আমি আর ভড়ং নিতে পারলাম না, অনলাইন বুদ্ধিজীবী অনেকের মতো, এই বলে যে, সত্যজিৎ এর ফিল্ম ফালতু।

আমার ফিল্ম দেখার হিসাবে, ফিল্মে সত্যজিৎ জিনিয়াস, মাস্টার ফিল্মমেকার। কুরোসাওয়াদের মতো।

এখন মূল কথাবার্তায় আসি। ফিল্মের গল্প এইরকম, এক উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ফ্যামিলি। জামাই বউ আর তাদের পিচ্চি সন্তান। তাদের বাসায় আসেন এক আগুন্তুক। স্ত্রী যিনি তার ছোট মামা মনোমোহন, যিনি অনেক অনেক বছর আগে, ভ্রমণের নেশায় দেশ ছেড়েছিলেন। গল্পের প্রাথমিক সাসপেন্স হল, এই লোক আসল ছোট মামা কি না, বা এর কোন কুমতলব আছে কি না।

ফিল্ম দেখতে দেখতে, যেহেতু আমি ফেলুদা সব পড়েছি আর সত্যজিৎ এর গল্প পড়েছি কমবেশি, আমার মনে হচ্ছিল যে, সম্ভবত এটাই তার শেষ ফিল্ম। দেখার পরে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম, ধারণা ঠিক।

আগুন্তুক চরিত্রটার মাধ্যমে সত্যজিৎ যেন নিজের কথাবার্তা বলেছেন। আধুনিক সমাজ, উন্নতির সভ্যতা বিষয়ে তার সমালোচনা। আধুনিক সমাজ ও সভ্যতা মানুষের জন্য ভালো কি না, এই সন্দেহ ছিল তার সম্ভবত, জীবনের শেষ পর্যায়ে।

আধুনিক সভ্যতার বিপরীতে আগুন্তুক লোকটির পক্ষপাতিত্ব দেখা যায় বন্য সভ্যতার দিকে। আদিবাসী সমাজের দিকে। সেগুলিতেই তিনি ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছেন তার সারাজীবন।

কিন্তু এটাকে আধুনিক সভ্যতার সমস্যার বিপরীতে  সত্যজিৎ এর সল্যুশন ধরলে,  যে আদিবাসী সমাজই ভালো, এটি সমস্যাজনক।

আদিবাসী কনসেপ্টটাতেই সমস্যা আছে। যেমন, তোমরা হইলা আদি তথা প্রিমিটিভ। আর এর বিপরীতে আমরা আধুনিক। এই আদি ও আধুনিকের বাইনারীতে, আদি সব সময়ই নিচে থাকে। এমনকী যখন আধুনিক লিবারেল বলে যে, তোমরা আদিবাসী, তোমরা ভালো, তোমরা পরিবেশের ক্ষতি করো না ইত্যাদি ইত্যাদি, তখনো তারা উপরে থাকে। এমনকী তখনকার উপরে থাকাটা আরো শক্তভাবে। যেহেতু এখানে সে ঐ লোকগুলারে আদিবাসী বলে প্যাট্রোনাইজ করছে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক ইত্যাদি বলে কোন একদল লোকরে, অপেক্ষাকৃত ভালো সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখার কোন যুক্তি নেই। যেমন, নৌকার মাঝিকে আপনি সংস্কৃতি হিসাবে বিবেচনা করলেন ও কিছু লোকরে আজীবন মাঝি করে রাখলেন। পালকীকে সংস্কৃতি জ্ঞান করে কিছু লোকরে পালকীবাহক করে রেখে দিলেন। এটা কিন্তু আপনি তার উপকার করলেন না। বরং আপনার “সাংস্কৃতিক” স্বার্থে তাকে ব্যবহার করলেন।

দেখতে হবে সে কী চায়।

আমি আগুন্তুকের আদি সমাজে ফিরে যাওয়াকে সত্যজিৎ এর দেয়া সল্যুশন হিসেবে দেখব না।  কারণ এমন কোন জায়গায় সত্যজিৎ তার ফিল্মকে নিয়ে যান নি। তিনি আধুনিক সভ্যতার সমালোচনা করেছেন, ও আদি সমাজে চলে যেতে চেয়েছেন, যেমন আগুন্তুক ব্যক্তিটি গেছেন, ওটাকে ব্যক্তিগত হিসেবে ধরব কারণ তিনি জীবনে ঘুরেই বেড়িয়েছেন। কিন্তু ঐ পরিবারকে আদি সমাজে চলে যাবার কথা বলেন নি আগুন্তুক। শেষ কথা হিসেবে তিনি বাচ্চাটাকে বলেছেন, কূপমণ্ডূক না হতে। অর্থাৎ কুয়ায় থাকা ব্যাঙ, যে কুয়ার বাইরের কিছু জানে না, এমন কেউ না হতে বলেছেন।

ফিল্মে একবার এটির ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন বাচ্চাটিকে। একেবারে শেষে এসে একই জিনিস আবার আসে। অর্থাৎ, এটা একটা মূল জায়গা। সত্যজিৎ নতুন প্রজন্মের প্রতি আশা রেখেছেন ও তাদের কূপমণ্ডূক না হতে উপদেশ দিয়ে গেছেন।

অর্থাৎ, অন্ধভাবে কেবল আধুনিক সভ্যতার গুণাগুণ না করে, এর সমালোচনা করতে ও অন্যান্য অপ্রচলিত সমাজগুলিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে তিনি উৎসাহিত করে গেছেন।

এবং আমার মনে হয় ফেলুদার মাধ্যমে সত্যজিৎ যে জিনিসটা বলতে চেয়েছেন, তার একটা সমালোচনা করেছেন আগুন্তুকে। অর্থাৎ এটি একটি আত্মসমালোচনাও।

ফেলুদাতে তোপসে হলো নতুন প্রজন্ম। ফেলুদা লজিক্যাল, আধুনিক সাইন্স এবং সভ্যতার একজন প্রতিনিধি। তার কর্মকাণ্ডে তোপসে এই শিক্ষা পায় যে, ঐ জ্ঞানটাই মূখ্য।

আগুন্তুকের বাচ্চাটিকে আগুন্তুক যে শিক্ষাটা দিয়ে গেলেন, যে না, সাইন্স ও  আধুনিক সভ্যতার কুয়ায় পড়ে থাকলেও চলবে না, কূপমণ্ডূকতা থেকে বাঁচা যাবে না। বরং খোলা থাকতে হবে, দেখতে হবে, জানতে হবে ও উদার মন নিয়ে ভাবতে হবে, কেবল উপযোগিতার বিচার করে নয়।

এবং এই বাচ্চাটির জন্য আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই যে, কূপমণ্ডূক না হওয়ার পরে আরো কিছু কাজ বাকী থাকবে তার। যেমন, আইডেন্টিটি পলিটিক্স করে সে যেন, কোন জাতির লোককে ব্যবহার না করে, এই সততা ও বুঝ যেন তার থাকে।