আমাদের বড় বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা মনে করতেন বাঙালিদের শারীরিক শক্তি দরকার। লেখকদের জন্য তো আরো বেশী। এ সংস্লিষ্ট তার আলাপটি আমরা পাই নাসির আলী মামুনের সাথে কথাবার্তায়। আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার সমগ্র, যা বাঙালী লেখকদের এক অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ, এর মধ্যে আছে সেই সাক্ষাৎকারটি। সেখানে ছফা বলছেন,
মামুনঃ আইচ্ছা ছফা ভাই, আপনে যে বলেন বাঙালি মুসলমান লেখকদের শারীরিক শক্তি দরকার।
ছফাঃ শুধু মুসলমান নয় সমস্ত বাঙালিদের।
মামুনঃ কী কারণে বলেন কথাটা?
ছফাঃ এটার কারণ, লেখাটি হচ্ছে কিনা, লেখাটির খুব সহজ ব্যাখ্যা যেটা হয়, মানুষ যৌনসঙ্গম কতক্ষণ করে? সহজভাবে মানুষ যৌনসঙ্গম কত মিনিট করে?
মামুনঃ এখন চুপ করা ছাড়া উপায় নেই।
ছফাঃ ক’মিনিট করে?
মামুনঃ কয়েক মিনিট।
ছফাঃ কিন্তু লেখাটি হচ্ছে, উৎকৃষ্ট লেখা ননস্টপ যৌনসঙ্গমের মত। অর্থাৎ, দু’ঘন্টা পাঁচ ঘন্টা একভাবে লেখা, এটার জন্য যে শক্তি দরকার সে পরিমাণ খাবার এখানে বাঙালি লেখকরা খেতে পারে না। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান দর্শন অন্য সমস্ত যেগুলো মগজ থেকে তৈরী হয়, সেটার জন্য যে প্রোটিনের সঙ্গে প্রতিভার ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে। রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণ বলে একটা ভ্রমণকাহিনী আছে। সেখানে বলছে- এই যে লোকগুলো আমাদের প্লেনটা চালিয়ে নিচ্ছে, বিরাট বিরাট হাড্ডি, কী প্রাণশক্তি এবং যেইটা তারা এই যে সামনে এগুচ্ছে, আমাদের কাছে, আমাদের ভারতবর্ষের লোকদের কাছে, আমাদের অন্ন নেই। অন্ন নেই, প্রাণও নেই। সুতরাং, এইটা হচ্ছে খুব ভয়ংকর জিনিস। প্রথম জিনিস। কারণ এই পুষ্টির সঙ্গে প্রতিভার একটা যোগ, এটা বৈজ্ঞানিক সত্য।
মামুনঃ আমাদের পুষ্টিস্বল্পতার জন্য কি আমাদের সাহিত্য নিম্নমানের?
ছফাঃ কথাটা পার্টলী ট্রু। এখানে এটা হচ্ছে দুষ্টচক্র। তোমাদের এই খাদ্য খারাপ বলে তোমাদের কল্পনা খারাপ। তোমাদের কল্পনা খর্ব বলেই তোমাদের খাদ্য অল্প। এটা একটা দুষ্টচক্র। এটা যখন বলে আমরা গরিব কেন? আমরা গরিব বলেই আমরা কম খাই। কম ক্রয়ক্ষমতা। কম ক্রয়ক্ষমতা বলে আমরা গরিব। এটা একটা দুষ্টচক্র এবং এটা একটা প্যারাডক্স।
মামুনঃ এটা প্যারাডক্সকে কীভাবে ভাঙতে হবে?
ছফাঃ এটা ভাঙতে গেলে এন্টায়ার ব্যক্তির মধ্যে নয়, এটা এন্টায়ার সামাজিক কাঠামোর মধ্য থেকে এরকম একটা ভাঙচুর তৈরী করতে গেলে এটা ভাঙা যায় না। একজন ব্যক্তি ভাঙতে পারে না। একটা নতুন জেনারেশন দরকার।
আহমদ ছফা যে বাস্তবসম্মত চিন্তা করতেন তার এক নমুনা খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে তার এই সহজ কথাটি। এটি একেবারেই সহজ ব্যাপার যে, একজন ব্যক্তি যেরূপ খাবার খাবেন সেরূপই তিনি তৈরী হবেন। আপনার মধ্যে চিন্তা করার ও লেখার পর্যাপ্ত শক্তি না থাকলে ভেতরে প্রতিভা থাকলেও কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন না।
তবে একথাও ঠিক প্রতিভাহীনকে সুষম খাদ্য দিলে সে সৃষ্টিশীল কাজ করতে শুরু করবে এমন না। কথা হলো, তার ভেতর প্রতিভা থাকলে তার বিকাশের জন্য ঠিক খাদ্য খুব গুরুত্বপূর্ন।
এবং এর সাথে এক্সারসাইজ, বডিওয়েট দিয়ে হোক বা জিমে গিয়ে হোক, ওয়েট ট্রেইনিং তার জন্য দরকারি।
কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ন জিনিসকে গুরুত্ব দিতে আপনি দেখবেন না কাউকে। তারা মনে করেন হয়ত, শারীরিক শক্তি ছাড়া পাঁচ সাত ঘন্টা একজন বই পড়তে পারবে, ও জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ ধরে রাখবে পারবে।
সাহিত্য করাদের ভেতরে গাঞ্জা, মদ, সিগারেট ইত্যাদিকে যেরূপ রোমান্টিসাইজ করা হয়েছে ও হয়, তার অর্ধেকও হয় না শারীরিক শক্তি ও পুষ্টিকে। যেন গাঞ্জা ও স্বস্তা দরের মদই দেবে লেখার ও চিন্তার এনার্জি। চিন্তার দৈন্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন!
আমাদের স্বাভাবিক খাবারের মধ্যে বেশী থাকে কার্বোহাইড্রেট, কম থাকে প্রোটিন। কিন্তু মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো আমাদের খাওয়া প্রোটিনের এমাইনো এসিড দ্বারা তৈরী নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। যেসব হরমোন এবং এনজাইম শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে, রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় তারা প্রোটিন দিয়ে তৈরী।
কার্বোহাইড্রেট খেলে আমাদের ঘুম ঘুম ভাব বা ক্লান্তি আসে। কারণ কার্বোহাইড্রেট মস্তিষ্কে এমাইনো এসিড ট্রাইটোফ্যানের পরিমাণ বাড়ায়। যার ফলে মস্তিষ্কে সেরেটোনিন নিঃসৃত হয়, যা ঝিমানি হরমোন; ঘুমসহ আরো নানা কাজে তা অবশ্য দরকারী।
তবে এর জন্য সব খাদ্যই প্রোটিনযুক্ত হতে হবে এমন না। মোট খাওয়া ক্যালরির ১২ ভাগ প্রোটিন হলেই যথেষ্ট। আর ওয়েট ট্রেনিং বা জিম করলে মাসল রিপেয়ারের জন্য ওয়েটের প্রতি কেজিতে প্রায় ২ গ্রাম প্রোটিন দরকার হয়।
আমাদের ডিফেন্স মেকানিজম ও ডিনায়াল
আমাদের মধ্যবিত্ত মিডিয়া, মধ্যবিত্তের ফেইসবুক একটা জিনিস ডিনাই করতে চায় যে, আমাদের দেশ গরিব, তথা আমরা অর্থনৈতিক ভাবে দরিদ্র।
বাংলাদেশের স্টার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান একবার এক সাক্ষাৎকারে খাদ্যজনিত সমস্যাটি তার মতো করে উপস্থাপন করেছিলেন। এ নিয়ে চারিদিকে ট্রল শুরু হয়ে যায়। বক্তব্যটি ছিলঃ
“সবাই তো সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবে। টি-টোয়েন্টিতে দক্ষতা যেমন দরকার, শক্তিরও দরকার আছে। দুটিই না থাকলে আপনি পারবেন না। টি-টোয়েন্টির জন্য সবচেয়ে বেশি টাকা পায় কারা? গেইল, ডি ভিলিয়ার্স—কী পাওয়ার ওদের খেলায়! জাতিগতভাবেই আমরা শারীরিকভাবে ওদের চেয়ে পিছিয়ে। জন্মের পর থেকে আমরা খাই সবজি খিচুড়ি…নরম করে রান্না করা। এই তো আমাদের খাওয়া, তাই না! আর ওরা ছোটবেলা থেকে অরেঞ্জ জুস খায়। আমাদের হয়তো পাঁচ-দশ ভাগ শিশু এই খাওয়াটা পায়। আমাদের তো ওই সামর্থ্যটা নেই। আর খাওয়াবেন কী, তা-ও তো ভেজাল। আপনি অরেঞ্জ জুস খাওয়াবেন? ফরমালিনে ভরা। বাংলাদেশে নাকি তিনটা ফলে সবচেয়ে বেশি ফরমালিন। কমলা, আপেল আর মাল্টা। যে তিনটা ফল বেশি খাওয়া উচিত, সেগুলোই বাংলাদেশে খাওয়া যায় না।”
সাকিব এক বর্নও মিথ্যা বলেন নি এখানে। সমস্যা হলে অরেঞ্জ জুসের জায়গায় সুষম খাদ্য বা প্রোটিন যুক্ত খাদ্য বসিয়ে পড়ুন। সাকিব বাস্তবতাটাই বলেছিলেন।
কিন্তু তাকে নিয়ে ট্রল শুরু হয়, হাসি তামাশার মাধ্যমে আমাদের গরিবি অবস্থাকে ডিনাই করা হয়, এই ডিনায়াল হচ্ছে কালেক্টিভ সাবকনশাসের ডিফেন্স মেকানিজম। এই ডিনায়ালের মাধ্যমে তার ইগো পরিতৃপ্তি হয়।
বাস্তবটা আমাদের মেনে নেয়াটা দরকারী। খেলার জন্য বলেন, লেখার জন্য বা সেক্স করার জন্য বলেন, শারীরিক শক্তি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন এক জিনিস, এবং এটি বহুলাংশে নির্ভর করে আপনি কী খাচ্ছেন তার উপর, এবং দিনে এক্সারসাইজ করছেন কি না ঘুমিয়ে শুয়ে বসে কাটাচ্ছেন, তার উপর।
আহমদ ছফা বলেছিলেন সমস্যার সমাধানের জন্য এক নতুন জেনারেশন দরকার। আমার মনে হয় এই জেনারেশন এখনকার জেনারেশন। এখনকার নতুন লেখক যারা, তারা। এখনকার সময়ে এক বড় পরিবর্তন হয়েছে। ইন্টারনেট প্রযুক্তির কারণে বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ার সাথে আমরা সরাসরি কানেক্টেড হতে পারছি। ইনফরমেশন এবং গুরুত্বপূর্ন চিন্তা জানতে পারছি, চিন্তকদের কাছ থেকে নিতে পারছি। মাল্টি ডাইমেনশনাল নলেজ এপ্রোচের দিকে যেতে পারছি। সুতরাং, এখনই আমাদের সময় লাইফস্টাইল থেকেই পরিবর্তন শুরু করা, আগের জরাজীর্ণতার স্টাইল পরিহার করে, নতুন ভাবে, আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রতে নতুন দিনের জন্য।
রেফারেন্সঃ
আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার সমগ্র, খান ব্রাদার্স, সম্পাদনা নূরুল আনোয়ার।
ব্রেইন পাওয়ারঃ হোয়াই প্রোটিন আর স্মার্টঃ সাইকোলজি টুডে
প্রত্যাশার সীমাটা বুঝা উচিত, সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো।