মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » বাংলাদেশে গণ আন্দোলন কি হবে?

বাংলাদেশে গণ আন্দোলন কি হবে?

গণ আন্দোলন বলতে এখানে কী বুঝাইতেছি আগে বলি।

যখন সাধারণ মানুষেরা স্বতস্ফূর্তভাবে মাঠে নামবে সরকার পরিবর্তনের জন্য, একযোগে আন্দোলন করে যাবে এবং সরকারের পতন ঘটাবে। এটারে গণ অভ্যুত্থানও বলা যাইতে পারে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং এর সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটাই চান।

অন্যদিকে সরকার তথা আওয়ামীলীগ এটা ঠেকাইতে চান ছলে, বলে, কৌশলে।

যতই বলেন আমেরিকার বা বহির্বিশ্বের চাপ, সেই তারা তো জোর করে এসে ক্ষমতা বদলাইয়া দিয়া যাবে না। তারা যেটা করতে পারে, চাপ দিয়া একটা পরিবেশ তৈরি যেখানে গণ আন্দোলন করতে পারে জনগণ। মানুষ মাঠে নামতে পারে, মিটিং মিছিল করতে পারে।

অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক সরকার পরিবর্তনের জন্য মূল পয়েন্ট ঐ গণ আন্দোলনেই।

একটা গণ আন্দোলন কীভাবে তৈরি হয়?

প্রথমে কিছু লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ছাত্রছাত্রী এনারা সিস্টেমের দোষ বের করেন, এগুলা নিয়া লেখালেখি করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব লোকদের নিজেদের ভেতরে একটা অসন্তুষ থাকে যে, সিস্টেম থেকে অন্যায্য ভাবে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, তাদের দাম দেয়া হচ্ছে না, তারা প্রতিভার দাম পাচ্ছেন না। তাই ক্রিয়েটিভলি সিস্টেমের নানা দোষ ত্রুটি অন্যান্য সাধারণ মানুষের সাথে হচ্ছে তারা দেখান, তারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

তারা অনবরত ক্ষমতা কাঠামোরে প্রশ্ন করেন, সমালোচনা করেন।

এরা প্রাথমিক জনমত তৈরি করেন।

এইজন্য দেখবেন, যারা সিস্টেমের সমালোচনা করে ক্ষমতায় থাকা লোকেরা তাদের দেখতে পারে না, জেলে দেয় বা ইভেন মেরেও ফেলে। আপনি হয়ত ভাবতেছেন, একটা সাধারণ লেখায় কী আর হয়, তারে মেরে ফেলতেছে কেন।

কিন্তু পাওয়ার সিস্টেম বুঝে এরাই তৈরি করে তাদের ধ্বংসের ভীত। এদের থামাতে পারলে ধ্বংস থামানো সম্ভব।

বাংলাদেশে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ মেজর দুইটা রাজনৈতিক দল আছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু বাংলাদেশের ডিফাইনিং ঘটনা, তাই আওয়ামীলীগের পক্ষে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক ম্যাটেরিয়ালস আছে। তারা সেইগুলার উপর ভিত্তি করে ন্যারেটিভ তৈরি করে ও সমর্থন পায়। যেমন একাত্তরের চেতনা, ইত্যাদি।

বর্তমান বিএনপির যারা ইয়াং ইন্টেলেকচুয়াল আছেন, তাদের অনেকে আওয়ামীলীগের এই কোর জিনিশটারে প্রশ্ন করতেছেন ও ডিনাই করতেছেন। এইরকম ডিনাই আগে কিছু বামেরা এবং জামায়াতও করছে, কিন্তু জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী থাকায় তাদের ওই ডেনায়াল গুরুত্ব পায় নাই। কিন্তু বিএনপিরটা লং টার্মে পাবে, যদি তারা মুক্তিযুদ্ধরে ডিনাই না করে রিডিফাইন করতে পারে। এটা বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের মূল কাজের একটা। বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় তাদের ভেতরকার এক সমস্যা হইল কতটুকু ডিনাই করবে আর কী রিডিফাইন করবে তা বুঝতে না পারা। এটা বড় সমস্যা কারণ রাজনৈতিক দলের মত বুদ্ধিজীবীদের সংহতি নাই তারা বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করেন।

তারা যে ভিন্ন ন্যারেটিভ দিবেন, এখান থেকে তাদের অনেক অনুসারী তৈরি হবে, যারা এই ন্যারেটিভে বিশ্বাস করবে।

এর সাথে সরকারের করাপশন, গণতন্ত্র-ভোটাধিকার নাই করে দিছে, ন্যায়বিচার নাই ইত্যাদি, এবং নানা ইস্যুকেন্দ্রিক সমালোচনা তো আছেই। এই সাম্প্রতিক বিষয়গুলা প্রতিনিয়ত জারী রাখা দরকার কারণ তাতে মানুষেরা রিলেট করতে পারবে নিজের জীবনের সাথে।

এখান থেকেই সক্রিয় গণ আন্দোলনের কিছু আগে ফ্যানাটিকেরা লিডারশীপে চলে যাবে, বা দলের নেতৃত্বে থাকা ফ্যানাটিকেরা সামনে আসবে। তারা আন্দোলনরে ভিজিবল একটা রূপ দিবে, মাঠে নামবে, হিংস্রতাও হইতে পারে এবং এরপরে সেখান থেকে প্র্যাক্টিক্যাল লিডারেরা দায়িত্ব নিয়ে গণ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ করবে।

এর যেকোন এক জায়গায় ল্যাকিংস থাকলে গণ আন্দোলন হবে না।

খালি বুদ্ধিজীবী দিয়া গণ আন্দোলন হয় না, খালি ফ্যানাটিক, খালি দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন লিডার দিয়াও হয় না।

এই তিনটার সংমিশ্রণ লাগে।

গণ আন্দোলনে কোন সুখী মানুষ অংশ নেয় না। যারা সিস্টেম নিয়ে অসন্তুষ্ঠ, যারা মনে করে তাদের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই সিস্টেমের জন্য, তারা সফল হতে পারছে না, অর্থনৈতিক সামাজিক নিরাপত্তা পাচ্ছে না এই সিস্টেম থেকে, এইখানে সব নষ্ট হয়ে গেছে, – তারাই সিস্টেম চেইঞ্জ করার আন্দোলনে নামবে।

খেয়াল করবেন, সরকার বিরোধীরা সব সময় বিরোধী দলের সমর্থন দিয়া পোস্ট করেন না, কিন্তু এমন সব বিষয়ে পোস্ট করেন যেগুলি নেগেটিভ অর্থাৎ বিদ্যমান সিস্টেম বিষয়ে অসন্তুষ তৈরি করে। তাদের টার্গেট অডিয়েন্স এইসব অসন্তুষ্ঠ নাগরিকেরা। এইসব নাগরিকেরা তাদের জীবনের সাথে মেলাতে পারবেন এবং আরো অসন্তুষ্ট হবেন।

অন্যদিকে সরকার পক্ষের লোকজন সরকারকে সব সময় প্রত্যক্ষ প্রশংসা করেন এমন নয়, তারা পোস্ট করেন পজেটিভ বিষয়। যাতে মানুষ সিস্টেম নিয়ে তুষ্ট হয়, আশাবাদী হয়। চীনে সরকার টাকা দিয়ে মানুষ রাখে পজিটিভ নিউজ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করার জন্য।

দুই পক্ষের লড়াই এখানে, পাবলিকরে অসন্তুষ্ট করা, হতাশ করা এবং পাবলিকরে আশাবাদী করার মধ্যে। যে পক্ষ কার্যকর ভাবে করতে পারবে, তাদের পক্ষে লোকজন বেশি থাকবে।

সরকার বিরোধী বা সিস্টেম বিরোধী হতাশ, অসন্তুষ্ট মানুষেরা হচ্ছে গণ আন্দোলনের ভিত্তি। এরা থাকলেই নেতাদের পক্ষে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়।

গণ আন্দোলনে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী ধারনার মিশ্রণ থাকে সাধারণত। বর্তমান সরকার বিরোধীদের ক্ষেত্রে এই তিনটাই আছে।

রাজনৈতিক অসন্তোষ – ভোটাধিকার, গণতন্ত্র নাই, বিচার ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে, চাকরিসহ নানা ক্ষেত্রে ন্যায় নাই, ম্যাসিভ করাপশন ব্যাংকিং সেক্টরে ইত্যাদি।

ধর্মীয় – এই সরকার ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার আছে।

জাতীয়তাবাদী – এই সরকার ভারতঘেষা, ভারতরে অধিক সুবিধা দিয়ে দিচ্ছে, ভারত আমাদের পদানত করে রাখছে, ইত্যাদি।

দেখবেন প্রায়ই এক ধরনের স্ট্যাটাস দেখা যায়, যে আমরা আওয়ামীলীগ করতাম কিন্তু এখন এই অবস্থা দেখে এই সরকারের বিরোধিতা করছি।

যারা আগে ভালো অবস্থানে ছিল কিন্তু এখন কোন কারণে অর্থনৈতিক বা সামাজিক স্ট্যাটাসে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এরা এই দলের।

এখন দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে, ইনফ্ল্যাশন বেড়ে গেছে, এইদিকে রিজার্ভও কমে গেছে। ফলে অনেক মধ্যবিত্ত আছেন যারা আগে স্বচ্ছল ছিলেন কিন্তু এখন চাহিদা মেটাতে পারতেছেন না। এরা এখন এই সরকারের বিরোধিতা করে গণ আন্দোলনে শরীক হবার মত অবস্থায় আছেন।

ভিত্তি থাকলেই হবে না, এরে কাজে লাগাইতে হবে।

এর জন্য দরকার হয় পারসুয়েশনের। পারসুয়েড করতে হয় ঐ সিস্টেম নিয়া হতাশ লোকদেরই, কারণ তারা শোনার জন্য বসে আছে।

গণ আন্দোলন হবে না যদি সবাই তাদের আইডেন্টিটি বিসর্জন দিয়া একক আইডেন্টিটিতে বিশ্বাস করতে না পারে।

গণ আন্দোলনে একজন ব্যক্তি প্রথমত নিজের আইডেন্টিটিরে স্যাক্রিফাইস করে, এবং সবে মিলে এক বৃহত্তর গোল পূরণে শরিক হয়। যেহেতু গণ আন্দোলনে ভবিষ্যতের আশার চাইতে বর্তমানরে ঘৃণাই মূল দরকারী বস্তু, তাই গণ আন্দোলনে একজন ভিলেন বা শয়তান অপরিহার্য। মানুষের সকল ঘৃণা যাতে এর উপর ন্যস্ত হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ ছিলেন এই ভিলেন।

এখন সরকার বিরোধীরা শেখ হাসিনাকে বা শেখ ফ্যামিলিরে ডেভিল হিশেবে দেখাইতে চান।

তাদের এইটা প্রভাইড করতে হয় পাবলিকের জন্য।

গণ আন্দোলনে এমন ফ্যানাটিক সমর্থকও দরকার, যারা প্রায় জীবন দিয়া দিবে। এই কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লিডারেরা ফ্যানাটিকদের উৎসাহিত করেন। এরা সাধারণত হয়ে থাকে ইনসিকিওর, এবং অবুঝ, যারা ভায়োলেন্স, এমনকি নিজের জীবনও দিয়ে দেয়, এর মাধ্যমে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। অনেক কবিরা পর্যন্ত এদের উৎসাহিত করতে স্লোগান লিখেন, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। খেয়াল করবেন, স্বদেশী আন্দোলনের ফ্যানাটিক ক্ষুদিরাম ছিলেন মায়ের মমতা ছাড়া বড় হওয়া এক কিশোর বালক। তারে এই ভায়োলেন্স আকৃষ্ট করছিল কারণ এর মাধ্যমেই তিনি মিনিং পাইছিলেন।

সাধারণত গণ আন্দোলন বলতে আমরা বুঝি যখন পাবলিক মাঠে নামে, প্রায়ই ভায়োলেন্স করে, ঐ অবস্থারে। কিন্তু ওইটা গণ আন্দোলনের সক্রিয় অংশ, এর আগে লম্বা সময় ধরে গণ আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি হবার কাজ চলতে পারে।

বর্তমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে ইয়াং বুদ্ধিজীবীরা ইন্টারনেট-প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের সমালোচনায়, এবং মানুষরে ন্যারেটিভ দিতে, তাদের অসন্তোষরে আরও বাড়াতে ভালো ভূমিকা পালন করেছেন। মূল ধারার, অর্থাৎ টিভি বা পত্রিকায় লেখা বুদ্ধিজীবীরা এইভাবে পারেন নাই। এর এক কারণ সরকার মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে, এক লক্ষ্যে একত্রিত হয়ে একক হিশেবে মানুষেরা দাঁড়াইতে পারে এমন পারসুয়েশন তারা করতে পারছেন কি না?

এখন দ্বিতীয় ফ্যানাটিক ফেইজ, এবং তৃতীয় দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন লিডারদের দায়িত্ব নেয়ার ফেইজ বাকি।

ফ্যানাটিক বা সক্রিয় ফেইজে ফ্যানাটিক সমর্থকদের জীবন বাজি রেখে কিছু কাজ করতে হবে। এইরকম স্বার্থ ত্যাগ করার মত সমর্থক কত আছে, এর উপর নির্ভর করবে আন্দোলনের গতি। না থাকলে গণ আন্দোলন হবে না।

সরকার বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা এই ফ্যানাটিক সমর্থকদের এখন সাহস দিবেন, যে সরকার পড়ে যাচ্ছে, সরকার দূর্বল। অলরেডি আসলে পড়েই গেছে, এখন দড়ি ধরে টান দিলেই খানখান।

তথ্যপ্রযুক্তির কারণে যেমন এই পারসুয়েশন করা সহজ, তেমনি মানুষদের কাছে তথ্যের সহজলভ্যতার কারণে তারা সহজে জেনে ফেলতে পারছে, যে বুদ্ধিজীবী বা নেতা তাদের মাঠে নেমে জীবনের ঝুঁকি নিতে বলছেন, তিনি কীভাবে বাস করছেন, এবং তার ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করছে কি না। এখানে একটা মরাল সমস্যার তৈরি হয় যা আবার গণ আন্দোলন তৈরি হবার বিরুদ্ধে কাজ করে।

আর অন্যদিকে, সরকারের পক্ষের লোকজন বলবে সরকার এখনো শক্ত, আমেরিকা-ভারত পক্ষে আছে, এখানে ভায়োলেন্স করে পার পাওয়া যাবে না। এটা ফ্যানাটিকদের ভয় দেখাতে, যাতে তারা একটিভ হইতে ভয় পায়। এর সেরা এক উদাহরণ সাম্প্রতিক কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে বললেন, যারা আগুনে বাস পুড়ায় তাদের ধরে আগুনে পুড়াতে।

আমেরিকান সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট এরিক হফার দ্য ট্রু বিলিভার নামে এক বই লেখেন ১৯৫১ সালে। ঐখানে তিনি ম্যাস মুভমেন্ট কীভাবে হয় তার বিশ্লেষণ করেছিলেন। তার ঐ এনালাইসিসটা ধরেই আমার এই বর্তমান সময় বিশ্লেষণ।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং