মুরাদুল ইসলাম » গল্প » স্টিফেন কিং এর গল্প ‘দ্য বুগিম্যান’

স্টিফেন কিং এর গল্প ‘দ্য বুগিম্যান’

দ্য বুগিম্যান

স্টিফেন কিং এর গল্প, অনুবাদ- মুরাদুল ইসলাম

 

“আমি আপনার কাছে এসেছি কারণ আমি আমার গল্প বলতে চাই” ডক্টর হার্পারের খাটে শুয়ে থাকা লোকটি বলছিল। তার নাম লেস্টার বিলিংস, জন্ম ওয়াটারবুরি, কানেকটিকটে। নার্স ভিকারস যে বিত্তান্ত নিয়েছেন সে অনুযায়ী লোকটির বয়স আটাশ বছর, নিউ ইয়র্কের একটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফার্মে কাজ করে, এবং সে তিন সন্তানের পিতা। সবাই মারা গেছে।

“আমি চার্চের ফাদারের কাছে যেতে পারব না, কারণ আমি ক্যাথলিক নই। আমি উকিলের কাছেও যেতে পারব না কারণ এমন কিছু করি নি যে উকিলের পরামর্শ নিতে হবে। যা আমি করেছি তা হলো আমার সন্তানদের হত্যা করেছি। একটা একটা করে। সবাইকে।”

ডক্টর হার্পার টেপ রেকর্ডারটা চালু করলেন।

বিলিংস শুয়ে রইল একেবারে ঠায় সোজা, একটু নড়াচড়া নেই। তার পাগুলি একটু বেরিয়ে আছে। একজন মানুষ প্রয়োজনীয় অপমানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে এমন এক ছবি যেন। তার হাত দুটি বুকের উপরে, যেমন মৃতদেহের থাকে। তার মুখ খুব সতর্ক, শাদা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ছিল সে। যেন ওখানে সে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে।

“আপনি কি সত্যি ওদের হত্যা করেছেন, নাকী-”

অস্থির হাত নেড়ে বিলিংস জানাল, “না। কিন্তু আমি এর জন্য দায়ী। ড্যানি ১৯৬৭ সালে, শার্ল ১৯৭১ সালে, এবং এই বছরে এন্ডি। আমি আপনাকে এই নিয়ে সব বলতে চাই।”

ডক্টর হার্পার কিছুই বললেন না। বিলিংসকে বৃদ্ধ ও জীর্ন দেখাচ্ছে। তার চুল পাতলা এবং চেহারা বিবর্ন। চোখদুটি জানান দিচ্ছে হুইস্কির সব খারাপ প্রভাব পড়েছে তার উপর।

“তারা খুন হয়েছে, বুঝতে পারছেন? কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করে না। যদি তারা করত তাহলে সব ঠিক হয়ে যেত।”

“কেন?”

‘কারন

বিলিংস থেমে গেল এবং সহসা কনুইয়ে ভর দিয়ে কক্ষটির দিকে তাকাতে লাগল। “ওটা কী?” সে প্রায় চিৎকার করে উঠল। তার চোখ দুই অতি সরু হয়ে উঠেছে তখন।

“কোনটা কী?”

“ওই দরজা।”

“ওটা আলমারি, বললেন ডক্টর হার্পার। “যেখানে আমি আমার কোট ঝুলিয়ে রাখি, এবং বাইরে যাবার জুতাগুলি রাখি।”

“ওটা খুলুন। আমি দেখতে চাই।”

“ডক্টর হার্পার কিছু না বলে উঠে পড়লেন, এগিয়ে গিয়ে আলমাড়ির দরজা খুললেন। ভিতরে একটি রেইনকোট চার অথবা পাঁচটি হ্যাংগারের একটিতে ঝুলে আছে। এর নিচে এক জোড়া চকচকে ওভারশু। এর একটির ভেতরে নিউ ইয়র্ক টাইমস বেশ সতর্কভাবে গুঁজে রাখা আছে। এই ছিল আলমাড়ির ভিতর দৃশ্য।

ডক্টর হার্পার বললেন, “ঠিক আছে তো?”

বিলিংস বলল, “ঠিক আছে।” সে কনুইয়ের ভর ছেড়ে তার আগের অবস্থায় ফিরে গেল।

ডক্টর হার্পার তার চেয়ারে যেতে যেতে বললেন, “আপনি বলছিলেন যে তোমার তিন সন্তান যে খুন হয়েছে তা প্রমাণ হলে সব সমস্যা মিটে যায়। এটা কেন?”

বিলিংস সাথে সাথেই বলল, “আমি জেলে যাব। সম্ভবত যাবজ্জীবন হবে। এবং আপনি জেলে সব কক্ষই দেখতে পারেন। সব কক্ষ।” সে কারণ ছাড়াই হাসল।

“কীভাবে আপনার সন্তানেরা খুন হলো?”

“আমার ভেতর থেকে সব কিছু দ্রুত চিপে বের করার চেষ্টা করবেন না!”

বিলিংস হঠাৎ করেই হার্পারের দিকে ঘুরল এবং তার দিকে তাকাল বেশ রুষ্টভাবে।

“আমি আপনাকে সব বলব, চিন্তা করবেন না। আমি আপনার সেই বদ্ধ উন্মাদ রোগীগুলির মত নই যারা নিজেদের নেপোলিয়ন ভাবে বা এইরকম ব্যাখ্যা দেয় যে আমি হিরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ি কারণ আমার মা আমাকে ভালোবাসতেন না। আমি জানি আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার জন্য শুধুমাত্র বলাই যথেষ্ট।”

ডক্টর হার্পার পাইপ মুখ থেকে সরিয়ে বললেন, “ঠিক আছে।”

“আমি রিটাকে বিয়ে করি ১৯৬৫ সাল আমি ছিলাম একুশ আর ও আঠার। সে অন্তঃসত্তা হয়ে পড়েছিল। ওটা ছিল ড্যানি। সে ঠোট বিকৃত করল আর একটি হালকাহাসি মুহুর্তেই মিলিয়ে গেল।

“আমাকে কলেজ ছাড়তে হলো এবং একটা চাকরী জোগাড় করতে হলো কিন্তু তাতে আমি কিছু মনে করি নি। আমি ওদের দুজনকে ভালোবাসতাম। আমরা খুব সুখেই ছিলাম।”

“ড্যানির জন্মের কিছুদিন পরে রিটা আমার অন্তঃসত্তা হয়ে পড়ে। এবং শার্লের জন্ম হয় ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে, ততদিনে ড্যানি মরে গেছে। এন্ডি ছিল এক দূর্ঘটনা। রিটা তাই বলত। সে বলত মাঝে মাঝে জন্ম নিয়ন্ত্রনের ওষুধগুলি কাজ করে না। কিন্তু আমি মনে করি ওটা দূর্ঘটনা ছিল না। বাচ্চারা পুরুষদের বেঁধে রাখে আপনি জানেন। তাই মহিলারা এটা করে থাকে, বিশেষত পুরুষটি তার চাইতে বেশী বুদ্ধিমান হয়। আপনার কি এটা সত্য মনে হয় না?”

ডক্টর হার্পার সম্মতি বা অসম্মতি কিছুই না জানিয়ে একটা শব্দ করলেন।

“তবে এতে কিছুই যায় আসে না। আমি এন্ডিকে ভালোবাসতাম।”  সে প্রতিশোধপরায়ণ একটা ভাব নিয়ে কথাটা বলল, যেন সে তার বাচ্চাদের ভালোবাসত স্ত্রীর প্রতি ঘৃনা থেকে।

“কে সন্তানদের খুন করেছে?” হার্পার জিজ্ঞেস করলেন।

“বুগিম্যান।” সাথে সাথেই উত্তর দিল লেস্টার বিলিংস। “বুগিম্যান তাদের সবাইকে খুন করেছে। আলমাড়ি থেকে বের হয়ে এসে সবাইকে খুন করেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল এবং একটি বিকৃতহাসি দিয়ে বলল, “আপনি আমাকে পাগল ভাবছেন, তাই তো। আপনার মুখ দেখে তা বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমার কিছুই যায় আসে না তাতে। আমি আপনাকে বলব এবং এখান থেকে চলে যাব।”

হার্পার বললেন, “আমি শুনছি।”

“এটা শুরু হয়েছিল যখন ড্যানির বয়স প্রায় দুই বছর এবং শার্ল তখন একেবারে শিশু। সে কাঁদতে শুরু করল যখন রিটা তাকে বিছানায় নিল ঘুম পাড়াতে। আমাদের ছিল দুই বেডরুমের বাসা। শার্ল আমাদের কক্ষে একটি দোলনায় ঘুমাত। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম সে কাঁদছে কারণ সে এখন আর বিছানায় বোতল নিয়ে যেতে পারে না। রিটা বলল এটাকে ইস্যু বানিও না, ছেড়ে দাও, তাকে বোতলটা নিতে দাও, একসময় নিজেই ওটা আর নিবে না। কিন্তু এভাবেই বাচ্চারা খারাপ হতে শুরু করে। আপনি ওদের সবকিছুতে সম্মতি দিতে থাকেন আর ওরা নষ্ট হতে থাকে। তারপর একসময় আপনার হৃদয় ভাঙ্গে। কোন মেয়েকে অন্তঃসত্তা বানিয়ে ফেলে, অথবা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অথবা সিসি হয়ে যায়। আপনি ভাবতে পারেন একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন আপনার বাচ্চাটি- আপনার পুত্রটি- সিসি হয়ে গেছে?”

“কিছুক্ষণ, যখনও সে কান্না থামাল না, আমি তাকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে যেতাম বিছানায়। তখনো কান্না থামালে কয়েকটা থাপ্পর দিতাম। তখন আমাকে রিটা বলল, সে বার বার “আলো” বলছিল। কিন্তু আমি তা জানতাম না। এত ছোট বাচ্চা, কীভাবে বুঝব সে কী বলছে। কেবল মা তা বুঝতে পারে।”

রিটা একটি রাত-বাতি লাগাতে চেয়েছিল। প্লাগের মধ্যে লাগানো যায় মিকিমাউস বা হাকলবেরী হাউন্ড বা এরকম কিছু যুক্ত বাতিগুলির একটি। কিন্তু আমি তাকে লাগাতে দেই নি। যদি শিশুরা বাচ্চাকালে অন্ধকারের ভয় কাটিয়ে উঠতে না পারে তাহলে সে ভয় আর কোনদিন কাটে না।

“যাইহোক, সে গ্রীষ্মে মারা গেল শার্লের জন্মের পরে। সেদিন রাতে আমি ওকে বিছানায় নিয়ে গিয়েছিলাম এবং বিছানায় গিয়েই ও কাঁদতে শুরু করল। আমি তখন শুনলাম ও কী বলছে। সে ঠিক আলমাড়িটার দিকে হাত দিয়ে ইশাড়া করল যখন সে কথাটা বলছিল।

সে বলল, “বুগিম্যান, বুগিম্যান, ড্যাডি।”

আমি লাইট নিভিয়ে ফেললাম এবং আমাদের কক্ষে গিয়ে রিটাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে এরকম একটি শব্দ বাচ্চাদের শেখাতে চায়। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল ওকে কয়েকটি চড় মারতে কিন্তু মারলাম না। ও জানাল এমন শব্দ শেখায় নি। আমি ওকে বললাম মিথ্যাবাদী।

“ওই গ্রীষ্মটা আমার জন্য খারাপ ছিল বুঝতেই পারছেন। আমার একমাত্র চাকরিটা ছিল একটি গুদামে পেপসি-কোলা ভরে রাখা, তাই সব সময় ক্লান্ত থাকতাম। প্রতিরাতে শার্ল জেগে উঠে কাঁদত এবং রিটা ঘুম থেকে উঠত আর নাক টানত। আমি আপনাকে বলছি, মাঝে মাঝে আমার মনে হত তাদের দুজনকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেই। বাচ্চার কখনো কখনো আপনাকে পাগল করে তুলবে। তাদের তখন খুন করতে পারবেন।”

যাইহোক, শার্লের কান্নায় তিনটার সময় আমার ঘুম ভাঙল। আমি অর্ধ জাগ্রত অবস্থায় বাথরুমে গেলাম। রিটা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি ড্যানির রুম দেখে এসেছি কি না। আমি তাকে বললাম নিজে গিয়ে দেখে আসতে এবং বিছানায় গেলাম। আমি প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তখন রিটার চিৎকার শুনতে পাই।

আমি উঠে যাই ঐ কক্ষে। শিশুটি মরে পড়ে আছে। শাদা একেবারে ময়দার মত। খালি কেবল কিছু কিছু জায়গায় রক্তের দাগ। পায়ের পিছনে, মাথায়, নিতম্বে। তার চোখ ছিল খোলা। এটাই সবচেয়ে মারাত্মক। খোলা চোখ, যেন কাচনির্মিত নিথর। অশ্বেতাঙ্গ ওই ভিয়েতনামি বাচ্চাগুলির ছবির মত, যা আপনারা দেখে থাকেন। কিন্তু একজন আমেরিকান বাচ্চার এভাবে তাকানো উচিত না। মরে পড়ে আছে। ডায়াপার এবং রাবারের প্যান্ট পরিহিত অবস্থায়, কারণ কয়েক সপ্তাহ ধরে সে আবার বিছানা ভেজাচ্ছিল। ভয়ংকর, আমি বাচ্চাটিকে ভালোবাসতাম।”

বিলিংস তার মাথা হালকা ভাবে নাড়িয়ে আবার একটি ভয়ার্ত হাসি দিয়ে বলতে লাগল। “রিটা খুব জোরে চিৎকার করছিল।

সে চাইছিল ড্যানিকে তুলে ধরতে কিন্তু আমি তা করতে দিলাম না। পুলিশ কোন প্রমানে আপনি হাত দেন তা চায় না। আমি তা জানতাম-”

হার্পার আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে আপনি তখন জানতেন ওটা বুগিম্যানের কাজ ছিল?”

“না, তখন জানতাম না। কিন্তু আমি একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম। তখন ওটা আমার তেমন কিছুই মনে হয় কিন্তু আমার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা রয়ে গিয়েছিল।”

“সেটা কী?”

“আলমাড়ির দরজাটা খোলা ছিল। খুব বেশী না। কিন্তু আমি জানতাম আমি দরজা বন্ধ করে গিয়েছিলাম। ড্রাই কিলিং ব্যাগ ছিল সেখানে। যদি কোন বাচ্চা এগুলি নিয়ে খেলা করতে যায় তাহলে শ্বাসরোধ হতে পারে তার। আপনি জানেন তো?”

“হ্যা, এরপর কী হলো?”

বিলিংস নিজেকে ধিক্কার দিল। “আমরা তাকে কবরস্থ করলাম।” বিষাদগ্রস্থ ভাবে সে তার হাতের দিকে তাকাল, যে হাতদ্বয় ছোট তিনটি কফিনে মাটি দিয়েছে।

“কোন আইনগত অনুসন্ধান হয়েছিল কি?”

“অবশ্যই” অবজ্ঞাপূর্ন বিদ্রুপ জ্বলে উঠল বিলিংসের চোখে।

স্টেথোস্কোপওয়ালা এক গেয়ো গর্দভ এসেছিল এবং বললো, বাচ্চাদের সাধারণ ব্যাখ্যাতীত মৃত্যু বা ক্রিব ডেথ। আপনি এরকম বাজে কথা আর শুনেছেন? বাচ্চাটির বয়স ছিল তিন বছর!”

হার্পার সতর্কভাবে বললেন, “ক্রিব ডেথ প্রথম বছরেই হয় সাধারনত। কিন্তু পাঁচ বছরের পর্যন্ত শিশুদের মৃত্যুর সার্টিফিকেট বিবেচনা করে ভালো ব্যখ্যার…”

বুলশিট! বিলিংস হিংস্রভাবে বাঁধা দিয়ে উঠল।

হার্পার তার পাইপে পুনরায় আগুন দিলেন।

“আমরা শার্লকে ড্যানির রুমে নিয়ে গেলাম ড্যানির শেষকৃত্যের একমাস পরে। রিটা সর্বাত্মক ভাবে যুদ্ধ করল বাঁধা দিতে, কিন্তু আমার কথাই ছিল শেষ কথা। ড্যানির মৃত্যু অবশ্যই আমাকে আহত করছিল, অবশ্যই। আমি চাইতাম শার্ল আমাদের সাথেই থাকুক। কিন্তু আপনি  বাচ্চাদের অতি আগলে রাখতে পারেন না। অতি আগলে রাখলে হলে শিশুরা অথর্ব হয়ে গড়ে উঠে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা আমাকে সমুদ্র সৈকতে নিয়ে যেতেন আর কর্কশ সুরে চিৎকার করতেন। “এত দূরে যেও না। ওখানে যেও না! এখন স্রোত বেশী! তুমি মাত্র এক ঘন্টা আগে খেয়েছ! তোমার সীমার বাইরে যেও না!” এতে কী হলো? আমি এখন পানির কাছেও যেতে পারি না। এটাই সত্য। সৈকতের কাছে গেলে আমার খিঁচুনি ধরে। রিটা একবার আমাকে আর বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিল স্যাভিন রকে, যখন ড্যানি জীবিত ছিল। আমি কুকুরের মত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমি জানি, বুঝতে পারছেন? আপনার কখনোই বাচ্চাদের অতি আগলে রাখা ঠিক না। নিজের ক্ষেত্রেও এমন হলে চলবে না। জীবন বয়ে যায়। শার্লের স্থান হলো ড্যানির বিছানায়। যদিও পুরনো বিছানার চাদর আমরা ফেলে দিয়েছিলাম। কারণ আমি চাই নি আমার মেয়েকে ওই জীবানুগুলি আক্রমণ করুক।

“এক বছর চলে গেল। এবং একরাতে যখন আমি শার্লকে বিছানায় নিয়ে গেলাম সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। “বুগিম্যান, ড্যাডি, বুগিম্যান, বুগিম্যান!”

“আমার সচকিত হয়ে উঠলাম। ঠিক একইভাবে বলেছিল ড্যানি। আমার মনে হতে লাগল আলমাড়ির দরজার কথা, অল্প খোলা ছিল একটি খাঁজের মত যখন আমরা ওকে পেয়েছিলাম। আমি চাইলাম শার্লকে সে রাতে আমাদের বিছানায় নিয়ে যেতে।”

“নিয়েছিলেন কি?”

“না” বিলিংস তার হাত ঠিক করল এবং তার মুখে ফুটে উঠল সহসা ফিকে বেদনার চিহ্ন। “কীভাবে আমি রিটার কাছে যাই এবং বলি যে আমি ভুল ছিলাম? আমাকে শক্ত হতে হয়েছিল। রিটা সবসময়ই ছিল জেলিফিশের মত, দেখুন বিয়ের আগেই কত সহজে আমার সাথে বিছানায় গিয়েছিল।”

হার্পার বললেন, “অন্যদিকে, দেখুন কত সহজে আপনি ওর সাথে বিছানায় গিয়েছিলে।”

বিলিংস তার হাত ঠিক করা থামিয়ে দিয়ে, ধীরে তার মাথাটি ঘুরাল হার্পারের দিকে এবং বলল, “আপনি কি আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করছেন?”

“অবশ্যই না” বললেন হার্পার।

বিলিংস উত্তর দিল, “তাহলে আমার মত আমাকে বলতে দিন। আমি এখানে এসেছি আমার বুকের কাছে জমা কথাগুলি উগড়ে দিতে। আমার গল্প বলতে। আমি আমার সেক্স লাইফ নিয়ে আপনার সাথে কথা বলছি না, যদি এটা আপনি আশা করে থাকেন। রিটা এবং আমার খুবই সাধারন সেক্স লাইফ ছিল, ওই নোংরা কোন বিষয় ওতে ছিল না। আমি জানি অনেক লোক এসব নিয়ে কথা বলে, কিন্তু আমি তাদের মধ্যে নই।”

“ঠিক আছে।” অস্বস্থিকর এক ঔদ্বত্যের সাথে বলল বিলিংস। মনে হলো তার চিন্তার সুতা কেটে গেছে। তার চোখ অস্বস্থিকর ভাবে চারিদিকে ঘুরে গিয়ে স্থির হলো আলমাড়ির উপরে, যার দরজা খুব ভালোভাবে বন্ধ।

“আপনি কি দরজাটা খোলা দেখতে চান?” জিজ্ঞেস করলেন হার্পার।

“না!” বিলিংস উত্তর দিল তাড়াতাড়ি। সে এক সন্ত্রস্থ হালকা হাসি দিল। “আমি কেন আপনার অভারশু দেখব?”

বিলিংস বলল, “বুগিম্যান ওকে নিয়ে নিল।”

কপাল চুলকালো বিলিংস, যেন সে তার স্মৃতি আঁকছে।

“এক মাস পরে। কিন্তু এর আগে কিছু একটা ঘটেছিল। আমি ঐ কক্ষে একটা শব্দ শুনেছিলাম এক রাতে। এবং এরপর বাচ্চাটি চিৎকার করে উঠল। আমি খুবই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খোললাম-বাতি জ্বলছিল- এবং বাচ্চাটি বিছানায় উঠে বসে কাঁদছিল এবং কিছু একটা যেন সরে গেল। ছায়ার ভেতরে, আলমাড়ির ওদিকে কিছু যেন হড়কাতে হড়কাতে চলে গেল।

“আলমাড়ির দরজা কি খোলা ছিল?”

“খুবই সামান্য। খাঁজমাত্র।” বিলিংস তার ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। “শার্ল চিৎকার করছিল বুগিম্যান নিয়ে। সে আরো বলছিল কিছু একটা যা সম্ভবত “ক্লজ” কিন্তু শুনাচ্ছিল “ক্রজ” এর মত। ছোট বাচ্চাদের “এল” উচ্চারনে সমস্যা হয় আপনি জানেন। রিটা উপরে উঠে এল এবং জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। আমি বললাম শার্ল সিলিং এ ছায়ার নড়াচড়া দেখে ভয় পেয়েছে।”

হার্পার বললেন, “ক্রসেট?”

“কী?”

“ক্রসেট ক্লজেট। হয়ত সে বলতে চাচ্ছিল ক্লজেট তথা আলমাড়িটার কথা।”

বিলিংস বলল, “হয়ত। হয়ত তাই। কিন্তু আমার তা মনে হত না। আমার মনে হয় সে বলছিল ক্লজ।” তার চোখ আবার আলমাড়ির দরজাটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তার গলার স্বর ফিসফিসানির রূপ নিল, “ক্লজ, লম্বা ক্লজ।”

“আপনি কি আলমাড়িটা দেখেছিলেন?”

“হ…হ্যা।” বিলিংস এর হাতদ্বয় তার বুকের উপরে শক্তভাবে পরস্পরের সাথে আঁটা।

“সেখানে কি কিছু ছিল? আপনি কি দেখেছিলেন-”

 

“আমি কিছুই দেখি নি!” বিলিংস হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল। এবং যখন শব্দগুলি বের হয়ে আসতে লাগল তখন মনে হল তার আত্মার গভীর থেকে একটি কালো ছিপি খুলে গেছে। “যখন ও মারা গেলে, আমি ওকে পেলাম। সে ছিল কালো। পুরোটাই কালো। সে তার নিজের জিভ খেয়ে ফেলেছিল আর দেখতে মিন্সট্রেল শোতে নিগারের মত কালো হয়ে উঠেছিল, এবং আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার চোখগুলি ছিল, আপনি যেমন স্টাফ করা প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখে থাকেন, উজ্জ্বল এবং ভয়ংকর, মার্বেলের মত এবং চোখদ্বয় যেন বলছিল, এটা আমাকে নিয়ে গেল ড্যাডি, তুমি ওকে নিয়ে যেতে দিলে, তুমি আমাকে হত্যা করলে, তুমি ওকে সাহায্য করলে আমাকে হত্যা করতে।”

বিলিংসের কথা বন্ধ হলো। একটি বড় এবং নিরব অশ্রুধারা তার মুখের একপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল।

“এটা ছিল মস্তিষ্ক খিঁচুনি। বাচ্চাদের এমন হয় মাঝে মাঝে। মস্তিষ্ক থেকে এক ধরনের খারাপ সংকেত। হার্টফোর্ডে ওর একটা ময়নাতদন্ত করা হয়, এবং তারা বলে ঐ খিঁচুনি থেকে ও নিজের জিহবা গিলে ফেলে। এবং আমাকে একাই বাড়িতে ফিরতে হয়েছিল কারণ ওরা রিটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল ওষুধ দিয়ে। রিটা প্রায় উন্মাদ হয়ে পড়েছিল। আমাকে ঐ বাড়িতেই যেতে হয়েছিল সম্পূর্ন একা, এবং আমি জানতাম যে শিশুরা এমনি এমনি খিঁচুনিতে পড়ে না। আপনি ওদের ভয় পাইয়ে খিঁচুনি ধরাতে পারেন। এবং আমাকে ঐ বাড়িতেই যেতে হলে যেখানে ওটা ছিল।”

সে ফিস ফিস করে বলল, “আমি খাটে ঘুমালাম। লাইট জ্বালিয়ে।”

“কিছু ঘটেছিল?”

বিলিংস বলল, “আমি একটি স্বপ্ন দেখি। আমি একটি অন্ধকার কক্ষে এবং সেখানে এমন কিছু ছিল আলমাড়ির মধ্যে, যা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। এটা একটা শব্দ করছিল, অদ্ভুত এক শব্দ। এটা আমাকে মনে করিয়ে দিল এক কমিক বইয়ের কথা যা আমি ছোটকালে পড়েছিলাম। ক্রিপ্টের গল্প, আপনার তা মনে আছে? তাদের ছিল একটি লোক নাম গ্রাহাম ইংলেস, সে পৃথিবীর সব অদ্ভুত ভয়ংকর জিনিস আঁকতে পারত। যাইহোক, সেই গল্পে নারীটি তার স্বামীকে পানিতে ডুবিয়ে মারে। তার পায়ে সিমেন্ট ব্লক বেঁধে ডুবিয়ে দেয়। পরে সে ফিরে আসে। সে পচে গেছে কালো-সবুজ রঙ, মাছ খেয়ে ফেলেছে এক চোখ, মাথার চুলে সমুদ্রের আগাছা। সে ফিরে আসে আর মহিলাটিকে খুন করে। এবং যখন আমি মাঝরাতে জেগে উঠলাম, আমার মনে হলো ঐ বস্তুটি আমার দিকে ঝুঁকে আছে। তার লম্বা থাবা বিস্তার করে।

ডক্টর হার্পার তার ডেস্কে থাকা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকালেন। লেস্টার বিলিংস প্রায় আধ ঘন্টা ধরে কথা বলছে। তিনি বললেন, “যখন আপনার বউ ফিরে আসলেন বাড়িতে,  আপনার প্রতি তার অনুভূতি বা আচরন কেমন ছিল?”

বিলিংস অহংকারী ভাবে বলল, “ও এখনো আমাকে ভালোবাসে। আমি যা বলি তা এখনো ও করতে চায়। এটাই স্ত্রী’র দায়িত্ব, তাই না? এই যে নারী স্বাধীনতা তা কেবল অসুস্থ লোকই তৈরী করে। একজন মানুষের জন্য জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হলো তার জায়গা কোনটা তা বুঝতে পারে। তার, তার…”

“জীবনের গন্তব্য?”

“হ্যা, ঠিক তাই!” আঙ্গুল ফুটিয়ে বলল বিলিংস। “এটাই, এবং একজন স্ত্রী’র কাজ তার স্বামীকে অনুসরন করা। অহ, প্রথম কয়েকমাস রিটা ছিল খুব ফ্যাকাসে, গান গায় না, টিভি দেখে না হাসে না। আমি জানতাম ও এসব কাটিয়ে উঠতে পারবে। যখন বাচ্চারা খুব ছোট থাকে, আপনি ওদের সাথে খুব ভালো ভাবে অত যুক্ত হতে পারেন না। কিছুদিন পরে ব্যুরো ড্রয়ার খুলে ওদের ছবি বের করে দেখতে হবে মনে করার জন্য ওরা আসলে দেখতে কেমন ছিল।”

“ও আরেকটা সন্তান নিতে চাইল” গম্ভীরভাবে যোগ করল সে। “ আমি ওকে বললাম এটা বাজে চিন্তা। চিরকালের জন্য নয়, কিন্তু সেই সময়ের জন্য বাজে চিন্তা। আমি তাকে বললাম এই সময়ে আমাদের এসব কাটিয়ে উঠা দরকার ও নিজেদের আরো বেশী উপভোগ করা দরকার। আমরা আগে কখনো এ সুযোগ পাই নি। যদি মুভি দেখতে যেতে চান তাহলে বেবি সিটার খুঁজতে হত। শহরে মেটস দেখতে যেতে পারতেন না যদি না ওর বন্ধুরা বাচ্চাদের দেখে রাখত, কারণ আমার মা আমাদের বিষয়ে কিছুই করতেন না। আমাদের বিয়ের পরে খুব তাড়াতাড়িই ড্যানির জন্ম হয়, দেখেছেন? মা বললেন রিটা হলো ভবঘুরে, একজন সাধারণ বাজারি মেয়ে। বাজারি মেয়েই তিনি ওদের বলতেন। অস্বাভাবিক নয় কি? তিনি একবার আমাকে বসিয়ে বলেছিলেন বাজারি বেশ্যার কাছে গেলে যেসব রোগ হতে পারে সেসব সম্পর্কে। কীভাবে আপনার শিশ্নে কেবল একটি ছোট ফোঁড়ার মত দেখবেন একদিন, এবং এরপরদিন থেকে পচে যাওয়া শুরু। এমনকী তিনি আমাদের বিয়েতেও আসেন নি।”

বিলিংস তার হাতের আংগুলগুলি দিয়ে তার বুকে বাজাতে লাগল।

“রিটার গাইনোকোলজিস্ট তার কাছে বস্তুটি বিক্রি করেছিল, নাম আইইউডি বা ইন্টারইউরিন ডিভাইস। ডাক্তার বলেছিল, অব্যর্থ। সে কেবল মহিলাদের বিশেষ জায়গায় ওটা লাগিয়ে দেয়, এই কাজ শেষ। এখানে কিছু থাকলে ডিম্বানু নিষিক্ত হতে পারে না। আপনি বুঝতেই পারবেন না যে ওটা ওখানে আছে।” সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বিলিংস হাসল। “কেউ জানতে পারত না ওটা ওখানে আছে কি নেই। এবং পরের বছর রিটা আবার অন্তঃসত্তা হয়ে পড়ল, অব্যর্থের নমুনা!”

হার্পার বললেন, “কোন জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্বতিই একশোভাগ সঠিক নয়। পিল মাত্র আটানব্বই ভাগ সঠিক। আই ইউ ডি হয়ত বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে ভারী রজঃস্রাবের প্রবাহের কারণে, এবং কোন কোন ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে মলত্যাগের চাপে।”

“হ্যা, অথবা আপনি তা বের করে নিতেও পারেন।”

“তাও সম্ভব।”

“তারপর কী হলো, সে ছোট ছোট কাপড় চোপড় বুনছিল, শাওয়ারে গান গাচ্ছিল আর পাগলের মত খাচ্ছিল আচার। আমার কোলে শুয়ে বলছিল কীভাবে এটা ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে। অসহ্য!”

“শার্লের মৃত্যুর পরে বছরের শেষ মাথায় এল বাচ্চাটি?”

“হ্যা, ঠিক। ছেলে শিশু। ও নাম রাখল এন্ড্রু লেস্টার বিলিংস। আমি ওটার বিষয়ে কিছু করতে চাই নি, বিশেষত প্রথমদিকে। আমার নীতি ছিল যেহেতু সে এই ঝামেলা তৈরী করেছে তাই নিজে সামলাক। আমি জানি এটা শুনতে খারাপ লাগবে, কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে কীসব পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে গিয়েছিলাম আমি।”

“কিন্তু আমি বাচ্চাটির দিকে আকৃষ্ট হলাম। সে ছিল খুবই ছোট বাচ্চা আর দেখতে ঠিক আমার মত। ড্যানি ছিল ওর মায়ের মত, শার্ল আমাদের কারো মতই ছিল না, হয়ত ছিল আমার দাদী এনের মত। কিন্তু এন্ডি ছিল আমার মত দেখতে।”

আমি কাজ থেকে ফিরে এসে ওর সাথে খেলা করতাম। সে আমার একটা আঙ্গুল মাত্র ধরতে পারত, হাসত এবং বাচ্চাদের মত আধো আধো শব্দ উচ্চারন করত। নয়মাসের বাচ্চা তার বয়স্ক বাবার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসছে, আপনি বিশ্বাস করতে পারেন?”

“এরপর এক রাতে আমি একটি দোকান থেকে বেরিয়ে আসছিলাম শিশুদের বিছানার উপরে ঝুলানোর জন্য কিছু রঙবেরঙের খেলনা নিয়ে। বাচ্চারা ধন্যবাদ বলার মত বয়েসে পৌছার আগ পর্যন্ত উপহার পেয়ে তার কদর করে না, এটাই ছিল সব সময় আমার নীতি। কিন্তু আমি তখন ছোট বাচ্চাটির জন্য ওই অদ্ভুত জিনিসগুলি কিনছিলাম, এবং তখনই আমি বুঝতে পারি যে আমি বাচ্চাটিকে সবচাইতে বেশী ভালোবাসি। আমার তখন আরেকটি চাকরি, বেশ ভালো চাকরি, ক্লুয়েট এবং সনসের জন্য ড্রিল বিট বিক্রি করা। আমি খুব ভালো করছিলাম এবং এন্ডির বয়স যখন এক তখন আমরা ওয়াটারবুরীতে চলে গেলাম। পুরনো জায়গা, যেখানে আমাদের অনেক খারাপ স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

“এবং অনেক আলমাড়ি।

“পরবর্তী বছর ছিল আমাদের জন্য সবচাইতে সেরা। আমি আমার ডান হাতের সব আঙ্গুল দিয়ে দিতে পারি সেই বছর আবার ফিরে পাওয়ার বিণিময়ে। তবে, ভিয়েতনামের যুদ্ধ তখনো চলছিল, আর হিপিগুলি এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কাপড়হীন অবস্থায়, আর নিগারগুলি চিৎকার চেঁচামেচি করছিল প্রচুর, কিন্তু এর কিছুই আমাদের স্পর্শ করে নি। আমরা ছিলাম এক শান্ত জায়গায়, ভালো প্রতিবেশীদের মাঝে। আমরা সুখে ছিলাম”, সে সহজে সারমর্ম করে নিল। “আমি রিটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম একবার সে কি দুশ্চিন্তিত না। আপনি জানেন, দূর্ভাগ্য তিন হয়ে আসে, এবং এভাবেই। ও বলল আমাদের জন্য নয়। আরো বলল, এন্ডি ছিল বিশেষ। ঈশ্বর তার চারপাশে এক বলয় তৈরী করে রেখেছেন।”

বিলিংস বিষাদগ্রস্তভাবে তাকাল সিলিং এর দিকে।

“শেষ বছর খুব ভালো ছিল না। বাড়িটির কিছু একটা যেন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার জুতা হলে রাখতে শুরু করলাম কারণ আলমাড়ির দরজা খোলা আমি পছন্দ করতাম না। আমি ভাবতে লাগলামঃ কী হবে যদি ওটা ওখানে থাকে? গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে এবং আমি দরজা খোলা মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বে? আমি ভাবতে লাগলাম এবং যেন শুনতে পাচ্ছিলাম সন্দেহজনক শব্দ, যেন কিছু একটা ছোট, ভেজা সবুজ ও কালো রঙ্গের বস্তু, ওখানে অল্প নড়ছে।”

“রিটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো কাজে খুব পরিশ্রম যাচ্ছে কি না, এবং আমি উত্তেজিত ভাবে ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আগেকার দিনের মতই। আমার বিবমিষা লাগছিল ওদের একা ফেলে কাজে যেতে, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আমার ভালো লাগছিল। ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করুন, মনে হচ্ছিল আমি যেন বেঁচে গেছি। আমি ভাবতে লাগলাম ওটা হয়ত আমাদের হারিয়ে ফেলেছিল যখন আমরা বাড়ি বদলে ফেলি। ওটা আমাদের খুঁজে বেরিয়েছে, রাতে রাস্তায়, হয়ত ড্রেনের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে। আমাদের গন্ধ শুঁকে শুঁকে। এক বছর লেগেছে ওর আমাদের খুঁজে পেতে। ওটা ফিরে এসেছে। ওটা এন্ডিকে চায়, এবং আমাকে চায়। আমি ভাবতে লাগলাম, হয়ত আপনি যখন কোন কিছু দীর্ঘ সময় ধরে ভাবেন ও বিশ্বাস করেন, তখন এটি সত্য হয়ে যায়। হয়ত যেসব দানবের ব্যাপারে আমরা ছোটকালে ভীত থাকতাম, সেই ফ্র্যাংকেনস্টাইন এবং উলফম্যান এবং মমি, হয়ত এগুলি সত্যি। যেসব শিশু কাঁটাপথে হারিয়ে যায়, হ্রদে ডুবে যায় বা যাদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না, এইসব শিশুদের হত্যা করার জন্য যথেষ্ঠ সত্যি। হয়ত…”

“আপনি কি ভয়ে কিছু লুকোচ্ছেন মিস্টার বিলিংস?”

বিলিংস দীর্ঘ সময় নিরব হয়ে থাকল। ডিজিটাল ঘড়িতে সময় গেল দুই মিনিট।

তারপর সে হঠাৎ করেই বলল, “এন্ডি মারা গিয়েছিল ফেব্রুয়ারীতে। রিটা তখন ওখানে ছিল না। সে তার বাবার কাছ থেকে খবর পেয়েছিল যে ওর মা গাড়ি দূর্ঘটনায় পড়েছেন নববর্ষের পরের দিনে, এবং বাঁচবেন বলে মনে হচ্ছে না। সে ঐ রাতেই বাস ধরে চলে যায়।

“ওর মা মারা যান নি কিন্তু দীর্ঘ সময়- প্রায় দুই মাসের মত সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন। একজন খুব ভালো মহিলা এন্ডির সাথে দিনে থাকতেন। আমি আর এন্ডি থাকতাম রাতে। এবং আলমাড়ির দরজা বার বার খুলে যাচ্ছিল।”

বিলিংস তার ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। “বাচ্চাটি আমার সাথে ঘুমাচ্ছিল কক্ষটিতে। এটা হাস্যকর ব্যাপারও। রিটা একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল বাচ্চাটির বয়স দুই বছর হলে আমি ওকে অন্য কক্ষে রাখতে চাই কি না। বাচ্চাদের মা বাবার সাথে এক কক্ষে থাকা ঠিক না জানেন তো? ধরুন এতে সেক্সের ব্যাপারে ওদের ট্রমা তৈরী হতে পারে এবং এইসব। কিন্তু আমরা কখনোই ওসব করিনি বাচ্চা না ঘুমালে। এবং আমি বাচ্চাটিকে অন্য কক্ষে সরাতে চাইছিলাম না। আমি ভয় পাচ্ছিলাম, ড্যানি এবং শার্লের ঘটনার পরে।”

“কিন্তু আপনি ওকে সরিয়ে ছিলেন, তাই নয় কি?” ডক্টর হারপার জিজ্ঞেস করলেন।

বিলিংস অসুস্থ এবং বিবর্ন এক হাসি দিয়ে বলল, “হ্যা, আমি সরিয়েছিলাম।”

নিরবতা শুরু হলো। বিলিংস এই নিরবতার সাথে যুদ্ধ করছিল। .

শেষপর্যন্ত সে জোরের সাথে বলল, “আমাকে করতে হয়েছিল। আমাকে করতে হয়েছিল। রিটা যখন ছিল তখন সব ঠিক ছিল কিন্তু ও চলে যাবার পরে, অস্বাভাবিক হতে শুরু করল। এটা শুরু হলো।” সে চোখ বড় করে তাকাল হার্পারের দিকে এবং বুনো হিংস্রতায় ফুটে উঠল ওর মুখে। “অহ, আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি জানি আপনি কী ভাববেন, আপনার কেইসবুকের আরেকটি উন্মাদ গল্প, আমি জানি তা, কিন্তু আপনি ওখানে ছিলেন না, বিশ্রী আত্মতুষ্ঠ পাগলের ডাক্তার।

“একরাতে বাড়ির সবক’টি দরজা খুলে গেল। একদিন সকালে উঠে আমি হল এবং আলমাড়ির দিকে, ও সদর দরজার দিকে পেলাম মাটি ও আবর্জনার চিহ্ন। ওটা কি বাইরে যাচ্ছিল? ভেতরে আসছিল? আমি জানি না! ঈশ্বরের শপথ, আমি জানি না!

বিলিংস ওর মাথার চুলে হাত বুলালো। “ আপনি রাত তিনটার সময় ঘুম থেকে উঠলেন, এবং শব্দ শুনে প্রথমে বললেন এটা কেবল ঘড়ির শব্দ, কিন্তু এর নিচে আরো একটি শব্দ এলো আপনার কানে। কী যেন খুবই গোপনীয়তার সাথে হেঁটে যাচ্ছে, তবে অতি গোপনীয়তার সাথে নয়, কারণ সে চাইছে আপনি তার উপস্থিতি সম্পর্কে জানুন। একটা কিছু গড়িয়ে যাবার শব্দ আসছে রান্নাঘরের ড্রেইন থেকে। অথবা সিড়িতে থাবা রাখার শব্দ। এবং আপনি চোখ বন্ধ করেন, শব্দ শোনে চোখ বন্ধ করা খারাপ জানেন আপনি, কিন্তু আপনি যদি ওটাকে দেখেন…

“এবং সব সময় আপনি ভাবেন এই বুঝি হালকা শব্দ বন্ধ হয় আর অট্টহাসি শুরু হয়, আর গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ আছড়ে পড়ে আপনার মুখে, এরপর হাত এসে পড়ে আপনার গলায়।”

বিলিংস ছিল ভয়ে মলিন ও সে কাঁপছিল।

“তাই আমি বাচ্চাটিকে সরিয়ে ফেললাম। আমি জানতাম ওটা চলে যাবে বাচ্চাটির কাছে, কারণ বাচ্চাটি অপেক্ষাকৃত দূর্বল।

এবং ওটা তাই করল। এই প্রথম রাতের মত বাচ্চাটি মধ্যরাতে চিৎকার করে উঠল, অবশেষে। আমি উঠে গিয়ে দেখি ও বিছানায় দাঁড়িয়ে আছে আর চিৎকার করছে, “বুগিম্যান ড্যাডি, বুগিম্যান।”

“ড্যাডির সাথে যাব, ড্যাডির সাথে যাব।” বিলিংস এর স্বর বাচ্চাদের মত হয়ে উঠল। তার চোখ বড় বড় হয়ে যেন মুখের অধিকাংশ দখল করে ফেলেছে, এবং সে খাটে যেন একেবারে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

“কিন্তু আমি পারলাম না।” বাচ্চাদের মত স্বরে বলতে লাগল বিলিংস। “আমি পারলাম না। এবং এক ঘন্টা পরে শোনা গেল এক বড় চিৎকার। এক ভয়ংকর চিৎকার। এবং আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমি ওকে কত ভালবাসতাম কারণ আমি দৌড়ে গেলাম, এবং আমি লাইটও অন করলাম না, কেবল দৌড়ে গেলাম ও দেখলাম, ও ঈশ্বর, ওটা বাচ্চাটিকে ধরে ঝাঁকাচ্ছিল, যেমন ছোট কুকুর কাপড়ের ক্ষুদ্র টুকরা ধরে ঝাঁকায়, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম কিছু একটা ভয়ংকর, ঝুঁকে থাকা কাঁধ, কাকতাড়ুয়ার মত মাথা, এবং আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম, যেন প্লাস্টিকের বোতলে মরা ইঁদুরের গন্ধ এবং আমি শুনলাম…

সে থামল। এবং তার স্বর আবার স্বাভাবিক বয়স্ক স্বরে ফিরে এল। “আমি শুনলাম যখন ওটি এন্ডির ঘাড় ভাঙল।” বিলিংস এর গলার স্বর ছিল ঠান্ডা এবং নিথর। “এটা বরফ ভাঙ্গার শব্দের মত, যখন আপনি গ্রাম্য পুকুরে স্কেটিং করেন তখন এমন শব্দ হয়।”

“এরপর কী হলো?”

“আমি দৌড়ে চলে গেলাম।” একই শান্ত ও নিথর স্বরে বলল বিলিংস। “আমি সারা রাত খোলা থাকে এমন একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম। এটা পুরোপুরি কাপুরুষতা না? দৌড়ে সারা রাত খোলা থাকে এমন একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম এবং ছয় কাপ কফি পান করলাম। এরপর আমি ফিরে গেলাম বাড়িতে। তখন ভোর হয়ে গেছে। আমি পুলিশকে খবর দিলাম উপরে উঠার আগেই। সে মেঝেতে পড়েছিল আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকে অভিযুক্ত করছে। একটি ক্ষুদ্র রক্তের ধারা ওর একটি কান দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এক ফোঁটা মাত্র আসলে। এবং আলমাড়ির দরজাটা খোলা ছিল, খাঁজমাত্র।”

স্বরটি বন্ধ হল। হার্পার ডিজিটাল ঘড়িতে দেখলেন। পঞ্চাশ মিনিট চলে গেছে।

“নার্সের সাথে এপয়ন্টমেন্ট করুন একটি। আসলে একটি না, কয়েকটি। মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার?” বললেন হার্পার।

“আমি এখানে এসেছি কেবলমাত্র আমার গল্প বলতে। আমার ভেতর থেকে ঝেড়ে ফেলতে। দেখেছেন আমি পুলিশকে মিথ্যা বলেছি? আমি ওদের বলেছিলাম বাচ্চাটি হয়ত তার বিছানা থেকে উঠে আসার চেষ্টা করেছিল রাতে, এবং তারা আমার কথা বিশ্বাস করল। অবশ্যই বিশ্বাস করেছিল। এটা ঐরকমই দেখাচ্ছিল। অন্যগুলি যেমন ছিল, দূর্ঘটনার মত। কিন্তু রিটা জানত, শেষপর্যন্ত ও জেনেছিল।

বিলিংস তার ডান বাহু দিয়ে চোখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।

ডক্টর হার্পার একটু থেমে গিয়ে বললেন, “মিস্টার বিলিংস এখানে কথা বলার মত অনেক কিছুই আছে। আমি বিশ্বাস করি আপনি যে অপরাধবোধ বয়ে বেড়াচ্ছেন তার কিছু আমরা দূর করতে পারি, কিন্তু প্রথমে আপনার চাইতে হবে এর থেকে মুক্তি।”

বিলিংস চোখ থেকে তার বাহু সরিয়ে চিৎকার করেই বলল, “আপনার কি বিশ্বাস হয় না আমি চাই?”

তার চোখগুলি ছিল লাল, আহত এবং বিষন্ন।

“এখনো হয় না।” বললেন হার্পার। “মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবারে ঠিক আছে?”

দীর্ঘ নিরবতার পর বিলিংস বিড়বিড় করে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে।”

“নার্সের সাথে এপয়ন্টমেন্ট করে ফেলুন মিস্টার বিলিংস। এবং ভালো থাকুন।”

বিলিংস শূন্যভাবে হাসল, অফিস থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত হেঁটে, পিছনে না তাকিয়ে।

নার্স স্টেশন দেখা গেল খালি। একটি ছোট নির্দেশিকা ঠাঙানো আছে যাতে লেখা, “শীঘ্রই ফিরে আসছি।”

বিলিংস ফিরল এবং আবার গেল অফিসে। “ডাক্তার, আপনার নার্স-”

কক্ষটি খালি।

কিন্তু আলমাড়ির দরজা খোলা। খাঁজমাত্র।

“খুব ভালো, খুব ভালো।” আলমাড়ির ভেতর থেকে একটি স্বর ভেসে এল। শব্দগুলি এমনভাবে উচ্চারিত হলো যেন ঐ মুখভর্তি সামুদ্রিক আগাছা।

বিলিংস ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল যখন আলমাড়ির দরজা ঝট করে খুলে গেল। সে তার নিচের দিকে উষ্ণতা অনুভব করছিল কারণ ইতিমধ্যেই নিজেকে ভিজিয়ে ফেলেছে।

“খুবই ভালো” বলল বুগিম্যান বেরিয়ে আসতে আসতে। তার এক পচা এবং কোদাল নখরযুক্ত হাতে ডক্টর হার্পারের মুখোশ।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং