প্রাচীন দার্শনিক ও সেইজদের যবনিকা

বুক অব ডেড ফিলোসফার একটি বই দার্শনিকদের মৃত্যু নিয়ে। বইটির লেখক সাইমন ক্রিচলে। তিনি একজন অধ্যাপক এবং নিউ স্কুল অব সোশ্যাল রিসার্চ নিউ ইয়র্ক এর দর্শন বিভাগের প্রধান। বইয়ের শুরুতে দার্শনিক মিশেল ডি মন্টেইনের একটি চমৎকার কথা আছে। মিশেল ডি মন্টেইন বলেছেন আমি কোন বই তৈরী করলে বিভিন্ন মৃত্যু সম্পর্কে মন্তব্য ইত্যাদির একটা রেজিস্টার বানাতাম। যে মানুষকে মৃত্যু সম্পর্কে শিক্ষা দিবে সেই শেখাতে পারবে কীভাবে বাঁচতে হয়।

 

 

পেরিয়ান্দার এর মৃত্যুকথা

 

থেলিস, সলোন, চিলনের মতো করিন্থের পেরিয়ান্দারকেও গ্রীক ছয় পরমবিজ্ঞ বা মহাজ্ঞানীদের একজন ধরা হয়।

পেরিয়ান্দার (৬২৮- ৫৮৮ বিসি) দুইজন লোককে নিযুক্ত করলেন, তারা যেন তৃতীয় একজন লোকের সাথে নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করে, হত্যা করে এবং কবর দেয় ঐ জায়গায়। এরপর তিনি আরো চারজন লোক নিযুক্ত করলেন, তারা যেন ঐ লোক দুইজনকে হত্যা করে ও কবরস্থ করে। এরপর তিনি একদল লোককে নিযুক্ত করলেন, তারা যেন ঐ চারজন লোককে খুঁজে বের করে ও শাস্তি দেয়। এইসব ব্যবস্থা করে তিনি প্রথম দুইজন লোকের সাথে দেখা করতে গেলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। কারণ তিনিই ছিলেন সেই তৃতীয় ব্যক্তি।

বইটি থেকে কয়েকটি কাহিনী বাংলা করে দেয়া হলো।

 

 

এপিমেনিডেস এর বিত্তান্ত

 

কথিত আছে ক্রিটের এপিমেনিডেসকে তার বাবা পাঠিয়েছিলেন মাঠে ভেড়া দেখাশোনার জন্য। তিনি ভেড়া দেখা বাদ দিয়ে এক গুহায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার ঘুম ভাঙে ৫৭ বছর পরে। ঘুম থেকে উঠে তিনি ভাবলেন হালকা ঘুমিয়ে উঠেছেন। চারিদিকে ভেড়ার খোঁজ করে ভেড়া পেলেন। নিজের বাড়িতে গিয়ে দেখলেন তার বাবার ফার্ম অন্য লোকের দখলে, এবং বদলে গেছে সব কিছু। অবশেষে তার ছোট ভাইকে পান, সে তখন বৃদ্ধ। তার কাছ থেকে সব শুনে তিনি সত্য বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন যে ৫৭ বছর তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন।

এই এপিমেনিডেসকে লোকেরা নবীর মতো সম্মান করতো। যখন প্লেগের আক্রমণে মানুষ মারা যেতে লাগলো তখন বাঁচার জন্য এথেনিয়ানরা খোঁজে এনেছিল তাকে। তিনি নিদান দেন, যেসব জায়গায় কোন ভেড়া শুয়ে থাকতে সিদ্ধান্ত নেয়, ওই জায়গাতেই তাকে বলি দিতে হবে। তবেই মুক্তি মিলবে প্লেগ থেকে। তার কথানুযায়ী কাজ করা হয়েছিল। প্লেগ থেকেও মুক্তি মিলেছিল এথেনিয়ানদের।

ক্রিটের বাসিন্দা এই সেইজ একবার বলেছিলেন, “ক্রিটানরা, সর্বদা মিথ্যাবাদী।”

তার কথাটি বিখ্যাত প্যারাডক্সের জন্ম দেয়। ক্রিটানরা সর্বদা মিথ্যাবাদী, একজন ক্রিটানের এই কথাটি সত্য না মিথ্যা হয়? কথাটি সত্য হলে, বক্তব্যটি মিথ্যা হয়। কথাটি মিথ্যা হলে, বক্তব্যটি সত্য হয়।

ক্রিটানরা বলে থাকে ২৫৯ বছর বেঁচেছিলেন তাদের এই মহৎ ব্যক্তি। তবে ক্রিটানদের এই কথা আমরা বিশ্বাস করবো নাকী করবো না?

 

 

পিথাগোরাসের আশ্চর্য শিম বিদ্বেষ

 

পিথাগোরিয়ান তথা পিথাগোরাসের অনুসারীদের ছিল গুপ্তসংঘের মত একটা ব্যবস্থা। তারা তাদের ভিতরের তথ্যাবলী, নিয়ম নীতি ইত্যাদি বাইরে প্রকাশ করতেন না। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর পরম সত্য সংখ্যায়, অমরত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে। খাদ্যের বেলায় মাংস, মাছ, এমনকী ডিমও খেতেন না। সবচেয়ে ভয়ানক বিদ্বেষ ছিল তাদের শিমের প্রতি। পিথাগোরাস তার শিম বিদ্বেষ পেয়েছিলেন সম্ভবত মিশরীয়দের কাছ থেকে। শিম বীজের আকৃতি অণ্ডকোষের মত, তাই ছিল শিম বিদ্বেষ।

আইনোনিয়ান উপত্যকার সামোস দ্বীপে ছিল পিথাগোরাসের নিবাস। সেখানকার শাসক পলিক্রেটিস এর নিয়ম নীতি পিথাগোরাসের পছন্দ হল না। তিনি তার দ্বীপ ছাড়লেন। অনুসারীদের নিয়ে দক্ষিণ ইতালির ক্রোটনে গেলেন। তার বেশ প্রভাব বাড়তে লাগল। বর্তমানের দিনের ক্যালাব্রিয়া অঞ্চল পর্যন্ত তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল।

স্থানীয় এক ধনী লোক ছিল নাম সাইলো। তার সাথে একবার পিথাগোরাস অহংকার ও তাচ্ছিল্য পূর্ন ব্যবহার করলেন। এতে সাইলো ক্ষেপে গিয়ে তার দলবল নিয়ে পিথাগোরাসের আবাসস্থলে আগুন দিল। পিথাগোরাসের শিষ্যরা শুয়ে একটা সাঁকো নির্মান করলেন আর তার উপর দিয়ে পিথাগোরাস কোন ক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন।

পিথাগোরাস দৌড়ে যেতে যেতে একসময় দেখলেন সামনে একটি শিমের বাগান। এটি দেখে তিনি থেমে গেলেন। বললেন, মরতে হলে পিথাগোরাস মরবে, তবুও শিমের বাগান পার হবে না।

সাইলো’র লোকজন পিছন পিছন ধাওয়া করে আসছিল। তারা দাঁড়িয়ে থাকা পিথাগোরাসকে সহজেই ধরতে পারলো। এবং তার জিহবা কেটে মেরে ফেললো।

পিথাগোরাসের এই মরে যাওয়াকে যারা বোকামি ভাবছেন তাদের জন্য একটা তথ্য হলো, অধিকাংশ স্কাসিক্যাল স্কলার মনে করেন পিথাগোরাস নামে কেউ ছিল না। দক্ষিণ ইতালিতে একদল লোক, যারা নিজেদের পিথাগোরিয়ান বলত, তারা তাদের একজন কাল্পনিক গুরু তৈরী করেছিল, যার নাম তারা দিয়েছিল পিথাগোরাস।

 

 

তিমিচার জিহবা

 

যেসব মহিলারা দর্শনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেই আগেকার সময়ে, তার মধ্যে একজন এই তিমিচা। প্রাচীন কালের মহিলা দার্শনিকদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় বেশীরভাগ মহিলারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন পিথাগোরিয়ান ঘরানাতে।

এই তিমিচাও পিথাগোরিয়ান ছিলেন। সিসিলিয়ান টাইরান্ট ডাইনোসাস দ্বারা পিথাগোরিয়ানদের যখন ধর পাকড় করা হচ্ছে তখন ধৃত হত তিমিচা এবং তার স্বামী মাইলিয়াস। তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়। নির্যাতনের কারণ ছিল একটা প্রশ্নের উত্তর বের করা। সেই প্রশ্নের সাথেও আবার শিম জড়িত। প্রশ্নটি ছিল, কেন পিথাগোরিয়ানরা মরবে তবুও শিম মাঠের উপর দিয়ে যাবে না, এটা তারা কেন করে?

তিমিচা কোন মতেই মুখ খুলবেন না। কিন্তু তার ভয় হলো নির্যাতনের মুখে বলে ফেলতে পারেন তাদের গুপ্ত সংঘের গোপন তথ্যটি। তাই তিনি কামড়ে নিজের জিভ ছিঁড়ে ফেললেন আর থু দিয়ে ফেলে দিলেন টাইরান্ট ডাইনোসাসের মুখে।

এর পর তাকে হত্যা করা হয়।

পিথাগোরিয়ানদের শিম সংস্লিষ্ট ব্যাপারটি তাই আসলেই ছিল গুরুতর।

 

 

রোরূদ্যমান দার্শনিক হিরাক্লিটাসের ও গোবর  

 

দার্শনিক হিরাক্লিটাসকে ( ৫৪০-৪৮০ বিসি) বলা হয় রোরূদ্যমান দার্শনিক। তার কান্নার কারণ ছিল মানুষের আচরণ, বিশেষত তার সহনাগরিকদের আচরন।

হিরাক্লিটাসের ১৩৯ বানী বেঁচে আছে। তার মধ্য থেকে তার যেসব চিন্তা দেখা যায়, তাতে তিনি মনে করতেন লোকেরা গর্দভের মত জীবন যাপন না করে যাতে এই মহাবিশ্বের নিয়ম, তথা লগোস মেনে জীবন যাপন করে।

কিন্তু লোকেরা তার কথা শুনল না। ক্ষিপ্ত দার্শনিক মানবজাতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে চললেন পাহাড়ে। সেখানে তিনি ঘাস, গুল্ম ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করতে শুরু করলেন।

এতে তার একটি মারাত্মক রোগ হলো, ড্রপসি। শরীরে জলীয় পদার্থ জমে ফুলে ওঠা ধরণের রোগ।

এই রোগের চিকিৎসা নেবার জন্যই তিনি আবার তার শহরে ফিরে আসেন। চিকিৎসা ছিল গোবরে ডুবে থাকা। তার গোবরে মৃত্যু নিয়ে তিনটি গল্প আছে প্রচলিত।

এক, তিনি গোবরে ডুবে গিয়ে মারা যান।

দুই, গোবর শুকিয়ে গিয়েছিল এবং তীব্র আয়োনিয়ান সূর্যের গরমে তিনি মারা যান।

তিন, তার শরীরে গোবর এমন ভাবে লেগেছিল, এবং বন্ধুরা এই গোবর পরিস্কার করতে পারে নি। ফলে, কুকুরগুলি থাকে চিনতে পারে নি, কুকুরের আক্রমনে তিনি মারা যান।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিরাক্লিটাসের ১৩৯ টা বানীর মধ্যে একটা বানী ছিল, ‘কুকুকেরা যাদের চিনে না তাদের প্রতিই ঘেউ ঘেউ করে।’

 

 

এনাক্সোগোরাস এবং ধাতব সূর্য

 

এনাক্সিমিনেসের শিষ্য একাক্সোগোরাস (৫০০-৪২৮ বিসি) মনে করতেন বাতায় হচ্ছে ইউনিভার্সাল এবং অফুরন্ত, আর এই বাতাস থেকেই আমাদের উদ্ভব।

তিনি মিলেটাসে তার সহনাগরিকদের বলতেন সূর্য এবং তারাদের সম্পর্কে জানতে।

তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হতো, এনাক্সোগোরাস, তুমি কি তোমার জন্ম ভূমি নিয়ে ভাবো না?

এনাক্সোগোরাস তখন তারাদের দিকে দেখিয়ে বলতেন, ঐ তো আমার জন্মভূমি, আমি তা নিয়েই ভাবি।

এনাক্সোগোরাস একবার দাবী করলেন সূর্য হচ্ছে লাল গরম ধাতবে পূর্ন। এইজন্য মিলেটাসে তার বিচার হয়ে। সেই বিচারে শাস্তির ভয়ে তিনি মিলেটাস থেকে অদৃশ্য হয়ে যান।

নির্বাসনে থাকা অবস্থাতেই তিনি মারা যান। মরার আগে তিনি বলে যান তার মৃত্যুর দিনে যেন শিশুদের ছুটি দেয়া হয়।

এনাক্সোগোরাসের এই নির্বাসনে মৃত্যু আমাদের আরেকটা কথা বুঝতে সাহায্য করে যে, সক্রেটিসের মত বিচার আরো অনেক দার্শনিক চিন্তকদের হয়েছিল। যেমন সোফিস্ট প্রডিকাসকেও এথেনিয়ানরা যুবকদের কুপথে নেবার অভিযোগে বিচারে হত্যা করেছিল। সোফিস্টগুরু প্রোটাগোরাসেরও (৪৮৫-৪১০ বিসি) এমন বিচার হয় তার ধর্ম বিষয়ে সংশয়ের জন্য। শাস্তি এড়াতে তিনি পালিয়ে যান এবং জাহাজডুবিতে পড়েন।

 

 

ইলিয়ার জেনো’র বীরত্বপূর্ন মৃত্যু

 

ইলিয়ার জেনো (৪৯৫-৪৩০ বিসি) বিখ্যাত জেনো’র প্যারাডক্স দিয়েছিলেন। জেনো বলতেন, কোন কিছু সরছে তার মানে এটা যে জায়গায় আছে সেখান থেকে সরছে অথবা যে জায়গায় নেই সেখানে সরছে। আর যেহেতু কোন বস্তু যেখানে সে নেই সেখানে সরতে পারে না তাই, বস্তুটি আসলে তার জায়গাতেই আছে। এর অর্থ হলো গতি বা মোশন এক ধরণের বিভ্রান্তি।

জেনো বলছেন গতি বলে কিছু নেই এমন কথা শোনার পর ডায়োজিনিস দ্য সিনিক নাকী উঠে হন হন করে চলে গিয়ে মোশন দেখিয়েছিলেন।

যাইহোক, এই জেনো টাইরান্ট নিয়ারচাসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নিয়েছিলেন। ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেনো বললেন, তিনি কিছু বলতে চান কিন্তু তা বলবেন কেবল নিয়ারচাসের কানে কানে।

শুনতে নিয়ারচাস কান এগিয়ে দিলে জেনো সর্বশক্তি দিয়ে তা কামড়ে ধরেন। তাকে আর ছাড়ানো যায় না। তাকে এই কামড়ে থাকা অবস্থানেই সেনারা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।