ভূমিকাঃ
জ্ঞানগুরু সক্রেটিস পজেটিভ কোন উত্তরে যান নি, নেগেটিভিটিতেই ছিল তার অবস্থান। এইজন্য জর্মন দার্শনিক জি ডব্লিউ এফ হেগেল সক্রেটিসের পদ্বতিকে অসম্পূর্ন ভেবেছিলেন, তার সমালোচনা ছিল এর বিরুদ্ধে। কিন্তু ড্যানিশ দার্শনিক সোরেন কীয়ের্কেগার্ড সক্রেটিসের এই নেগেটিভিটিতে থেমে যাওয়াকে উদযাপন করেছেন, একে মাহাত্ম্যপূর্ন হিসেবেই দেখেছেন। নেগেটিভিটি জ্ঞানের শুরু ও সম্ভাবনা, নেগেটিভিটি আরাধ্য!
মধ্যমাঃ
জ্যাক গিলেনহাল অভিনীত ফিল্ম এনিমিতে অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ দেখানো হয়েছে। ইতিহাসের শিক্ষক এডামরুপী গিলেনহাল ফিল্মের শুরুতেই এই বক্তব্য দেয়ঃ
“নিয়ন্ত্রণ, এর সব কিছুর মূলে নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি স্বৈরশাসকের একটা অবসেশন থাকে, এবং এটা হলো এই নিয়ন্ত্রণ। প্রাচীন রোমে তারা লোকদের খাদ্য এবং সার্কাস দিয়েছিল। তারা জনগনকে বিনোদন দিয়ে ব্যস্ত রেখেছিল কিন্তু অন্য একনায়ক ব্যবস্থা অন্য পদ্বতি অবলম্বন করে জ্ঞান ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রনের জন্য। কীভাব তারা করে? শিক্ষা ব্যবস্থার মান নামিয়ে দেয়, সংস্কৃতিকে সীমাবদ্ধ করে, তথ্যকে সেন্সর করে, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হ্রাস করে, এবং এটা মনে রাখা প্রয়োজন এই প্যাটার্ন ইতিহাসে বার বার হয়ে আসছে।”
ফিল্মটি ডেনিস ভিলেন্যুভ এর নির্মান, নোবেল বিজয়ী পর্তুগীজ লেখক হোসে সামারাগোর ‘ডাবল’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।
নিয়ন্ত্রণ প্রতিটি স্বৈরশাসক বা টোটালিটারিয়ান শাসন ব্যবস্থার জন্য দরকারী বিষয়। সাধারণত এটা করা হয়ে থাকে শক্তি প্রয়োগ করে। জনগণকে একটা সীমা বেঁধে দেয়া হয় তার প্রতিবাদ আন্দোলনের, এই সীমা লংঘন করলেই তাদের উপর নেমে আসে শাস্তির খর্গ কৃপান।
মূল কথাঃ
ইন্টারনেটের যুগে তথ্যের প্রবাহ অবাধ। এখানে নানা মত, আলোচনা, সমালোচনা বিভিন্ন রাজপথ প্রতিবাদী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। সেজন্য সরকার ব্যবস্থা চাইবে ইন্টারনেটে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে। হয়ত প্রায় সব বড় সরকারই এমনটা করে থাকে বিভিন্ন ভাবে। কিন্তু চাইনিজ সরকার কীভাবে তা করে, তা জানা গেছে।
২০১৪ সালে বড়সড় ইমেইল লিকের মাধ্যমে জানা যায় চাইনিজ সরকার তার প্রোপাগান্ডা মেশিন চালাচ্ছে ইন্টারনেটে সরকার পক্ষে মত জোরদার করার জন্যে। চীনের এই প্রোপাগান্ডা টেকনিক নিয়ে গবেষনা করেছেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্যারি কিং, স্ট্যানফোর্ড ইউনভার্সিটির জেনিফার প্যান, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়াগো’র মার্গারেট রবার্টস।
তাদের এই গবেষনা কর্মের মাধ্যমে এমন কিছু তথ্য জানা গেছে, যা আধুনিক ইন্টারনেট যুগে সরকারী সেন্সর বা নিয়ন্ত্রণ কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে।
প্রথম ব্যাপারটাই হলো, সাধারন ভাবে যা মনে হয়, সরকার কিছু লোককে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে যারা সরকারের হয়ে তর্ক বিতর্ক করে, সরকার বিরোধীদের মত খন্ডন করে; ঘটনা এমন নয় চাইনিজ সরকারের ক্ষেত্রে। তারা এর পরিবর্তে লোক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে ভালো ভালো (পজেটিভ) খবর শেয়ার দেয়ার জন্য। যে খবরগুলো ফেইক নয়, সরকারের পক্ষে যায় এবং গবেষকেরা বিশ্লেষণ করে যেসব খবর বেশী পেয়েছেন সেগুলি হলোঃ চাইনিজ সংস্কৃতি কেন অসাধারন বা কেন চীনে বসবাস অসাধারন, দেশপ্রেম, চাইনিজ খেলাধুলার দলগুলির সেরাত্ব ইত্যাদি নিয়ে।
গবেষকেরা এর নাম দিয়েছেন চিয়ারলিডিং কন্টেন্ট। এই ধরনের কন্টেন্ট শেয়ারের কারণ হলো, এর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনা এবং ব্যর্থতার খবরগুলি ঢাকা দেয়া। এইসব নিউজ এর অতি শেয়ার পরিচালনা করে সিরিয়াস ইস্যু থেকে জনগনের মনযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
এখানে প্রোপাগান্ডার কৌশলটা কখনোই এটা নয় যে, যেসব চিয়ারলিডিং কন্টেন্ট শেয়ার হচ্ছে সেগুলিতে জনগনকে বিশ্বাস করানো, বরং এই নিউজগুলি শেয়ার করা হয় যাতে সরকারের জন্য বিব্রতকর ইস্যুগুলিতে মানুষ কম মনযোগ দিতে পারে।
চাইনিজ সরকার চায় জনগন স্বাধীনভাবেই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করুক। এর মাধ্যমে তারা সোশ্যাল মিডিয়া মনিটর করেই জানতে পারবে মানুষ কী ভাবছে। যেসব সমালোচনা তাদের সাহায্য করে, যেমন কীভাবে জনগনকে আরো খুশী বা সন্তুষ্ট করা যায় ইত্যাদি তারা স্বাগত জানায়। কিন্তু যেসব সমালোচনা প্রতিবাদী ও বিক্ষোভ আন্দোলনে রূপ নিতে পারে তারা এগুলি সরিয়ে দিতে চায়।
চাইনিজ সরকার এই বিপদজনক সমালোচনাগুলি থেকে জনগনের দৃষ্টি সরাতে চায় তাদের প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে। চিয়ারলিডিং কন্টেন্ট শেয়ার করার জন্য প্রচুর মানুষকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জনমনে এমন ধারনা যে এদের সংখ্যা প্রায় দুইশ মিলিয়ন এবং এদের পঞ্চাশ সেন্ট করে দেয়া হয় প্রতি পোস্টের জন্য। তাই এদের নাম দেয়া হয়েছে পঞ্চাশ সেন্ট পার্টি। কিন্তু গবেষকেরা তাদের কত টাকা দেয়া হয় বা কতজন নিয়োগ দেয়া হয়েছে এর কোন হদিশ পান নি। কিন্তু তারা জানিয়েছেন যে বছরে প্রায় ৪৪৮ মিলিয়ন পোস্ট কমেন্ট ইত্যাদি সরকার প্রোপাগান্ডা স্বরূপ তৈরী করিয়ে থাকে।
সরকার এর স্বার্থে যায় এমন ভালো খবর, মন্তব্য শেয়ারের মাধ্যমে সিরিয়াস ইস্যু থেকে জনগনের মনযোগ বিচ্ছিন্ন করার এই ইউনিক পদ্বতিটি যেহেতু সাধারণ সেন্সরিং পদ্বতির মত হিংস্র নয়, এবং অনেক বেশী কার্যকরী; তাই এই পদ্বতি অনলাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো নানাভাবে প্রয়োগ হবে বিভিন্ন দেশে, একথা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর তথ্যের ছড়াছড়ি, মানুষের মনযোগের সময় খুবই অল্প হয়, এবং অন্য কোন নিউজের মাধ্যমে তার মনযোগ সরানো যায় অতি সহজেই।
পশ্চাতদেশ
চীনের এই তৎপরতার পিছনে কারণ হলো তাদের বর্তমান শাসন তান্ত্রিক অবস্থা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বড় শত্রু ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের সংযুক্ত হতে থাকা। যেটা গ্র্যান্ড মাস্টার লি কুয়ান ইউ বলে গেছেন, “প্রযুক্তি তাদের এই সিস্টেমকে বাতিল করে দিতে যাচ্ছে। ২০৩০ এর মধ্যে ৭০ ভাগ বা ৭৫ ভাগ লোক শহর, ছোট শহর, বড় শহর এবং বৃহৎ শহরে বাস করবে। তাদের কাছে থাকবে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট টিভি। তারা তথ্যসমৃদ্ধ থাকবে এবং একত্রিত হতে পারবে। এখন যেমন অল্প কিছু লোককে মনিটর করে, শান্ত রেখে শাসন করা যাচ্ছে, এইভাবে ঐ বিশাল সংখ্যক লোককে শাসন করা যাবে না।”
সুতরাং, এই বিশাল সংখ্যক লোককে নিয়ন্ত্রণের পন্থা নিয়ে চীনকে ভাবতে হচ্ছে।
উপসংহারঃ
গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের একটি অর্থপূর্ন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই ধরনের ম্যানিপুলেশন এবং নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে হবে, এর জন্য নাগরিকদের নিতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; এমনই আমাদের বলে এসেছেন নোয়াম চমস্কি। অনলাইন বাস্তবতা; ফেইক-নিউজ ও সত্যোত্তর যুগে এসে, সেই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আরো বেশী প্রয়োজন; এবং তাকে আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বার্থেই।