কোন ঘটনাই শেষ এবং স্থির নয় যতক্ষণ তা দুনিয়াতে ঘটছে। সব ঘটনার ফল থাকে, তা আরো কিছু ঘটনা তৈরী করে বা তৈরী করতে প্রভাব ফেলে। তাই কোন ঘটনাকে কেবল ঐ ঘটনা হিসেবে না দেখে তার পরের এবং তারও পরের ঘটনা কী হতে পারে সেইদিকে চোখ রাখা দরকারী।
কোন মানুষের জীবনে কোন ঘটনাই শেষ সফলতা নয়, এবং কোনভাবেই একজন মানুষের জীবনকে সুখী বলা যায় না যতদিন না পর্যন্ত সে মারা যায়। কারণ আজ সে সুখী থাকলে কাল অসুখী হবার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
এখানে লিডিয়ার রাজা ক্রসিয়াসের (৫৯৫ বিসি-৫৪৬ বিসি) কথা বলা যায়। তিনি প্রায় পনের বছর রাজত্ব করেছিলেন এবং ছিলেন এক সম্পদশালী রাজা।
হেরোটোডাসের বর্ননা মতে একবার প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞানী ব্যক্তি সলোন তার রাজ্যে গিয়েছিলেন। সম্পদের জন্য বিখ্যাত ক্রসিয়াস সলোনকে নানা ভাবে মুগ্ধ করার চেষ্টা করেন। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার দেখা সবচাইতে সুখী ব্যক্তিটি ক্রসিয়াস নয় কি?
সলোন না সূচক উত্তর দেন। তিনি বলেন ভাগ্যে কী আছে বলা যায় না। ফলে একজন লোকের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলা সম্ভব না এ ব্যাপারে।
রাজা এতে আহত হন। সলোন চলে যান।
এরপর দূর্ভাগ্য নেমে আসে ক্রসিয়াসের উপরে। তার ছেলে মারা যায়, তার সম্পদের জন্য আক্রমণ করেন পারস্যের রাজা সাইরাস।
ক্রসিয়াস পরাজিত হন। তাকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তিনি সলোনের নামে চিৎকার করতে থাকেন।
সাইরাসের আগ্রহ হয়। তিনি জানতে চান ঘটনা কী।
ক্রসিয়াস তাকে সব বলেন। সলোনের কথা যে ঠিক তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
সাইরাস এরপর তাকে মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি দেন।
এক বর্ননামতে, এই হলো রাজা ক্রসিয়াসের গল্প।
আরেকটি ফেবল বা রূপক গল্প আছে এমন।
এক লোকের ঘোড়াটি হারিয়ে গেল একদিন।
প্রতিবেশীরা বলল, “দুঃখজনক! তোমার কী দূর্ভাগ্য!”
লোকটি বলল, “দেখা যাক।”
কিছুদিন পরে লোকটির ঘোড়া আরো ২০ টি বন্য ঘোড়া নিয়ে ফিরে এলো। লোকটি এবং তার ছেলের তখন ঘোড়ার সংখ্যা দাড়াল একুশটি।
প্রতিবেশীরা বলল, “কী সৌভাগ্য তোমার! তোমার আনন্দে নাচা উচিত।”
লোকটি শান্তভাবে বলল, “দেখা যাক।”
ঘোড়া দেখাশোনা করতে গিয়ে ঘোড়ার আঘাতে পা ভেঙে গেল লোকটির একমাত্র ছেলের।
প্রতিবেশীরা এবার বলল, “দূর্ভাগ্য তোমার! আমরা দুঃখিত।”
লোকটি বলল, “দেখা যাক।”
কয়দিন পর দেশে যুদ্ধ লাগল। সেনাবাহিনীতে লোক নেয়া শুরু হলো। সব সুস্থ ও যুবক ছেলেদের যুদ্ধে নেয়া হলো। লোকটির ছেলে বেঁচে গেল পা ভাঙা থাকার জন্য।
এবার প্রতিবেশীরা লোকটিকে বলল, “তুমি কী ভাগ্যবান!”
লোকটি আগের মতোই শান্তভাবে বলল, “দেখা যাক।”
কোন ঘটনাই স্থির নয়। সফলতা বা ব্যর্থতা কিছুই স্থির নয়। এদের দু’জনের সাথেই একইরকম আচরন করার কথা বলেন রুডিয়ার্ড কিপলিং-
If you can meet with Triumph and Disaster
And treat those two impostors just the same;
চীনের দার্শনিক মেনসিয়াসের জীবনের ঘটনা বলে এই লেখাটি শেষ করা যায়। ঘটনাটি মাইকেল পুয়েট ও ক্রিস্টিন গ্রস লো এর লেখা দ্য পাথ বইতে আছে। মেনসিয়াস ছিলেন কনফুসিয়ান ধারার দার্শনিক। তিনি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন রাজার উপদেষ্টা হবেন, রাজা তার উপদেশ শুনে দেশ চালাবেন। কনফুসিয়াসের আদর্শ মত একটি সুখী দেশ গড়ে উঠবে। তিনি অনেক রাজার কাছে গিয়েছিলেন তার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু কেউ রাজী হন নি।
অবশেষে কুই রাজ্যের রাজা রাজী হলেন। তাকে উপদেষ্টা বানালেন। মেনসিয়াস কিছু লোক পেলেন যারা তার কথা শুনত। এটা ছিল তার জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা তখন।
কিন্তু কিছুদিন পরে মেনসিয়াস লক্ষ করলেন তিনি যা ভেবেছিলেন তা নয়। রাজা আসলে তার কথা শুনছেন না। বরং তাকে ব্যবহার করে অন্য রাজ্য আক্রমণের ন্যায্যতা তৈরী করছেন।
বিষন্ন হয়ে পড়লেন মেনসিয়াস। তিনি দেখলেন যা ছিল তার সবচাইতে সফলতা তাই হয়ে গেল সবচাইতে বড় ব্যর্থতা। তিনি হতাশ হয়ে তার গ্রামে ফিরে গেলেন। এবং আবার ভাবতে লাগলেন জীবন সম্পর্কে। সেইসব ভাবনাই তাকে গুরুত্বপূর্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে, এবং আধুনিক দুনিয়ায় তার সেই সব ভাবনা জনপ্রিয় হয়ে আছে, মানুষের কাজে লাগছে। অর্থাৎ, সবচাইতে বড় ব্যর্থতাটি আবার যেন সফলতাই হয়ে গেল, বা সফলতায় প্রভাব রাখলো।