আমাদের এখানে ক্রিকেট জনপ্রিয় কেন?

  ক্রিকেট ও আভিজাত্য  

উপমহাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় খেলা। ইন্ডিয়ায় ক্রিকেট কেন জনপ্রিয় তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলো দ্য ইকোনমিস্ট। ভারতের এত জনসংখ্যা, সারা দেশে মানুষেরা তো আর ধনী না; তাহলে ক্রিকেটের মত এত ব্য্যবহুল খেলা কেন জনপ্রিয় হয়? কেমনে হয়?

ভারত হকিতে লাগালাগা ছয় বার (১৯২৮-১৯৫৬) অলিম্পিক মেডেল জিতছিল। কিন্তু তাও হকি ক্রিকেটের চাইতে জনপ্রিয় হইতে পারে নাই। আর এমনো না যে শুরু থেকে ইন্ডিয়া ক্রিকেটে খুব ভালো ছিল। তারা আস্তে আস্তেই উন্নতি করছে। এবং বিশ্বসেরার কাপ তাদের হাতে উঠল এই ধোনির যুগেই।

ইকোনোমিস্ট এই মত দিল, ক্রিকেট ছিল ইংরাজদের খেলা। ইংরাজ শাসকেরা যারা ইন্ডিয়ায় ছিলেন, কর্মচারীরা ছিলেন; এরা ক্রিকেট খেলতেন। যেহেতু এটা ইংরাজ শাসকেরা খেলতেন তাই ইন্ডিয়ার এলিটেরা তা গ্রহণ করলো। ক্রিকেট খেলারে তারা মর্যাদাপূর্ন মনে করতে লাগল। ইন্ডিয়ার সমাজে বর্নবাদ বা কাস্ট সিস্টেম আছে। তাই ধনীরা, এলিটেরা ক্রিকেট খেলার মাধ্যমে তাদের আভিজাত্য দেখানির একটা সুযোগ পাইল যেন।

তবে ইংরাজরা জোরেসোরে নেটিভদের মাঝে এই খেলা শুরু করছে এমন না। হয়ত তাদের এমন কোন উদ্দেশ্যও ছিল না যে এই খেলা ছড়াইয়া দিতে হবে। তারা খেলত আর তার দেখাদেখি দেশী অভিজাতরা তা গ্রহণ করছেন।

                                ক্যাপ্টেন কুক ও স্কার্ভি বিত্তান্ত

এই ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন কুকের কথা স্মরণে আসে। গ্রেট ক্রিকেটার ক্যাপ্টেন কুক নন, গ্রেট নাবিক ক্যাপ্টেন কুক।

তিনি তখন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বাইর হইতেন। সেই সময়ে স্কার্ভি ছিলো জাহাজে আতংক। নাবিকেরা এতে মারা যাইত। ভয়ংকর একটা ব্যাপার ছিল যাত্রার কালে এই রোগে জাহাজে অনেক নাবিকের মৃত্যু। তাই প্রায় সবাই এই রোগের ব্যাপারে আগ্রহী হইয়া উঠল। তখন ভিটামিন সি কী লোকে জানে না। বুদ্ধিমান ক্যাপ্টেন কুক ভিন্নভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি খোঁজ নিয়া দেখলেন ডাচ জাহাজে স্কার্ভি হয় না নাবিকদের। তখন তিনি দেখতে গেলেন ডাচ জাহাজে তারা কী এমন ভিন্নকিছু করে যার জন্য নাবিকদের স্কার্ভি হয় না।

তিনি গিয়া ভিন্ন যে জিনিস পাইলেন তা হইল বাঁধাকপির আচার। বাঁধাকপিরে কাইটা ল্যাকটিক এসিডের মাধ্যমে এক ধরনের টেংগা আচার বানানি হয় যা অনেক দিন ভালো থাকে। ডাচ জাহাজে তারা এই আচার খাইত।

ক্যাপ্টেন কুক ভাবলেন হয়ত এই কারণেই এদের স্কার্ভি হয় না। এটা ছিল তার ইনসাইট। তিনি ঠিক করলেন নিজের সমুদ্র যাত্রায়ও এই বাঁধাকপির আচার নিয়া যাইবেন। কিন্তু তখনকার সময়ে ইংরাজ জাহাজের নাবিকেরা ছিল মারাত্মক, এদের হ্যান্ডেল করা সহজ ছিল না। এরা আবার বাঁধাকপি দেখতে পারত না।

তো কুক বুঝতে পারলেন এদের স্কার্ভি প্রতিরোধে বাঁধাকপির আচার খাওয়াইতে গেলে এরা তা মানবে না। উলটা অতি দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় যাওয়া হইতেছে যাতে স্কার্ভির ভয় আছে, এইটা ভাইবা বিদ্রোহ কইরা বসবে। তাই তিনি একটু ভিন্ন পন্থায় হাটলেন। শ্রমিকদের স্বাভাবিক খাবার দেয়া হইল আর অফিসারদের অন্য খাবারের সাথে বাঁধাকপির আচারও দেয়া হইতে লাগল। শ্রমিকদের দেখাইয়া দেখাইয়া এটা করা হইল। শ্রমিকেরা ভাবতে লাগল এইটা নিশ্চয়ই উৎকৃষ্ট কোন খাবার। 

এইরকম কয়েকদিন চলার পরে ক্যাপ্টেন কুক ঘোষনা দিলেন, তাইলে এখন থেকে সপ্তাহে একদিন শ্রমিকদিগকেও এই আচার দেওয়া যাইতে পারে।

তখন যখন শ্রমিক নাবিকদিগকে আচার দেয়া হইল তারা আগ্রহের সাথে গ্রহণ করলো। জাহাজের সবাই আয়োজন কইরা খাইল তা। ক্যাপ্টেন কুকের উদ্দেশ্য সফল হইল। আর তিনি স্কার্ভি প্রতিরোধ করতে সক্ষম হইলেন। এইটা এক মজার এবং বুঝার মত ঘটনা।

                      ক্রিকেট ও মানুষের অথরিটি মানার প্রবণতা

প্রাচীন রোমানেরা ব্লন্ড চুল লাইক করত না। কারণ ব্লন্ড চুলে বুঝাইত প্রস্টিটিউট বা ফ্রেঞ্চ/জার্মান দাস। তাই যেসব রোমানদের চুল ব্লন্ড ছিল এরা চুল কালো করত কালার দিয়া। কিন্তু অগাস্টাস সিজার সম্রাট হইবার পর থেকে এই ট্রেন্ড হ্রাস পাইতে থাকে। অগাস্টাস সিজার ছিলেন ব্লন্ডচুলী। তাই লোকেরাও আর ব্লন্ডচুলে অস্বস্থি ফীল করত না।

অথরিটিরে, অভিজাতরে মানুষ যুগে যুগে মাইনা আসছে এইভাবে, চেতনে বা অবচেতনে।

ইংরাজরা যাওয়ার পরে ভারতের শাসক হইলেন বা পাওয়ারফুল হইলেন ধনীরা, এলিটেরা। তারা আভিজাত্যের চিহ্ন স্বরূপে চালাইয়া গেলেন ক্রিকেট খেলা। একটা আভিজাত্য, রাজনৈতিক তাৎপর্য পাইল এই খেলা যা এখনো রইয়া গেছে। ইন্ডিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ইন্ডিয়ান পার্লামেন্টের হইয়া ব্যাট হাতে ওপেন করছিলেন। এইরকমভাবে আর কোন খেলারে অভিজাতেরা তাৎপর্যপূর্ন বলে প্রমোট করে নাই। 

যেহেতু অথরিটির খেলা হইল ক্রিকেট তাই সারাদেশের লোকের মনে অথরিটির খেলা ক্রিকেট একটা সমীহজনক আসন পাইয়া গেল।

এইরকমভাবে ইন্ডিয়ায় ক্রিকেটের জনপ্রিয় হওয়া, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে ক্রিকেটের জনপ্রিয় হওয়ারেও ব্যাখ্যা করে। কারন যে সময়ের কথা বলা হইতেছে ওইসময়, যখন ইন্ডিয়া পাকিস্তান ভাগ হইল তখন দুই দেশেই পাওয়ারফুল হইছিলেন অভিজাতরা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটু ভিন্ন বলা যাইতে পারে। বাংলাদেশে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের ক্রিকেট জনপ্রিয়তার প্রভাব আইসা লাগছে। পাকিস্তানের ক্রিকেটেরও প্রভাব লাগছে। তার উপর বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় এবং ততদিনে ক্রিকেটের বাণিজ্যিক ভ্যালু তৈরী হইয়া গেছে।

অথরিটির খেলা হইলেই পাবলিকে তা নিবে কেন এই ধরনেরও একটা প্রশ্ন আসতে পারে। মানুষের একটা সাইকোলজিক্যাল টেন্ডেসি আছে অথরিটিরে মানার, অনুসরন করার। আর আমাদের এই অঞ্চলে আরো বেশী, এখানে রাজতন্ত্র ছিল। রাজারে মানা হইত নিঃসংকোচে। বাংলার মসনদে যখন মুসলমান সুলতানেরা বসলেন তখন এক পর্যায়ে তারা হিন্দু ছোট ছোট রাজাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাইখা চলতেন। দেশে তখন সুফী উলেমারা ছিলেন। এরা মুসলমান শাসকেরা আসবার আগে থেকেই এখানে আসছিলেন। তাদের অনুসারীও তৈরী হইছিল বেশ। মুসলমান শাসকদের সাথে এই উলেমাদের একটা দ্বন্দ্ব ছিল। উলেমারা মনে করতেন ইসলাম অনুযায়ী খলিফা হইলেন তারা, ধর্ম বিষয়ে তাদের মতই গ্রহণ করতে হবে সুলতানরে। কারণ ইসলামে রাজতন্ত্রের বেইল নাই। আর সুলতানেরা দেখলেন এই দেশে রাজতন্ত্র নামে চমৎকার এক জিনিশ আছে, রাজা হইয়া গেলেই হয়। দেশের লোকে বিনা বাক্যব্যায়ে রাজারে মানে। তাই তারা সর্বময় ক্ষমতার রাজা তথা সুলতান হইতেই মনস্থ করলেন এবং হিন্দু ছোট ছোট রাজা যারা ছিলেন তাদের সাথে মিলমিশ কইরা চলতে লাগলেন, উলেমাদের অসন্তুষ্ট কইরা। এই কথা এখানে বলার উদ্দেশ্য হইল আমাদের ঐতিহাসিক রাজতন্ত্রের শক্তিটারে সামনে আনা। এর প্রভাব এত বেশী ছিলো যে মুসলিম শাসকেরা যারা আইছিলেন এরা ধর্মীয়ভাবে রাজতন্ত্রে বিশ্বাস না করলেও পরে তা মাইনা নেন নিজেদের স্বার্থে।  

এই রাজতন্ত্র মানার টেন্ডেসিই আমাদের অভিজাত অথরিটি মানার টেন্ডেসিরে আরো জোরালো করছে বলে মনে হয়। এইজন্য অথরিটির খেলা হিশাবে ক্রিকেট শক্তভাবে গৃহীত হইছে জনমনে।

                বানিজ্যিক ভ্যালু ও আমাদের নয়া কুটির শিল্পের ইতিহাস

আধুনিককালে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার আরেক কারণ এর বাণিজ্যিক ভ্যালু, এর সাথে আসে মিডিয়ার প্রচার প্রচারনা। ক্রিকেট দীর্ঘ সময় ধইরা হয়, একটা উত্তেজনা বজায় থাকে। এর সাথে একটা অনিশ্চয়তায় থাকে প্রতি বলে। ফলে, জুয়া নামক মহান খেলাটির খেলোয়াড়েরা ক্রিকেটরে দারুণ লাইক করেন। ক্রিকেটের সাথে এখন জুয়া এবং জুয়ারী নামগুলা দৌড়াইয়া আসে। তারা বিরাট অংকের বাণিজ্য করেন ক্রিকেট নিয়া। খেলোয়ার কেনেন, অফিশিয়ালস কেনেন, খেলা আয়োজন করেন। এইরূপ নানাবিদ কাহিনী শোনা যায়। উনারা জুয়ার বড় শিল্পী তথা শিল্পপতি।

আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকায় বিপিএল, আইপিল ইত্যাদি টুর্নামেন্টের সময় স্বল্পপরিসরে জুয়া খেলা চালাইয়া যান স্থানীয় খেলোয়াড়েরা। ইমরান হাশমীর জান্নাত নামে একটা ফিল্ম ছিল যেইখানে তিনি ক্রিকেট জুয়ারী ছিলেন। সম্ভবত এই ধরনের পপুলার মাধ্যমে ক্রিকেট জুয়ার উপস্থাপন জুয়ারে আরো পপুলার করছে।

আমাদের এই ছোট ছোট জুয়ার কুটির শিল্পগুলো দিনে দিনে বড় হচ্ছে। জুয়া একটা দারুন খেলা। এই পৃথিবী চলে রিওয়ার্ড আর পানিশম্যান্টের উপরে। আমাদের আদি মোরালিটিও তৈরী হইছিল এই পুরস্কার ও শাস্তির বেসিসে। জুয়ার যে পুরস্কার তার অনিশ্চয়তা এরে আরো লোভনীয় কইরা তুলে এবং এর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করতে থাকেন খেলায় অংশগ্রহণকারীরা। তারা বারে বারে খেলেন। কেউ লস করলে সেই অর্থ উদ্ধারের জন্য আরো খেলেন। আর দিন শেষে শূন্য রানেই ঘরে ফেরেন।

আমি আতংকিত বোধ করছিলাম যখন শুনতে পাইলাম পরিচিত একজন এই ধরনের জুয়ায় আসক্ত। এক সন্ধ্যাতেই নাকী তাদের লাখ টাকা লাভক্ষতি হইয়া যায়। রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়া যাচ্ছেন খেলাটারে।

প্রথম প্রমথ চৌধুরী একবার বলেছিলেন, “যে খেলার ভিতর আনন্দ নেই কিন্তু উপরি পাওনার আশা আছে, তার নাম খেলা নয়, জুয়াখেলা।”

যারা জুয়া খেলার জন্য খেলা দেখেন, এদের মধ্যে আনন্দের চাইতে উপার্জন বা অর্থনৈতিক লাভটাই বেশী কাজ করে। ফলে, ঐ খেলা দেখাটাও অদ্ভুত হয়ে যায়। আনন্দ বিদায় নেয় চিত্রপট হতে।

                 ক্রিকেটে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও আমাদের ভ্রান্তিসুখ

উপমহাদেশে ক্রিকেটের লগে রাজনীতিটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়াইয়া গেছে, যেহেতু এইখানে খেলাটার শুরুই হইছে রাজনৈতিক আবহে। এখন যাবতীয় উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ দেখা যায় বিভিন্ন ক্রিকেট পেইজের কমেন্ট বক্সে। ইভেন, লাস্ট ইংরাজ টিমরে যে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম টেস্টে হারাইল তখন এটারে তুলনা দেয়া হইল পলাশীর যুদ্ধের লগে। ক্রিকেটার মিরাজের ছবি দিয়া বানানি হইল মিরাজ-উদ-দৌলা। যদিও, সিরাজ, বাংলার নবাব পরাজিতই হইছিলেন, আর পলাইতে গিয়া হইছিলেন কতল।

ইন্ডিয়ার লগে বাংলাদেশের খেলা হইলেও আমাদের জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম দেখা যায়। পাকিস্তানের লগে জিতলে বলা হয় একাত্তরের প্রতিশোধ! কিন্তু ক্রিকেট আসলে নিছকই এক খেলা। বিনোদন। বাংলাদেশ টেস্টে আর ওয়ানডেতে যদি ইন্ডিয়ারে হোয়াইট ওয়াশও করে তবুও যেইসব ইস্যুতে ইন্ডিয়া বাংলাদেশরে অধিকার খর্ব করতেছে, অন্যায় করতেছে তার মীমাংসা হয় না। ওগুলা কূটনৈতিক বিষয়, বাংলাদেশের কূটনৈতিক পর্যায়ের বিচক্ষণতার উপর এদের সমাধান অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই, জনগণের ঐসব ইস্যুতে দাবী থাকা উচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে, অথরিটির কাছে; মাশরাফিদের কাছে নয়। আর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম বা অন্য কোন দেশের ক্রিকেট টিম; তাদের ক্রিকেট টিমই। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারনী ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা নাই।

ইংরাজ টিমরে হাজার টেস্টে হারাইলেও যাবে না দুইশ বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। তাই এতে বৃথা শান্তি খুঁজে পাওয়ার কিছু নাই।

পাকিস্তানরে একশোবার হারাইলেও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শাসক ও সামরিক বাহিনীর করা অকথ্য নির্যাতনের প্রতিশোধ হয় না। এমন কিছু বলা মুক্তিযুদ্ধরে ছোট করে আসলে।

ক্রিকেটিও অর্জনের বিচার করা হবে ক্রিকেটের হিশাবে।

                        খেলার অথরিটি প্রমোটঃ ভালো ও মন্দে

যুগে যুগে অথরিটি মানুষরে বিনোদন দ্বারা ব্যস্ত রাখতে চায়। এর জন্য বাইছা নেয় পপুলার খেলাটারে। বাংলাদেশে ক্রিকেটরে নেয়া হইছে। ইন্ডিয়াতেও। এটা খুব কাজে দেয় মানুষরে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে। তবে ভালো কাজেও এই নিয়ন্ত্রণ বা খেলার ম্যানিপুলেশন ব্যবহার করা সম্ভব। ভালোর অন্তত একটা উদাহরণ তো আছেই। মন্দের উদাহরণ অসংখ্য হইছে এবং হইতেছে। তাই কেবল ভালোটাই বলা যাক। 

সেটা গ্রেট নেলসন ম্যান্ডেলা করেছিলেন। অনেক ঝামেলার পরে, গৃহযুদ্ধ প্রায় ঠেকাইয়া ম্যান্ডেলা তখন প্রেসিডেন্ট হইছেন সাউথ আফ্রিকার। তখন তার প্রধান কাজ ছিল, ফাদার অব দ্য নেশন হইয়া শাদা (আফ্রিকানার) আর কালোদের একত্র করা। শাদাদের মধ্যে সবাই তারে বিশ্বাস করত না। ডানপন্থী উগ্ররা আবার জড়ো হইতে শুরু করছিলো। একসময় শাদা-কালা সংঘাতের থ্রেট ভয়ংকর আকার ধারন করতে শুরু করলো, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ তে। তখন ম্যান্ডেলা এক দারুণ জিনিশ প্রয়োগ করলেন শাদাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য। তা হইল রাগবি।

রাগবি আছিল সাউথ আফ্রিকার শাদাদের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলা। এইজন্য কালো অধিকার আদায়ের সংগ্রামীরা এটা ডিজলাইক করত। তারা মনে করত এই খেলাটা কালাদের উপরে শাদাদের অত্যাচারের প্রতীক। ম্যান্ডেলার পার্টি এএনসি একসময় সাউথ আফ্রিকা যাতে বিশ্ব রাগবি থেকে বাইর হইয়া যায় এই চেষ্টা করছে। এবং তারা সফলও হইছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হইয়া, দেশের শাদা ও কালারে একত্র করতে ম্যান্ডেলা এই রাগবিরই জয়গান গাইলেন। তিনি বিশ্বকাপ আয়োজন সাউথ আফ্রিকাতে আনলেন।

তিনি জাতীয় দলের ক্যাপ্টেনের লগে গিয়া ফ্রেন্ডশীপ করলেন। ১৯৯৫ সালে যখন ফাইনালে অষ্ট্রেলিয়া আর সাউথ আফ্রিকা রাগবিতে মুখোমুখি হবে, ম্যান্ডেলা আগেরদিন গেলেন ট্রেনিং ক্যাম্পে। গিয়া সাউথ আফ্রিকান প্লেয়ারদের উৎসাহ দিলেন। তাদের গিয়া বললেন, আপনারা পুরা জাতির জন্য খেলতেছেন। শাদা আর কালা সবাই আপনাদের সাথে আছে।

আর ফাইনালের দিন নিজেই জার্সি আর ক্যাপ পইরা গেলেন। খেলার আগে তিনি যখন লম্বা পা ফেইলা গিয়া ক্যাপ্টেনরে গ্রীট করলেন, তখন জোহানেসবার্গের এলিস পার্কে শত শত শাদা দর্শকেরা চিল্লাইয়া উঠল, নেলসন, নেলসন বইলা!

এইভাবে ম্যান্ডেলা শাদাদের ভিতর থেকে ভয় দূর করেন। আর সাউথ আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ ঠেকাইতে, সাউথ আফ্রিকারে সংহত করতে তিনি খেলারেও ব্যবহার করলেন।

  

এখানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার আরেক কারণ ও আমাদের শাদা সিধা ক্রিকেট

এখানে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার আরেক কারণ হইল তা কম পয়সায় খেলা যায়। আমরা যখন খেলতাম টেনিস বলের দাম ছিল পনরো টাকা মনে হয়। আর একটা ব্যাট হইলেই হয়। তিন জন হইলেই খেলা যায়। জায়গা অল্প হইলে হয়। রাস্তাতেও খেলা যায়। মেগ বৃষ্টির দিনে ঘরে খেলা যায় বা ঘরের দাইড়ে খেলা যায়।

আগে অথরিটি বা অভিজাত প্রভাবে ক্রিকেট গৃহীত হইছে। কিন্তু জনপ্রিয় হইছে এর সহজতার জন্য। সহজে খেলা যায় এইজন্য।

মজার জন্য খেলতে তো ব্যাট প্যাড হেলমেট লাগে না।

আমার ভাই একটা ক্রিকেট বাইর করছিলো পিচ্চি পিচ্চি, আট দশ ইঞ্চি সাইজের ব্যাট বানাইয়া। বল বানাইত কাঠরে কাইটা গোল করে বা সুপারি দিয়া। এইটাও অনেক খেলছি। ক্রিকেট যত খেলা হইছে আমার আর কোন খেলা এত হয় নাই।

নির্মল আনন্দের জন্য খেলা হইত ঐ ক্রিকেট। ভালোবাসার ক্রিকেট।

এখনো খেলা দেখতে বইলে ওই আনন্দের জন্যই বসি। এই ক্রিকেটাররা যারা আছেন,  এবং প্রাক্তনেরা, সবাইরে আপনজন মনে হয়। একবার কমান্ডো ট্রেইনিং এ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আইছিল সিলেট ক্যান্টনমেন্টে। আমরা তখন কলেজ থেকে তাদের দেখতে গেছিলাম। তখন কী উত্তেজনা! অটোগ্রাফ কালেক্ট করছিলো হোস্টেলের প্রায় সবাই বোধহয়।

ক্রিকেটাররা ধরেন একটা বাজে শট খেইলা আউট হইল। তখন খারাপ লাগে। কিন্তু তবুও আসলে মনের গভীরে এই বিশ্বাস থাকে যে, সে তো ইচ্ছা কইরা আউট হয় নাই। কেউ কী ইচ্ছা কইরা আউট হয়! সে তার সর্বোচ্চটাই দিতে চাইছে। দিনশেষে তাই ক্রিকেটারদের জন্য লাইকই বরাদ্ধ থাকে। তা সব দেশের ক্রিকেটারদের জন্যই। বাংলাদেশ এবং প্রিয় ক্রিকেটারদের জন্য একটু বেশী বেশী।

নভেম্বর ২০১৬’তে লেখা।