মুরাদুল ইসলাম » গল্প » গল্পঃ শেষ অস্ত্র

গল্পঃ শেষ অস্ত্র

ইঁদুরের উপদ্রব এতোই বেড়েছে যে, তাদের যন্ত্রণায় বেঁচে থাকাটা দায় হয়ে পড়েছে। আব্দুর রহমান সাহেব তার এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে এমন ইঁদুরের বিস্তার দেখেন নি। সারা বাড়িতে ইঁদুর আর ইঁদুর। দিনে দুপুরে দেখা যায় ইঁদুরেরা দলবল নিয়ে ঘোরাঘোরি করছে।

এতোসব ইঁদুরকে নিধন করা বিড়ালের কাজ নয়। বিড়ালেরা তাই অসহায়, তারা আত্মসমর্পন করে বসে আছে। আব্দুর রহমান সাহেবের বাড়িতে তিনটি বিড়াল। তারা ইঁদুর মারে না, ইঁদুরের পিছনে ধাওয়াও করে না। ভাত মাছ যা পায় খায়, ইঁদুরদের ঘাঁটাতে যায় না।

ভাতের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে ইঁদুর মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। মরেছেও অনেক। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয় নি। ইঁদুরেরা খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে। যে হারে মরেছে তার চাইতে বেশি বেড়েছে। ফলে গণিতের অলঙ্ঘনীয় নিয়ম মতেই ইঁদুরদের সংখ্যাধিক্য হয়েছে। হয়েই চলেছে।

বায়োলজিতে কীসব ব্যাপার স্যাপার আছে। কোন এক সিস্টেমে কোন এক প্রাণীর সংখ্যা এভাবে বেড়ে যেতে পারে না। এতে বাস্তুসংস্থান তাল হারিয়ে ফেলে, হয়ে যায় টালমাটাল। ফলশ্রুতিতে, এক নীরব কলকাঠি থাকে প্রকৃতির হাতে, যা সিস্টেম সন্নিবেশিত প্রাণীকূলের সংখ্যাকে এক সাম্যাবস্থায় রাখে।

আব্দুর রহমান সাহেবের বাড়িতে এটি রক্ষিত হচ্ছে না। এক প্রাণী বেড়েই চলেছে। কেন এমন হচ্ছে, কে জানে!

আব্দুর রহমানের দাদা হারিছ চৌধুরী ইঁদুর পুষতেন এই জন্যই কী?

এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যায় না। কারণ এমন হওয়াটা স্বাভাবিক যে, বাস্তব জীবনে অনেক অনেক প্রশ্ন থাকে যেগুলির উত্তর জানা যায় না।

আব্দুর রহমানের মেজাজ খিচরে আছে। তিনি তার বড় ছেলে মজনু শেঠকে একটু আগে বলেছেন একটা ইঁদুর ধরে আনতে। ইঁদুর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য সর্বশেষ যে অস্ত্র তার কাছে আছে, আজ তিনি সেটিই প্রয়োগ করবেন। কাল রাতেই মনস্থির করে ফেলেছেন। যা হবার হবে।

এতদিন তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। আশা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। গ্রামের বাঁশঝাড়ে বাঁশঝাড়ে তীক্ষ্ণ নজর রেখে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রবকে সহ্য করে যাচ্ছিলেন বাঁশঝাড়ের দিকে চেয়ে। শুনতে অবিশ্বাস্য ও উদ্ভট মনে হলেও এটা সত্য।

আব্দুর রহমান ধারণা করেছিলেন বাড়িতে ইঁদুরের উপদ্রব আসলে একটি সংকেত। বাঁশঝাড়ে ফুল আসার সংকেত। কত শত বছর পরে পরে নাকি এমন হয়। বাঁশঝাড়ে ফুল আসে। দুই তিনশ বছর পরে পরে মনে হয়। আব্দুর রহমানের ঠিক ইয়াদ নেই।

তবে তিনি নিশ্চিত, একথা তার দাদীর মুখে শুনেছেন। দাদী তার তখন থুত্থুড়ে বৃদ্ধ। ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, জমাদার শেঠ আলুর ক্ষেতে বাক্সভর্তি সোনার মোহর পেয়েছিল যেই সময়, তখন বাঁশঝাড়ে এসেছিল ফুল, আশ্চর্য ঘটনা।

এই জমাদার শেঠ আব্দুর রহমানের নিকঠ পূর্বপুরুষ।

আচ্ছা, এইজন্যই কি আব্দুর রহমান সাহেবের দাদা ইঁদুর পুষতেন খাঁচায়, লেজ কেটে দিয়ে?

আব্দুর রহমান অনেক বাঁশঝাড়ে ঘুরেছেন। নানা গ্রামে খবর লাগিয়েছেন। দিন গেছে। দিনে দিনে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়েছে বাড়িতে। কিন্তু কোথাও বাঁশঝাড়ে ফুল আসার খবর আসে নি।

তাই, আব্দুর রহমান শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তার জানা শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি ইঁদুরদের সমূলে নিধন করবেন। অব্যর্থ অস্ত্র।

মজনু শেঠ ইঁদুর ধরে নিয়ে এসেছে। ঘাড় বাঁকা এক ইঁদুর।

আব্দুর রহমান হাতের সুঁই ও কালো সুতা নেড়ে বললেন, এরে উলটা কইরা ধর, বান্দির পুলা।

মজনু শেঠ ইঁদুরকে উলটা করে ধরে।

অল্প দূরে ভীড় জমিয়েছে বাড়ির ছেলে বুড়োরা। তারা কৌতূহল নিয়ে দেখছে আব্দুর রহমানের কার্যকলাপ। কিন্তু কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছে না।

আব্দুর রহমান ছেলের দিকে খেঁকিয়ে উঠলেন, বান্দির পুলা, মাথা চাইপা ট্যাং শক্ত কইরা ধর।

ছেলে মজনু শেঠ বাপের কথামতো তাই করে। আজকের গালিতে তার মন খারাপ হয় না। কারণ তার ভিতরেও কৌতূহল।

ইঁদুরকে শক্ত করে ধরা হয়েছে। ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দ করছে ইঁদুর।

আব্দুর রহমান বললেন, উঁচা কইরা ধর, আমার সামনে আন।

ছেলে ইঁদুরকে আব্দুর রহমানের মুখের সামনে নিয়ে আসে।

আব্দুর রহমান বলেন, শক্ত কইরা ধরবি। ছাড়বি না। মইরা গেলেও ছাড়বি না। ছাড়লেই সব শেষ।

ছেলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আব্দুর রহমান লম্বা সুঁই নিয়ে ইঁদুরের পশ্চাতদেশ সেলাই করতে থাকেন। ইঁদুরের আর্তচিৎকার শুরু হয়।

মজনু শেঠ শক্ত করে ধরে রাখে। উত্তেজনায় তার নাক ঘেমে যায়।

অল্প দূরে থাকা বাড়ীর লোকেরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে যেন দেখতে থাকে।

এই ইঁদুরকে পশ্চাতদেশ সেলাই করে ছেড়ে দেয়া হবে। এটি দৌড়ে যাবে তার দলের কাছে। সে যন্ত্রণা পেতে পেতে একসময় মারা যাবে।

কিন্তু এই যন্ত্রণায় দিনগুলিতে, এই চূড়ান্ত ভয়াবহতার দিনগুলিতে তাকে যেসব ইঁদুরেরা দেখবে, তারা ভয়ে এই বাড়ী ছেড়ে পালাবে। আর কখনো আসবে না।

এমনই হয়। এমনই হয়ে আসছে।

২৮ জানুয়ারি, ২০১৯

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং