ক্রিপ্টো এক- নেটওয়ার্ক ইফেক্ট, কেন্দ্রহীন ব্যবস্থা ও ক্রিপ্টো

আপনারা নিশ্চয়ই ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিটকয়েন, ব্লকচেইন এসবের ব্যাপারে শুনেছেন। শোনার কথা। কারণ ডিসেম্বর ২০১৭ তে ক্রিপ্টোকারেন্সির মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ছিল ৮০০ বিলিয়ন ডলার। নভেম্বর ২০১৮ তে, প্রায় ১২ মাস পরে তা কমে দাঁড়ায় ১৮২ বিলিয়ন ডলারে। সুতরাং, এটি দুনিয়ার একটি ইন্টারেস্টিং ঘটনা।

নেটওয়ার্ক ইফেক্ট নামে দারুণ একটা জিনিস আছে। ধরা যাক, আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আপনার কাছে অত্যাধুনিক একটা মোবাইল দেয়া হলো। দেশের বা দুনিয়ার আর কারো কাছে মোবাইল নেই। তখন আপনার মোবাইল কি আপনাকে কোন ভ্যালু দিতে পারবে, মোবাইলের মূল ভ্যালু দূরের লোকজনের সাথে কথা বলা ধরে নিলে?

পারবে না। কারণ আর কারো কাছে মোবাইল নেই।

যত বেশি মানুষ মোবাইল ব্যবহার করবে, নেটয়ার্কে যোগ দিবে, ততো আপনার মোবাইলের ভ্যালু বেড়ে যাবে। ততো বেড়ে যাবে অভারল নেটওয়ার্কের ভ্যালু।

১৯০৮ সালে এটি এন্ড টির সেই সময়ের চেয়ারম্যান থিয়োডর ভেই লক্ষ্য করলেন কোন জায়গায় এটি এন্ড টি বেশি কাস্টমার সংগ্রহ করে ফেলতে পারলে প্রতিযোগিদের পক্ষে সুবিধা করা সম্ভব হয় না।

অর্থাৎ, ভেইল বুঝতে পারলেন এটি এন্ড টি’র শক্তি তাদের প্রযুক্তিতে নয়, নেটওয়ার্কে।

ইনভেস্টর মিটিং এ তিনি স্পষ্টভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেন।

এর প্রায় ৭২ বছর পর ইথারনেটের ফাদার বলে খ্যাত রবার্ট ম্যাটক্যাফে বলেন, ‘কোন নেটওয়ার্কের শক্তি তাতে যুক্ত নড (ধরেন লোক) এর স্কয়ার (দ্বিগুন) (N^2)।’  একে বলে ম্যাটকেফের ল।

এবং ডাইরেক্ট নেটওয়ার্ক আসলে এটাই। সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ইফেক্ট এখানে দেখা মিলে। ফেইসবুকে যত বেশি লোক যুক্ত হবে ততো বেশি তার শক্তি। গুগল প্লে স্টোর যত লোক ব্যবহার করবে, যত ডেভলাপার ব্যবহার করবে, ততই তার শক্তি।

নেটওয়ার্ক আপনার ভাষা। নেটওয়ার্ক আপনার প্রিয় ধর্ম। নেটওয়ার্ক রাস্তাঘাটের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

আরো অনেক ধরণের নেটওয়ার্ক ইফেক্ট আছে। কিন্তু আপাতত এই পর্যন্তই থাকলো এই বিষয়ে, কারণ এখন কেন্দ্রহীন বা ডিসেন্ট্রালাইজ সিস্টেমে চলে যাবো।

তিন ধরণের সিস্টেম সম্পর্কে জানা যাক।

সেন্ট্রালাইজড সিস্টেমঃ

সেন্ট্রালাইজড সিস্টেমে একটা কেন্দ্র থাকে নিয়ন্ত্রণে। একটা মূল কেন্দ্র বা মূল অথরিটি বা সার্ভার এখানে থাকে।

ডি সেন্ট্রালাইজড সিস্টেমঃ

ডি-সেন্ট্রালাইজড সিস্টেমে একটা মূল কেন্দ্র থাকলেও আলাদা অনেক সাব কেন্দ্র থাকবে। নডগুলি সাব কেন্দ্রের সাথে, আর সাব কেন্দ্রগুলি মূল কেন্দ্রের সাথে যুক্ত থাকবে। অনেক সময়, মূল কেন্দ্র না থেকে সম ক্ষমতাসম্পন্ন সাব কেন্দ্রগুলি মিলে ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম গঠিত হতে পারে।

অর্থাৎ, এই দুই প্রকার সিস্টেমের পার্থক্যটা হলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ সেন্ট্রালাইজ সিস্টেমে একচেটিয়া। এটি হতে পারে সরকার, বা কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেমে পাওয়ার শেয়ার হয়ে যায়।

ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেমঃ 

ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেমে সিস্টেমের অংশগুলি নানা স্থানে ছড়ানো থাকে। নন-ডিস্ট্রিবিউটেড সিস্টেমে সিস্টেমের অংশগুলি এক জায়গায় থাকে।

উদাহরণঃ

আপনি মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ব্যবহার করছেন, ও ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার দিয়ে এটি পড়ছেন, ধরা যাক। এই মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেম সেন্ট্রালাইজড, কারণ এর নিয়ন্ত্রণ করে মাইক্রোসফট কোম্পানি। আর এটি নন-ডিস্ট্রিবিউটেড, কারণ আপনার কম্পিউটারে, এক জায়গা থেকেই কাজ করছে।

কিন্তু যদি কোন ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম, যেমন লিনাক্স ব্যবহার করে, ওপেন সোর্স ব্রাউজার, ধরা যাক ফায়ারফক্স দিয়ে পড়ছেন, তাহলে বলা যায়, এটি ডিসেন্ট্রালাইজড। যেহেতু এগুলির পেছনে অনেক মানুষের অবদান আছে, সেন্টারের নিয়ন্ত্রণ নাই বা কম। কিন্তু এটি ডিস্ট্রিবিউটেড না, কারণ আপনি আপনার কম্পিউটারে, অর্থাৎ লোকেশন এক।

ক্রিপ্টোকারেন্সি, যেমন সবচাইতে বড় ক্রিপ্টো বিটকয়েন একইসাথে ডিসেন্ট্রালাইজড এবং ডিস্ট্রিবিউটেড। কেন্দ্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, এবং পিয়ার টু পিয়ার বেসিসে স্বাধীন কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক।

সমস্যাঃ

কিন্তু এই ধরণের সিস্টেম, কোন কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কীভাবে চলবে? বিশেষত যখন নেটওয়ার্কে যুক্ত ব্যক্তিরা অপরিচিত।

এখানে যে চুক্তি বা আদান প্রদান, তার বিশ্বস্থতা কীভাবে রক্ষিত হবে?

একটি বিখ্যাত সমস্যা ছিল এ নিয়ে, যেটির এক প্রকার সম্ভাব্য সমাধান করতে পেরেছে বিটকয়েন ক্রিপ্টোকারেন্সি।

সমস্যাটি এভাবে বর্ণনা করা যায়।

ধরা যাক, পলাশীর যুদ্ধের এক ইমাজিনারি চিত্র। ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ঘিরে আছেন নবাব সিরাজের চার সেনাপতি।

একজন মীর জাফর আলি খান।

একজন মীর মদন।

একজন মোহন লাল।

আরেকজন…আপনি।

দুর্গের ভেতরে আধুনিক অস্ত্রে তৈরি ইংরাজ সৈন্যরা। এখন অবস্থাটা এমন, দুর্গ আক্রমণ করতে হলে চারজন সেনাপতিকে একসাথে আক্রমণ করতে হবে। অন্যথায় পরাজয়। আবার যদি সেনাপতিরা ঠিক করেন যে আক্রমণ করবেন না, বরং ইংরাজদের আক্রমণ প্রতিহত করবেন, সেটাও একসাথে চারজনে করতে হবে। যেকোন একজন না করলেই মারাত্মক পরাজয়।

চারজন সেনাপতি চারদিকে আছেন দুর্গের।

চারজনই জানেন এদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক হতে পারেন।

চারজনই জানেন যে, দূত পাঠালে দূত ভুল মেসেজ দিতে পারে বা, ইংরাজরা দূতকে ধরে মেসেজ বদলে দিতে পারে।

এমতাবস্থায়, সেনাপতিরা কীভাবে ঠিকভাবে যোগাযোগ করবেন? কীভাবে একসাথে আক্রমণ বা প্রতিহত করে নিয়ে আসবেন বিজয়ের বরমাল্য?

এই সমস্যাটি, বাইজেন্টাইন সেনাপতিদের উদাহরণ দিয়ে, এর নাম দেয়া হয়েছিল বাইজেন্টাইন জেনারেলস প্রবলেম

অনেকদিন এর কোন সমাধান ছিল না।

পরে বিটকয়েনের সাতোশী নাকামোটো (এক বা একাধিক ব্যক্তি) এর সমাধান দেন, বিটকয়েনের মাধ্যমে।

কিভাবে আপনারা মেসেজ আদান প্রদান করতে পারেন বিশ্বস্থতার সাথে, যেখানে মীর জাফর আলি খানের কাছ থেকে ‘আক্রমণ করব সকালে’ মেসেজটি যে আসলেই সত্যি তা আপনি নিশ্চিত হবেন, এবং অন্যরাও একইভাবে?

হ্যাশিং হলো কম্পিউটিং এর এক পদ্বতি যার মাধ্যমে মেসেজকে কিছু ক্যারেক্টারে বদলে দেয়া যায়। যেমন, ‘আক্রমণ হবে সকালে’ এই মেসেজ হ্যাশিং এর মাধ্যমে হতে পারে এমন, 213cce3794e6ebecaecfc7959454dcce3794e6ebecaecf77a44c33ccabb87a4c767ae997fd982fd4559454dcce3794e6

এখন এই সাংকেতিক মেসেজ ক্লাইভের হাতে পড়লেও সমস্যা নেই।

সাংকেতিক মেসেজের সাথে একটি সাংকেতিক নাম্বার যোগ করতে হবে। একে বলে নন্স। যেমন, এটাক হবে সকালে 3246b.

সব সেনাপতির কাছে এই হ্যাশ করা মেসেজ রিসিভ করার জন্য কিছু আংশিক তথ্য থাকবে, যাকে বলে হ্যাশ টার্গেট।

আপনি হ্যাশ করা মেসেজ পেলে আপনার হ্যাশ টার্গেটের সাথে মিলিয়ে দেখবেন, যদি মিলে যায় তাহলে মেসেজটি আসলেই অন্য সেনাপতির কাছ থেকে এসেছে।

হ্যাশ করা মেসেজের সাথে নন্স যোগ করতে প্রচুর গাণিতিক হিসাব করতে হয় কম্পিউটারকে। এতে সময় যায়। অনেক কম্পিউটার শক্তির দরকার হয়। মেসেজ+নন্স+হ্যাশ টার্গেট = ক্রিপ্টো মেসেজ।

এই নন্স এর কঠিন হিসাবের জন্যই, বিপক্ষ শক্তি আপনাদের মেসেজ পেলেও ভুল মেসেজ আপনাদের পাঠাতে পারবে না। কারণ তাকে মেসেজ পেলেই হবে না, নন্সকে পুনরায় হিসাব করতে হবে।

পারবে, যদি তার কম্পিউটার শক্তি খুবই বেশি হয়।

সেক্ষেত্রে, আপনি সেনাপতি আপনার মেসেজ দিয়ে একটি ব্লক তৈরি করবেন। আপনার সৈন্যদের সব কম্পিউটিং পাওয়ার দিয়ে এর জন্য নন্স খুঁজবেন। এতে হ্যাশ টার্গেট হবে লম্বা। যা, বাস্তবিক ভাবে শত্রুর জন্য অর্থোদ্ধার করা অসম্ভবের কাছাকাছি।

ক্রিপ্টকারেন্সি এভাবে কাজ করে। যত বেশি লোক এই সিস্টেম ব্যবহার করবে, নেটওয়ার্ক ইফেক্টের কারণে এটি ততো বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থা কী রকম কনসেপ্টঃ

ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থা বা বিটকয়েন নিয়ে মিডিয়ায় যেসব তথ্য প্রচারিত হয়, এর কয়েকটা ধরণ আছে।

এক, তাড়াতাড়ি টাকা বানানোর কোন উপায়। বিটকয়েনের দাম দ্রুত বাড়ে, ইত্যাদি। এই ধারণাটি মূল ক্রিপ্টো আদর্শের ধারে কাছেও নেই। বিটকয়েনের দাম হঠাত বেড়ে যাওয়া ছিল মানুষের সাইকোলজির উপর নির্ভর করা একটা স্টক মার্কেটিও জিনিস। দাম বাড়ছে দেখে প্রচুর মানুষ কিনেছে, ফলে দাম বেড়েছে। এরপর হঠাত এই বিশ্বাস চলে যাওয়ায় বিক্রি শুরু হয়েছে, তাই দাম পড়েছে।

দুই, খুবই লিবারেটারিয়ান ও এনার্কিস্ট একটা ধারণা প্রচলিত আছে। যেহেতু বাইরের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না টাকা আদান প্রদানে, কোন ফি থাকবে না, এবং অনেক প্রাইভেসি থাকবে, তাই এটি অথরিটির বিরুদ্ধে। মূলত ক্রিপ্টো আসলে সাইবারপাংক মুভমেন্টের পরের এক ধাপই। ফলে, এই ধারণা কিছুটা ঠিক। কিন্তু পুরা নয়।

তিন, এই ডিসেন্ট্রালাইজড সিস্টেম বেইজড ক্রিপ্টো ইন্টারনেটের পরে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি এবং আমাদের চেনা পৃথিবীর অনেক কিছুই আমূল বদলে দেবে।

কেন্দ্রহীন ব্যবস্থার একটা উদাহরণ হতে পারে উইকিপিডিয়া বা ওপেন সোর্স সফটওয়ারগুলি। পুরোপুরি কেন্দ্রহীন না কারণ কিছু নিয়ম কানুন থাকবেই, কিন্তু ধরা যায়। এটাতে এনার্কিজমটা হলো, বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষেরা সহযোগিতামূলক ভাবে অংশ নিচ্ছেন, এর উন্নতির জন্য কাজ করছেন, এবং সবাই তার সুফল পাচ্ছেন। কিন্তু উইকিপিডিয়ার একটা মারাত্মক সমস্যা হলো, প্রায়ই দেখবেন উইকিপিডিয়া ডোনেশন চাচ্ছে, অর্থাৎ অর্থাভাব। ক্রিপ্টোকারেন্সি এই এনার্কিস্ট সহযোগিতামূলক প্রজেক্টগুলির জন্য একটা ডিসেন্ট্রালাইজড অর্থব্যবস্থাই নিয়ে এসেছে!

ফলে, এটি, সহজ জিনিস নয়। এর আদর্শ, এবং এর কার্যপদ্বতি মিলে একটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে কেন্দ্রহীন পৃথিবীর।

ভাবেন হবসিয়ান চিন্তার কথা, যেখানে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি বলা হয়েছিল পশুর মত, তাই শৃঙ্খলার জন্য দরকার অথরিটির শাসন, অর্থাৎ কেন্দ্র। কিন্তু প্রযুক্তিগত এই উদ্ভাবন ডিসেন্ট্রালাইজড ব্যবস্থাকে বাস্তব করতে পেরেছে, যেখানে অন্য পক্ষকে আপনার বিশ্বাস করতে হবে না, আদান প্রদান হবে নিঁখুত, কারণ সিস্টেমটি নিজেই কোন বিশ্বাস ভঙ্গ বা ভাঁওতাবাজির সুযোগ রাখছে না। টাকা আদান প্রদানের এই ভিন্ন ব্যবস্থা, এই ভিন্ন মুদ্রা কেন্দ্রের মূল নিয়ন্ত্রণ অর্থব্যবস্থাকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।