ড্যানিয়েল ড্যানেট একজন আমেরিকান দার্শনিক, লেখক এবং কগনিটিভ সাইন্টিটিস্ট। ফিলসফি অব মাইন্ড, ফিলসফি অব সাইন্স নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তিনি তার মাল্টি ডিসিপ্লিনারি চিন্তার জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ন ও আলোচিত একজন দার্শনিক। ক্রিটিক্যাল থিংকিং এর জন্য তিনি আমাদের যে ৭ টি টুলের সাথে পরিচিত করান, এগুলি চিন্তাকে আরও ভালো করতে সাহায্য করতে পারে।
এখানে সেই ৭ টি টুল তুলে ধরলাম।
১। নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিন
এটি কমন উপদেশ। নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ট্রায়াল এন্ড এররের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে লজিক্যাল কোন জায়গায় যেতে হলে, বা নিজেকে ক্রিটিক্যাল চিন্তক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে। নিজে একেবারে ভুল করেন না, কিংবা ভুল থেকে শিখবেন না, এমন হলে কখনো হবে না।
চিন্তায় আপনার ভুল হতেই পারে। এটি খুব স্বাভাবিক বিষয়। বেশিরভাগ সময়ে আমরা আমাদের চিন্তাগত অবস্থান বা বক্তব্যকে আমাদের ব্যাকটি ‘আমি’র সাথে মিশিয়ে ফেলি। তখন বক্তব্যের ভ্রান্তি আমাদের চোখে পড়ে না।
যেসব ভুল হতে পারে বলে আমার এখন মনে হচ্ছে,
এক, তথ্যগত ভ্রান্তি – আপনার কাছে যে তথ্য ছিল ভুল।
দুই, যুক্তিতে ভ্রান্তি। এটা হতে পারে।
তিন, অসতর্ক হয়ে কোন পয়েন্ট মিস করে যাওয়া।
চার, ইমোশনাল – উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, ভয় বা অন্য কোন আবেগ তাড়িত হয়ে যাওয়া।
এগুলি আপনি কবলে পড়লে এদের থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী চিন্তায় এগুলি পরিহার করার চেষ্টা করা দরকারী। চিন্তার ক্ষেত্রে ভুল শিক্ষক।
ধরা যাক কোন বিষয়ে আমি চিন্তা করছি, যুক্তি দিয়েই যে, জুমলা সেরা কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। কারণ জুমলার থিম বানায় আমার কোম্পানি। কিন্তু পরে আমি তথ্য পেলাম ৩৩.২% ওয়েবসাইট চলছে ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে, এবং অন্য সব গুলি সিএমএস মিলিয়ে দশ পার্সেন্টও হবে না। অর্থাৎ ওয়ার্ডপ্রেস অনেক এগিয়ে। এই নতুন তথ্য আমাকে নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য করবে সিএমএস নিয়ে। কিন্তু আমি যদি আমার প্রথম অবস্থান ‘জুমলা সেরা’ এটাকে আমার ব্যক্তিস্বত্তার সাথে মিশিয়ে ফেলি তাহলে আমি আহত বোধ করব নতুন তথ্য মেনে নিতে। কিন্তু আমার এই অবস্থানটি তো আমি ছিলাম না। আমি, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে অবশ্যই জুমলা ভালো না ওয়ার্ডপ্রেস ভালো, বা আমার যেকোন চিন্তা থেকে বড়।
ব্যক্তিকে বক্তব্য থেকে আলাদা করতে পারলেই ভুল মেনে নেয়া সহজ হয়। এবং আপডেটেড তথ্যের কারণে অবস্থান বদলালেও তা মান্যতে কষ্ট হয় না।
২। প্রতিপক্ষকে সম্মান করুন
আপনি আপনার প্রতিপক্ষকে কেন সম্মান করবেন? কারণ তারা যদি বুঝতে পারে আপনি সম্মান দিয়ে তাদের কথা শুনছেন তাহলে আপনার কথাও তারা শুনবে। আর আপনার কথা ভালোমত শুনলে তারা আপনার যুক্তি মান্যতে বাধ্য হবে কারণ আপনার যুক্তি যেহেতু বেটার। কিন্তু প্রথমেই প্রতিপক্ষকে অসম্মান করে ফেললে সে আপনাকে শত্রু মনে করে আর আপনার কথা মন দিয়ে শুনবে না।
নিতান্তই ইডিয়টদের সাথেও আপনার তর্ক করতে হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা খুব কমন। এসব ক্ষেত্রে সম্মান রাখা অনেক কঠিন। কিন্তু তাকে কনভিন্স করতে চাইলে আপনার সম্মান বজায় রাখতে হবে।
৩। ‘নিশ্চয়ই’ সতর্কতা
ড্যানেট এটাকে ইংরাজিতে লিখেছেন ‘শিওরলি ক্ল্যাক্সন’, ক্ল্যাক্সন মানে একধরনের ইলেকট্রিক হর্ন। বাংলায় এটা হয়ত এভাবে প্রযোজ্য হতে পারে, যখন কোন লেখক লেখেন “নিশ্চয়ই………” “অবশ্যই…” বাক্যটিকে সন্দেহের চোখে দেখুন। উদাহরণ,
সাধারণত নিশ্চয়ই ব্যবহার করার অর্থ হলো, লেখক যা বলতে চাইছেন তার স্বপক্ষে শক্ত যুক্তি হাজির করেন নাই। এটি একটি ওয়ার্নিং বা সতর্কতা। অনেক সময় এমন হতে পারে লেখক আগে যুক্তি হাজির করেছেন পরে নিশ্চয়ই বলেছেন। কিন্তু আপনার কাজ হলো এটা চেক করে দেখা।
৪। বুলিসর্বস্ব প্রশ্নের উত্তর দিন
এই ধরণের প্রশ্ন লেখক করেন চিন্তার বিপরীতে একটা ধোঁয়াশা তৈরি করার জন্য। যেমন, এখানে কোনটা রাইট কোনটা রং কে উত্তর দিতে পারবে?”
এই ধরণের প্রশ্নের ক্ষেত্রে, আপনি সাথে সাথেই বলুন, আমি পারব। অবশ্যই পারব।
বক্তা বুলি সর্বস্ব প্রশ্ন করেন আসলে উত্তরের আশায় নয়।
আপনি উত্তর দিয়ে ফেললে বক্তা তার অবস্থান বদলাতে বাধ্য হবেন। কারণ এটি তার জন্য আন – এক্সপেক্টেড।
উদাহরণ, নিজেকে আর কত ছোট করবেন? এমন প্রশ্ন কেউ করতে পারে তর্কে হেরে গিয়ে।
এটা প্রশ্ন হলেও উত্তরের আশায় নয়। আপনি উত্তর দিতে পারেন। এদের প্রশ্ন হিসেবেই নিন।
৫। অকামের রেজর প্রয়োগ করুন
দার্শনিক উইলিয়াম অব অকামের নামানুসারে এই নীতি। ড্যানেটের কথায় এই নীতি প্রয়োগ করবেন এভাবে,
যখন কোন সমস্যার জন্য আপনার কাছে সহজ ও সাধারণ উপায়ে সমাধান আছে তখন জটিল ও কঠিন সমাধানের দিকে যাবেন না।
৬। আবর্জনায় সময় ব্যয় করবেন না
এটা ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবং লাইফের জন্য ভালো ভাবে যায়। সাইন্স ফিকশন লেখক স্টারজিওনের একটা ল আছে। তার জনরার অনেক সমালোচনা হয় দেখে তিনি বলেছিলেন, যেকোন জনরাতেই ৯০% হলো আবর্জনা।
আপনি রেনেসাঁ পিরিয়ডের ছবি দেখে ভাবছেন, আরে সব তো মাস্টারপিস। কিন্তু আপনি দেখছেন সময়ের ব্যবধানে টিকে যাওয়া অসাধারণ কাজগুলি। আরও অনেক অনেক এমেচার ও ফালতু কাজও হয়েছে। টিকে নি। যেকোন সময়ে যেকোন সেক্টরে বেশিরভাগ জিনিস আবর্জনা হবে। এগুলি এড়িয়ে চলতে হবে।
তর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা। বেশিরভাগ যুক্তি হবে একেবারে আবর্জনা। এগুলি এড়িয়ে চললে আপনার সময় বাঁচবে।
৭। ডিপিটি থেকে সাবধান
ডিপিটি হচ্ছে এমন একটি বক্তব্য যা একদিক থেকে তুচ্ছভাবে সত্যি, কিন্তু অন্যদিক থেকে মারাত্মকভাবে ভুল। এই ধরণের বক্তব্য মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
যেমন ড্যানেট উদাহরণ দেন, “ভালোবাসা একটি শব্দমাত্র।”
এই বাক্যটি ঠিক আছে অর্থগত ভাবে। ভালোবাসা তো শব্দই।
কিন্তু গভীর অর্থে গেলে মিথ্যা, কারণ ভালোবাসা তো কেবল শব্দ না, এটি গুরুত্বপূর্ন। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, অনুভূতি ইত্যাদি অনেক কিছু জরিয়েই তৈরি হয় ভালোবাসা।
বয়স একটি সংখ্যা মাত্র।
এটিও ডিপিটিতে আক্রান্ত। বাক্যগত ভাবে ঠিক। কিন্তু গভীর অর্থে ঠিক না। বয়স অনেক কিছু, কেবল সংখ্যা নয়, স্মৃতি অভিজ্ঞতা নানা কিছু।
সংযুক্তিঃ