কাল জিজেকের বই প্যানডেমিক পড়তে গিয়া কোরিয়ান-জর্মন ফিলোসফার বিং (বা বিয়ুং) চুল হানের দি বার্ন আউট সোসাইটি বইটাও পড়লাম। চুল হান বলতেছেন যে ওয়েস্টার্ন সমাজ মানুষরে ডিপ্রেস করে দিতেছে, এবং মানসিক সমস্যায় ফালাইতেছে তাদের একটা প্রতিযোগিতায় ফালাইয়া। যেই প্রতিযোগিতারে আমরা বলি ইঁদুর দৌড়। অমুক পারছে তবে আমি কেন পারব না, এই ধারণা ঢুকাইয়া দিতেছে মানুষের মধ্যে স্বস্তা মটিভেশনাল বা সেলফ হেল্প ইন্ড্রাস্ট্রি। চুল হান ভাবেন, চূড়ান্ত ডিপ্রেসের যে অবস্থা “আমারে দিয়া কিছু হবে না” এইটার উৎপত্তি হয় তখনই, যখন এই ধারণা খাওয়াইতে থাকা হয় “তোমারে দিয়া যেকোন কিছু সম্ভব।”
চুল হান সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট ইত্যাদি নানা কিছু নিয়া তার মতামত ব্যক্ত করেন। সেইগুলা কীভাবে মানুষের মেন্টাল হেলথে প্রভাব ফেলতেছে।
জিজেক প্যানডেমিক বইতে তার যে ক্রিটিক করেছেন, আমি তা ঠিক মনে করি। এছাড়াও ওয়েস্টের সমাজ আসলে এক স্তর না, ঐখানেও নানা স্তর আছে। যেই রেট রেইস ও কন্টিনিউয়াস ডেভলাপমেন্টের তাড়ণা জনিত সমস্যা, সোশ্যাল মিডিয়ার মিস করে যাবার ভয়ের মত, এইগুলা সকল স্তরে একইভাবে নাই।
চুল হান ইভলুশনারি ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখলে একটা ব্যাখ্যা হয়ত পাইতেন। বা ভিন্ন এক পার্সপেক্টিভ। যেমন কালকের আগের দিন আমি দি ইভলুশন অব ডেজায়ার বইটা পড়ি।
বিজ্ঞানী ডেভিড বাস সেই বইতে চার্লস ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন নীতির উপর ভিত্তি করে মানুষের সেক্সের জন্য প্রতিযোগীতা এবং এর ফলে “ডেজায়ার” বা “সেক্সুয়াল ডেজায়ারের” উৎপত্তি, প্রাণী হিসাবে মানুষের মেটিং স্ট্র্যাটেজি এগুলা নিয়া আলাপ করছেন। মিন জিনস বইটাতে যেসব জিনিস ছিল, ডেভিড বাসের বইটাতে প্রায় একই জিনিস, একটু বেশি ব্যাখ্যায়।
ইভলুশনারি সাইকোলজিতে, পুরুষ সম্পদ কিনে, বাড়ি গাড়ি ইত্যাদি আর কি, বিপরীত লিঙ্গরে আকর্ষণের জন্য। এগুলা তার স্বক্ষমতার সিগনাল দেয়, যে আমি নিরাপত্তা দিতে পারব ভবিষ্যত সন্তানদের।
আর এই যে, দেখানো সম্পদ কেনা, এটা সোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়ানো। এই জায়গায় আমরা কেন মানুষ সোশ্যাল স্ট্যাটাসের পেছনে ছুটে তা বুঝতে পারি। সমাজের হায়ারার্কিতে তার অবস্থান যত ভালো হবে ততো ভালো সঙ্গী সে পাবে। ফলত, তার উত্তরসুরীরা বেটার হবে।
এই কথা বুঝতে অসুবিধা হইলে আপনে গ্রামের বংশ মর্যাদা কনসেপ্টের কথা ভাবেন। ভালো বংশের ছেলে ভালো বংশের মেয়েই বিয়ে করে, এরেঞ্জড ম্যারেজের কনসেপ্টে। এই বংশ মর্যাদার কনসেপ্টই সোশ্যাল স্ট্যাটাস।
ওয়েস্টার্ন সোসাইটির কিছু জায়গায় যে রেট রেইস, তা এই সোশ্যাল স্ট্যাটাস গেইনের জন্য। এই প্রতিযোগিতারে আরো বাড়াইছে ইনস্টাগ্রাম, ফেইসবুক জাতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। বন্ধু বা পরিচিতরা গাড়ি কিনছে বাড়ি কিনছে তা ব্যক্তি দেখতে পাইতেছে বা সে গাড়ি বাড়ি কিনলেও দেখাইতে পারতেছে।
খেয়াল করবেন, এখানে দেখানোটাই মূল কাজ। সেই অভজার্ভেশনের ফিলোসফিক্যাল সমস্যার মত যে (জর্জ বার্কলে উত্থাপিত), গহীন জঙ্গলে একটা গাছ মাটিতে পড়লেন, ওইখানে শোনার জন্য কেউ ছিল না, তাইলে শব্দ হইল কি?
আপনে কোহীনূর হীরার মালিক হইয়া বসে থাকলেন, কিন্তু কাউরে দেখাইলেন না, তখন কিন্তু আর ওইটা সামাজিক স্ট্যাটাস বাড়াইতে কাজ করলো না।
তো চুল হানের আরেকটা সমালোচনা আমি করতে চাই বাংলাদেশের সমাজের প্রেক্ষিতে। সমালোচনা না বলে এইটারে বলা যায় একটা সতর্কতা দেই বাংলাদেশের বিবেচনায়। চুল হানের থিওরি বাংলাদেশের সমাজের জন্য নয়।
কারণ, আমাদের হতাশা কাজ করতে করতে না, কাজ না পাইয়া।
যেসব মানুষরে সরকার পড়ালেখা করাইতেছে ভার্সিটিতে, তাদের ভালো কাজই দেয়া যাইতেছে না।
ওয়েস্টার্ন সমাজের এক লেভেলে সেলফ-ইম্প্রুভমেন্টের জন্য অতি আকাঙ্খা যদি হতাশা ডাইকা আনে, আমাদের ক্ষেত্রে এইটা হইল, নিজের ইম্প্রুভমেন্ট দরকার কি না, কী ইম্প্রুভ করতে হবে, এবং ইম্প্রুভ না করার ইচ্ছাই সামগ্রিক হতাশা বাড়ায়।
কারণ, স্কিলের দিক থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঐ জিনিস দিতে পারতেছে না ছাত্র ছাত্রীদের, যেইটা আজকের দিনে দরকার বা ভবিষ্যতের দিনে দরকার হবে।
এবং আমাদের কালচার হইল এন্টি-জ্ঞান, এন্টি-ইন্টেলেকচুয়াল এবং অভারল একটা ‘যা হয় হোক’ টাইপের। এই কর্মবিমুখতার সমস্যারে চুল হান দিয়া দেখতে চাইলে ভুল হবে। যদিও অনেকে এটা দেখতে চাইবে, কারণ এটি তাদের আরো কর্মবিমুখতার অজুহাত হিসেবে কাজ করবে।
আমাদের সামগ্রিক ডিপ্রেশনের আরেকটা কারণ হিসাবে আমি মনে করি, এখানে ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পানিশমেন্টের মেকানিজম কাজ করে।
চুল হান ওয়েস্টের ক্ষেত্রে এইটা এইভাবে বলেছেন যে, ‘এই সমাজ আর ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পানিশমেন্টের সমাজ না, পাগলা গারদ, ব্যারাক বা জেলখানার। বরং এই সমাজ হইল ফিটনেস স্টুডিও, অফিস, ব্যাংক, এয়ারপোর্ট, শপিং মল ও জেনেটিক ল্যাবরেটোরির। এখন আর এইটা ডিসিপ্লিনারি সমাজ না, বরং এটা এচিভমেন্টের সমাজ। মানুষের “অবিডিয়েন্স সাবজেক্ট” না বরং “এচিভমেন্ট-সাবজেক্ট”।’
আমার মনে হয় এখানে ফুকো’র ডিসিপ্লিনারি সমাজ আসলে বিস্তৃত হয়েছে। মানুষরে যখন আপনি সফলতা বা এচিভমেন্টের লোভ দেখাইয়া নিয়ন্ত্রণ করবেন, সেটা নিয়ন্ত্রণই। এখানে ফুকো’র মেকানিজম আরো তীব্রভাবে কাজ করে, একটু ভিন্ন ভাবে আর কি। এই ভিন্নতার জন্য এটারে ফুকোর নাম না নিয়া কেউ দেখতে পারেন। তাতে অসুবিধা নাই। সমাজরে ব্যাখ্যা করা গেল কি না, সেটাই বিষয়।
কয়েকটা উদাহরণ আমি দিতে চাই এখানে।
প্রথমত কর্পোরেট কালচারে আপনে দেখবেন একটা ব্যাপার আছে, স্ট্যান্ড আপ মিটিং। সকালে অফিস শুরুর সময়ে সবাই যাবে। দাঁড়াইবেণ গোল হইয়া। তারপর বলবেন একে একে আজ তারা কী করবেন।
বাংলাদেশের টেক কোম্পানিতে এটা হয়। অন্যান্য কর্পোরেট কোম্পানিতে একইরকম আরো কিছু থাকতে পারে। ওয়ার্ল ওয়াইডও এইটা পপুলার।
আমি যখন প্রথম এটা দেখলাম, তখনই বুঝতে পারলাম এইটা তো ফুকোর ডিসিপ্লিনারি পানিশমেন্টের এক সার্থক রূপায়ণ।
স্কুলেরা যেমন করে।
এই প্রতিদিন একই সময়ে করতে থাকা রিচুয়াল যে অন্তঃসারশূন্য প্রোডাক্টিভিটির দিক থেকে তা সহজেই বুঝা যায়। কারণ এইটা একরকম স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে যায় আর কে কী বলতেছে তা কেউ খেয়ালই করে না। ইভেন যা বলছে ওইটা সে করল কি না, এই নিয়াও ফলো আপ থাকে না। আর কেবল তার ম্যানেজারই জানবে আসলে সে কী করতেছে।
তাহলে এই জিনিস কেন করা হয়। এর মূল কাজ কী।
এর মূল কাজ হলো, একটা নিয়ম মানানো। নিয়ম মানানো মানে আপনারে অবচেতনে বুঝাইয়া দেয়া আপনি এখানে কাজ করতেছেন আমার হইয়া। এবং আপনারে নিয়ম মানতেই হবে।
আরেক কাজ, এর উছিলায় নির্দিষ্ট সময়ে সবার অফিসে আসা নিশ্চিত করা। অফিসগুলা প্রোডাক্টিভিটি নষ্ট করে মানুষের এবং নিজেদের যখন তারা সমাজ হইয়া উঠে। যেমন, কোন এমপ্লয়ী আছে ধরা যাক, যে ফ্লেক্সিবল থাকলে বেটার করবে। তো তারে কোম্পানি আলাদা সুযোগ দিতে পারবে না। কারণ অন্যান্য এমপ্লয়ীরা এতে অভিযোগ তুলবে। এই জায়গায় কোম্পানি সমাজ হইয়া উঠে। আর তখন তারে একটা কম্যুনিস্ট ব্যবস্থায় চলতে হয়, সবার সমতা বিধান করে, আর সেখানে আউটপুটও আসে এভারেজ।
আরেক কাজ, ঐ মিটিং এ ব্যক্তিরা দিয়া বলানো সে কী করবে আজ। এই প্রকাশ্য ওয়াদা একটা কনসিস্টেন্সি বায়াস তৈরি করে তার মধ্যে। ফলে তার সেলফ ইগোর মান রক্ষার্থে সে কাজটি করতে চাইবে।
যে নত মস্তক বিনয়ীদের (ডোসাইল বডি) সমাজ তৈরি করা শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চমস্কি যারে বলেন ইনডক্ট্রিনেশন অব দ্য ইয়থ, এর আরেকটা পর্যায় হইল কোম্পানিগুলা বা কর্পোরেট কালচার।
আমার মনে হয় বিং চুল হান যে বাস্তবতার কথা বলতে চাইছেন, তা আমাদের দেশের কর্পোরেট কালচারে আছে কিছু কিছু, গ্লোবালাইজেশনের কারণে। গ্লোবালাইজেশনের গু।
পরবর্তী একটা উদাহরণ আমি দিতে চাই বলিউডের গসিপ থেকে। ইউটিউবে বলিউডের গসিপ আগে আমি দেখতাম মাঝে মাঝে। হিউমেন স্টুপিডিটির এই সার্থক উপস্থাপনগুলি অসাধারণ।
ধরেন, কোন এক অনুষ্ঠানে কোন নায়ক রাগী চোখে চাইছেন কারো দিকে। এইটা নিয়াও এমনভাবে বলবে যে, মনে হবে উনি কি না কী করছেন। এগুলার আবার হিউজ দর্শক। ফলে অভারল যে একটা স্টুপিডিটির মেলা, এটা সেরা বিনোদন।
এগুলা দেখতে গিয়া, দেখলাম যে বলিউডের সফল নায়কগুলা যেমন সালমান, শাহরুখ এদের স্যার স্যার বলে অতি ভক্তি করে জুনিয়র নায়কগুলা। মনে হয় পায়ে পইড়া গড়াগড়ি করবে এমন।
বুঝেন, শাহরুখ সালমানের মত নায়করে এরা এমন করে, ব্র্যান্ডো বা নীরো বা আল পাচিনোও না।
স্যার স্যার বলায় এমনিতে খারাপ কিছু নাই। ওয়েস্টার্ন সমাজে বয়স্কদের স্যার বলে অনেকে সম্মান করতে। বা এমনেই অপরিচিতরে বলে হঠাৎ কিছু চাইতে গেলে, যেমন লিফটে উঠতে গেলে এক্সকিউজ মি স্যার এইটা আমারেই বলতে পারে বুড়া একজন লোক।
কিন্তু উপনিবেশের প্রভাবাক্রান্ত আমাদের সমাজে এই স্যার ভিন্ন মাত্রা নিয়া উপস্থিত। এখানে স্যার একটা উচ্চে থাকা জিনিস।
স্যারের নিচের থাকারা স্যাররে স্যার বলেন। এই বলাবলির তীব্রতা এতো যে, সরকারের কর্মচারীরা স্যার না বলায় ঝামেলা করেছেন, এমন ইতিহাস আছে।
বলিউডে এই স্যার স্যার বলার একটা জঘণ্য ও কুৎসিত চল আছে। যেই চলের বিস্তার বলিউডের গু খাওয়া আমাদের সমাজের মিডিয়াতে, এবং সমাজের কিছু লেভেলে প্রচলিতও হইছে।
এখানে হইতেছেটা কী আসলে? জুনিয়র নায়কেরা আরো এচিভ করতে চায়। এই আরো এচিভের জন্য তাদের সহযোগিতা বা সুদৃষ্টি দরকার ইন্ড্রাস্টি মোড়লদের। ফলে এই অবিডিয়েন্স। এটা বিনয় বা সম্মান প্রদর্শন না। এটা হইল নতমস্তক বিনয়, যেইটা স্লেইভ এবং মাস্টারের সম্পর্কে থাকে। স্লেইভ মাস্টাররে এই জিনিস দেয় বিনিময়ে সে কিছু পায়। এখানেও সে বিনিময় আছে, একটু উহ্য সামাজিক মেকানিজমের কারণে।
যাই হোক, একবার ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ডে নায়ক শাহরুখ খান ভাড়ামি করতে করতে জুনিয়র নায়ক নীল নিতিন মুকেশের নাম নিয়া ফান করে।
আমি আগের অনেক ভিডিওতে দেখছি, এমন ফান করা হলে জুনিয়ররা গদগদ হয়ে যায়। বাট, এই জায়গায় দেখলাম মুকেশ রিএক্ট করলো।
আমার মনে হইল, ভালো করছে সে।
কিন্তু পরে আমারে একজন (সৈকত, থ্যাংক্স তারে) জানাইলেন, একটা নিউজের লিংক দিয়া যে, এইটা নাকি বানানো ছিল। নীল মুকেশরে তার চাইতে অসুন্দর নায়ক শাহরুখ খান নিজেই এইটা করতে বলছেন, মুকেশ এটা বলতেছে সাক্ষাতকারে।
এটা দেখে আমি ভাবলাম, এই জায়গায় এর চাইতে ভয়ংকর ওয়ে ছিল কি আর শাহরুখের বা বলিউড অথরিটির?
শাহরুখ সালমান এরা বলিউডের একটা অথরিটি, একটা পাওয়ার। তাদের নেটওয়ার্কের কারণে।
এইভাবে যদি কোন জুনিয়র নায়ক রাইগা গিয়া অপমান কইরাই ফেলে, তখন অথরিটি কী করবে।
সবচাইতে ডেঞ্জারাস যে জিনিসটা সে করতে পারে, ঐ নায়করে দিয়াই বলানো যে, আসলে এইটা বানানো ছিল।
আর এইভাবে জিনিসটারে ব্যালেন্স করা।
এইটাও একটা ডিসিপ্লিনারি পানিশমেন্টের মেকানিজম। এক তোমারে উপরে উঠতে হলে আমারে স্যার স্যার করতে হবে, বা আমার সাথে হাসিমুখে কাস্টিং কাউচে বইসা গীত গাইতে(!) হবে। এবং কখনো যদি কেউ ঘাড় তেড়ামি করতে চায়, তারেও লাইনে আনার ব্যবস্থা আছে। ব্যাকস্টেইজে নিয়া, পাওয়ারফুল কিছু ব্যক্তি দিয়া বা জিনিস দিয়া তারে বাধ্য করানো হবে কিছু জিনিস করতে। যেইটা তার ঘাড় তেড়ামিরে বিনাশ কইরা দেয়।
এই জায়গায় মুকেশ সরি বললে পরে, তা খারাপ হইত অথরিটির জন্য। কারণ তখন নিশ্চিত হইত লোকে যে আসলে অপমানই করছে সে। কিন্তু যখন সে স্বীকার করল বানানো ছিল তখন আর অপমানই হয় নাই, স্যারের সাথে খেলানেলা হইছে।
আমি মনে করি অথরিটির এই কন্ট্রোলিং মেকানিজমটা আরো ভয়াবহ। এটা ধামা চাপা দেয়া না, বরং সমগ্র বিষয়টারেই পালটে দেয়া।
থিওরিটিক্যাল এই আলাপে ঘটনাটির আসল সত্যি কী এটা অধর্তব্য।
এই দুই ডিসিপ্লিনারি মেকানিজম আমাদের সমাজে কাজ করে। এর শুরু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে। এরপর মিডিয়া ও পপুলিজমে।
বাংলাদেশের নন্দিত (পপুলিস্টের বাংলা?) কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদরে গইলা গিয়া যে তার ভক্তরা স্যার বলে, এইটার সাথে বলিউডের নায়কদের স্যার বলার তফাত খুব কম। কেউ বলতে চাইবেন টিচার হিসাবে তারে স্যার বলে। সেই হিসাবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা মান্নান সৈয়দরেও তো মহাস্যার বলার কথা। বলে না তো দেখি কেউ, ছাত্ররা ছাড়া। এই জায়গায় আপনি হয়ত ধরতে পারবেন, এই স্যার বলাবলির নতমস্তক বিনয়ের সাথে এন্টারটেইনমেন্ট ও পপুলিজম জড়িত।
এখন আপনে আরেকটা বাস্তবতা দেখেন, এখানে অনেক রাইটার আছে যারা হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখতে চাইতেছে। হুবহু। ছফা হুমায়ূনের লেখার সম্পর্কে বলতে গিয়া একটা কথা বলছিলেন, যেটা তার নির্বাচিত স্বাক্ষাতকারের বইয়ে আছে, এবং এই কথাটি বিং (বিয়ুং) চুল হানের ওয়েস্টার্ন সোসাইটির ক্রিটিকের সাথে যায়।
কিন্তু মানসিক শুদ্ধতার একটা প্রশ্ন আছে না, অর্থাৎ বাইরের রাস্তার লোক কী চায় সেই জন্যে আমি লিখব, নাকী আমার প্রাণ কী চায় সেই জন্য লিখব? এখন এই জিনিসগুলো একটা বড় ফ্যাকটর, এবং এগুলো নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। – আহমদ ছফা।
ছফা যে জিনিসটা বুঝাইতে চান যে, একটা ব্যক্তি যখন নিজেরে হারাইয়া ফেলে রাস্তার লোকদের জন্য, সাহিত্যিক সেন্সে এইটা খারাপ হবে। কিন্তু এর চাইতে বেশি সমস্যা হইল ব্যক্তির মানসিক।
দার্শনিক কীয়ের্কেগার্ড বলছিলেন যে মানুষ নিজেরে হারায় এতো ধীরে যে নিজেই টের পায় না।
মডার্নিটির যে ক্রাইসিস, এই ক্রাইসিসের মূলে হইল এই নিজেরে হারানোর ব্যাপারটা। যেটা বিং চুল হান নিও লিবারাল ক্যাপিটালিস্টিক সমাজের সমালোচনা করতে করতে বলতে চাইছেন, ছফা আরো সহজে বলছেন লেখকদের সমালোচনা করতে আর এরো অনেক আগে সোরেন কীয়ের্কেগার্ড অনেল লেখে গেছেন এটা নিয়া।
আমরা যে নতমস্তক বিনয়ীদের সমাজ পাইতেছি, এরা এক অবিডিয়েন্ট স্লেইভ হইতেছে এচিভ করার জন্য, বসরে খুশি রাখতে অথরিটিরে খুশি রাখতে কাস্টিং কাউচরে ঘরবাড়ি বানাইতেও তাদের আপত্তি নাই। অন্যদিকে, আরেক ভাবে অবিডিয়েন্ট দাসানুদাসে পরিণত হইতেছে রাস্তার লোকদের খুশি করতে করতে নন্দিত হইতে গিয়া।
যদি আমাদের সমাজে ডিপ্রেশনের কোন রুট কজ থেকে থাকে, বাংলাদেশের সমাজ বলেন বা দুনিয়ার, এই রুট কজ হইল নিজেরে হারানো রাস্তার লোকের চাওয়ার কাছে। বাইরের সমাজের লোকদের হ্যাপি করতে চাইয়া।
এর কিওর কি? একটাই কিওর, এবং তা সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট নয়, বরং সেলফ-আন্ডারস্টেন্ডিং। নিজেরে বুঝা। নিজের কর্মকান্ডগুলিরে বুঝা। কেন আমি এই জিনিস করতেছি, কেন এই জিনিস ভাবতেছি। বা ছফার মতে, আমার প্রাণ কী চায়। আমার দায়িত্ব কী, আর আমি কী প্রতিযোগিতা করতেছি যেইটা আসলে সামাজিক স্ট্যাটাসের জন্যে।
এক্সট্রিম ফর্মে একটা লাইফের জন্য মটো হইতে পারে, এন আন একজামিনড লাইফ ইজ নট উয়র্থ লিভিং। যেইটা সক্রেটিসের শিক্ষা, এবং এরিস্টটলের শিক্ষক প্লেটো তারে শিখাইছিলেন। কিন্তু এরিস্টটল এই জিনিসরে সাধারণ মানুষের জন্য ঠিক মনে করতে পারেন নাই। কারণ এই হার্শ এক্সপেরিমেন্টাল লাইফ একজন দার্শনিকের জন্য হইতে পারে, কিন্তু নর্মাল মানুষ অত চিন্তা করে জীবন যাপন করে না। এই বাস্তবতা হিসাবে নিছেন এরিস্টটল। তাই সাধারণ মানুষের জন্য তিনি ডে টু ডে কর্মরে প্রাধান্য দিছেন। যে ব্যক্তি সেলফ নলেজ গ্যাদার করবে, নিজের সীমাবদ্বতাগুলি বুঝার ট্রাই করবে, ও ডেইলি কিছু একটিভিটির মাধ্যমে তার লাইফরে নিজের কন্ট্রোলে রাখবে। যা তারে হ্যাপিনেস অব দ্য সউল বা ইউদাইমোনিয়ার দিকে নিয়ে যাবে।
নিজেরে না হারানো, নিজের সউলের চাওয়ারে গুরুত্ব দেয়া একটা কারেজের ব্যাপার। এইজন্য কারেজ এরিস্টটলিয়ান এথিকসের একটা মেজর জিনিস।
এবং এই নিজেরে না হারানোর বা অন্যভাবে বলতে গেলে নিজেরে অক্ষুন্ন রাইখা জীবন যাপনই হইল ইউদাইমোনিয়ার প্রথম শর্ত বলতে পারি, যেইটা হইল আত্মার হ্যাপিনেস, যেই আত্মার হ্যাপিনেসই হইল আসল হ্যাপিনেস বলছিলেন এরিস্টটলেরও শতবছর আগে, ডেমোক্রিটাস।
বিং চুল হানের যে ক্রিটিক, সমাজ ব্যক্তিরে “সাবজেক্ট” এ পরিণত করতেছে, এই সাবজেক্ট আসলে কী? চিন্তা করলে দেখা যায়, তখন আপনে বা আমি জাস্ট একটা বডি হিসাবে বিবেচ্য হই, এবং আমাদের সউলরে ডিনাই করা হয় বা আমরা করি, তখন কি আসলে আমি আর আমি থাকি বা আপনি আর আপনি থাকেন?
আপনে আমি তখন একটা বডিতে, একটা সাবজেক্টে অধোঃপতিত হই।
এচিভ করতে যাইয়া অবিডিয়েন্ট দাসে বা বাইরের রাস্তার লোকরে হ্যাপি করতে যাইয়া পপুলার হইতে বা সমাজরে হ্যাপি করতে গিয়া গাড়ি করতে বাড়ি করতে বা বিয়া করতে বা কোন একটা স্টাইলে কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা আমাদের সউলরে হত্যা করি।
ফলে একটা সউললেস বডি হয়, ওইটাই “সাবজেক্ট” একটা কেবল। এবং এইসব “সাবজেক্ট” এর যে ডিপ্রেশন, সউললেস বডিদের যে ডিপ্রেশন ও মানসিক সমস্যা তা পুরা সোসাইটিরে ইফেক্ট করে।