ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসঃ “সিরিয়াস আর্টের উদ্দেশ্য আপনার পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া নয়”

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের সাক্ষাৎকার থেকে এই অংশটি বাংলায় অনুবাদ করে এখানে দিলাম, কারণ তা আমাদের এখানেও খুবই প্রাসঙ্গিক। হাই আর্ট এবং লো আর্টের পার্থক্য বুঝা হচ্ছে না এখানে। ভালো লাগাকেই এবং আনন্দ পাওয়াকেই সাহিত্য-শিল্প বিচারের মাণদণ্ড বলে ধরে নিয়েছেন প্রচুর লোক। কমার্শিয়াল আর্টের এই সময়ে, ইন্টারনেট প্রযুক্তি ভিত্তিক কমার্শিয়াল বিনোদন ও তথ্য বিস্ফোরণের কালে, আমাদের মনযোগ হয়েছে ক্ষুদ্র, আমাদের শিল্প কেন্দ্রিক আশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আনন্দ চাই, ১০০ ভাগ ভালো লাগা চাই, এক বসাতে শেষ করা চাই।

সিরিয়াস সাহিত্যকে আমরা মনে করি ফালতু কারণ এর মাঝে আমরা দ্রুত আনন্দ পাই না, বা এর ভেতরের আনন্দ খুঁজে নেবার জন্য দরকারী কষ্ট করার মানসিকতা আমাদের নেই, নষ্ট হয়ে গেছে টিভি এবং প্রযুক্তিভিত্তিক দ্রুত স্বস্তা বিনোদনের মাধ্যমগুলি বাহুল্যতায়।

এই সময়ে ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের কথাগুলি সমস্ত বিষয়টাকে নিয়ে পুনঃচিন্তা করার সুযোগ দিতে পারে কাউকে কাউকে, সবাইকে অবশ্যই নয়।

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস একজন আমেরিকান সাহিত্যিক। উত্তরাধুনিক সাহিত্যে তিনি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন এক নাম, নভোকব’স চাইল্ড।

তার এই সাক্ষাৎকারটি পাবেন কনভার্সেশন উইথ ডেভিড ফস্টার ওয়ালেস বইতে।

 

 

ল্যারি ম্যাকক্যাফরিঃ টেলিভিশন সাধারণ লোকেরা যেমন মনে করে, হতে পারে চার চাইতে অনেক জটিল, কিন্তু দেখা যায় এটি তার দর্শকদের চ্যালেঞ্জ বা ডিস্টার্ব করতেই চায় না প্রায়, যেমন আপনি আমাকে লিখে জানিয়েছিলেন যে আপনি করতে চান। এই যে চ্যালেঞ্জ করতে চাওয়া বা একটা ব্যথা দেয়ার অনুভূতি এটাই কি আপনার কাজকে টেলিভিশন শো গুলির চাইতে বেশী “সিরিয়াস” করেছে?

 

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসঃ আমার একজন পছন্দের শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রায়ই বলতেন, একটা ভালো ফিকশনের কাজ হলো যে বিরক্ত (ডিস্টার্বড) আছে তাকে আরাম দেয়া এবং যে আরামে (কম্ফোরটেবল) তাকে বিরক্ত করা। ফিকশনের (গল্প-উপন্যাস) উদ্দেশ্য হলো, পাঠককে, যিনি আমাদের মতোই, তার মাথায় এক ধরণের অগ্নিসংকেত দেয়া, তাকে তার কাল্পনিক স্বত্তার কাছে প্রবেশ করিয়ে দেয়া।  যেহেতু মানুষ হবার একটি এড়ানো যায় না এমন বিষয় হলো কষ্ট ভোগ বা দুর্দশা, আমরা মানুষেরা যে শিল্পের কাছে আসি এর একটা কারণ হলো এই দুর্দশার অভিজ্ঞতা নেয়া, অবশ্যই সত্যিকার অভিজ্ঞতা নয়, পাঠ থেকে বা দেখে যেমন অভিজ্ঞতা নেয়া হয় এমন অভিজ্ঞতা নেয়া, বলা যায় দুর্দশার একটা সরলীকরণ রূপকে নেয়া। আমার কথা কি বুঝতে পারছেন? বাস্তব জীবনে আমরা কষ্টভোগ বা দুর্দশাভোগ করি একা একাই, সত্যিকার ভাবে পুরোপুরি অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারা অসম্ভব। কিন্তু যদি কোন গল্প উপন্যাসে আমরা কাল্পনিক ভাবে চরিত্রের দুঃখ কষ্টের সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারি, তাহলে মনে হয় বাস্তব জীবনেও হয়ত আমরা সহজে নিজেদের দুঃখের বিচারে অন্যেরটা কল্পনা করে নিতে পারব। এটা দারুণ, মুক্তিদায়ক; আমাদের ভেতরের একাকীত্ম এতে কমে। হতে পারে এটা এতই সহজ। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, এখনকার টিভি এবং জনপ্রিয় ধারার ফিল্ম বা অধিকাংশ নিম্ন শিল্প (লো আর্ট – স্বস্তা উপন্যাস, ফিল্ম ইত্যাদি) – এদের মূল উদ্দেশ্য হলো টাকা কামানো। তারা আকর্ষনীয় কারণ তারা জানে দর্শক বা পাঠকেরা ১০০ ভাগ আনন্দ চায় কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখা যায় আনন্দ ৪৯ ভাগ থাকলে দুঃখ ৫১ ভাগ। কিন্তু “সিরিয়াস আর্ট” এর মূল উদ্দেশ্য আপনার পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া না, এগুলি আপনাকে অস্বস্থির মধ্যে ফেলে দিতে চায়,  অথবা আপনাকে বাধ্য করে কাজ করতে এর আনন্দের খোঁজ পেতে। একই জিনিস বাস্তব জীবনের জন্য সত্য, বাস্তব জীবনের আনন্দ সাধারণত অস্বস্থি এবং কঠোর পরিশ্রমের বাই-প্রোডাক্ট। এখন যেসব দর্শক-পাঠক, বিশেষত যুবক বয়েসের যারা এটা দেখে বড় হয়েছে যে আর্ট মানেই ১০০ ভাগ আনন্দ, তাদের জন্য সিরিয়াস সাহিত্য-শিল্পের মর্ম উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এটা ভালো নয়। সমস্যা এটা নয় যে বর্তমানের পাঠককূল গর্দভ। আমি এটা মনে করি না। টিভি এবং ব্যাবসায়িক আর্ট কালচার তাদের অলস, এবং চির কিশোর করে রেখেছে। তাই কাল্পনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে বর্তমানের পাঠকের সাথে যুক্ত হওয়া খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে।

 

ল্যারি ম্যাকক্যাফরিঃ আপনার পাঠকেরা কীরকম হবে বলে আপনি কল্পনা করেন?

 

ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসঃ আমি মনে করি তারা হবে কমবেশী আমার মতোই, ২০ থেকে ৪০ এর মধ্যে যাদের বয়েস, যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে বা ভালো শিক্ষাদীক্ষা আছে এটা বুঝার জন্য যে হার্ড ওয়ার্ক সিরিয়াস গল্প উপন্যাস পাঠের জন্য পাঠকের কিছু কষ্ট করতে হয়। যেসব লোকেরা আমেরিকার কমার্শিয়াল সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছে, এর সাথে যুক্ত আছে, এতে মুগ্ধ হয়ে আছে কিন্তু তাও এমন কিছুর অভাব বোধ করছে যা কখনো কমার্শিয়াল আর্ট দিতে পারে না। হ্যা, আমি মনে করি তরুণ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তায় আগ্রহীরা, বা যেই হোক হবে আমার পাঠক। যেসব তরুণ লেখকদের প্রতি আমি মুগ্ধ, যেমন লেইনার, ভলম্যান এবং দেইচ, এমি হোমস, জন ফ্রেঞ্জেন, লরি মোর, রিক পাওয়ারস, এমনকী ম্যাকনার্নি ও লেভিট  এবং এইসব লোকেরা যাদের জন্য লেখছেন, তারাই। আমি গত বিশ বছরে দেখেছি লেখকেরা কীভাবে তাদের পাঠকের সাথে সংযোগ করবেন ও কোনো ধরণের আর্ট থেকে পাঠকের কি চাওয়া দরকার ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

 

আর্ট বিষয়ে আরো লেখাঃ

আর্ট কি তার কাজ কী

কাইনেটিক আর্ট ও স্ট্যাটিক আর্ট

শিল্পের নিয়ম মানা ও ভাঙ্গা বিষয়ে

আর্টিস্টিক ক্রিয়েটিভিটি বিষয়ে