ঢাকার স্মৃতিঃ অন্ধকারের শেষ প্রান্তে

আমার সবচাইতে এডভেঞ্চারাস লাইফ ছিল ঢাকায়। কারণ সেই প্রথম পুরা ফ্যামিলির বাইরে থাকা আর পুরাই অপরিচিত মানুষের সাথে থাকা ও চলা। অপরিচিত মানুষ মানেই ডেঞ্জার ও রহস্য কারণ তারাই হইল “আদার”।

আর ঢাকার মত জায়গা, যেইখানে কতো মানুষ কতো ধান্দায় ঘুরে। আইনের প্রয়োগও কম এতো জনবহুলতার কারণে, ফলত একটা ওয়াইল্ড ব্যাপার আছে সেখানে। আমি প্রথম যে জায়গায় উঠছিলাম, শুনছিলাম এই এলাকা বাজে। এখানে নাকি ছিনতাই হয়। কয়েকমাস আগেও অফিসের একজনের ম্যাক নিয়া ভাইগা গেছে কিছু ছিনতাইকারী।

তাই,  ওই সময়ের অবস্থা ছিল একটা উত্তেজনাময়।

একটা স্মৃতি এইরকম। ওইদিন হয়ত অফিস ছিল না। বিকালে ঘুমাইছিলাম। আর পরে রাতে উঠলাম, আর উঠতে উঠতে বারোটা বাইজা গেছে। খাবার ইচ্ছা ছিল না। পরে মনে হইল খাইতে হবে।

বিখ্যাত ম্যাগি নুডলস খাব। কিন্তু দেখি দেয়াশলাই নাই যে চুলা জ্বালাব।

আর তখন সাগুফতার ভিতরের দিকে সব দোকানপাট বন্ধ। তাও নামলাম। পুরা অন্ধকার আর শুনশান নিরবতা।

মানুষজন নাই।

এক লোকরে হঠাত দেখলাম হাঁটতেছেন। আন্ধারে চেহারা দেখা যায় না।  আন্দাজ পয়ত্রিশ হবে বয়স। আমি তারে গিয়া বললাম, দোকান কি এখন খোলা পাব এইদিকে?

লোক বললেন, না। এখন তো বন্ধ। যাইতে হবে কালাপানিতে। কী দরকার আপনের?

আমি বললাম, ম্যাচ।

আপনে মানিক ভাইয়ের বাড়িতে উঠছেন না?

হ্যা।

উনি বললেন, আপনে আসেন আমার লগে।  

আমি বেশি না ভাইবাই গেলাম। আর আপনে জানেন, এইভাবেই হরর গল্পের নায়কেরা বিপদে পড়েন।

উনি তার বাসায় নিয়া গেলেন। বাড়িও আন্ধারে বইসা আছে, নিরবে।  গিয়া উনি দু’তলার জানালা লক্ষ কইরা তার আম্মারে চিল্লাইয়া বললেন, আম্মা আম্মা, আমাদের ঘরে যে ম্যাচ আছে, ঐ ম্যাচ দেন।

উনার আম্মা খুঁজলেন। পাইতেছিলেন না।

ভদ্রলোক এইবার তালা খুইলা নিজেই উপরে গেলেন। সময় যাইতেছিল। আমি নিচে দাঁড়ানো। হাত দেখা না যাওয়া অন্ধকারে। আমি ভাবতেছিলাম উনি তার বউরে না বইলা আম্মারে কেন জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু আমার এইটা মাথাতে আসলো না, আমি কেন ধইরাই নিলাম যে উনার বউ বাসাতেই আছেন। নাও তো থাকতে পারেন। আর উনি বিবাহীত এইটা আন্দাজ করছিলাম বাচ্চাদের গলা শুনে। এই বাচ্চা বা বাচ্চারা তো তার বাচ্চা নাও হইতে পারে। কিন্তু এইগুলা তখন মাথায় আসে নাই, কেবল আসছে রহস্যটা কী, বউরে না বলে মা’রে জিজ্ঞেস করলেন কেন উনি। হয়ত বউ এইভাবে মাঝ রাতে ম্যাচের কথা জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হইতেন। ইত্যাদি ভাবতেছিলাম।

কিছু পরে ভদ্রলোক আইসা বললেন, ভাই আমার ঘরে ম্যাচ নাই। আমাদের চুলা অটোমেটিক। আমি আগে আনছিলাম কিছু ম্যাচ, ভাবছিলাম ঐগুলা আছে। কিন্তু নাই।

আমি বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি কষ্ট করলেন। আমি রাস্তার উপরে গিয়াই আনতেছি।

তখন আমি এক প্রকার নিশ্চিতই ধইরা নিলাম, বউয়ের ঝাঁড়ি খাইয়া আসছেন উনি।

আমি যাইতে শুরু করলাম।

অর্ধ পথ গেছি, আন্ধারে আন্ধারে। কিছু পরে দেখি আবার পিছন থেকে একজন ডাকতেছে।

আমি দাঁড়াইলাম, আর লোকটা আসলো। দেখলাম সেই লোক। তিনি এবার ম্যাচ নিয়া আসছেন। বললেন, এইটা দেখেন তো কাজ করে কি না। অনেক আগের। আমার আম্মা বাইর কইরা দিছেন।

আমি চেষ্টা করে দেখলাম জ্বালানোর। জ্বলে না। উনারে ধন্যবাদ দিয়া ম্যাচটা রেখে দিলাম।

এরপর রাস্তার উপরে যাই। গিয়া একটা দোকান খোলা পাই। ফলে আর কালাপানিতে যাইতে হয় নাই।

ম্যাচ পাইছি। পার পিস দুই টাকা দাম।

আর ঐ যে ভদ্রলোক, যারে আপনে এতক্ষণ কিছু কিছু রহস্যময় ভাবতেছিলেন, উনি ম্যাচ জ্বলে না দেইখা ওই সময় বলতেছিলেন, একটু লজ্জ্বিত হইয়াই, ফালাইয়া দেন ভাই।

কিন্তু আমি ফেলি নাই। যে নিঃস্বার্থ আগ্রহ ও মানবিক বোধে তিনি সাহায্য করতে আগাইয়া আসছিলেন, তারে ফালানো যায় না! ম্যাচটা তাই রাইখা দিছিলাম।

এখন আর নাই ওইটা। কিন্তু ছবি আছে। আর এই লেখাও থাকল ঐ ম্যাচ, ও ঐ লোকের সম্মানে, অন্ধকারে যার চেহারা দেখা হয় নাই। তার ম্যাচ জ্বলে নাই, কিন্তু ট্রাস্ট ও মানবিকতার একটা স্পার্ক তার পুরান ম্যাচ লাগাইতে পারছে। একটা প্রতিকী হিসাবে ধরলে পরিবেশের অন্ধকার ছিল মানুষের ডার্কনেসের প্রতীক, আর ভদ্রলোকের ম্যাচ দেয়ার চেষ্টা ও পুরান ম্যাচটা আমার হাতে দেয়া ছিল সেই আন্ধার শেষের আলো। যেই আলোর আশাতেই আমি লেখি, আপনে পড়েন, ও আমরা সম্মিলিত ভাবে আগাইয়া নিতে থাকি সভ্যতারে।

আমি ঐ লোক ও তার পরিবারের জন্য আনন্দময় জীবন কামনা করি।