বই ও লেকচার যে কারণে কাজ করে না

বই হচ্ছে একটি মাধ্যম যেখানে লেখক তার চিন্তা বা আইডিয়া লিখে রাখেন। এটি পড়েন পাঠক। পড়ার মাধ্যমে তিনি তার নিজের মস্তিষ্কে লিখিত চিন্তা বা আইডিয়াগুলি নেন। সাধারণভাবে এটা হলো বই থেকে কীভাবে জ্ঞান ছড়ায় বা আহরিত হয় তার মডেল।

আপনি হয়ত এটি লক্ষ করেছেন যে কোন বই পড়ার পর এর খুব কম জিনিসই মনে থাকে। এর একটা কারণ স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্বতা। কিন্তু স্মৃতিশক্তির উপর পুরো দোষ দেয়া যাবে না। কারণ আপনি যখন বইটি পড়েছিলেন তখন আপনার মনে হয়েছিল অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন। কিন্তু পরে, ধরা যাক ছয়মাস পরে চিন্তা করতে গিয়ে আপনি কয়েকটি বাক্য ছাড়া দেখলেন বিষয়টা আর মনে নেই। বা মূল বিষয়টাই মনে নেই। এই অবস্থায় পুরো দোষ স্মৃতি শক্তির উপরে দেয়া যায় না। বরং বই কীভাবে কাজ করে জ্ঞান সঞ্চারণে, এবং মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে কোন জিনিস শেখে – এই দুই মডেলের তুলনামূলক আলোচনা করে দেখতে হবে। দেখতে হবে যে দুই মডেলের পার্থক্য কোথায় এবং কোন কোন পার্থক্যের কারণে বই জ্ঞান সঞ্চারণ তথা ট্রান্সফার করতে মাধ্যম হিসেবে ব্যর্থ।

বইয়ের সাথে এখানে লেকচারের কথা আনা যাক। কোন লেকচারের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার হয়। শ্রোতারা যখন উপস্থিত থাকেন তখন তাদের মনে হয় তারা বিষয়টি বুঝতে পারছেন। কিন্তু পরে দেখা যায় আসলে যতটা ভেবেছিলেন ততটা বুঝতে পারেন নি।

লেকচারের ক্ষেত্রে মডেলটা হল, একজন ব্যক্তি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। তার সামনে শ্রোতারা শুনছেন। কেউ কেউ নোট করছেন।

এখানে জ্ঞান বা তথ্য ট্রান্সফার করা হচ্ছে সামনের ব্যক্তি সবার উদ্দেশ্যেই। আলাদা ব্যক্তির গ্রহণ ক্ষমতা কতটুকু, কীভাবে তিনি প্রসেস করবেন ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। এই পদ্বতিকে বলে ট্রানমিশনিজম। বই ও লেকচার ট্রান্সমিশনিজম পদ্বতিতে কাজ করে।

ট্রান্সমিশনিজম মানুষের লার্নিং বিষয়ে একটি ভুল মডেল। যেখানে ধরা হয় বক্তা জ্ঞান দিচ্ছেন ও শ্রোতারা শুনে তা গ্রহণ করছেন। বা লেখক লিখে গেছেন, পাঠকেরা পড়ে তা গ্রহণ করছেন। কিন্তু আসলে মানুষ এভাবে গ্রহণ করতে পারে না।

বই এবং লেকচার দুইটিও এই পদ্বতিতে কাজ করে। [ আমেরিকার কে-১২ শিক্ষা কারিকুলাম থেকে লেকচার বাদ দেয়া শুরু হয়েছে।]

বই চিন্তায় সাহায্য করে এ নিয়ে বলতে গিয়ে যে কথাটি বলা হয় তা হল লেখায় থাকা বস্তু বা আইডিয়া বিষয়ে ব্যক্তি কল্পনা করেন, বই পড়ে লাভ কী প্রবন্ধে এ নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছিলাম। টিভি বা ভিডিওর ক্ষেত্রে এমন হয় না। কিন্তু এটি এভাবে কাজ করলেও, এখানে মনে রাখতে হবে লেখকেরা ডিটেইল বর্ননা দিয়ে দেন লেখায়। সেই অনুসারেই পাঠক চিন্তা বা কল্পনা করেন। ফলে এখানে লার্নিং এর জায়গা কম থাকে।

বই থেকে লার্নিং হয়, যখন পাঠক ওই জিনিসটি নিয়ে প্রশ্ন করেন। এই প্রসেসটা এত সূক্ষ্ম যে পাঠক নিজেই বুঝতে পারেন না। যেমন আমি একটা জিনিস পড়ছি তখন আমার মনে হল আমার কোন অভিজ্ঞতা, কোন বইয়ে পড়া অন্য কিছুর সাথে বর্তমানে পড়তে থাকা জিনিসটি মিলে বা ব্যতিক্রম। তখন আমি এই মিল বা ব্যক্তিক্রমতা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।

অথবা, কোন জায়গায় এসে আমার মনে হল, এই ব্যাপারটা কীভাবে হয় আমি বুঝতে পারছি না, তাই চিন্তা করতে শুরু করলাম।

বা আমি বইটি থেকে নোট নিলাম, সামারি করলাম, বা বইয়ের আইডিয়ার আলোকে নানা ব্যাখ্যা দিলাম বিভিন্ন বিষয়ের। এইসবের ক্ষেত্রে ব্যক্তি কিন্তু লেখকের আইডিয়াই লিখেন না, তিনি জিনিসটাকে প্রসেস করেন, সিন্থেসাইজ করেন, এনালাইজ করেন। এটি লার্নিং হিসেবে কাজ করে।

ব্রেইন এভাবেই শিখে। এটাকে বলে থিংকিং আবাউট থিংকিং। চিন্তা নিয়ে চিন্তা করা। মেটাকগনিশন।

একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই জিনিসটা সহজে আসে না। এমনকি তিনি যদি জানেন এভাবে এভাবে করতে হয়, মেটাকগনিশনের মাধ্যমেই বই থেকে শেখা যায়, তাও তিনি এটি সহজে করতে পারবেন না।

আপনি মনে করতে পারেন যদ্যপি আমার গুরু বইতে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক আহমদ ছফাকে বলেছিলেন, কোন বই পড়ে তা নিজের ভাষায় লিখতে পারেন কি না, সেটা ভাবতে। যদি নিজের ভাষায় লেখতে পারেন, তাহলে আপনি বুঝেছেন। রাজ্জাক সাহেব এখানে মানুষের ব্রেইন কীভাবে শিখে, এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন নিজের অভিজ্ঞতায়। মেটাকগনিশন ট্রিগার করতেই তিনি আহমদ ছফাকে এই উপদেশ দিয়েছিলেন।

চিন্তাশীল পাঠের জন্য যেসব প্রশ্ন আসে, আমি কী পড়ছি? আমি কি বইটি সারমর্ম করতে পারব? আমি কি অন্যকে বুঝাতে পারব? আমার কী কী প্রশ্ন করা উচিত?

আমি কি ব্যাপারটা বুঝেছি? নাকি আরো কোন লেখার সাহায্য নেব? নাকি আবার পড়ব?

ইত্যাদি।

এই কারণে বই নিয়ে আলোচনা ভালো। আলোচনা বলতে কয়েকজন বসে  এনগেইজিং আলোচনা, প্রশ্ন উত্তর এবং  বিভিন্ন ব্যাখ্যা ইত্যাদি। এগুলি মেটাকগনিশনের মাধ্যমে ওই বই থেকে লার্নিং তথা শিখতে সাহায্য করে।

 

এই লেখাটিও ট্রান্সমিশনিজম পদ্বতিতে কাজ কড়ছে। আমি লেখছি ও আপনি পড়ছেন। ইন্টারনেটে প্রচুর ভালো লেখা, প্রচুর জীবন বদলে দেয়ার মত কাজ কারবারের পদ্বতি লেখা আছে। অনেক মানুষই এগুলি পড়েন। এদের বেশিরভাগেরই পড়ে কোন উপকার হয় না। কারণ এসব ক্ষেত্রে পড়াটাই শেষ কথা নয়। জিনিসটা কাজে লাগাতে হবে। তা না হলে আপনি পড়ে সময় নষ্ট করলেন।

এই লেখায় যে বিষয়ে আলোচনা করা হল তা কীভাবে কাজে লাগাবেন? মেটাকগনিশনকে গুরুত্ব দিন। বই থেকে শেখার পদ্বতিটি শিখুন। বই নিয়ে, বইয়ের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ও আলোচনা করুন। বই পড়া বাদ দিন, বই আলোচনা শুরু করুন। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সমমনা লোক, একই বই পড়া লোক সহজে আপনি পেয়ে যেতে পারেন। তাদের সাথে মিলেই চিন্তা বিষয়ক চিন্তার মাধ্যমে লার্নিং শুরু করুন।

 

সংযুক্তিঃ 

“In general, those who have more expertise, who are better readers, and who are more successful students seem to have greater awareness and control of their own cognitive activities while reading. The research also reveals that adults evaluate and regulate their ongoing efforts to understand, although there is considerable room for improvement in these skills. Finally, the research shows that adults are remarkably unsuccessful at assessing how well they have comprehended a text and whether or not they are ready to take a test on the material.”

Baker, L. (1989). Metacognition, comprehension monitoring, and the adult reader. Educational Psychology Review, 1(1), 3–38.