মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » মহাকালের মহাগর্তে ইন্ডিভিজুয়াল একটা ধইঞ্চা

মহাকালের মহাগর্তে ইন্ডিভিজুয়াল একটা ধইঞ্চা

মহাকালের যে গর্তে আমরা সবে বাস করতেছি, সেই আমাদের পূর্বপুরুষদের শুরু থেকে, এই বাস করায় আমাদের সবার মিলেমিশে এক অস্তিত্ব আছে। যেটারে সমাজ সভ্যতা বা যে নামেই ডাকেন।

আমরা এই যাত্রায় বিভিন্ন পাটাতন তৈরি করছি। যেমন জ্ঞানের পাটাতনের কথাই ধরেন। এই যে বাংলা ভাষার অক্ষরগুলা দিয়া লেখতেছি, এই অক্ষর, এইগুলা দিয়া লেখার নিয়ম অনেক অনেক ব্যক্তি মিলে, অনেক সময় চিন্তা ও কাজ করে তৈরি করছেন। আরো অনেকে ব্যবহার করছেন, জনপ্রিয় করছেন। ফলে, এখন আপনে এইটা বুঝতে পারেন, আমি লেখতে পারতেছি। আমার ভেতরে যে চিন্তাটার জন্ম হইছে তা প্রকাশ করতে পারতেছি, আপনার সাথে কমিউনিকেট করতে পারতেছি। এটা এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি।

তারপরে, যে প্লাটফর্মে লেখলাম, এইখানের কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজ কিছু মানুষ তৈরি করছিলেন। এই ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে এই প্রডাক্টের নির্মাতারা বানাইছেন এই লেখার প্লাটফর্ম। অনেক প্রযুক্তিগত টুল এটার সাথে জড়িত, যেমন ক্লাউড স্টোরেজ, ডিজাইনের টুল ইত্যাদি, সবগুলার ফান্ডামেন্টাল মানুষেরা একসময় তৈরি করে গেছিলেন। সেইসবের উপর ভর করে এইসকল টুল তৈরি হইছে।

এইভাবে সমাজ ও সভ্যতায়, আইন আদালত বিচার, সামাজিকভাবে বসবাসের পদ্বতির নিয়ম কানুন তৈরি হইছে মানুষের চেষ্টায়, নিরন্তর ট্রায়াল এন্ড এররের মাধ্যমে। আমরা এইগুলার সুবিধাভোগী। জন্ম নিয়াই একটা শিশু আজ স্মার্ট ফোন পায়, একসময় মানব শিশু জন্ম নিয়া দেখত সে জঙ্গলে, চারপাশে অন্ধকার।

আমাদের যাত্রা সব সময়েই অতীত সভ্যতার উপর ভর করে।

আমরা যদি এইরকম হইতাম, কোন জ্ঞান আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মরে দিয়া যাইতে পারতাম না, তাহলে এখনো আমরা আমাদের নিকটাত্মীয় শিম্পাঞ্জীদের অবস্থায় থাকতাম।

গ্রাউন্ডহগ ডে ফিল্মের মত একই কাজ বার বার করা হইত।

ইন্ডিভিজুয়াল তথা একক ব্যক্তির নানা বড় সাফল্য থাকে, যা সমাজের সভ্যতার গতিপথ বদলে দেয়, কিন্তু তারেও তৈরি হইতে হয় সভ্যতার জ্ঞানের উপর ভর করে। পুরানা ফিজিক্সের জ্ঞান না থাকলে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা সূত্র বের করতেন না, হয়ত আবার নিউটনের মত অভিকর্ষ নীতিই বের করতেন।

আমাদের উন্নতির মূলে আমাদের সেকন্ড ব্রেইন, যেই ব্রেইন মানব সভ্যতার সামষ্ঠিক অর্জন, যা আছে নানা বই পুস্তকে।

আমরাও সেই সেকন্ড ব্রেইনে কন্ট্রবিউট করে যাই।

যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেইখান থেকে নিয়া আরো ইনোভেট করতে পারে।

এই যে একটা মহাযাত্রা, এতে একজন ব্যক্তি দিয়া কিছুই না। একজন ব্যক্তি মহা জিনিয়াস হইলেও কিছু হইত না যদি সামগ্রিকভাবে জিনিয়াস, প্রতিভাবান, মাঝারি প্রতিভাবান, কম প্রতিভাবান, প্রতিভাহীন ও গাড়লেরা না থাকতো।

মানুষের “ভিড়” বা “ক্রাউডের” অংশ না হইয়া নিজের একজন ব্যক্তি হইয়া উঠা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। তখন সে নিজে চিন্তা করবে, বুঝতে শিখবে। কিন্তু এর মানে কখনোই না সে নিজেরে একাই সকল কিছু মনে করবে। মহাকালের মহাযাত্রার সাপেক্ষে সে এমন কিছু হয় নাই, হইতে পারবে না। কেউই হইতে পারে নাই।

কারণ এইখানে যার সাথে তুলনা হচ্ছে তা দুনিয়ার বিগত দিনের সব জ্ঞানী, মহা জিনিয়াসদের জ্ঞানের সম্মিলন। এর সাথে তুলনা হয় না, কারণ এর উপর দাঁড়াইয়াই আমাদের থাকতে হয়।

এইটা কি একটা রুঢ় বাস্তবতা যে মহাকালের মহাকায় গর্তে ইন্ডিভিজুয়াল ধইঞ্চা? না, বরং এইটা মানুষের জন্য স্বস্তির। তার কাঁধে সভ্যতারে টাইনা নেয়ার দায় নাই। সে তার নিজের লাইফ নিজে যাপন করতে পারবে। তার সাহায্যের জন্য আছে সভ্যতার সেকেন্ড ব্রেইন।

যখন আমরা সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানের কথা বলি, যেমন রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি, তখন আমাদের ইন্ডিভিজুয়াল হিরোদের দিয়া বিচার করলে হবে না। এই হিরো পূজাসমূহ তৈরি করে অন্যায় ও অসাম্য। ধইরা নিলেন কোন হিরোই বানাইছেন আপনার দেশ। এই চিন্তা তো প্রিমিটিভ, জঙ্গলি সমাজের চিন্তা। পরে, এই হিরোর উত্তরসূরিদের পূজা করলেন। তারা কায়েম করলো তাদের রাজত্ব। তারা তাদের আদর্শ, চিন্তার প্রতিফলন দেখাইয়া খাইয়া দিলো পাবলিকের মানবাধিকার। তোমার যে মানবাধিকার থাকলো না, যেই অধিকার আধুনিক সমাজে জন্ম নিয়াই তুমি প্রাপ্ত হও; তোমার ভয়েজ গেল কই, তারই খালি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আছে, তোমার নাই? তোমার স্বাতন্ত্র্য কি পূজায় ও পূজনীয়দের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে? এর চাইতে কি ভালো হইত না যদি তুমি সামগ্রিক পাবলিক লিবার্টিরে বেশী পূজা করতা?

এইটা এক প্যাথেটিক বাস্তবতা। এই ধরণের চিন্তা ডমিনেন্ট যে সমাজে, সেখানে রিপাবলিক, বা জনতন্ত্র করতে পারবেন না।

লেইট রোমান রিপাবলিকে জুলিয়াস সিজারের এম্বিশন ও শাসনের বিরুদ্ধে খাড়াইছিলেন, ক্যাটো দ্য ইয়াংগার। তিনি ছিলেন রোমান রিপাবলিকান ভ্যালুর পক্ষে, দেখতে পাইতেছিলেন সিজারের এম্বিশন ও পলিটিক্যাল রিফর্ম রিপাবলিকের ভ্যালু নষ্ট করে দিবে। তিনি সফল হইতে পারেন নাই, সিজারই জিতছেন। গৃহযুদ্ধে জিতার পর সিজার রিপাবলিক ভেঙ্গে দেন, ক্যাটো সিজারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার চাইতে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করে হারিকিরি করেন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রিপাবলিকের নীতি ও ভ্যালুর পক্ষে আমৃত্যু তার অবস্থান নেবার স্পিরিটের জন্য, আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদাররা তারেই আদর্শ হিশেবে নিছিলেন, সিজাররে নেন নাই।

মিশেল ডি মঁতেইন তার প্রবন্ধগুলাতে ক্যাটো সম্পর্কে ওই সময়ে রোমান কবিদের লেখা কিছু লাইন উল্লেখ করেছিলেন। এর এক লাইন ছিল, “ক্যাটো সবাইরে আইন শিখাইয়া গেলেন।”

ক্যাটোর এই সিজারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর স্পিরিট হইল, কালেকটিভ হিউম্যান ফ্রিডমের পক্ষে দাঁড়ানো, এবং এক ব্যক্তির সর্বসময় ক্ষমতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। তাই, এইখানে যে আমি ক্যাটোরে নিয়া বলতেছি তা ব্যক্তি ক্যাটোর মাহাত্ম্যের বর্ণনা না ব্যক্তিপূজার দিক থেকে না, বরং তিনি যে ব্যক্তির চাইতে ভ্যালুর পক্ষে কঠিনভাবে দাঁড়াইছিলেন, সেই স্পিরিটের বর্ণনা। ক্যাটো এই লেখা দেখলে নিশ্চয়ই ভালো বলতেন।

রোমান এই প্রভাবশালী পলিটিশিয়ান ও স্টোয়িক দার্শনিক তার স্ট্যাচু বসানোর বিপক্ষে ছিলেন, বলছিলেন, আমি চাই না মানুষ বলুক এইখানে ক্যাটোর মূর্তি কেন, বরং বলুক ক্যাটোর মূর্তি নাই কেন?

রাষ্ট্র, সমাজ ও কালেক্টিভ যেসব সিস্টেম আছে, সেইসব ন্যায়ভাবে তৈরির ক্ষেত্রে, ক্যাটোর কালেক্টিভ ভ্যালু, হিউম্যান লিবার্টির পক্ষে দাঁড়ানোর স্পিরিটের বিকল্প নাই। এবং এই স্পিরিটের সহজ দার্শনিক রূপ হচ্ছে, এই পোস্টের শিরোনাম, মহাকালের মহাগর্তে ইন্ডিভিজুয়াল একটা ধইঞ্চা। সিজারের চাইতে রোমান রিপাবলিক বড়।

আম পাবলিকের চাইতে এইটা বেশী বুঝা দরকার প্রতিভাবানদের। জিনিয়াসেরা এটা কমবেশি বুঝেন।

No man is an island entire of itself; every man

is a piece of the continent, a part of the main.

John Donne

May be an image of 1 person and text that says 'The person who goes about saying "I did, did it," will never find peace.'

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং