অপরাধবোধ এবং এর প্রয়োজনীয়তা

মানুষের জীবন কি কেবলমাত্র তারই জীবন? নাকী সমাজের প্রতি তার একটি দায়িত্ব রয়েছে? এই ধরনের প্রশ্ন করলে অধিকাংশ মানুষই বলবেন, মানুষের জীবন খালি তার জীবন নয়, সমাজের প্রতি এবং অন্যদের প্রতি তার দায়িত্ব আছে। এবং মানুষেরা তার জীবন যাপনে পরিবার আত্মীয় এবং সমাজের প্রতি তাদের এ দায়িত্ব পালন করেন বা করেন বলে মনে করেন।

ধরা যাক, আপনি একজন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবক। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। আপনি চাকরি চান এবং এই কাজের পরিবর্তে আপনি একটি বেতন প্রত্যাশা করেন। আপনি মনে করেন দেশে দুর্নীতিবাজেরা দুর্নীতি করে ধনী হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মচারীদের প্রতি আপনার ক্ষোভ আছে।

কিন্তু, আপনি সকালে চা খাচ্ছেন। সেই চায়ের শ্রমিকেরা তাদের মূল্য পাচ্ছে না যথাযথভাবে। তারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনার কোন চিন্তা নেই। নিত্য চা খাওয়ার জন্য আপনার মধ্যে কোন অপরাধবোধ কাজ করে না।

দুই, আপনি রিকশায় চড়ছেন। রিকশাওয়ালা একজন ব্যক্তি যে নিজের ঘাম ঝড়িয়ে আপনাকে টেনে নিয়ে যায়। তার শ্রমের বিপরীতে আপনি যে টাকা তাকে দেন, তা পর্যাপ্ত নয়; দেশ বিদেশের শ্রমমূল্যের খবর রাখা আপনি তা জানেন। কিন্তু এ নিয়ে আপনি কখনো ভাবেন না।

উপরোক্ত দুই ঘটনায়, এবং এই ধরনের অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রে কথা এটা নয় যে আপনি চা খাবেন না, বা রিকশায় চড়বেন না। এগুলি আপনি করছেন, করবেন যেহেতু সিস্টেমের মধ্যে আপনি ঐসব শ্রমিকদের চাইতে উচ্চ আসনে বসেন কেবল মাত্র জন্ম ভাগ্যে। আপনার জায়গায় তারা থাকলে হয়ত তারাও একই কাজ করত। এটা করাই বর্তমান অর্থনৈতিক সিস্টেম চালু থাকা। এই অর্থনৈতিক সিস্টেম বদলের যদি কোন ধারণা থাকে, আমি সেদিকে যাবো না আপাতত। আমার বর্তমান লেখার বিষয় সমাজে মানুষের এথিক্যাল অবস্থান।

আপনার চা খাওয়া বা রিকশায় চড়া খারাপ নয়, কিন্তু এখানে অপরাধবোধ না থাকাটা ভয়াবহ। এবং অনৈতিক।

অপরাধবোধ না থাকলে আপনি আপনার নিজের জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। ধরা যাক আপনার টাকা হলো। বিলাশ ব্যসন, এবং আত্মতৃপ্তির জন্য কিছু দান খয়রাত করলেন। এই আপনার দায়িত্ব পালন শেষ বলে আপনার মনে হলো। আপনি দানের আত্মশ্লাঘা অনুভব করবেন।

আর অপরাধবোধ থাকলে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার প্রতিদিনের জীবন ও বেঁচে থাকায় অন্য অনেক মানুষের অবদান আছে। আপনি চা শ্রমিকদের সম্পর্কে তখন জানতে চাইবেন। তাদের অবস্থা নিয়ে পড়ালেখা করার তাগিদ অনুভব করবেন। তাদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে থাকবেন। কখনো আপনার যদি অর্থনৈতিক বা অন্য কোন ধরনের ক্ষমতা হয় তাহলে এই ধরনের মানুষদের আপনি সাহায্য করবেন। তখন আপনার মনে হবে না আপনি দান করছেন, কারণ আপনি বুঝতে পারবেন এটা আপনার দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনের আনন্দ হতে পারে আপনার, দানের অহংকার নয়।

এই অপরাধবোধ অন্ধ ভোগবাদী কনজিউমার না বানিয়ে আপনাকে সচেতন একজন মানুষ বানাবে। ইউরোপের লোকেরা কম দামে পোশাক পরতে পারে বাংলাদেশের মত দেশের শ্রমিকদের ঘন্টায় বিশ টাকা দিয়ে।  এই পোশাক তৈরীর সাপ্লাই চেইনে শ্রমিকেরা যে মানবেতর ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা ইউরোপের ভোক্তারা এতদিন বুঝে নি, রানা প্লাজা ঘটনার পরে তাদের অল্প গোচরে এসেছে ব্যাপারটা। কিন্তু তা জানা কি ভোক্তার উচিত নয় যা আমি খাচ্ছি বা পরছি তার পিছনে কাদের শ্রম আছে? তারা খাচ্ছে কি?

অপরাধবোধ তাই খুবই দরকারী জিনিস এই ক্ষেত্রে। আপনি একটা সুবিধাপ্রাপ্ত সামাজিক শ্রেনীতে জন্ম নিয়েছেন বলেই কিছু সুবিধা পাচ্ছেন। জ্ঞানার্জন এবং বিভিন্ন স্কিল বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। একজন চা শ্রমিকের ছেলে তা পাচ্ছে না কেবলমাত্র তার জন্মের কারনে।

জন্ম একটি ভাগ্য। আপনি যে সামাজিক ক্লাসে জন্ম নিয়েছেন, যেসব সুবিধা পাচ্ছেন তা কেবলই ভাগ্যে।

আপনার দায়িত্ব এই ভাগ্যগুণে প্রাপ্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করা, এবং যারা দুর্ভাগ্যের কারণে এই সুযোগ পায় নি, তাদের জন্যও কিছু করা। কারণ আপনার জীবনে তাদের অবদান আছে।

মানুষের হিপোক্রিসি এই যে, সে নিজের সব প্রাপ্তিকে তার পরিশ্রম, প্রতিভা বা প্রাপ্য ইত্যাদি মনে করে এবং অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতাকে দূর্ভাগ্য বলে ধরে নেয়। যদিও প্রত্যেক প্রাপ্তিতে ভাগ্যের ভূমিকা থাকে প্রচুর।

অষ্ট্রেলিয়ান মোরাল দার্শনিক পিটার সিংগার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বর আক্রমণ দেখে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবতার জন্য সাহায্য করার প্রয়োজন বোধ করেন। তিনি তার তত্ত্ব দাঁড় করান, তিনি ধনী দেশের লোকদের বিলাসী জীবন যাপনকে অনৈতিক বলেন এবং একটি কাল্পনিক গল্প তিনি উপস্থাপন করেন এভাবেঃ

ধরা যাক, একজন লোক তার দামী কাপড় ও জুতা পরে যাচ্ছেন একটি পুকুরের পাশ দিয়ে। পুকুরে একটি শিশু ডুবে যাচ্ছে। আশপাশে কোন মানুষ নেই। তিনি শিশুটিকে বাঁচাবেন কি না? বাঁচাতে গেলে তার কাপড় ও জুতা নষ্ট হবে। আর না বাঁচাতে গেলে শিশুটি মারা যাবে।

অধিকাংশ লোকই এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তারা বাঁচাবেন শিশুটিকে। এবং না বাঁচানোটি অনৈতিক হবে।

সিংগার তখন বলেন, তাহলে আপনি যে বেশী টাকা দিয়ে দামী জুতা ও দামী কাপড় কিনছেন সেই টাকাটা কোন দাতব্য সংস্থায় দান করে দিন যারা পৃথিবীর দুর্গত সব এলাকায় মানুষের জন্য কাজ করছে। আপনার এই টাকা একটি নয়, কয়েকটি শিশুর হয়ত জীবন বাঁচাবে।

পিটার সিংগারের যুক্তি হলো, পৃথিবীর দুর্গত যেসব এলাকায়, দূর্ভাগ্যপীড়িত যেসব মানুষ বাঁচার জন্য যুদ্ধে রত তাদের সাহায্য করা উচিত অপেক্ষাকৃত সৌভাগ্যবানদের, বিলাসী জীবন যাপনে টাকা না উড়িয়ে।

মানুষের জীবনে কোন অর্থ তৈরীর জন্য সবচেয়ে সেরা উপায় হলো মানবতার বড়ো একটা কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করা। তা হতে পারে এনিম্যাল রাইটস, আর্ত মানবতার সেবা, বা পরিবেশ রক্ষা ইত্যাদি।

পিটার যে যুক্তি দেন আর্ত মানবতার সেবার উদ্দেশ্যে ধনীদের দান করার জন্য, এর পিছনে অপরাধবোধের অংশ আছে। ভাবুন, একটা লোক তার দামী কাপড় ও জুতা নষ্ট হবে ভেবে গরীব শিশুটিকে বাঁচাল না, ডুবতে দেখেও চলে গেল হেটে। তার ভিতরে অপরাধবোধ তৈরী হওয়া দরকার, অন্যথায় সে কখনোই বুঝবে না সে একটি অনৈতিক কাজ করেছে।

সাধারণ মানুষকে তাদের বিলাসী জীবন যাপনের অপরাধবোধ বা গিল্ট বুঝাতেই পিটার সিংগার এই কাল্পনিক গল্প সামনে আনেন।

অপরাধবোধ তাই গুরুত্বপূর্ন। সাধারনত মানুষের মধ্যে বিলাসী জীবন যাপনের জন্য অল্প অপরাধবোধ এমনিতেই উৎপন্ন হয়। সে জানে অন্য মানুষেরা কষ্টে আছে আর এদিকে সে বিলাসে ব্যস্ত। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের পন্য বিক্রির জন্য ভোক্তাদের মধ্যে এই অপরাধবোধ তৈরী হোক তা চায় না।  স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক বলেন, স্টারবাকসের কফি ইত্যাদিতে লেখা থাকে এর ৫% যাবে আফ্রিকায় বিপন্ন মানবতার সেবায়, ৫% গুয়েতেমালায় ইত্যাদি। এগুলির মাধ্যমে ঐসব কোম্পানিগুলি এমন একটি অবস্থা তৈরী করে যে, ভোক্তার কফি খাওয়াটা ভোগ নয়, আসলে এক ধরনের দান। এই প্রক্রিয়ায় তারা ভোগের অপরাধবোধ কমাতে চায়। তারা ভোক্তাকে আরো আরো ভোগে মত্ত করতে চায়, যেখানে ভোক্তা এই বিভ্রান্তিতে থাকবেন যে তিনি আসলে ভোগ করছেন না, দান করছেন।

 

শেষকথা

আপনার জীবনে বিভিন্ন ভাবে যেসব মানুষ অবদান রেখে চলেছেন তাদের আপনার মনে রাখা দরকার। এর জন্য এই না যে সব ছেড়েছুড়ে আপনি সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন, আমি তা বলি না। কারণ অবদানের দিক থেকে পরিবারের অবদানই বেশী। তাদের প্রতি দায়িত্ব আছে আপনার। কিন্তু অভারল আপনার মনে রাখা দরকার অন্য সব মানুষদের কথাও যারা দূর্ভাগ্যের জন্য সামাজিক সিস্টেমে ভোক্তভোগী হয়ে আছেন। পিটার সিংগারকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি নিজে ইউরোপে জীবন যাপন করেন, অনেক বইপত্র কিনেন, এগুলির অনেক খরচ, এই টাকা দিয়েও অনেক মানুষ বাঁচানো যেন, আপনার এই যে বিলাস একে আপনি কীভাবে জাস্টিফাই করবেন?

পিটার সিংগার
ছবিঃ পিটার সিংগার

পিটার সিংগার দীর্ঘদিন ধরে তার (এবং তার স্ত্রীও) আয়ের অর্ধেক দাতব্য সংস্থায় দিয়ে দেন, একেবারে সাধারণ জীবন যাপন করেন। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, আমি জাস্টিফাই করি না। আমি এগুলি হয়ত দিতে পারতাম।

এই উত্তরটি হচ্ছে অসাধারণ। অর্থাৎ, তিনি তার বই কেনা বা সাধারণ জীবন যাপনের ব্যয়কেও জাস্টিফাই করতে যান নি। তিনি তার ভেতরে অপরাধবোধ রাখেন এর জন্য।

যে জাস্টিফাই করে, সে দামী কাপড় ও জুতা নষ্ট হবে বলে ডোবা থেকে গরীবের ডুবন্ত শিশুকে না বাঁচানোর ব্যাপারটাকেও জাস্টিফাই করতে পারবে। হয়ত বলবে, আরো তো মানুষ আছে পৃথিবীতে বা একজন মানুষের মৃত্যু তেমন কিছু না অথবা গরীব হয়ে তার বেঁচে থাকার চাইতে ডুবে মরাই ভালো। নিজের অনৈতিকতাকে জাস্টিফাই করার জন্য যুক্তি’র অভাব হয় না, একজন অনৈতিক মানুষের।

আপনার মধ্যে যেন অপরাধবোধ থাকে। এই অপরাধবোধগুলিই আপনাকে একজন ভালো মানুষে পরিণত করতে পারে।

মানুষ হয়ে, অন্য মানুষের দুঃখ যদি আপনি না বুঝেন, তাহলে আর বুঝার কেউ নেই।