হুমায়ূন আহমেদের গল্প সে ও শিশুহত্যা বিষয়ে

নতুন জন্মানো শিশুরে হত্যা করার ঘটনা পৃথিবীতে অনেক আগেকাল থেকেই চলে আসছে। যদিও আমাদের বর্তমান ‘মানবিক’ ধারণায় আমরা মনে করি শিশুদের হত্যা করা সবচেয়ে জঘন্য, তবুও শিশুহত্যার ইতিহাস দেখলে দেখা যায় সে ইতিহাস বিস্ময়কর।

শিশুদের যেসব কারণে হত্যা করা হতো তা মোটামোটি এরকমঃ

১। দারিদ্রতার জন্য। দারিদ্রতার জন্য সন্তান বেঁচে দেবার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে, যেমন শায়েস্তা খাঁ এর আমলে বাংলাতেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।

২। বিকলাঙ্গ বা কোন ভয়ংকর রোগগ্রস্থ শিশু জন্মালে। এসব শিশুদের ডাইনি বা অন্যান্য নাম দিয়ে হত্যা করা হত। অর্থাৎ মানব হিসেবে তাদের স্বীকার না করেই হত্যাটি করা হতো, যাতে অপরাধবোধ থাকে না।

এছাড়া নারী শিশুর ক্ষেত্রে এ হত্যার হার বেশী।

৩। কোন দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ। এক্ষেত্রে সুন্দর সুস্থ শিশুই হত্যা করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে শিশু ধরে এনে উৎসর্গ করা হতো।

বেশীরভাগ শিশুর জন্মের সময় হত্যার সিদ্ধান্ত কিন্তু নিয়েছেন তাদের মা’ই, এবং তিনি নিজেই তা কার্যকর করেছেন। শুনতে বিস্ময়কর হলেও এমন হয়ে আসছে।

এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কোন জঙ্গলে ফেলে রেখে আসা হতো শিশুটিকে। একে কম নির্মম মনে হবার কোন কারণ নেই, কারণ রূপকথার গল্পের মত শিশুটিকে অন্য কেউ খুঁজে পেয়ে বাঁচিয়ে ফেলবে এমন আশা ছিল খুবই ক্ষীণ। এখনকার সময় গাড়ি চলতে থাকা ব্যস্ত রাজপথে শিশুকে ফেলে আসার মত ছিল তখনকার শ্বাপদপূর্ন জঙ্গলে ফেলে আসাটা।

মানুষ এজন্যই রূপকথার গল্প তৈরী করেছে, এমন সব মানুষের গল্প যাদের বাচ্চাকালে ফেলে দেয়া হয়েছিল কোন কারণে, পরে অন্য কেউ নিয়ে লালন পালন করে, এবং পরে তারা বিশেষ কেউ হয়ে উঠেন। প্রায় সব সমাজেই এই গল্পের প্যাটার্ন পাওয়া যায়। মা’রা এটা ভেবেই স্বান্তনা পেতেন যে হয়ত তাদের শিশুটি বেঁচে থাকবে। তারা দয়া মায়াহীন সাইকোপ্যাথ ছিলেন এমন বলা যায় না। মায়া মমতা তাদের ছিল এখনকার মা’দের মতোই। কিন্তু সমাজ পরিস্থিতি ও ধারণা ভিন্ন ছিল।

গঙ্গায় শিশুহত্যা; Source: filipspagnoli.wordpress.com

মা’রা এই যে বাচ্চাদের ফেলে রেখে এসে ভাবতেন তারা হয়ত বেঁচে আছে, একে পেইন এভয়ডিং সাইকোলজিক্যাল ডিনায়াল দিয়ে বুঝা যেতে পারে।

জঙ্গলে ফেলে আসা বাদে অন্য সব শিশু হত্যার জন্য মা’রা চাইতেন কম কষ্ঠে সন্তানকে খুন করতে। শ্বাসরুদ্ধ করে ইউরোপে, এবং চীনে পানিতে ডুবিয়ে।

ইউরোপে সময়ের পরিবর্তন হলেও, নানা আইন হলেও এই শিশু হত্যা কিন্তু কমানো যায় নি। ইংল্যান্ডে ১৬২৪ সালে একটি আইন হয়, কোন নারী যদি কোন স্বাক্ষী না রেখে প্রসব করেন ও সন্তান মৃত হয় তাহলে তিনি শিশু হত্যায় অভিযুক্ত হবেন। এমন আইনও শিশুহত্যা কমাতে পারে নি। এমনকী পাথর নিঃক্ষেপ করার শাস্তি দিয়েও শিশু হত্যা কমানো সম্ভব হয় নি।

কমিয়েছে কনডম। কনডম ব্যবহার শুরুর পরেই শিশু হত্যা কমেছে।

কিন্তু শিশু হত্যার নৈতিকতা আছে কী?

হুমায়ূন আহমেদের একটি গল্পের নাম সে। এই গল্পে এক ভদ্রমহিলা এমন একটি সন্তান প্রসব করেন যা একটি মাংসপিন্ড। ভেতর থেকে শুঁড় বেরিয়ে আসছে। এবং তার টানা টানা দুই চোখ। গল্পে আছেঃ

“কুৎসিত কদাকার একটা কিছু যার দিকে তাকান যায় না। এ আর যাই হোক মানবশিশু নয়। চেনা-জানা পৃথিবীর সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একতাল মাংসপিণ্ড। এর থেকে হাতীর শুঁড়ের মত আট-দশটি শুঁড় বেরিয়ে এসেছে। শুঁড়গুলি বড় হচ্ছে এবং ছোট হচ্ছে। তালে তালে মাংসপিণ্ডটিও বড়-ছোট হচ্ছে। মানবশিশুর সঙ্গে এর একটিমাত্র মিল- এই জিনিসটিরও দু’টি বড় বড় চোখ আছে। চোখ দুটি ঘুরিয়ে সে দেখছে চারদিকের পৃথিবী। চোখ দু’টি সুন্দর। কাজল টানা।”

এই সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর ডাক্তারেরা একে খুন করে ফেলেন। হুমায়ূন আহমেদ গল্পটি এমনভাবে বলেছেন যে পাঠকের ঐ বস্তুটির প্রতি মায়া জন্মে।

কিন্তু কথা হলো, কাজটি নৈতিক হলো কি না?

জোনাথান গ্লোবাল, জেমস রাচেল, এবং পিটার সিংগারের মতো দার্শনিকেরা এমন সব হত্যা ঠিক না বেঠিক এর কিছু নৈতিক ভিত্তি চান বিচার করার জন্য। তাদের কথা হলো মানব জাতি নিজে মানব জাতির অংশ হয়ে বলতে পারে না যে কোন মানবসন্তানকে হত্যা করা বেঠিক। এর জন্য তাদের কিছু নৈতিক ভিত্তি বিচারে নিতে হবে, হত্যা ঠিক না বেঠিক তা বিচারের জন্য।

প্রথমত হলো, এর সুখ এবং দুঃখ অনুভব করার ক্ষমতা আছে কি না।

দ্বিতীয়ত, তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে কি না, সেই অটোনমি তার আছে কি না। এই কারণে একজন সুস্থ চিন্তাসক্ষম এডাল্ট লোককে খুন করা নৈতিক ভাবে ভুল হয়, কারণ এর মাধ্যমে তার অটোনমিকে খুন করা হয়। এই অটোনমি বলতে নিজের জীবন সে রাখবে কি না সে সিদ্ধান্তও বুঝায়। এখানে কেবল সুখ ও দুঃখের অনুভূতি যুক্ত কেউ এবং সুখ দুঃখের অনুভূতি এবং অটোনমি সহ কেউ এই দুইজনের মধ্যে দ্বিতীয় জনকে হত্যা বেশী মারাত্মক। এই যুক্তিতে একজন বুদ্ধিক্ষমতাহীন মানুষ ও এক সুস্থ শিম্পাঞ্জির মধ্যে শিম্পাঞ্জিকে হত্যা করা নৈতিক ভাবে বেশী খারাপ।

পিটার সিংগার আবার বলেন অতীত ও ভবিষ্যতকে বুঝতে পারে কি না সে স্বত্তা এটাও বিবেচনায় নিতে হবে। রাচেল বলেন স্বত্তাটি বায়োলজিক্যাল জীবন যাপন করছে না বায়োগ্রাফিক্যাল জীবন যাপন করছে তাও দেখতে হবে। দু’টো কথাই আসলে প্রায় একই কথা।

এইসব যুক্তি সামনে এনে তারা ভয়ানক ভাবে রোগগ্রস্ত, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অক্ষম শিশুকে হত্যার পক্ষেই তাদের মত দেন। প্রতি বছর নেদারল্যান্ডসে প্রতি ১০০০ শিশু মৃত্যুর মধ্যে ৬০০ই হয় পিতা মাতার সিদ্ধান্তে।

সেই হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে ঐ বস্তুটিকে ডাক্তারদের খুন করাটা ঠিক আছে।

কিন্তু, এখানে সমস্যাটি হলো, জন্ম নেয়া শিশুটির মায়ের কাছ থেকে বা অন্যান্যদের কাছ থেকে তারা কোন অনুমতি নেন নি।

এবং গল্পে আমরা জেনে থাকি যে শিশুটির মা সব সময় এই ভয় করতেন যে তার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলা হবে। তিনি একজন ডাক্তারকে তাই প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যেন তার বাচ্চাকে না খুন করা হয়। এখানে যদিও মাতৃমমতা ইত্যাদি দেখানো হয়েছে, কিন্তু শিশু হত্যার ইতিহাস বলে মা’রাই সিদ্ধান্ত নিতেন। এই গল্পের ক্ষেত্রেও মা শিশুটিকে দেখলে কী সিদ্ধান্ত নিতেন বলা কঠিন। আমি ফিফটি ফিফটি সুযোগ ধরছি।

এই জন্মানো শিশুটির বাবা ও অন্যান্যরা একে খুন করতেই বলতেন, খুব সম্ভবত।

কিন্তু এই মা অথবা বাবা বা অন্যান্যদের কাছ থেকে অনুমতি না নেয়াটা ডাক্তারদের শিশু হত্যাটিকে জটিল করে তুলে, ও এর নৈতিক বৈধতাকে আঘাত করে। এবং তা মারাত্মক অপেশাধারী আচরনও বলা যায়।

 

 

রেফারেন্সঃ

হুমায়ূন আহমেদ, গল্পঃ সে, গল্প সমগ্র, কাকলী  প্রকাশনী, অষ্টম মুদ্রণ, পৃঃ ৬৮।

Infanticide; Aeon.co

Killing; Peter Singer

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner