মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » সহিংসতার ভূমিকাঃ প্রারম্ভ

সহিংসতার ভূমিকাঃ প্রারম্ভ

 

প্রারম্ভ

 

 

এক

 

এক গ্রামে একজন লোক প্রায়ই দেখতে পান যে তার জমিনের ধান গাছ এসে খেয়ে গেছে। কিন্তু দিনে তো তিনি পাহাড়া দিয়েই রাখেন। গরু তো চোখে পড়ে না। তার সন্দেহ হতে থাকলো যে পাশের বাড়ির তার শত্রু একজন সকালে, খুব ভোরে গরু নিয়ে আসে তার জমিতে এবং খাইয়ে নিয়ে যায়। এই সন্দেহ আসার পরে একদিন তিনি তার বাড়ির চালে বসে থাকলেন খুব ভোরে উঠে। তীক্ষ্ণ চোখ রাখলেন জমির দিকে।

 

একসময় দেখতে পেলেন অল্প অল্প নড়ছে একটা জায়গা্র ধানগাছগুলো জমিতে, আর গরুও দেখা যাচ্ছে। তখনো দিনের আলো ঠিকমত আসে নি। আবছা আলো।

 

ভদ্রলোক চাল থেকে নামলেন। শক্ত কাঠের টুকরা পড়ে ছিল তার উঠানে, সেটা হাতে নিলেন। লুঙ্গি বাঁধলেন ঠিকমত, আর আস্তে আস্তে জমির আল ধরে হেঁটে গেলেন সেই জায়গায়। গিয়ে দেখলেন ঐ লোকটাই, যার ব্যাপারে সন্দেহ করছিলেন তিনি। নিরবে বসে আছে, হাতে দড়ি। দড়ির অন্য পাশে গরু বাঁধা। গরু আরামে তার প্রাতরাশ সারছে সবুজ ধান গাছের মাধ্যমে। ধান গাছ তাদের প্রিয় হয়।

 

কাঠহাতের ভদ্রলোক আর সহ্য করতে পারলেন না। গরু মচ মচ করে খাচ্ছে তার ধান গাছ দেখে রক্তে যেন আগুন লাগল তার। কাঠের টুকরা শক্ত করে ধরে নিরবে বসে থাকা লোকটাকে আঘাত করলেন সর্বশক্তি দিয়ে, পেছন থেকে। লোকটা তখন কী ভাবছিল কে জানে! সে আকস্মিক তীব্র আঘাতে হতভম্ব হবার আগেই সম্ভবত মরে গেল।

 

এই গল্প আমি শুনেছিলাম একজনের কাছে। সত্য গল্প। ভদ্রলোক ঐ লোকটাকে খুন করে পরে বড় একটা ঝামেলায় পড়েন। তার কেবলি মনে হতে থাকে ঐ মৃত লোকরে, তিনি নাকী ঐ লোকটাকে দেখতে পেতেন। তাই প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে কয়েক মাইল হেঁটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসে রাতে থাকতেন। আবার শেষরাতের দিকে হেঁটে বাড়িতে যেতেন।

 

 

দুই

 

“হঠাৎ দাওয়া থেকে ছুটে এসে মুহুর্তে হালিমার চুলের গোছা চেপে ধরল আবুল। তারপর কোনো চিন্তা না করে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দিল ওর তলপেটে। উহ, মাগো, বলে পেটটা দু-হাতে চেপে ধরে বসে পড়লো হালিমা। রাগে তখন ফোঁপাচ্ছে আবুল, আমার ঘরের ভাত মাংশ ধ্বংস কইরা রাস্তার মানুষের লগে পিরীত। জানে খতম কইরা দিমু না তরে। কাইটা রাস্তায় ভাসায় দিমু না তরে। ………

 

……আবুল তখন ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে চলেছে হালিমাকে। ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঝাঁপি বন্ধ করে মনের সুখে মারবে। ওর ইচ্ছেটা হয়ত বুঝতে পেরেছিলো হালিমা। তাই মাটি আঁকড়ে ধরে গোঙাতে লাগল সে, ওগো তোমার পায়ে পড়ি। আর মাইরো না, মইরা যামু।

 

…বউ মারায় একটা পৈশাচিক আনন্দ পায় আবুল। পান-বিড়ির মত এও যেন একটা নেশা হয়ে গেছে ওর। মেরে মেরে এর আগে দু-দুটো বউকে প্রাণে শেষ করে দিয়েছে।”

 

উপরোক্ত অংশটুকু জহীর রায়হানের বিখ্যাত উপন্যাস হাজার বছর ধরে থেকে নেয়া হয়েছে। এখানে আবুলের বউ পেটানোর পরিচয় মিলে।

 

একই উপন্যাসের আরেক চরিত্র বুড়ো মকবুল বউদের দিয়ে ধান মাড়ায়। দু’টো বউকে লাঙ্গলে জুড়ে দিয়ে জমি চাষ দেবার কথা ভাবে। তাদের অমানুষিক পরিশ্রম করায়। বউদের সেও মারে, এ ব্যাপারে উপন্যাসে আছে,

 

“বউদের অবশ্য মকবুলও মারে। তাই বলে আবুলের মত এতটা নির্দয় হওয়াটা মোটেই পছন্দ করে না সে। মারবি তো মার, একটুখানি সইয়া মার। অপরাধের গুরুত্ব দেইখা সেই পরিমাণ মার। এ হলো মকবুলের নিজস্ব অভিমত।”

 

 

 

 

তিন

 

“সম্রাট পঞ্চম জর্জের প্রতিকৃতি আঁকা তামার একটি পয়সা। কাঠ কয়লার আগুনে পড়ে পেয়েছে নতুন এক চেহারা। না আছে মুকুট, না সম্রাটের মুখ, মনে হয় জমাট আগুনের একটি গোলাকার পাত। চিমটে দিয়ে কয়লা থেকে যখন কালু তুলে আনল গনগনে পয়সাটা গোটা মজলিসে কেঁপে কেঁপে গেল একটি ভীতির ছায়া। শুধু ভাবান্তর নেই মাতবরদের মুখে। আপনাদের বিচারের মানদণ্ডে তারা অবিচল।

 

ইতিমধ্যেই বসিয়ে দেয়া হয়েছিল মেয়েটিকে। দুজন যোয়ান তার হাত পাগুলো চেপে ধরেছে, যদিও নাকের আদলে ছোট্ট একটি কুঞ্চনে আর বিনা প্রতিবাদে ওদের হাতে হাত-পাগুলো সঁপে দেয়ারও মাঝে কেমন একটা অবজ্ঞা ছিটিয়ে রেখেছে মেয়েটি। যেন বলছে প্রয়োজন কি এই জবরদস্তির!

 

এবার রমজান নিজেই এগিয়ে আসে। দু’তালুর যাঁতায় থুঁতনিটা চেপে রেখে উঁচিয়ে ধরে ওর মুখখানি। চোখ বুঁজে নেয় মেয়েটি। মেয়েটি কি কাঁপছে? যেমন কাঁপে কোরবানীর পশুগুলো? দূর থেকে লেকু কিছুই বুঝতে পারে না। রমজানের হাতের ফাঁক দিয়ে যতটুকু নজরে পড়ে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে কেমন ঝিম মেরে আছে ও। লাল টকটকে ওর মুখ, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুখে এসে ঠাঁই করেছে। মনে হয় পাকা শসার ছিলকের মত চিকন মুখের চামড়া ফুঁড়ে এখনি রক্তের ফিনকি ছুটবে।

 

চিমটের আগায় পোড়া পয়সাটা ধরে এক পা এগোয় কালু, ছ্যাঁৎ করে চেপে ধরে, অনেকক্ষণ চেপে রাখে, মেয়েটির কপালের ঠিক মাঝখানে যেখান থেকে কিঞ্চিৎ চালু হয়ে নেমে গেছে ওর সুন্দর টিকোল নাকটি আর দুপাশে ছড়িয়ে পড়েছে দুটো কাজল রেখা ভ্রু।

 

লেকু দেখল নির্দয় ব্যাধের মুঠোয় অসহায় পাখির ছানার মত কি যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে গেল মেয়েটি। তারপর নিথর হল।”

 

এই অংশটি শহীদুল্লা কায়সার এর সংশপ্তক উপন্যাস থেকে। এখানে হুরমতিকে ব্যাভিচারের অপরাধে গ্রামের মাতবরেরা শাস্তি দেয়। সেই শাস্তি ছিল একটি তামার পয়সা উত্তপ্ত করে কপালে ছ্যাকা দেয়া, এবং সেই শাস্তি প্রয়োগের বর্ননা আছে উপরোক্ত অংশে।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং