ফেটিশিস্টের অস্বীকার ও বর্তমান আন্দোলন

প্রচুর প্রাণীদের হত্যা করা হচ্ছে প্রতিদিন মানুষের খাবারের জন্য। এই সব প্রাণীদের ফার্মে খুবই অসহায় এক অবস্থায় পালন করা হয়। বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জেকশন দিয়ে খুবই অল্প জায়গায় রাখা হয়। মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় ক্রাইম হচ্ছে ফ্যাক্টরি ফার্মিং, এমন বলে থাকেন অনেকে, এবং সেই বলার পিছনে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে।

পৃথিবীতে প্রতিদিন মারাত্মক সব সহিংসতা হচ্ছে। ব্রুটালি মানুষ মানুষকে মারছে, চোখ তুলে নিচ্ছে, হাত কেটে ফেলছে। এর অনেক অংশই অসহায় মানুষদের উপরে। যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চল সমূহের কথা বাদই দিলাম।

ধরেন, আমাদের দেশের অনেক অব্যবস্থাপনার কথা। রাস্তায় গেলেই দেখা যায় শীতের মধ্যে বা বৃষ্টির মধ্যে অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। প্রচুর বৃদ্ধ মানুষকে, শিশুদের দেখা যায় মারাত্মক ভারী শ্রমের কাজ করতে।

এইসব ঘটনা মানুষেরা জানে যে ঘটছে। প্রতিদিন ঘটছে। চা শ্রমিকদের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে, তাদের খুবই অল্প বেতন দিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে, বৃদ্ধ বয়েসে চিকিৎসার অভাবে তার ভুগছে। ইত্যাদি জানার পরেও মানুষ কীভাবে সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, সকালে ধোঁয়া ওঠা চা খায়, বিনোদনে অংশ নেয়, ক্রিকেট খেলায় দল জিতলে দেশের বিরাট বিজয় বলে উল্লাশে ফেটে পড়ে, খেলা নিয়ে বিতর্কে মাতে ও ঘন্টা ঘন্টা ব্যয় করে বিশ্লেষণ করে? কীভাবে সে অন্য সব ভয়ংকর জিনিস যা মানুষের উপর ঘটে চলেছে তা ভুলে গিয়ে এমন আচরণ করতে পারে?

  ছবিঃ ১৯০৩/৪ সালে পশ্চিম বাংলায় সিকিমের এক নারী ব্রিটিশ এক পুরুষকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের একটি টার্ম আছে ফেটিশিস্ট ডিজাবোয়াল নামে। ফেটিশিস্টের অস্বীকার। জিজেকের কথায়, এটি হচ্ছে এমন, “আমি এটি জানি, কিন্তু জানতে চাই না যে আমি জানি, তাই আমি জানি না।

অর্থাৎ, জানলেও, এই জানার ফল আমি মানতে চাই না, অস্বীকার করি, তাই আমি অভিনয় করে যেতে পারি যে আমি জানি না।”

গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়েও একই কথা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত হারে বাড়ছে। ভিয়েতনামের অনেক জায়গায় তাপমাত্রা এত বেড়েছে যে কৃষকেরা দিনে কাজ করতে পারেন না, রাতে কাজ করেন। তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে এভাবে বাড়তে থাকলে পৃথিবীর অনেক জায়গাই চাষবাস ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।

এসব খবর মানুষের সামনে আসলেও মানুষ ফেটিশিস্টের অস্বীকার প্রবণতার কারণে অস্বীকার করে যেতে চায়।

হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা আছে, খুবই ইন্টারেস্টিং, তিনি কোন লেখায় লিখেছিলেন তা মনে নেই। কথাটি আমার প্রিয়, এবং সেটি এমন,

 “সারা পৃথিবীতে বহু লোক রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়। তাতে আমাদের খারাপ লাগে না কারণ আমরা কাউকে জিজ্ঞেস করি না সে খেয়েছে কি না।”

এখানে ঘটনাটি হচ্ছে, যে ফেটিশিস্ট ঘটনাটি জানা স্বত্তেও অস্বীকার করে গেছে, তাকে হঠাৎ যদি একেবারে ঘটনার মুখোমুখি করে তোলা যায়, তখন সে অস্বীকার করতে পারে না যে সে জানে না। কারণ আর কোন পথ তার নেই। তখন তার খারাপ লাগবে ও সে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

যেটি হয়েছে ঢাকায় দুজন স্কুল স্টুডেন্ট বাসচাপায় নিহত হবার পরে, এবং আরো তীব্র হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদে নামার পরে। পরিবহণ ব্যবস্থার অনিয়ম এখন আর কেউ এড়িয়ে যেতে পারছে না।

কিন্তু এখানেও ফেটিশিস্টের অস্বীকার কাজ করছে। পরিবহণ ব্যবস্থার অনিয়ম যে গভীর, এবং আরো অনেক প্রশাসনিক অনিয়মের সাথে বেশ ভালোভাবেই যুক্ত হয়ে আছে, তা অস্বীকার করে যাচ্ছে লোকেরা। দেখিয়ে দিলে তারা মনে করছে আপনি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, আপনি নিরাপদ সড়ক চান না। এটি অবাস্তব কথা, কারণ নাগরিক হিসেবে নিরাপদ সড়ক কে না চায়। এবং তারাও এটি জানে যে অনিয়মের রুট অনেক গভীরে। কিন্তু এটি স্বীকার করলে স্বীকার করে নিতে হবে রাতারাতি পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি হবে না। এবং এরকম রাজপথ হঠকারী আন্দোলনে হিতে বিপরীত কিছু ফল হতে পারে।

কিন্তু এই দ্বিতীয় স্বীকার যা প্রথম স্বীকারের কনসিকুয়েন্স হিসেবে আসে, তা করতে তারা অস্বীকার করে একজন ফেটিশিস্টের মত। জানার কনসিকুয়েন্স বা ফল নিতে না পারার দরুন জানাটাকে না জানা মনে করে তারা চিৎকার করছে।

এটিই ফ্রয়েডিয়ান টার্মে ফেটিশিস্টের অস্বীকার।