আমি “মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা” নামে শিল্প–সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করি। নামে ত্রৈমাসিক বটে, আদতে এটি তিন মাস পর পর প্রকাশিত হয় না। বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রকাশিত হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ মানসম্মত লেখা না পাওয়া।
মুরাদুল ইসলামের খুব ছোট্ট একটি গল্পের বই আমার হাতে আসে। বইটির ছোট ছোট গল্পগুলো পড়তে পড়তে একটি গল্পে আমার মনোযোগ আটকে যায়। কারণ গল্পটি আমার ভালো লাগে। যদিও বই বা পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো লেখা মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রকাশের নিয়ম নেই, তবু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই গল্পটি ওই পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশ করব। অবশ্য গল্পটি মুরাদুলের বইতে যেভাবে ছাপা হয়েছে, হুবহু সেইভাবে তা পুনর্মুদ্রণ করা হবে না; কিছুটা সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করতে হবে। আমি লেখককে না জানিয়েই তা করে ফেলি; এই ভেবে যে প্রকাশের আগে আমি আমার সম্পাদিত ভাষ্যটি লেখককে পাঠাব এবং সম্পাদিত ভাষ্যটি সম্পর্কে তাঁর মতামত এবং আমার পত্রিকায় তা প্রকাশের অনুমতি চাইব। আমি যেভাবে সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করেছি, লেখক তা অনুমোদন করলেই শুধু তা প্রকাশ করা হবে, নইলে নয়।
তবে পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ থেমে যাওয়ায় গল্পটি লেখক মুরাদুল ইসলামকে পাঠানো হয়নি।
প্রায় দেড় বছর বছর মুরাদুল ইসলামের সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে যোগাযোগ হলে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে আলাপের এক পর্যায়ে তাঁর এই গল্পটির কথা আমার মনে পড়ে যায়, এবং আমি আমার সম্পাদিত ও পরিমার্জিত ভাষ্যটি তাঁকে পাঠিয়ে দিই এবং এই ভাষ্যটি সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাই। তিনি আমাকে বলেন, সম্পাদনা ও পরিমার্জনা ‘ইন্টারেস্টিং’ হয়েছে এবং তিনি তাঁর এই গল্পের সম্পাদিত ভাষ্যটি নিজের ফেসবুক পেজ কিংবা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন এবং আমার অনুমতি চান। আমি তাঁকে সানন্দে অনুমতি দিই, কারণ মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পরবর্তী সংখ্যাটি কবে প্রকাশিত হবে তা নিশ্চিত নয়।
আমার পত্রিকায় প্রকাশ করা উদ্দেশ্যে আমি এই গল্পটির নাম পরিবর্তন করেছি। গল্পের শুরুর কয়েক প্যারা পুরোপুরি বাদ দিয়েছি; বাদ দিয়েছি ভেতরের কিছু শব্দ ও বাক্য। এবং অল্প কয়েকটি শব্দ ও বাক্য যোগ করেছি। এই সার্বিক সম্পাদনা ও পরিমার্জনা আমি কী কী কারণে করেছি (আধুনিক ছোটগল্প লেখার কারিগরি কলাকৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে), মুরাদুল ইসলাম তা আমার কাছে জানতে চান। আমি এ বিষয়ে তাঁকে লিখিত আকারে জানানোর প্রতিশ্রুতি দিই।
আজ সেই প্রতিশ্রুতির কথা ভেবেই অল্প কয়েকটি কথা লিখতে বসেছি।
প্রথমত বলা দরকার আমার পত্রিকার জন্য মুরাদুলের এই গল্প নির্বাচন করার কারণ কী। আগেই বলেছি গল্পটি আমার ভালো লেগেছে। ভালো লাগার কারণ:
১. লেখকের কল্পনাপ্রতিভা, ভৌত জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তুপুঞ্জ ও দৃশ্যাবলির প্রতি সরস কৌতুকময় দৃষ্টি; নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও মানবিক সংবেদনশীলতা।
২. গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাব্যিক বয়ান; সে বয়ানের উপযোগী কোমল সুর (যা একটা মেলানকোলিক আবহ তৈরি করেছে; গল্পটা বলা হচ্ছে যেন–বা গভীর রাতে, অন্য কোনো সময়েই নয়।)
৩. বাক–সংযম, শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য বর্জন, বিশেষণের ব্যবহার সীমিত রাখা। (এই ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি আমার বিবেচনায় ধরা পড়েছে, আমার সম্পাদনার প্রয়োজন হয়েছে সেসব কারণেই।
৪. গল্পটির প্রথম প্যারা ও তার পরের কয়েকটি বাক্য আমি বাদ দিয়েছি কাহিনির স্বাভাবিক বিকাশের প্রয়োজনে; পূর্বাভাসমূলক বাক্যগুলো বাদ দিয়েছি, কারণ পাঠক সামনে এগুলেই যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে তার আভাস আগেই দেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে আমার বোধ হয়েছে।
৫. গল্পটির নাম আমি ছেঁটে দিয়েছি, কারণ লেখকের দেওয়া নামটি বিবৃতিমূলক, সিদ্ধান্তমূলক; তাতে পাঠকের নিজের ব্যাখ্যা ও কল্পনা বিঘ্নিত হতে পারে।
৬. এই গল্প সম্পর্কে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, এটি পাঠকের মনে গভীর এক এমপ্যাথি (সমমর্মিতা, করুণা, মায়া) সঞ্চার করে। লেখকের বয়ানে ও দৃশ্যায়নে সমস্ত বস্তুজগৎ জীবন্ত প্রাণসত্তার মতো হয়ে ওঠে; বিশেষত লাইটপোস্টগুলো, তারা কেউ বুড়ো, কেউ যুবক, কেউ সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটে, কেউ চলে গিটার হাতে নিয়ে…। এবং সবার জন্য পাঠকের মনে এমপ্যাথি জেগে ওঠে।
আমি মনে করি, সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কাজ পাঠকের মনে এমপ্যাথি জাগানোর মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগ স্থাপন করা।
মশিউল আলম
ঢাকা, ২৫ জুলাই ২০২০
ল্যাম্পপোস্ট
১. আমার জানালা দিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্ট দেখা যায়।
২. আমি রাত জাগি; দীর্ঘক্ষণ জেগে থাকি।
৩. কী কারণে জাগি তা না–ই বললাম; (এখানে তা অপ্রাসঙ্গিক)।
৪. এরকমই এক রাতজাগা গভীর রাতে, যখন অন্ধকার ছিল ভীষণ কালো, তখন (ওটা) আমার চোখে পড়ে প্রথম; একটি ল্যাম্পপোস্ট; আমার জানালার কিছু দূরে, একা একা দাঁড়িয়ে আছে।
৫. আমি অবাক হয়ে যাই [তখন]।
৬. এত দিন আমি এই পথে যাই, এই পথে আসি, কখনো, কোনও দিনও একবারের জন্যও দেখিনি তাকে।
৭. আমার আসলেই অবাক লাগে।
৮. সে তার মাথায় আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
৯. তার জন্য আমার খারাপ লাগে: আহা ল্যাম্পপোস্ট! একা একা রাত জাগে!
১০. আমার তখনও অনেক কিছু জানা হয়নি; আমি তখনও ঘুণাক্ষরে ভাবিনি, কত কিছু, কত অবাক–করা কিছু অপেক্ষা করে রয়েছে আমার জন্য।
১১. ল্যাম্পপোস্টের সৌন্দর্য আমাকে টেনেছিল।
১২. আমি জানালার ধারে ঠায় বসে বসে তাকে দেখতে শুরু করলাম।
১৩. আমার টেবিলে চায়ের কাপ ভাপ ছাড়তে ছাড়তে উৎসাহ হারিয়ে ঠান্ডা যায়; সেদিকে আমার লক্ষ থাকে না; কারণ আমি নিমগ্ন হয়ে যাই ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোতে; কিংবা তার ভাষায়।
…
১৪. এভাবে বেশ কদিন যাওয়ার পর আমার কেন জানি কিছু জিনিস বিদঘুটে মনে হতে লাগল; কেমন যেন কিছুটা অপার্থিব।
১৫. একদিন রাত দেড়টার দিকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ঠিক আগের জায়গাতেই ল্যাম্পপোস্ট।
১৬. তবে এই ল্যাম্পপোস্টটা আগের রাতেরটার মতো নয়; কিছুটা অন্য রকম। কিছুটা বয়স্ক, কিছুটা বুড়ো–বুড়ো চেহারার।
১৭. আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।
১৮. আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম: হ্যাঁ, নিশ্চিত, এটা আগের রাতেরটা কিংবা প্রথম যেটাকে দেখেছিলাম, সেই ল্যাম্পপোস্ট নয়।
১৯. কিন্তু এ তো অসম্ভব!
২০. এ কীভাবে হবে?
২১. এই জায়গায় যদি সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে ল্যাম্পপোস্ট বদলাত, তাহলে আমি তা টের পেতাম।
২২. আমার সন্দেহ হলো।
২৩. আমি ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালার ধারে ঠায় বসে রইলাম। [দেখতে হবে ল্যাম্পপোস্ট কীভাবে বদলে যায়।] (চেয়ে রইলাম বাইরের দিকে।)
২৪. রাত সাড়ে তিনটায় [প্রথম] নড়ে উঠল বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট।
২৫. ঠিক মানুষের মতো তাকাল চার পাশে।
২৬. তারপর ধীরে ধীরে তার চিকন দুটি পা বের করে আনল মাটির নিচ থেকে; কিছুটা সামনে ঝুঁকে নেমে পড়ল সড়কে।
২৭. আমি শুধু ওই ল্যাম্পপোস্টটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম বলে লক্ষ করিনি: এরই মধ্যে অসংখ্য ল্যাম্পপোস্ট ফুটপাত থেকে নেমে চলে এসেছে মূল সড়কে; সবাই পা টেনে টেনে হাঁটছে।
২৮. আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল; আমি ঘামছিলাম।
২৯. তবুও চোখ সরালাম না।
৩০. অনেক অনেক ল্যাম্পপোস্ট: [সারিবদ্ধভাবে], কিছুটা এলোমেলো একটা মৌন মিছিলের মতো হাঁটছে।
৩১. কারও হাতে গিটার; কেউ কেউ ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে।
৩২. কারও আলো হলুদ, কারও লাল, কারও নীলচে।
৩৩. তারপর একসময় বুড়ো ল্যাম্পপোস্টকে মাঝখানে রেখে অন্য সবাই গোল হয়ে দাঁড়াল। কেউ কেউ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছে।
৩৪. আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি; ভিতরে অদম্য কৌতূহল।
৩৫. হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট আমার জানালার দিকে আঙুল নির্দেশ করল: তার দুটি আঙুল অব্যর্থ নিশানায় আমার দুই চোখের মণির দিকে তাক করা।
৩৬. তৎক্ষণাৎ সব ল্যাম্পপোস্ট একসঙ্গে তাকাল আমার জানালার দিকে; এক সঙ্গে সবার বিভিন্ন রঙের আলো এসে আছড়ে পড়ল আমার জানালায়।
৩৭. আমার জানালার অণু–পরমাণু এবং ততোধিক ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রনগুলো সহ্য করতে পারল না বোধহয়; আমার চোখের সামনেই মিলিয়ে গেল।
৩৮. আমি কিছুটা ভয় পেলাম; চিৎকার করে উঠতে গেছি, এমন অবস্থায় কে যেন পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরল।
৩৯. কচি কচি দুটো ছোট্ট হাত, কিন্তু তাতে অসম্ভব জোর।
৪০. আমি মাথা একটু ঘুরিয়ে যা দেখতে পেলাম, তা না দেখলেই বোধহয় ভালো হতো: পেছন থেকে দুই হাতে আমার মুখ চেপে ধরেছে আমারই টেবিল ল্যাম্প; তার গা থেকে বেরোচ্ছে ধবধবে সাদা আলো।
৪১. কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো মূল সড়কে: এক ঝলক নীল আলো দিয়ে আমাকে বানিয়ে ফেলা হলো একটা ল্যাম্পপোস্ট।
৪২. আমাকে বলা হলো সব কথা: কীভাবে ল্যাম্পপোস্টেরা প্রতি রাতে নগরভ্রমণে বের হয়।
৪৩. আমাকে বলা হলো আমিও তাদের একজন।
…
৪৪. আমি এখন প্রতি রাতে ঘুরে বেড়াই; গভীর রাতে।
৪৫. যখন আকাশ ফুলকির মতো অসংখ্য তারা ফুটিয়ে পৃথিবীকে ঢেকে দেয় অন্ধকার চাদরে, তখন আমি হাঁটতে বের হই।
৪৬. এইভাবে, ঠিক এইভাবে প্রতিদিন রাতে, আমি আমার হলুদ আলোতে গল্প বলে যাই…।
৪৭. নিশ্চয়ই কেউ একদিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমার গল্পের আলোতে বাঁধা পড়ে যাবে।
মশিউল আলমের উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তনুশ্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় রাত, ঘোড়ামাসুদ, জুবোফ্স্কি বুলভার, মাংসের কারবার, দ্বিতীয় খুনের কাহিনি।