শেক্সপিয়রের হ্যামলেট একটা ওয়ান্ডারফুল ড্রামা সাহিত্যের দুনিয়ায়। এই নাটকের গল্পটা হইল এইরকম যে, ডেনমার্কের প্রিন্স হ্যামলেটের বাপ মারা গেছেন কিছুদিন আগে। হ্যামলেটের চাচ্চু ক্লদিয়াস রাজা হইছেন। এবং তিনি রানীরে তথা হ্যামলেটের মা’রে বিয়া করছেন। শুভ বিবাহ।
প্রিন্স হ্যামলেটের কাছে মৃত রাজার ভূত আসে। যেই রাজা হইলেন হ্যামলেটের বাপ। আর ভূত হইলেন হ্যামলেটের বাপের ভূত।
এই ভূত আইসা হ্যামলেটরে বলে ভাই ক্লদিয়াস কানে বিষ ঢাইলা তারে খুন করছে। সে যেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়।
হ্যামলেট বাপের ভূতরে (বাপের ভূত কি বাপ হয়?) কথা দেয় যে সে কঠিন প্রতিশোধ নিবে।
এরপরেই খেলা উলটাইয়া যায়। আমরা দেখি হ্যামলেট হা হুতাশ করে। নানা ডায়লগ দেয়। নানা কিছু করে। আর প্রতিশোধরে বিলম্বিত করে। একটা এবসার্ড নায়ালিস্ট চরিত্র মনে হয় আমাদের হ্যামলেটরে। বিষাদগ্রস্থ, নাই নাই কিছু তার।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড হ্যামলেটের এনালাইসিস করতে গিয়া তার সাইকোএনালিটিক পদ্বতিতে গেছিলেন। তিনি বলছিলেন, প্রতিটা বাচ্চার যে একটা ইচ্ছা থাকে সে তার মায়ের জামাই তথা পিতারে দুনিয়া থেকে সরাইয়া দিবে আর মারে দখল কইরা নিবে, হ্যামলেটের চাচ্চু ক্লদিয়াস এই কাজই তো আসলে করছিল। ফলে হ্যামলেট প্রতিশোধ নিতে পারে না। কারণ প্রতিশোধ নিতে গেলে ক্লদিয়াসরেই মারতে হবে, যেই ক্লদিয়াস তার অডিপাস কমপ্লেক্সরে বাস্তব রূপ দিয়া তার একটা অংশ হইয়া গেছে।
আর তখনই প্রতিশোধ নিতে না পাইরা এক ডিপ্রেশন আর নায়ালিজমে পইড়া যায় হ্যামলেট। এমনকি সে উন্মাদ হইয়া গেছে এমন মনে হইতে থাকে। নাটকের চরিত্ররাও তারে পাগল ভাবে একসময়।
এই এনালাইসিস উইয়ার্ড লাগতে পারে আপনার। উইয়ার্ড লাগলে ঠিক আছে, এইটা উইয়ার্ডই।
ক্রিটিকদের কাছে এইটা একটা প্রশ্নই ছিল যে, হ্যামলেট প্রতিশোধ নিতে এত টাইম লাগাইল কেন। এই কেনো’র উত্তর খুঁজতে গিয়া ফ্রয়েড যেমন হ্যামলেটরে অডিপাস কমপ্লেক্সে ফেইলা ফিট করতে চাইছেন (বা আরেক মতে অডিপাস কমপ্লেক্সের ধারণা হ্যামলেট থেকেই পাইছেন), তেমনি আরো অনেকে হ্যামলেটরে ঠিক হিরো মানতে চান নাই। কারণ যেই মাসকুলিনিটি, বীরত্ব প্রত্যাশিত থাকে প্রিন্সের কাছে, প্রিন্স হ্যামলেট ঐদিকে যায় না।
ফ্রেঞ্চ-আমেরিকান লিটারারি ক্রিটিক ও দার্শনিক রেনে জিরার্দ অন্য রকম একটা ব্যাখ্যা দিছিলেন তার প্রবন্ধ “হ্যামলেটের বিরস প্রতিশোধ বা হ্যামলেট’স ডাল রিভেঞ্জ” প্রবন্ধে।
তিনি দেখাইছিলেন, হ্যামলেট যে ভূতের কথা শুইনা লাফাইয়া লাফাইয়া খুন করতে যায় না তার বাপের খুনিরে, কারণ সে নিজেই দ্বিধায় ছিল যে, তার আব্বু নির্দোষ ছিলেন কি না।
তখনকার সমাজে প্রচলিত নাটকি নিয়ম ছিল রিভেঞ্জ হবে হুটহাট। জাইনা গেছ বাপের খুনি, আর অপেক্ষা কী। লাগাও গুল্লি।
কিন্তু শেক্সপিয়র এর অন্তঃসারশূণ্যতা বুঝতে পারছিলেন। এই রিভেঞ্জ থিয়েটারের। কারণ এইভাবে প্রতিশোধের পর প্রতিশোধ চলতেই থাকে। রক্তপাতের পরে রক্তপাত।
শেষের দিকে হ্যামলেটের প্রেমিকা যখন সুইসাইড করে, তখন তার ভাইয়ের সাথে হ্যামলেটের দ্বন্দ্ব হয়। সেই দ্বন্দ্বে ওফেলিয়ার ভাইরে শেক্সপিয়র দেখান প্রতিশোধ উন্মুখ ইয়াং যুবক হিসাবে। তার সাথে দ্বন্দ্বে গিয়া হ্যামলেটেরও প্রতিশোধ স্পৃহা জাইগা উঠে। এইটা জিরার্দের কোর থিওরি, মিমেটিক ডেজায়ারে পড়ে। অন্যের ডেজায়ার অনুকরণ করেই মানুষের মাঝে ডেজায়ার জন্মে।
তো, এর পরেই হ্যামলেট তার মৃত প্রেমিকার ভাইয়ের লগে ডুয়েল ফাইটে রাজী হয়। এরপরেই, ঘটনাক্রমে হ্যামলেট, অফেলিয়ার ভাই, ক্লদিয়াস, রানী সবাই মারা যান। ট্রাজেডি সম্পন্ন হয়।
কিন্তু এর পরে একটা ইন্টারেস্টিং দৃশ্য থাকে। নরওয়ের প্রিন্স ফরতিনব্রাস আসেন সৈন্য নিয়া। আইসা ডেনমার্ক নিজের শাসনে নেন। এই ফরতিনব্রাসের বাপরে আবার মারছিলেন হ্যামলেটের বাপ, আর তাদের জায়গা দখল করছিলেন।
ফরতিনব্রাস এই নাটকে আসলে দ্বিতীয় হ্যামলেট। পুরা হ্যামলেটের মতোই তারে বানানো হইছে। তার বাপও মারা গেছেন, সেও প্রিন্স। তারপর সেই আইসা ডেনমার্কের রাজা হয়। ও হ্যামলেটের প্রতি সম্মানও জানায় সে।
হ্যামলেটের যে দ্বিধা ছিল তার বাপ নির্দোষ কি না, তার এই দ্বিধা ঠিক আছিল। হ্যামলেটের বাপ নির্দোষ ছিলেন না। তিনি ফরতিনব্রাসের বাপরে মারছেন। ফলে ঐ জায়গাতেও একটা প্রতিশোধের পালা রইয়া গেছে।
জিরার্দ বলেন শেক্সপিয়র এইখানেই সেরা। তিনি এমন একটা রিভেঞ্জ ড্রামা লেখছেন যেইটা ঐ সময়ের প্রচলিত রিভেঞ্জ উৎসবের বিরুদ্ধে। এইখানে আমি মনে করি থ্রিলার লেখকদের জন্য একটা ইনসাইট আছে। যেকোন ফর্ম ব্যবহার করেই আপনে ডিপ জিনিস তৈরি করতে পারেন, শেক্সপিয়র হয়ত এইটাই দেখাইয়া দিছেন।
এই জন্য হ্যামলেটের দ্বিধা, তার হতাশা ও বিষন্নতা এইগুলা কোন সাইকোসিস না, বা অডিপাস কমপ্লেক্সের মানসিক সমস্যা না। বরং এইটা হইল তার বিবেক বুদ্ধি ও বিচার করার ক্ষমতা। রিভেঞ্জের অন্তঃসারশূণ্যতা উপলব্ধি কইরা, ভূতের অবিরত চাপের মুখে একটা দ্বন্দ্বমূখর বাস্তবতায় ক্ষালক্ষেপণ। এইটা তার ভালো সিদ্ধান্তই, সেইন ডিসিশন। যদিও ড্রামাতেও তারে স্যানিটি হারাইছে বলা হইছে ক্যারেক্টারদের মুখ দিয়া, আর দর্শক ক্রিটিকরাও তাই ভাবছেন।
কিন্তু আসলে হ্যামলেটেরই স্যানিটি ছিল। সে প্রতিশোধের মোহে অন্ধ হইতে না চাওয়া একজন বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন লোক হিসাবে, এবং রিভেঞ্জের বাতাবরণের মধ্যে থাইকাও এর ফালতুত্ব বুঝাইয়া দিতে পারা হিরো। ধুম ধাম প্রতিশোধ নিয়ে নেয়া জন উইক টাইপের হিরোদের চাইতে মহিমাময়।