মুরাদুল ইসলাম » সাক্ষাৎকার » হিমালয়ঃ “বাংলাদেশ একটা অনুর্বর মানুষের দেশ”

হিমালয়ঃ “বাংলাদেশ একটা অনুর্বর মানুষের দেশ”

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় “কে” লেখতে যাবার আগে বলে নেই, আমি এখন তার নামহীন বইটা পাশে রেখে এই ইন্টার্ভিউ গুগল ডকে তোলা শুরু করলাম, এবং তার নামের বানান কীরকম হবে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম তার নামহীন বইটাতে লেখকের নিজের নামই নেই।

হিমালয় হিউম্যান ডেভলাপমেন্ট নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলে থাকেন তার একমাত্র ক্ষমতা হলো  লিসেনিং বা শোনার ক্ষমতা। এটি শুনতে খুবই সাধারণ ক্ষমতা মনে হতে পারে। রলা বার্থের কথানুযায়ী লিসেনিং এবং হিয়ারিং এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাংলা ভাষায় এই পার্থক্য নিরূপণকারী কোন শব্দ আছে কি না, আমার মনে পড়ছে না। বার্থের কথায়, হিয়ারিং হলো ফিজিওলজিক্যাল ফেনোমেনন , অন্যদিকে  লিসেনিং হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল এক্ট। হিমালয়ের মতে তিনি এই সাইকোলজিক্যাল এক্টে পারদর্শী। তিনি গর্বভরে তা প্রচার করে থাকেন।

বাংলাসাহিত্যে নিরীক্ষামূলক গল্প লেখার একটা চল আছে সিরিয়াস সাহিত্য পরিমণ্ডলে। নিরীক্ষামূলক গল্পকে একটা আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। হিমালয় যেসব গল্প লিখেছেন, এবং তাতে যেসব নিরীক্ষা আছে বলে তার মুখে আমি শুনেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে গল্পগুলি পড়লে নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া সাহিত্যিকেরা চমকে উঠতে পারেন। [আমি নিজে এখনো পড়ে দেখি নি।]

তার সংখ্যা নিয়ে অবসেশন এবং তার জীবনের স্ট্রাগল, চিন্তা প্রক্রিয়া ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন বায়োফিকশন ধর্মী বই, যে বইটির কোন নাম নেই। বইটি এখন পর্যন্ত আমি প্রায় একশো পেইজ পড়েছি।

অটো বায়োগ্রাফিক্যাল উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হওয়া একজন নরয়েজিয়ান লেখক আছেন, নাম কার্ল অভ নউসেগার্ড। তিনি তার ৩৫০০০ পেইজের অটো বায়োগ্রাফিক্যাল উপন্যাসে বাপ, এক্স ওয়াইফ ইত্যাদি অনেকের ব্যক্তিগত জীবনের নানা কিছু প্রকাশ করে দেয়ায় বেশ বিতর্কিত হয়েছিলেন, যদিও সাহিত্য বিচারে তিনি সম্মানিত হন এবং তার বই প্রচুর বিক্রি হয়েছিল। হিমালয়ের বায়োফিকশনেও এমন জিনিস লক্ষ করা যায়।

এই ভূমিকা আর দীর্ঘায়িত না করে সাক্ষাৎকারে যাওয়া যাক। আমরা হয়ত পরিচিত হতে যাচ্ছি একজন বাঙালী দার্শনিকের সাথে, একজন চিন্তাপ্রবণ মানুষের সাথে, একজন মানুষের সাথে যিনি কম্যুনিটি ডেভলাপমেন্টকে জীবনের বড় উদ্দেশ্য জ্ঞান করেন, অথবা…. সাক্ষাৎকার পড়ে আপনার যা মনে হয়।

এই সাক্ষাতকারটি নেয়া হয় উইডেভসের অফিসে, ১৭ অক্টোবর ২০১৮ সালে। কথাবার্তার স্পিরিট লিখিত ফর্মে পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়, তাও যথাসম্ভব চেষ্টা করা হল। অল্প কিছু ক্ষেত্রে বাক্য পরিবর্তন করা হয়েছে বা শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে বোধগম্যতার কথা বিবেচনা করে। হাসি এবং বর্ননাভঙ্গির পুরোটা তুলে ধরা সম্ভব হয় নি লিখিত ফর্মের সীমাবদ্বতার কারণে। আশা করি পাঠক তা কল্পনা করে নিতে পারবেন।

– মুরাদুল ইসলাম, ২১ অক্টোবর ২০১৮, উইডেভস।

 

এই ভূমিকা হিমালয় ভাই নিয়ে আমার মূল্যায়ণ নয়। তার সাথে ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল ও আছে। তাই আমার মূল্যায়ণ নন বায়াসড হবে বলা যায় না। আবার ওই মূল্যায়ণ কেবল তার লেখালেখি চিন্তা প্রাধান্য পাবে এমনো বলা যায় না। কারণ ব্যক্তিগত ভাবে কারো সাথে সম্পর্ক থাকলে আচার ব্যবহার জীবন যাপনের অনেক কিছু দ্বারাই প্রভাবিত হয় মূল্যায়ণ। তাই সেদিকে যাচ্ছি না। কোনও একদিন হয়ত যাওয়া যাবে।

 

  • মুরাদুল ইসলাম, মে ২০১৯

 

 

ছবি মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়, ছবিসূত্রঃ তার ফেইসবুক প্রোফাইল।

মুরাদঃ আচ্ছা, এই, আমাদের ইন্টার্ভিউ শুরু হয়ে যাক এখন। রেকর্ড হবে কি ?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ?

মুরাদঃ রেকর্ড কি হবে সাউন্ড?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, এখানে রাখলে হবে।

মুরাদঃ আচ্ছা, ঠিক আছে, কী নিয়ে কথা বলা যায় প্রথমে?

হিমালয় তোমার যা ইচ্ছা বলো। আমার তো ইন্টার্ভিউ নিতে চেয়ে  কেউ নেয় না। (হাসি)

মুরাদঃ আপনার নামহীন বই নিয়েই কথা বলি।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ বলো।

মুরাদঃ আপনি তো বলছেন এটা একটা বায়োফিকশন। তা কী কারণে এটা একটা বায়োফিকশন?

হিমালয়ঃ ও, আচ্ছা, এই বইটা কী কারণে বায়োফিকশন তা বলার আগে আসলে এই বইটা লেখার প্রেক্ষাপট বিষয়ে বলা দরকার। তা না হলে হয়ত বিষয়টা বুঝা যাবে না। আমার যখন বিশ বছর বয়স তখন আমি চিন্তা করছিলাম যে উনত্রিশ বছর বয়স হলে একটা বই লিখব যাতে সব কিছু সংখ্যা দিয়ে ইন্টারপ্রেট করা যায়, কারণ আমি ছোটবেলা থেকেই হচ্ছে,  সব কিছুকে সংখ্যা দিয়ে ইন্টারপ্রিট করার চেষ্টা করি, লাইক ১০৯, এটা যেকোন মানুষের কাছে একটা সংখ্যা, কিন্তু আমার কাছে ১০৯ মানে হচ্ছে প্রেম। আবার ধরো ৯১১, মানে হচ্ছে আমরা বলি নাইন ইলিভেন, হয়ত নাইন ইলিভেনের ঘটনার কারণে এটি পরিচিত , কিন্তু আমার কাছে ৯১১ মানে হচ্ছে সেক্স। এরকম প্রত্যেকটি সংখ্যারই আমার কাছে আলাদা আলাদা মিনিং আছে। তাই যখন আমার বয়স বিশ বছর তখন আমি চিন্তা  করছিলাম যে আমার যখন বয়স বাড়বে , আমি ঠিক করেছিলাম উনত্রিশ বছর কারণ মনে করছিলাম হয়ত উনত্রিশ বছরের পর আমি আর সারভাইব করব না, তো উনত্রিশ বছর বয়েসে একটা বই লেখব এই সংখ্যাগুলার ইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে দিয়ে। তো মাঝখানে দেখা গেছে যে এই, বিশ বছরে বয়েসে তো ছোট ছিলাম, ঠাট্টা মশকরা ফান হিউমার রম্য ইত্যাদি লেখলাম ব্লগে, আমার গল্পের বইই বের হয়ে গেল দুইটা, কিন্তু যে বইটি লেখব বলে ভেবেছিলাম তা আর লেখা হচ্ছিল না। তো তার পরে হচ্ছে, ২০১৭ এর মার্চে জীবনানন্দ দাশের একটা বই হচ্ছে…

মুরাদঃ কমলালেবু?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু, ঐ বইটা পড়ার পরে, আমি একটা রিভিউ লেখছিলাম ফেইসবুকে যে, কোথায় কমলালেবু। ঐ বইটা পড়ার পরে বড় রকম ধাক্কা খেলাম। একচুয়ালি,  আমি যে একটা লাইফ লিড করলাম, এই উলটা পালটা, কোন ডটেড প্যাটার্ন নাই। কিন্তু আমি তো ছোটবেলা থেকেই চেষ্টা করছি মনিষী হবো, কিন্তু আমার লাইফের তো কোন ট্রেসই নাই। ত্রিশ বছর হয়ে গেছে, লেখালেখিও করতেছি না, ২০১৫ সালের পর আর কোন বইও বের করি নাই। ঐ রিভিউটা লেখতে গিয়ে আমি জীবনানন্দ দাশ আর আমার মাঝে একটা কো-রিলেশন  খুঁজে পাই। তার ইমাজিনেশন আর আমার ইমাজিনেশন এই দুইটার মাঝে একটা বড় কো-রিলেশন খুঁজে পাই। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ঐ লেখাটা না পড়লে আসলে আমার এই স্টেইটমেন্টটা বুঝা যাবে না, কারণ আমার ধারণা আমি ঐ পোস্টটাতে জীবনানন্দ দাশকে যেভাবে তুলে ধরছি, ঐভাবে এই বাংলা আর কলকাতা মিলিয়ে আর কেউ ওরকম ভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারে নাই, আই ক্যান চ্যালেঞ্জ। বিকজ, আমি জিনিসটার ভেতরে ঢুকছি। তার থট প্রসেসটা বুঝতে পারছি কারণ আই …বিলং টু দি সেইম থট প্রসেস।

মুরাদঃ শাহাদুজ্জামানের বইতে কি উনি ঐভাবে উঠে আসছেন?

হিমালয়ঃ সেটা আসে নাই। সেটা শাহাদুজ্জামানের ব্যর্থতা।  কিন্তু আমি পড়ে আমার মতো করে ইন্টারপ্রিট করে নিছি, বিকজ আমি যখন বই পড়ি তখন প্রত্যেকটা লাইনে লাইনে লেখকের থট প্রসেস চ্যালেঞ্জ করি এবং বুঝার চেষ্টা করি আমি হইলে ঐটা কীভাবে লেখতাম। এই কারণে আমার লাইফের ৮৯% বই আমি শেষ করতে পারি নাই।

শাহাদুজ্জামানের লেখা আমি পছন্দ করি, কিন্তু তার উপন্যাসের ভক্ত আমি কোনদিন ছিলাম না, এখনো নই। আমি তাকে ইমেইলও করছি যে উপন্যাস আপনার জায়গা না। কিন্তু যেটা হইছে, আমি জীবনানন্দ দাশের ঐ জিনিসগুলা ফিল করতে পারতেছিলাম। ভিজুয়ালাইজ করতে পারতেছিলাম। ফলে আমি ঐটার একটা রিভিউ লেখি, আর রিভিউ লেখতে গিয়ে আমার ফিল হয় যে একটা বই লেখা উচিত যে বইটা হচ্ছে আমার টোটাল জীবনকে রিপ্রেজেন্ট করবে। জীবনকে রিপ্রেজেন্ট করতে গেলে ত অটোবায়োগ্রাফি হয়। অটোবায়োগ্রাফি, ঐটা একটা বুলশিট জিনিস। অটোবায়োগ্রাফি যারা লেখে তারা হয় নিজেরে অতি মহান বানায় অথবা কন্ট্রোভার্সি তৈরি করে। ফলে অটোবায়োগ্রাফি জিনিসটাকে আমার কাছে কাগজ নষ্ট ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। কারণ নিজের লাইফকে এনাফ ক্রিটিক্যালি দেখতে যে লাইফ বিলং করতে হয়, যে থট প্রসেসের মধ্য দিয়া যাইতে হয়, যে ক্রাইসিসের- স্ট্রাগলের মধ্য দিয়া যাইতে হয়, সেটা নেয়ার মতো এনার্জি মানুষের নাই। খুব কম মানুষের এটা আছে। তো অটোবায়োগ্রাফি যদি না লিখি তাহলে আমার লাইফকে পট্রে কীভাবে করব। তখন আমার মনে হল যে এটাকে একটা ফিকশন স্টাইলে লেখা যায়, যেখানে আমার লাইফের ইন্সিডেন্ট বা ইনফরমেশনের চাইতে আমার থট প্রসেস কী এবং কীভাবে, সেই জিনিসগুলা বেশি প্রাধান্য পাবে। তখন আমি ভাবলাম যে, আই বা আমি ধারণাটাকে ফ্লারিশ করার জন্য আমার একটা স্যাম্পল দরকার, এজন্য মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় নামক একজন মানুষের জীবনকে বেছে নিলাম, নিজের জীবন হওয়ায় প্রাইভেসী জনিত সমস্যা থাকল না। কারণ আমি যে বডিতে বিলং করি সেই মানুষটাকে নিয়ে লেখলে কারো অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নাই, কারো প্রাইভেসিও ক্ষুণ্ণ হবে না। ত এই কারণে আমি মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয় নামক একটা লোকরে বাইছা নিলাম, ফিকশনাল বিভিন্ন ক্যারেক্টার আনলাম, কিন্তু সেখানে যা আছে তার কোন কিছুই কিন্তু সত্যের অপলাপ না। এই কারণে এটাকে বলতে পারো বায়োফিকশন।

মুরাদঃ আচ্ছা, আপনি কি এটাকে উপন্যাস বলবেন? কারণ এখানে অনেক ফ্যান্টাস্টিক্যাল এলিমেন্টস আছে।

হিমালয়ঃ বায়োফিকশন ত অনেকদিন আগে থেকেই উপন্যাসের একটা জনরা। তুমি গুগলে স্টাডি করলেই দেখবা, যারা এস্থেটিকস নিয়া কাজ করেন তারা এটাকে উপন্যাসই… এটা আমার বলা না বলায় কিছুই যায় আসে না।

মুরাদঃ বাংলাদেশে ত এরকম উপন্যাস বা বই সাধারণত হয় না।

হিমালয়ঃ আমি এটাকে শুধু বাংলাদেশ না, আমি যেকোন রিডারদের বলি তারা যদি লাইফে ৫/১০ হাজার বই পড়ে থাকে তাহলে এরকম আর কোন বই পড়ছে কি না আমাকে জানাতে। আমাকে এখনো কেউ জানাইতে পারে নাই। সো দেখি কেউ জানাইতে পারে কি না। আমি যখন কোন কিছু চিন্তা করি তখন কেবল বাংলাদেশের কনট্যাক্সটে চিন্তা করি না। গ্লোবাল কনট্যাক্সটে চিন্তা করি, এবং গ্লোবাল কনট্যাক্সটে কম্পিট করার মত এরোগেন্স রাখি। পারি না পারি সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু আমি ঐভাবে চিন্তা করি। বাংলাদেশ একটা অনুর্বর মানুষের দেশ। এখানে প্রোডাক্টিভিটি মানে হচ্ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা, সো বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করে লাভ নাই।

মুরাদঃ আচ্ছা, আপনি যে জীবনানন্দ দাশ নিয়া পড়তে গিয়া তার থট প্রসেসের ভেতর ঢুকে  যাইতে পারলেন,তো আপনার কি মনে হইছে তার জীবন ভিত্তিক কোন উপন্যাস লেখার?

হিমালয়ঃ জীবনানন্দ দাশ নিয়ে এতো লেখা হইছে যে, আমার একটা কথা  হচ্ছে, যে কাজ সবাই করে সবাই পারে তা আমি করি না পারিও না। আমি যেটা করি, সেটা অধিকাংশ মানুষ পারবে না এটা আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি। জীবনানন্দ দাশ নিয়ে লেখলে একটা কম্প্যারিজন চলে আসবে, অমুকের তুলনায় কেমন, তমুকের তুলনায় কেমন। তাই জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখার আগ্রহ নাই। বরং আমি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে, মানে বই নিয়ে যে রিভিউ লেখছি , এরকম কেউ পারলে একটা লিখে দেখাক।

মুরাদঃ হা হা হা, আচ্ছা, আপনার বইয়ের ব্যাপারে অনেকে বলছেন এখানে নার্সিসিস্টিক উপস্থাপন আছে। আবার আমি যতটুকু পড়লাম দেখলাম যে আপনার ঔদ্ধত্য বা নার্সিসিজমের কাউন্টার বক্তব্য দিচ্ছে আপনার সংখ্যাটি, অর্থাৎ, সে আপনাকে দমিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এই জায়গাটাতে, সে কিন্তু আপনার তৈরি একটি ক্যারেক্টার। এটি আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হিমালয়ঃ আমি ত নিশ্চিত যে আমি নার্সিসিস্ট, কে নার্সিসিস্ট না? সবাই নার্সিসিস্ট। কেউ হয়ত একটু উগ্র, কেউ সংযত, কেউ শৈল্পিক নার্সিসিস্ট। কিন্তু নার্সিসিস্ট না হলে, অর্থাৎ আত্মপ্রেম না থাকলে সে কীভাবে গ্রেটার কনটেক্সটের সাথে নিজেকে যুক্ত করবে। আবার আমরা নার্সিসিস্ট বিষয়টাকে খুব ভুল বুঝি। আত্মপ্রেম আর আত্মরতিপরায়ণ কিন্তু এক না। আমি আত্মরতিপরায়ণ নই।

মুরাদঃ আমি সেইদিকেই আসছিলাম প্রশ্নে। বইতে আপনার ঔদ্ধ্বত্যকে দমিয়ে দেবার জন্য একটা ক্যারেক্টার আছে।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, আমি আমার ক্ষেত্রে এনাফ ক্রিটিক্যাল হইতে পারি। যেমন, তুমি ত পুরা বই পড়ো নাই, ফিফথ চ্যাপ্টারে আছে আমি যেসব জায়গায় চরম ডাম্ব, চরম স্টুপিড আচরণ করেছি সেগুলা নিয়ে। তাছাড়া প্রথম চ্যাপ্টারে আমি আমার বাপরে নিয়া যা লেখছি, এরকম কিছু লেখতে ত কেউ সাহস করে না।

মুরাদঃ হ্যাঁ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়রিতে আমি এরকম কিছু লাইন দেখছিলাম মনে হয়।

হিমালয়ঃ আর আমি ত আমার ব্যাপারে কোন রাখঢাক করি নাই। আমার বাপরে নিয়া যা লেখছি, বা আমার ছোটবেলায় মলেস্টের শিকার হওয়া নিয়া যা লেখছি, একজন আত্মরতিপরায়ণ লোক ত এমন লেখবে না।

মুরাদঃ কিন্তু মিস ইন্টারপ্রিট ত  হইল। অনেকে এটারে নার্সিসিস্টই বলতেছে।

হিমালয়ঃ এটার দুইটা কারণ আছে বলে আমি মনে করি। যারা এটা বলতেছে তারা ব্যক্তিগত ভাবে আমার পরিচিত। তাদের মনে হইতেছে আমি নিজের ঢোল পিটাইতেছি। যেমন স্ক্রিপ্ট ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টার্ভিউ নেবার ক্ষমতা, তাদের কাছে এটা সাধারণ। নতুন কেউ অবাক হবে, যে লোকটা এতক্ষণ স্ক্রিপ্ট ছাড়া কীভাবে ইন্টার্ভিউ নেয়। কিন্তু পরিচিতদের ক্ষেত্রে এটা হবে না। বুঝছো? তুমি যদি রবীন্দ্রনাথের সাথে নিয়মিত থাকো, তাহলে তাকেও একসময় সাধারণ মনে হবে।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, ওরা ইনফিরিওরিটি থেকে এটা বলে। যেরকম একটা মানুষের লাইফ হওয়া উচিত, অধিকাংশ মানুষ যেরকম একটা মানুষ লাইফ লিড করে, তাদের ওয়ে অফ লিভিং, ওয়ে অফ বিহেভিং বা বিলিভিং, এসবের কিছুর সাথেই আমার ম্যাচ করতেছে না, তখন তারা ভাবতে কী এমন পণ্ডিত হইয়া গেছে রে! কিন্তু নার্সিসিজম বলতে ওরা যেটা বুঝাইতেছে, এটা আমার নাই, থাকলে  ত ঐসব আমি লেখতাম না।

মুরাদঃ আচ্ছা, সংখ্যার সাথে যে আপনার কথোপকথন সেখানে দেখা যায় আপনি অলওয়েজ ইন ডাউট, মানে ডাউটের মধ্যে আছেন,  এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

হিমালয়ঃ জীবনে ডাউটটাই কি সত্যি না? যখন তুমি কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছাইয়া যাইবা তখন ত সেটাকে নারচার করার আর কিছু নাই। তুমি জাইনাই ফেলছ যে এই লোকটা একটা খারাপ লোক, তখন ত তুমি আর তার সাথে মিশতে পারবা না। বা তুমি জেনেই ফেলছ যে দুই আর দুইয়ে যোগ করলে চার হয়, সারাজীবন হয়, তাইলে তুমি নিজেকে গ্রো করবা কীভাবে? তখন তুমি এক্সপ্লোর করবা কীভাবে? যখন তোমার মধ্যে ডাউট থাকবে যে এটা নাও হইতে পারে, যেকোন কিউরিসিটি ইনোভেশনের মূলই ত হচ্ছে ডাউট। সো, আমি যদি ডাউটে না থেকে কনফার্ম হয়ে যাই, তাহলে আমি মারা গেছি একচুয়ালি।

মুরাদঃ আমি এরকম দেখছিলাম তারকোভস্কির একটা ফিল্মে, স্টকারে সম্ভবত, সেখানে এক রাইটার বলছিল একজন রাইটার লেখে কারণ সে অলওয়েজ ইন ডাউট, সে যদি নিশ্চিত হইত যে সে একটা জিনিয়াস তাইলে তো লেখার কোন দরকারই ছিল না।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ সেটাই ত। আমার যদি ডাউট না থাকে তাহলে ত ইনভেনশন ইনোভেশনের সুযোগই নাই। আমি মৃত মানুষ। আই এম ডেড। তাই এটাই কি হওয়া উচিত না?

মুরাদঃ কিন্তু আমরা আমাদের এখানে যেসব ইন্টেলেকচুয়াল দেখি, তাদের ত  ডাউট দেখি না।

হিমালয়ঃ প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশে কোন ইন্টেলেকচুয়াল আছে এটা আমি বিলিভ করি না। বাংলাদেশে নলেজেবল পার্সন আছে। নলেজেবল পার্সন আর ইন্টেলেকচুয়াল দুইটা এক না, দুইটার মাঝে পার্থক্য আছে। বাংলাদেশে নলেজেবল পার্সন আছে, সেই নলেজ তারা ব্যক্তিস্বার্থে, নিজেদের এসটাবলিশমেন্টের জন্য ব্যবহার করে। এনলাইটনমেন্টে ব্যবহার করে এমন কিছু আমার নজরে পড়ে নাই। বাংলাদেশের রেফারেন্সে বিচার করা তাই ঠিক না, নলেজেবল আর ইন্টেলেকচুয়াল যেহেতু এক না। নলেজ একটা সেলেবল জিনিস, আর ইন্টেলেকচুয়ালের সাথে উইজডমের একটা সম্পর্ক আছে। এই উইজডমের জন্য একটা স্যাক্রিফাইস ও স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যাইতে হয়। আমাদের লোকজন স্ট্রাগল বলতে বুঝে না খাইয়া থাকা। এছাড়া মেন্টাল স্ট্রাগলের যে জিনিসটা, এটা এরা বুঝতে পারে না। এইজন্যই আমাদের এখানে প্রবাদ প্রবচনগুলা বলে যে, এই ধরো, এক মন দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চুন দিলে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। সো, এই প্রবাদ প্রবচনসহ সব কিছুর মধ্যে স্টুপিডিটি আছে। আমি এই বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জন্য ভালো জায়গা মনে করি না। নলেজ চর্চা হইতে পারে।

মুরাদঃ আমাদের যেসব পরিচিত বুদ্ধিজীবী আছেন, যেমন সলিমুল্লাহ খান বা ফরহাদ মজহার, এদের সম্পর্কে আপনার কী ধারনা?

হিমালয়ঃ ফরহাদ মজহারের লেখা আমি পড়ছি, তিমির জন্য লজিকবিদ্যা আর ভাবান্দোলন। আমার মনে হয় নাই তার থট প্রসেস আমার আগ্রহ জাগাইতে পারে।

আর সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার আলাপ হইছে সুইডিশ ভাষা শেখার একটা কোর্সের খাতিরে। তখন আমি দেখছি যে তিনি অনেক বিষয়ে নলেজ রাখেন। নলেজেবল পার্সন। বাট তার নিজস্ব কোন বক্তব্য আছে এটা আমার মনে হয় নাই। যার নিজের কোন বক্তব্য নাই, সবি হচ্ছে, ইয়ে..ঐ…

মুরাদঃ ধার করা?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, ধার করা, সে নলেজেবল পার্সন, সোসাইটির জন্য দরকার। বাট আমার মনে হয় সে যদি তার নলেজকে থট প্রসেসের সাথে মিলিয়ে নিজস্ব একটা বক্তব্য বা ফিলিংস তৈরি করত, তাইলে সেটা তারে আমার কাছে রেসপেক্টেড একটা জায়গায় নিয়া যাইত। এখন তার প্রতি আমার সমীহ আছে, কিন্তু রেসপেক্ট আছে বলে মনে হয় না।

আর তার প্রতি আমার যে সবচাইতে বড় অভিযোগ আছে তা হল সে আহমদ ছফার নামের আগে মহাত্মা কেন লাগায়? মহাত্মা কেন? আমার মনে হয় এর মাধ্যমে সে ছফাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে ও কিছুক্ষেত্রে হাস্যকর করছে। উনি আহমদ ছফাকে পীর আউলিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। বাজে কাজ করছে। এটা ঠিক না। সে বলতে পারত আহমদ ছফা একজন বল্ড ক্যারেক্টার , সাহসী মানুষ। বা হোয়াটেবার, সে জ্ঞানী ব্যক্তি তার কাছে ত বিশেষণের অভাব হবার কথা না, কিন্তু সে মহাত্মা কেন লাগাবে?

মুরাদঃ এটা এক ধরনের ব্যঙ্গ টাইপ হয়ে যায়।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই। এটা, এটা খুবই আনএক্সপেক্টেড। উনার মতো একজন নলেজেবল পার্সনের কাছ থেকে। আমার কাছে অর্বাচীন, শিশুতোষ একটিভিটি মনে হইছে।

মুরাদঃ তা, আপনি কি এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে?

হিমালয়ঃ না, এশটাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কেন হবো? এশটাবলিশড হওয়া একটা যোগ্যতা। আমার সে যোগ্যতা নাই, যার যোগ্যতা আছে সে এশটাবলিশড হইলে সমস্যা কী? সবাই যদি অফট্র্যাক হইতে চায়, যদিও সবাই পারবে না, কিন্তু যদি সবার মাথার মধ্যে এটা ঢুকে যায় অফট্র্যাক হইতে হবে, তাহলে তো সোশ্যাল ইকো-সিস্টেম কলাপ্স করবে। এবং আমাদের মতো মানুষজন তখন সোসাইটির জন্য ক্ষতিকর হবে। সো এশটাবিলশড হবার প্রত্যাশা ঠিক আছে, যার নাই সেটা অন্য ব্যাপার, আমার নাই কিন্তু আমি এর বিপক্ষে না। আমার ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স থাকতে পারে, ঐ পথে না যাওয়া বা ঐ আকাঙ্ক্ষা না থাকা, কিন্তু ব্যক্তিগত আর সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ দুইটা তো আলাদা। সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে এশটাবলিশমেন্ট দরকারি জিনিস। কিছু এশটাবলিশড লোকজনের আনুকূল্য পাই বলেই তো আমাদের মতো লোকেরা কিছু করে খেতে পারছি। সো, তারা যদি না থাকে তো আমরা কী করব? খেতে গিয়া কামলা দেয়া ছাড়া তো উপায় থাকবে না। আবার সেই যোগ্যতাও তো নাই।

এটা ঠিক না, এই যে কিছু লোক যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে দাবী করে, এরা ঐ পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি কিছু ফ্যান্সি নাম দিয়ে এই এশটাবলিশমেন্ট জিনিসটাকে মানুষের সামনে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে।

মুরাদঃ এটা অনেকে বলেন যে, এরা তো মিডলক্লাস, মানে এই মিডলক্লাস শিক্ষিত শ্রেণী যখন দেখে যে তাদের মত বা চাইতে কম ট্যালেন্ট নিয়ে কেউ ধনী হয়ে আছে বা গেছে, তখন তাদের মধ্যে একটা ঈর্ষা কাজ করে। এখান থেকেই কাজটা করে।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, সেটা তো আমি তোমাকে প্রথমেই বললাম, আমাকে নার্সিসিস্ট বলার কারণটা কী? যখন ম্যাচ করে না তখন একটা ডিসকম্ফোর্ট ফিল করে। এই ডিসকম্ফোর্টের এক্সপ্রেশন একেকজন একেকভাবে দেয়।

বাংলাদেশে যেসব নলেজেবল লোকজন আছে, তারা মেধার দিক থেকে খুব গড়পড়তা মানের। একটু আউট অব দ্য ট্র্যাক জিনিসপত্র তাদের এন্টেনায় ধরে না। ফলে তারা ওইটা ক্যাচ করতে না পেরে, তাদের গ্রামারে ফেলতে না পেরে তখন হতাশাবোধ থেকে কিছু কথা বলে।

মুরাদঃ আচ্ছা, আমাদের এখানে নতুন যারা সাহিত্য করতে আসে, দেখা যায় তারাও সেই আগের দলাদলিই করে, এখন হইছে গিয়া অনলাইন পত্রিকা ভিত্তিক গ্রুপিং কালচার, এই যে সংস্কৃতি এর উন্নতি কেন হচ্ছে না? বা আপনি যে বলছিলেন প্রতিভার সাথে মানি মেকিং এর কোন বিরোধ নাই, এটা তো এখানে বেশিরভাগেই বুঝে না। কেন?

হিমালয়ঃ বুঝে না কারণ, বাংলাদেশে যারা সাহিত্যচর্চা করে তুমি তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড একটু চেক করে দেখো, কয়জনের মানি মেইক করার এবিলিটি ছিল, তারা পড়াশোনা করছে কোথায়? প্রথম কথা হইল এইটা।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো তারা আবার ড্রপ আউট, মানে ঐ জায়গা তার ভালো লাগে নাই। ফলে তারা যে একটা ভালো কেরিয়ার বাইছা নিবে এই সুযোগ ছিল না। ফলে সামগ্রিকভাবে যা হইছে, তারা বলতে চাইছে তোমার মানি মেইক করতে হইলে নীতি নৈতিকতা সব বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু এটা তো রং। মানি মেইক করা মানে তোমার অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করা। মানি জেনারেট মানে ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে গেছি। আমরা ঐ হয় ইন্ড্রাস্টিয়ালিস্ট বা পথে পথে ঘুরতেছি এই শ্রেণীই বুঝি। কিন্তু এর মাঝে যে অনেক লেয়ার আছে, চাকরিজীবী হতে পারে, ছোট উদ্যোক্তা হতে পারে, বা প্রকাশক হতে পারে, এইসব আমাদের বোধগম্য হয় না। আমি সব সময় বলি, তোমার লেভেল অব এক্সেলেন্সি বাড়াতে হলে দুইটা জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। এক ইকোনমিক্স সম্পর্কে তোমার ফ্যান্টাস্টিক একটা ধারনা থাকতে হবে, দুই মানুষের শরীর সম্পর্কে তোমার ক্লিয়ার নলেজ থাকতে হবে। এই দুই জিনিস সম্পর্কে যদি তোমার কোন প্রেজুডিস থাকে, ডিপ নলেজ না থাকে, তাহলে তুমি কোন ডিফরেন্স ক্রিয়েট করতে পারবা না।

যারা সাহিত্য করে, এদের সাহিত্য শুরু হয় প্রেমের কবিতা দিয়ে, ছড়া কবিতা লেখে, বা পরে মধ্যবিত্তের ক্রাইসিস এইসব হাবিজাবি… তো তারা কী করে? হয়ত পাঁচ দশটা বই করছে, ঐটার স্ট্র্যাকচার ফলো করার চেষ্টা করে, এবং মনে করে সাহিত্য হচ্ছে একটা গুরুমুখী বিদ্যা, আমার বইতে আনিসুজ্জামান স্যার যদি ভূমিকা লিখে দেয় বা কবির চৌধুরী স্যার যদি ভূমিকা লিখে দিত… তাদের নিজের উপরই তাদের কনফিডেন্স নাই, অন্যের সুপারিশে যদি জাতে উঠা যায়।

আমাদের এখানে সাহিত্যের কোরাম আছে, এক কোরামের লোক আরেক কোরামের লোককে দেখতে পারে না। নিজের কোরামের লোক পরস্পরকে ইয়ে…

মুরাদঃ তেল দেয়?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, ঐ পিঠ চাপড়া চাপড়ি করে। ফলে আমাদের টোটাল বাংলাদেশে কোন সমালোচনা সাহিত্য হয় না। আমাদের বুক রিভিউগুলা পড়লে দেখা যায় হয় ঐগুলা অতি প্রশংসায় জর্জরীত বা অতি বিষোদগারে ভারাক্রান্ত। ফলে সমালোচনা যেইটা, সম আলোচনা, সেই জায়গাটাই নাই। সমালোচনা মানে হইছে এখানে নিন্দা করা। এই দুইটা যে এক না, সেটাই বুঝে না।

মুরাদঃ আমাদের যে ইনক্লসিভ মিডিয়া আসছে (ব্লগ, ফেইসবুক) ওইখানে কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?

হিমালয়ঃ ব্লগ এসে কিছু মানুষকে, অভ্রতে বা বাংলায় লেখা শিখাইছে। তবে সামগ্রিকভাবে ব্লগ মানুষের লেখালেখির প্রতিভাকে আরো সংকুচিত করছে। আমার অভজার্বেশন থেকেই বলি। ব্লগে বড় লেখা মানুষ পড়ে না। আর বেশি কমেন্ট পাবার আকাঙ্ক্ষায়, মানুষ ছোট ছোট লেখা লেখার চেষ্টা করে, তখন তার ডেভলাপমেন্টটা হয় না। এই অতি কমেন্ট পাবার লোভ, এইজন্য আমরা অনেক এক্টিভিস্ট পেয়েছি, যারা দেশি বিদেশী নানা ইস্যুতে সেটা পারমানবিক বোমা, রোহিঙ্গা ইস্যু বা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ইস্যু হোক, সব ইস্যুতেই তারা সুন্দর সুন্দর লেখা লেখে, কিন্তু তেমন কোন মেরিট চোখে পড়ে না, পড়বেও না। কারণ তার ইচ্ছাই হচ্ছে কেমনে বেশি লোক আমার লেখা পড়বে, ঐ ডেপথই তার নাই।

মুরাদঃ হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগে অনেকরে ব্লগে দেখতাম যেরকম, এখনো দেখি ঐরকম, মানে সে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ঐ জায়গাতেই আছে।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, যখন কমেন্টপ্রাপ্তিই মূল লক্ষ্য হয়ে যায় তখন কন্টেন্ট বা কনটেক্সটের বাইরে কী করলে বেশি কমেন্ট পাওয়া যাবে এটাই প্রধান হয়ে উঠে। এজন্য লেখা ছোট ছোট করে, যে লোক বিজ্ঞাপন বানায় তার কাছে তুমি বড় ফিল্ম আশা করতে পারো না। ফিল্মের ভাষা আলাদা।

মুরাদঃ যেই সমস্যাটা আয়নাবাজি ফিল্মে হইছিল।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, বিজ্ঞাপন তো টাইট টাইট করতে হয় , আমাদের কিন্তু ঐটাই হইছে। এই অনুকাব্য, অনুগল্প এইসব কিছু হইছে। বড় লেখা তৈরি করা, বড় উপন্যাস লেখা, এনালিটিক্যাল গল্প লেখা, ঐ জায়গায় যাইতে পারে নাই কমেন্টের প্রলোভনে।

মুরাদঃ আচ্ছা, এখন আপনার গল্প নিয়ে কথা বলি। আপনি আপনার গল্পকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

হিমালয়ঃ আমার গল্প নিয়া বলা আসলে ডিফিকাল্ট। আমি যখন শাহাদুজ্জামানরে আমার গল্প পড়তে দিছিলাম তখন সে বলছিল যে তোমার গল্প পড়লে মনে হয় এইগুলা বানাইয়া লেখা। তোমার গল্পগুলা আসলে গল্প হয় না। আমি তারে, শাহাদুজ্জামানরে অবশ্য বলছিলাম যে আপনার বই মানুষ পড়ে, তার মানে এই না যে আপনি সার্টিফাই করার পরেই কোন কিছু গল্প হবে বা হবে না। হতে আমার টেইস্ট আর আপনার টেইস্ট ম্যাচ করে নাই। তো আমি গল্প, আসলে ভালো মন্দ এটা হল সাবজেক্টিভ ব্যাপার। আমি আসলে ঐ লাইনেই যাই না। আমি বলি আমার গল্প মানুষকে ধাক্কা দেয় কি না। আমার গল্প মানুষকে ধাক্কা দেয় এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। কেউ যদি পড়তে যায় তাকে ধাক্কা দেয়। আমার ভাষাশৈলী ভালো না বিকজ আমি লাইফে কথাসাহিত্য বেশি পড়ি নাই। যে কারণে ভাষা শৈলী ম্যাচুর হয় নাই। আমার প্রকাশভঙ্গীতে শৈল্পিকতা কম। এটা আমি ক্রিকেট খেলা দিয়ে বলতে পারি। একজন ব্যাটসম্যানের স্টাইল ভালো হলে সুন্দর লাগে , কিন্তু সে কন্টিনিউয়াস রান করলেই তাকে ভালো লাগে। আমার লেখার যে কন্টেন্ট মেরিট তা গল্প হোক বা নিবন্ধ ধরনের লেখা, তা মানুষকে ভাবায়।

মুরাদঃ মানে কাফকা যেরকম বলছিলেন যে, স্ট্যাব করতে হবে পাঠককে?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, রাইট, তোমাকে ধাক্কা দিবে। তোমাকে এটাচ করবে, বা এট্র্যাক্ট করবে বা ধরে রাখবে, সেটা নাও হতে পারে। তো এটাকে তুমি যেভাবে নেও। আমার লেখা সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হল, আমার লেখা মানুষকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু মুগ্ধ করে না।

মুরাদঃ মুগ্ধ করে না কি ভাষার কারণে?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, আমার লেখার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমার ভাষাভঙ্গি।

মুরাদঃ আচ্ছা, বাংলাসাহিত্যে এমন কয়টা লেখক আছে বলে আপনি মনে করেন যাদের ভাষাশৈলী খুবই সেরা, বা ভাষার কারণেই তারে পড়তে ভালো লাগে?

হিমালয়ঃ ভাষাশৈলী, যারা কথাসাহিত্য লেখে, যেমন হাসান আজিজুল হকের ভালো, সৈয়দ শামসুল হকের সুন্দর। কিংবা শহীদুল জহিরের ভাষাশৈলী হচ্ছে চমৎকার।

মুরাদঃ শুধু ভাষা শৈলীর কারণে আলাদাভাবে , যেমন কমলকুমার মজুমদার, তার ভাষা শৈলীই ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস, তার কন্টেন্ট তো বেশীরভাগ মানুই বুঝতে পারে না। তার ভাষা অত্যধিক কঠিন। কিন্তু এটা তো খুব বড় বেরিয়ার হবার কথা না।

হিমালয়ঃ আমি তো বেরিয়ার মনে করি না। আমার প্রথম বই বের হইছে এগারো সালে। এখন আঠারো চলতেছে, মানে সাত বছর তো হইলই। আর লেখালেখি করতেছি সেই চুরানব্বই সাল থেকে। মানে অলমোস্ট পঁচিশ বছর চলতেছে। যখন আট বছর বয়স তখন থেকেই লেখালেখি শুরু করি। তো এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য মানুষের ফিডব্যাক পাইছি লেখা নিয়ে । তাদের প্রায় সবারই কথা হল তোমার লেখার অধিকাংশ জিনিসই বুঝি না। সো এটা তাদের ব্যর্থতা বা আমার সীমাব্দ্বতা। আমি আমার সীমাবদ্বতা হিসেবেই মেনে নেই। কারণ ভালো লেখকের একটা বৈশিষ্ট্য হল সে তার মেসেজ কনভে করতে পারতে হবে। তা না হলে তাকে আমি দূর্বল লেখকই বলব। আমি দূর্বল লেখক, এটা মানতে আমার কোন অসুবিধা নাই।

মুরাদঃ আপনার নামহীন বইতে তো বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না, আমি যতটুকু পড়লাম আর কি।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ।

মুরাদঃ এটার ভাষা কি আলাদা?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, আমার গল্পের ভাষা আর নামহীন বইয়ের ভাষা আলাদা। নামহীন বইয়ে আমি পুরাটাই কথ্য ভাষায় লেখার চেষ্টা করছি, একটা র জিনিস রাখার চেষ্টা করছি, বাট আমার গল্পের বই যেগুলাত সেগুলাতে আমি ভাষা নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করছি। বিশেষকরে আমি নিজস্ব রূপক বানানোর চেষ্টা করতাম । নিজস্ব উপমা বানানোর চেষ্টা করতাম । লাইনগুলার একটার সাথে আরেকটার জোড় দেবার চেষ্টা করতাম। এটা একটা, আমার লেখা যারা পড়ছে, আমার একটা ক্রেডিট বলতে পারো, আমার লেখার কোন নাম দিতে হয় না, আমার একটা সিগনেচার টোন আছে, পড়লে বুঝা যায়।

মুরাদঃ গল্পে আপনি একজন এক্সপেরিমেন্টাল রাইটার?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ।

মুরাদঃ এত এক্সপেরিমেন্ট করার পরে এক্সপেরিমেন্টাল রাইটার হিসেবে সাহিত্যে আপনার নাম তো উচ্চারিত হতে দেখি না।

হিমালয়ঃ আমি তো কোন কোরামে নাই। যারা সাহিত্য চর্চা করে তারা হয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা কোন পত্রিকার সাথে যুক্ত। অথবা কোন টিভি মিডিয়ায় কাজ করে। এরকম মানুষই তো বাংলাদেশে সাহিত্যের এক্সপোজার নিয়ে কাজ করে। আমি তো কোন মিডিয়াতেও নাই, কোন সাহিত্য আন্দোলন বা সাহিত্য আড্ডা কোন কিছুতেই নাই। তো আমি হচ্ছি একজন, ইয়ে, ফ্রিল্যান্সার বলতে পারো। আমি এটাকে একটা কর্পোরেশন বলতে চাই, আমি এই কর্পোরেশনের সাথে নাই। একজন ফ্রিল্যান্সারকে কখনো কোন জব মার্কেট মনে রাখে না।

মুরাদঃ আচ্ছা, এটা তো আমাদের সাহিত্যের জন্য একটা সমস্যা?

হিমালয়ঃ সমস্যা আর কি। পৃথিবীতে সমস্যা বলতে কিছু নাই। রবীন্দ্রনাথের জন্ম না হইলে সাহিত্য চলত, মাইকেল মধুসূধনের জন্ম না হইলেও সাহিত্য চলত। পৃথিবীতে অপরিহার্য বলতে কিছু নাই।

মুরাদঃ কিন্তু ধরেন একটা রাইটার, আলাদা থেকে খুবই এক্সপেরিমেন্টাল ও ভালো লেখতেছে, কিন্তু তারে তো আমাদের কর্পোরেশন নিবে না।

হিমালয়ঃ না নিলো!

মুরাদঃ সে তাইলে কই যাবে?

হিমালয়ঃ তার কোথাও যাইতে হবে না তো!

মুরাদঃ সে তার লেখবে?

হিমালয়ঃ কাফকাকে তার জীবদ্দশায় কে চিনত?

মুরাদঃ হ্যাঁ, কে চিনত। তার মানে আপনি ফিউচার অডিয়েন্সের দিকে তাকাচ্ছেন।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে আজকে কতো কথা হয়, মেয়েদের মধ্যে এতো মাতামাতি। জীবনানন্দ দাস্যার প্রেমে পড়াটা এখন একটা আর্ট হয়ে গেছে। জীবনানন্দ দাশ আমার প্রথম প্রেম বা ছেলেরা বলবে ঘোর লাগা। আর জীবদ্দশায় এই জীবনানন্দ দাশরে কে কি গোনায় ধরছে? কবিরাই তো বরং তারে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছে।

মুরাদঃ রবীন্দ্রনাথও করছিলেন।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম বই পড়ে খুবই নেগেটিভ রিভিউ দিছে। বুদ্ধদেব বসু ছাড়া কেউই তো তার পক্ষে ছিল না, ইভেন একটা পর্যায়ে বুদ্ধদেব বসুর সাথে তার দূরত্ব তৈরি হইছে। আর আজকে এত বছর পরে জীবনানন্দ দাশের অবস্থান কোথায় আর ঐ সজনী ঘোষ না কি জানি

মুরাদঃ সজনীকান্ত।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, বা বিষ্ণু, সুধীন্দ্র চক্রবর্তী টক্রবর্তী বা আর যারা ছিল তারা কোথায়? সো, এই কারণে আমি অলওয়েজ বলি যে কানেক্টিভিটি। কানেক্টিভিটির জন্য ফিজিক্যাল প্রেজেন্সটা খুব জরুরী কিছু না। আমি আমার কাজ করে যাই। যদি আসলেই ভ্যালুয়েবল হয় তাহলে প্রকৃতি পে ব্যাক করবে। তাই কিছুই যায় আসে না।

মুরাদঃ আচ্ছা, আপনার বইয়ে লেখছেন যে কমিউনিটি ডেভলাপমেন্ট এটা আপনার লাইফের একটা প্রধান উদ্দেশ্য। এটা নিয়ে কিছু বলেন।

হিমালয়ঃ এটা আসলে সচেতন ভাবে হয় নাই। আমার বইতে দেখবা আমি মানুষকে ছোটকাল থেকেই প্রশ্ন করি। ছয় সাত বছর বয়স হবার পর থেকেই প্রশ্ন করি, তার কোন কথা পছন্দ হলে লিখে রাখি। ঐটা করতে করতে, তারপর দশ এগারো বছর থেকে মানুষের ইন্টার্ভিউ করা শুরু করলাম, এটা করতে করতে, আমার ত প্রথম ত্রিশ বছরে কোন এইম ছিল না লাইফের। ত্রিশ পার করার পর ভাবলাম যে একটা এইম হওয়া উচিত। তখন আমি এনালাইজ করলাম যে লাইফে সবচেয়ে বেশি কী করছি। লাইফে সবচেয়ে বেশি করছি হচ্ছে, মানুষের গল্প শোনা। গল্প শোনার মাধ্যমে তাদের সাথে একটা কানেক্টিভিটি তৈরি হইছে। ভাবলাম কানেক্টিভিটি নিয়ে কাজ করি, কিন্তু এটা করতে গিয়ে মাথায় আসল সোসাইটি। কিন্তু সোসাইটি একটা গ্রস জিনিস, সোসাইটি ডেভলাপ ওরা সম্ভব না। সোসাইটি ডেভলাপ করতে হলে এখানকার সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে চিন্তা করতে হবে। কিন্তু কমিউনিটি ডেভলাপ করা তুলনামূলক সহজ। সোসাইটি আর কমিউনিটিকে আমি দেখি এভাবে যে, এক থেকে একশো এটা হচ্ছে সব মিলাইয়া সোসাইটি। কিন্তু পাঁচ দশ পনেরো এরকম হচ্ছে কমিউনিটি। ৫ এর গুণিতক বা তিন পাঁচ সাত এরকম মৌলিক সংখ্যা, একেকটা কমিউনিটি। অর্থাৎ, আলাদা বা একইরকম যোগ্যতা সম্পন্ন কিছু মানুষ নিয়া। আমি দেখছি যে আমার জন্য কমিউনিটি ডেভলাপ করাটা ইজি। এবং যেটা হয় কমিউনিটি ডেভলাপ করলে তার আশপাশের মানুষকে সে প্রভাবিত করতে পারে। এতে ত্রিশ বছর চল্লিশ বছর পরে সোসাইটির এভারেজ লেভেল কিছুটা উন্নত হয়। যেমন ধরো, তোমার সাথে আমি কানেক্টেড। তোমার আশেপাশে আবার কিছু মানুষ তোমার ফলোয়ার থাকবে। সো, এইভাবে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে কানেক্টেড হই, তখন আমাদের সূত্রে আর কিছু মানুষ ভিন্ন ভাবে চিন্তা করা শিখবে। সেটার রেজাল্ট ত্রিশ বছর চল্লিশ বছর পর পাওয়া যাবে। আমরা ত মুদি দোকান খুলি নাই যে আজকের হিসাব আজকেই করতে হবে। এর জন্য দূরদর্শীতার দরকার আছে। সো, এইভাবে আমি ভাবলাম কমিউনিটি ডেভলাপমেন্টটা আমার লাইফের এইম হওয়া উচিত। ঐটাই, ঐটা ওইরকম সচেতন ভাবে হয় নাই। ত্রিশ বছর পরে লাইফ এনালাইসিস করে মনে হইছে এটা করা উচিত। ত্রিশ পার হইছে ত বেশিদিন হয় নাই, মাত্র দুই বছর হইছে। দেখা যাক।

মুরাদঃ আপনি ত পপুলার বিষয় যেমন বাংলা ফিল্ম, ক্রিকেট, গান ইত্যাদি নিয়া লেখেন আর তুলনামূলক ডিপ বিষয় নিয়া লেখেন। এই যে মিক্সিং, এটা কেন করেন?

হিমালয়ঃ আমার মূলত লেখার ইচ্ছা হচ্ছে মূলত এই ডিপ বিষয়গুলাই। কিন্তু যেটা হইছে আউটরিচ করার জন্য অনেক পপুলার জিনিস নিয়া লেখতে হয়। প্রত্যেকের ফ্রেন্ডলিস্টেই কিছু ডিফ্রেন্ট প্যাটার্নের লোক থাকে। ত বেশি মানুষের কাছে যাইতে হলে জনপ্রিয় জিনিস নিয়া লেখতে হবে, তবেই ওই ডিফ্রেন্ট প্যাটার্নের লোকগুলির কাছে পৌছা যাবে। তখন আমি দেখলাম এই দেশে ক্রিকেটের চাইতে পপুলার আর কিছু নাই। আমার লাইফে ক্রিকেটের একটা বড় ইনফ্লুয়েন্স আছে। সো লাকিলি আমি ক্রিকেট নিয়া লেখতে পারি, ফিল্ম নিয়া আমার আগ্রহ আছে। মিউজিক নিয়া আগ্রহ আছে, লিখতে পারি। বা পপুলার পার্সোনালিটি নিয়ে, কিন্তু কন্টেন্ট পপুলার হইলে আমার লেখার স্টাইল কিন্তু পপুলার না। আমি ক্রিকেট নিয়া পোস্ট লেখলেও সেটা অনেক বড় পোস্ট। ছোট খাট পোস্ট না। সেখানে এনালাইটিক এলিমেন্টস থাকে। ওইটা জাস্ট পড়ার জন্য পড়া না। তুমি পার্থক্য করতে পারবা। আমি ক্রিকেট নিয়া যেরকম পোস্ট লেখি এরকম তুমি সারা পৃথিবীতে, খালি বাংলাদেশ না, সারা পৃথিবীতে আর কোথাও দেখবা না। সো, কী হইছে? আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি, বুদ্ধিমান লোকের জন্য ইশারাই যথেষ্ট, বুদ্ধিমান লোক পোস্ট পড়েই বুঝতে পারবে এই লোকটার একটা এনালিটিক্যাল এসেন্স আছে। তার ক্রিটিক্যাল থিংকিং এবিলিটি ভালো। সো ঐসবের মাধ্যমে আমি আউটরিচ বাড়াই, যাতে যখন আমি আমার মূল লেখা যেমন মিসফিট নিয়া বা ইন্ট্রোভার্ট বিষয়ক পোস্ট লেখি এগুলা কেউ না কেউ পড়ে। আলটিমেটলি ওই যে কমিউনিটি বিল্ড আপ বা কানেক্টিভিটির কথা বললাম, এটা কিন্তু হয় আমার মূল লেখাগুলি লিখে, পপুলার লেখাগুলি লিখে নয়, যদি ওগুলি শেয়ার লাইক বেশি পায়। কেউ আমারে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে বলে না ভাই ঐ লেখাটা আমারে প্রভাবিত করছে। কিন্তু যখন মিসফিট নিয়া বা জীবনানন্দ নিয়া অর্থাৎ মূল লেখাগুলি লিখি তখন কিন্তু ঠিকই ইনবক্সে এরকম মেসেজ পাই। হাসপাতাল করার জন্য অনেক সময় কমার্শিয়াল ফিল্ম করে না? এটা হইছে সেরকম।

মুরাদঃ হ্যাঁ, আগে যে বলছিলাম জিজেক ফিল্ম নিয়া কথা বলেন লোকদের আকৃষ্ট করার জন্য।

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে ঐটাই। এটা ত আত্মস্বীকৃত, আমি কোন লুকোচাপা করি না। এটা নিয়া আমার লেখা আছে। আমার প্যাটার্নও আছে। যখন পপুলার কন্টেন্টের একটা পোস্ট লেখি, এরপর টানা দুইটা আবার আমার ট্র্যাকের পোস্ট।

মুরাদঃ আপনার হিউম্যান ল্যাব ৭৭৭ কোম্পানিটা কী নিয়ে?

হিমালয় হিউম্যান ল্যাব ৭৭৭ আমার ভাষায় হচ্ছে মানুষ ডেভলাপমেন্ট সংক্রান্ত একটি কোম্পানি। মানুষকে ডেভলাপ করার কোম্পানি। কিন্তু এই কথা বললে তো মানি মেইক করা যাবে না। মানুষ বুঝবে না। মানুষ ডেভলাপমেন্ট আবার কি?

মুরাদঃ হ্যাঁ, একটা ঔদ্বত্য আছে, আমারে ডেভলাপ করতে চায়!

হিমালয়ঃ এজন্য আমি বলি যে এটা একটা বিজনেস রিসার্চ কোম্পানি। বিজনেস রিসার্চের আন্ডারে আমার কিছু সার্ভিসে আছে। যেমন ডিসট্যান্ট মেন্টরশীপ। মানুষের ডিসিশন মেকিং এবিলিটি, ইনসাইট, ক্রিটিক্যাল থিংকিং, এগুলার ডেভলাপ করার জন্য হয়ত আমার কিছু এক্সপারটিজ আছে। যেহেতু আমি লাইফে অনেক মানুষের ইন্টার্ভিউ করছি। তাদের সাথে মিশছি। এজন্য আমি ডিসট্যান্ট মেন্টরশিপটা চালু করছি। তারপর ধরো, একজন মানুষ কোন ধরনের কেরিয়ারে গেলে ভালো হবে। কেরিয়ার প্রোফাইলিং, কেরিয়ার কাউন্সেলিং, এইসব সার্ভিস। তারপর বাংলাদেশের যেসব স্টার্ট আপ হচ্ছে, স্টার্ট আপগুলার কোন স্কুলিং নাই। সো, আমি স্টার্ট আ স্কুলিং নিয়ে কাজ করতেছি। সিইওদের ডিসিশন মেকিং এ হেল্প করা বা সিইও স্কুলিং করতেছি। তারপর ধরো বিজনেস এনালাইসিস, রিক্রুটমেন্ট, এমপ্লয়ী এম্পাওয়ারমেন্ট, যেটাতে ট্যালেন্ট নারচার করে এমপ্লয়ীদের আর এফিশিয়েন্ট বানানো এইসব জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করতেছি। বিজনেস প্ল্যান কীভাবে হবে হবে এগুলা নিয়ে আমাদের এখানে কোন কাজ নাই, বিজনেস রিসার্চ নাই, ডেটা নিয়ে কোন কাজ নাই, বা এখন তো স্টোরিটেলিং খুব গুরুত্বপূর্ন, এগুলি নিয়ে কোন কাজ নাই; এগুলো করার চেষ্টা করতেছি। পাশাপাশি হচ্ছে, আমার হিউম্যান ল্যাবের আন্ডারে একটা পাবলিকেশনস আছে। সেখান থেকে যাদের থট প্রসেস আমার ভ্যালুয়েবল মনে হয় তাদের বই করতেছি। মানুষ নিয়ে কাজ বললে তো মানুষ বুঝবে না তাই বিজনেস রিসার্চ কোম্পানি বলতেছি। এর ট্যাগ লাইন হল, লিসেন, এনলাইটেন, লেসেন। অর্থাৎ, শোনো, আলোকিত করো ও কমাও।

মুরাদঃ কমাও ?

হিমালয়ঃ লেসেন, এল ই ডাবল এস ই এন মানে কমাই দেয়া ।

মুরাদঃ কী কমাও?

হিমালয়ঃ এই যে মানুষের এঙ্গার, টেনশন, অদূরদর্শীতা বা ভিশনলেসনেস, দ্রুত আউটপুট পাবার আকাঙ্ক্ষা।

মুরাদঃ ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন বা গ্রিড?

হিমালয়ঃ হ্যাঁ, এগুলিকে কমানোর চেষ্টা। এগুলি সব করতে হলে লিসেন বা শুনতে হবে। এ ছাড়া কোন উপায় নাই। আমি এটা খুব এরোগ্যান্টলি বলি পৃথিবীতে যদি লিসেনারদের বেস্ট ইলিভেন গঠন করা হয় তাহলে আমি সেখানে থাকব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। আমি কোন প্রতিভাবান মানুষ না। আমার কোন এক্সট্রা অর্ডিনারি যোগ্যতাও নাই। আমি ছোটবেলা থেকে একটা গুণই রপ্ত করছি, এটাই সারাজীবন নারচার করছি, তা হল আমি খুব অসাধারণ শ্রোতা। তুমি তোমার লাইফে আমার চাইতে ভালো শ্রোতা কোনদিন পাইবা না।

মুরাদঃ আপনি চিন্তা করতে পারেন এটা কি যোগ্যতা নয়?

হিমালয়ঃ না না, ঐগুলা তো সব ঐ লিসেনিং এর কারণেই হইছে।

মুরাদঃ প্যাসকেলের একটা কথা আছে মানুষের সব সমস্যার মূলে হইল সে নীরবে এক রুমে বসতে পারে না ও চিন্তা করতে পারে না।

হিমালয়ঃ কিন্তু আমার যাই হইছে, চিন্তা এইসব, সব এই লিসেনিং এর কারণেই। আমার এটাই সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। এই লিসেনিং এর উপর জোর দিতে গিয়া আমি লাইফে কখনো বক্তব্য দেয়ার ট্রাই করি নাই। বক্তা হবার টার্গেটই নাই। তাই কেউ যখন বলে আমি খুব বাজে বক্তা, আই ফিল রিয়েলি গুড। আর কেউ যদি বলে ভাই আপনার বক্তব্য ভালো হইছে তখন আমি বিষণ্ণ হয়ে যাই। মনে হয় যে আমি কি আমার ট্র্যাক থেকে সরে গেলাম, শোনায় আরো মন দিতে হবে।


 

এই ইন্টার্ভিউ নিয়ে কিছু মন্তব্য এখানে আছে।

 

আরেকটি সাক্ষাতকার নেয়া ছিল। দুইটা এক করে ইবুক করা যেত।  কিন্তু ছোটভাই রেজওয়ান ট্রান্সক্রাইব করতে পারছে। কোনও একদিন সে কাজটি করতে পারলে সেই সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হবে আশা করি।

2 thoughts on “হিমালয়ঃ “বাংলাদেশ একটা অনুর্বর মানুষের দেশ””

  1. উনার সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে আরও প্রশ্ন করা যাইতে পারত|উনার মত সংখ্যা রিলেটেড বিষয় নিয়া ভাবা লোকজন খুব কম আছে |

  2. একটা পপুলার মিথ রয়েছে। আইনেষ্টাইন একা একাই পেটেন্ট অফিসে বসে মাথা ঘামিয়ে ঘামিয়ে কোন না কোন উপায়ে স্পেশাল রিলেটিভিটি নাজিল করে ফেলেন। বাস্তবতা হল, অনেক আগে থেকেই লরেন্টজ আর পায়কারসহ ততকালীন অনেকের এই বিষয়ে গবেষনা ছিলো, আইনেষ্টাইন সাহেব যেগুলোর কিছু বিষয় একসাথে ধরে বেধে একটা সুত্রে ফেলে দেন। যেটা তার গবেষনাপত্রের রেফারেন্সে ছিলো না। প্রবাবিলিটির থিওরীও রায় দিয়ে ফেলেছে আইনেস্টাইন E=mc^2 বের না করলে বড়জোড় আর ৩০ বছর পরেই কেউ না কেউ এটা বের করতোই।

    “রবীন্দ্রনাথের জন্ম না হইলে সাহিত্য চলত, মাইকেল মধুসূধনের জন্ম না হইলেও সাহিত্য চলত। ”

    হিমালয় সাহেবের এই লাইন দুটো নিয়ে দ্বিধা আছে আমার। সাহিত্য আসলেই কি এই ভাবে চলে? কিংবা সংগীত?

    রবিন্দ্রনাথ যে সাহিত্য লিখেছেন মাইকেল মধুসূদন তা পারবেন না। মাইকেল মধুসূদন যে সাহিত্য লিখেছেন হিমালয় সাহেবর তা লেখার রুচি হবে না। হিমালয় যা লিখবেন সেটা লেখার মুরোদ মুরাদুল ইসলামের নাও হতে পারে।🤐 এটা নিশ্চয়ই হিমালয় সাহেব স্বীকার করবেন?

    সাহিত্য বিশারদ নই। সাধারন ভাবে সবাই বুঝি, একটা আবিষ্কার আর একটা সৃষ্টি। বিজ্ঞান আর সাহিত্যের কি এই পার্থক্য নয়?
    একটা বিষয় পরিষ্কার, ইন্টেলেকচুয়ালি থট করার মত সাহিত্য এদেশে নাই। সাহিত্য কি? লেখাই তো নেই।
    নেই কেন? হওয়ানোর উপায়ই বা কি? উনার কথাই বলি, “প্রবাদ প্রবচনসহ সব কিছুর মধ্যে স্টুপিডিটি আছে।” এর কারন কি?? এই জাতির দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলেই এমন কেন?

    হিমালয় সাহেবকে প্রশ্ন করবেন আশা করি।

    পুনচঃ বাস্তবিক অর্থেই আপনাদের দুইজনের কথোপকথনের অপেক্ষায় ছিলাম যেদিনই দেখলাম আপনাদের দুইজনের কর্মস্থলই এক জায়গায় হয়েছে।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং