মুরাদুল ইসলাম » ভূ-রাজনীতি ও ইতিহাস » মানুষের ইতিহাসঃ নারী নিপীড়নের শুরু

মানুষের ইতিহাসঃ নারী নিপীড়নের শুরু

ক্রিস হারমানের এ পিপল’স হিস্টরী অব দি ওয়ার্ল্ড এর অনুবাদ।

 

সমাজে যখন নানা শ্রেণী গড়ে উঠল এবং রাষ্ট্রের জন্ম নিল, এর সাথে সাথেই নারীরা তাদের অবস্থান হারালেন। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস প্রায় শতাব্দিকাল আগেই একে বলেছেন “স্ত্রী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়”। একসময় নারীরা ছিলেন পুরুষের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহনের অংশীদার, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ফেলে দেয়া হলো অধীনতা এবং পরনির্ভর এক ব্যবস্থায়। সব সমাজে এবং একই সমাজের সব শ্রেণীতে এই অধীনতা একইরকম ছিল এমন নয়। সমাজ এবং শ্রেণী ভেদে এর ভিন্নতা ছিল। কিন্তু তা সব শ্রেণী সমাজেই ছিল, এবং এরই ধারাবাহীকতায় আজকের সমাজেও আছে, আর এই সমাজে একে মনে করা হয় প্রাকৃতিক বা মানব চরিত্রেরই ফল।

এই পরিবর্তন শুরু হয়েছিল অতিরিক্ত শস্য উৎপাদনের ফলে সমাজের মানুষের ভেতরে যে সম্পর্কের পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল এর ভেতর দিয়ে। আগে যখন শিকার-সংগ্রহ সমাজ ছিল তখন নারীরাও খাদ্য সংগ্রহে সমভাবে অংশ নিতে পারত। যখন সাধারণ নিড়ানি দিয়ে কৃষিকাজ হতো, সেই সময়েও নারীদের কাজে অংশ নেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু যখন ষাঁড়, ঘোড়া ইত্যাদি বড় পোষা প্রাণী এবং লাঙ্গল ভিত্তিক চাষবাস প্রক্রিয়া শুরু হলো তখন শ্রমবিভাজন শুরু হয়। কারণ এ ধরনের পরিশ্রমের কাজ নারীদের দ্বারা সম্ভব ছিল না সন্তান লালন পালনের সাথে সাথে। যেসব সমাজে নারীরা এসব ভারী কাজে অংশ নিত সেসব সমাজে সন্তান উৎপাদন অনেক কমে যেত, তা জনসংখ্যায় খারাপ প্রভাব ফেলত।  বারবারিয়ান, সুমেরিয়ান, মিশরীয় ইত্যাদি সভ্যতাতেও দেখা গেছে লাঙ্গল দিয়ে চাষবাসের কাজ পুরুষেরাই করত। [৭৩] ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় পুরুষেরাই ছিল একচ্ছত্র এবং তারাই হয়ে উঠল পরিবারের একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। যখন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হলো, তখন ব্যবসা বা যুদ্ধের কাজে মহিলারা অংশ নিতে পারত, কিন্তু তাও খুব একটা হতো না। কারণ যেহেতু শস্যের উপর পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার বজায় ছিল এবং ক্ষমতা তখন তাদের হাতেই যেতে থাকে। তাই দেখা যায় বেশীরভাগ যোদ্ধা এবং ব্যবসায়ীরা পুরুষ। এই ব্যবস্থায় নারীরা ঘরে কেবল স্ত্রী এবং সন্তান উৎপাদনের বস্তুতে পরিণত হয়।

যারা শাসক শ্রেণী ছিল, তাদের কাছে স্ত্রী ছিল আরেকটি অলংকারের মত। যাকে রক্ষা করতে হবে বিপদ থেকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে পৃথিবীতে আনতে হবে তার মাধ্যমে। শ্রমজীবীদের পরিবারে মহিলাদের যদিও অনেক পরিশ্রম করতে হতো, তথাপি তাদেরও পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহনে কোন অধিকার ছিল না। এর ছায়া আমরা এর পরের ধর্মসমূহ এবং মতাদর্শগুলোতে দেখতে পাই। আমরা দেখি যে মহিলা দেবীরা অপ্রধান কাজে নিয়োজিত। তারা হয়ত উর্বরতা বা সৌন্দর্যের দেবী। পৃথিবী তৈরী এবং এর শৃঙ্খলা বিধানের কোন কাজে এই দেবীদের দেখা যায় না।

মহিলাদের উপর বৈষম্য বা নিপীড়ন সব জায়গায় একইরকম ছিল না। আবার সব সময় অপরিবর্তনীয়ও ছিল না। কৃষক সমাজে তা একরকম ছিল, অভিজাত শ্রেনীতে ছিল অন্যরকম। দাসদের মধ্যে ছিল আবার অন্য রকম। দাসেরা মেয়ে বা ছেলে যাইহোক না কেন, তারা নিজেরা বাড়ি করে থাকতে পারত না। বিধবারা ছিল সবখানেই কারণ তরুণ বয়েসে মৃত্যুর হার ছিল বেশী। কোন কোন সমাজে নারীদের কোন অধিকারই দেয়া হতো না, কোন সমাজে সম্পত্তি এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেয়া হত। ১৯৮০’এর ফেমিনিস্টদের তত্ত্ব যেমন বলে পিতৃতন্ত্রের কথা সব জায়গায় মহিলাদের উপর নিপীড়ন একইরকম ছিল, তা নয়। তবে পূর্বের যে সমাজ ছিল অর্থাৎ প্রাথমিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ, সেই সময়ের চাইতে নারীদের অবস্থা অনেক খারাপ ছিল।

প্রথম শোষিত শ্রেনীর উত্থান সমাজকে আরো পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। শোষকেরা যেসব পদ্বতি প্রয়োগ করে তাদের শোষন কার্য পরিচালনা করত তার পিছনে সমাজের এক বড় অংশ সম্পদ ব্যয় হয়ে যেত। যেমন, চাকরের পিছনে ব্যয়, সেনাবাহিনী ও পুলিশে ব্যয়, বড় বড় মন্দির নির্মানে ব্যয়, প্রাসাদ বা বড় সমাধি নির্মানে ব্যয়- এগুলো শাসক শ্রেনী করত নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য। এই শোষনকার্য পরিচালনার জন্য ব্যয় নির্বাহের জন্য জনসাধারনকে আরো শোষনের প্রয়োজন পড়ে এবং তা চলতে থাকে। মূলত এভাবেই সমস্ত শোষন প্রক্রিয়া নিজেকেই নিজে ন্যায্যতা দিতে থাকে, বুঝাতে থাকে সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর কোন বিকল্প নেই।

সম্পদ নিজের করায়ত্ত্বে নেয়া মানে ক্ষমতা, ফলে এর জন্য অন্য সমাজের সাথে শুরু হয় যুদ্ধ। যুদ্ধের লাভই ছিল সম্পদ করায়ত্ত্ব। হাতে যত অতিরিক্ত সম্পদ তত বেশী শক্ত তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই শোষক শ্রেণীর উত্থান একসময় সমাজকে “কার্যকর” রাখার জন্য হলেও তারা সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠে। তাই আমরা প্রথম সভ্যতার পর ১০০০ এবং ১৫০০ বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে, সিন্ধুসভ্যতায় এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় নাটকীয় ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করি।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং