মানুষের ইতিহাসঃ নব্য প্রস্তর বিপ্লব

ক্রিস হারমানের এ পিপল’স হিস্টরী অফ দি ওয়ার্ল্ড থেকে বাংলায় অনুবাদ।

 

মানুষের জীবন ও চিন্তায় প্রথম বড় পরিবর্তনটির শুরু হয় মাত্র ১০,০০০ বছর আগে। মানুষ জীবন ধারনের জন্য ভিন্ন এক পদ্বতি বেছে নেয়, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের অতি উর্বর জায়গাগুলিতে[২৫] তারা শাকসবজী ও ফলমূল ইত্যাদি সংগ্রহের পরিবর্তে এগুলি চাষ করে উৎপাদন করতে শিখে যায়, পশুপাখি শিকারের পরিবর্তে এদের পুষতে শুরু করে। এটা ছিল এক উদ্ভাবন এবং এটি তাদের পুরো জীবন যাত্রাই বদলে দেয়।

তবে এই পরিবর্তন যে পূর্ববর্তীদের চাইতে তাদের জীবনকে সহজ করেছিল বিষয়টা এমন নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে তাদের অনেকের হাতে তেমন কোন অন্য উপায়ও ছিল না।[২৯] তারা প্রায় দুই থেকে তিন হাজার বছর ধরে এ জীবনের সাথে পরিচিত ছিল, তাদের বসবাসের জায়গাগুলি ছিল প্রচুর খাদ্যেপূর্ন এবং শিকারের জন্য বন্য প্রাণীদের সংখ্যাও ছিল বেশী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ পূর্ব তুরস্কে কোন একটি দল অল্প শ্রমেই মাত্র দুই তিন সপ্তাহে এত জংলী গম জাতীয় খাদ্যশস্য সংগ্রহ করতে পারত যে তাতে অনায়াসে তাদের এক বছরের খোরাকি হয়ে যেত। তাই তাদের জায়গা পরিবর্তনের কোন দরকার ছিল না।[২৭] তারা একই স্থানে বছর বছর ধরে বসবাস করতে লাগল। এতে তাদের পূর্ববর্তী ভবঘুরে চরিত্রের পরিবর্তন হলো, একস্থানে বসবাসের জন্য তারা প্রাথমিক একটি গ্রামের মত পরিবেশ তৈরী করতে পেরেছিল। এই সময়ে দশ বারোজনের দলের পরিবর্তে তারা শত শত হয়ে বসবাস করতে থাকে এবং ছোট খাট মাটির পাত্র,  পাথরের সরল যন্ত্রপাতি তৈরী করতে শুরু করে তারা।  প্রাচীন রোমান সভ্যতা থেকে আজকের সময়ের যে ব্যবধান, এই সময়ের মধ্যেই সেইসব মানুষের তাদের ভবঘুরে খাদ্য সংগ্রহ সমাজকে স্থির গ্রামের সমাজে স্থাপন করতে পেরেছিল।

কিন্তু একসময় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের প্রাকৃতিক ভাবে খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থায় বাঁধা তৈরী হল। উর্বর জমিগুলি হয়ে উঠল শুকনো এবং ঠান্ডা, প্রাকৃতিক ভাবে গম জাতীয় উদ্ভিদ কম জন্মাতে লাগল, শিকারযোগ্য প্রানী যেমন হরিণ, এন্টিলোপের সংখ্যা কমে গেল। শিকার-সংগ্রহ সমাজের গ্রামগুলি পড়ল বড় সমস্যায়। এভাবে তারা বেঁচে থাকতে পারে না। না খেয়ে মরতে হবে অথবা আবার ফিরে যেতে হবে সেই পুরাতন ভবঘুরে সমাজে, অথবা আরেকটি উপায় ছিল। তা হলো নিজের শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে শস্য উৎপাদন।

এই পথই তাদের নিয়ে যায় কৃষিভিত্তিক সমাজে। এত দীর্ঘদিন ধরে গাছপালা, বৃক্ষলতার সাথে থাকতে থাকতে মানুষ এদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানত। এদের এক দল তাদের জ্ঞান ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদনের জন্য গাছের বীজ লাগাতে শুরু করল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তারা জেনেছিল কিছু গাছের শস্য বা ফল অন্য গাছদের চাইতে ভালো, তারা এগুলি নির্বাচন করে লাগাতে শুরু করল। তারা  নতুন নতুন প্রজাতি এনে লাগাতে শুরু করে, নতুন জাত তৈরী করতে শুরু করল। প্রচুর শস্য উৎপাদন হলো এবং এই ফসল তাদের বন্য ভেড়া, ছাগল, গাধা ইত্যাদি প্রানীকে পোষ মানাতে সাহায্য করল।

প্রথম পর্যায়ের কৃষিব্যবস্থা (যাকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে বাগানচাষ।) এর মধ্যে ছিল বনজঙ্গল কুড়াল ও নিড়ানির মত যন্ত্র দিয়ে পরিস্কার করা এবং বাকী অংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, এবং এরপর লাটির মত যন্ত্র দিয়ে মাটি খুড়ে বীজ বপন করা। কয়েকবছর এভাবে চাষ করার পর সে জমির উর্বরতা চলে যেত। তখন মানুষেরা একইভাবে অন্য আরেকটি বন পরিষ্কার করে চাষ করত। এবং এই জমি পুনরায় জঙ্গলে পরিণত হবার সুযোগ পেত। এভাবে খাদ্য সংগ্রহ করে জীবন ধারনের ব্যবস্থা তখনকার জীবন ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এল। মানুষ আরো বেশী গ্রামব্যবস্থায় যুক্ত হলো। নির্দিষ্ট সময়ে বীজ বপন করতে হয়, ফসল তুলতে হয়, সেচ দিতে হয়, তাই মানুষের ঘুরে বেড়ানোর কোন অবকাশ থাকল না। এছাড়াও জঙ্গল পরিস্কার, বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত সময়কালে তাদের পরস্পরের সহযোগীতা আরো বেশী প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল।  ফসল ভাগ করা, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসল। অর্থাৎ, সামাজিক জীবন আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেল, নতুনভাবে পৃথিবীকে দেখার শুরু হলো, শুরু হলো নানা পুরানের গল্প, উৎসব এবং প্রথার।

এই পরিবর্তনকে সাধারনত ‘নিওলিথিক বিপ্লব’ নামে ডাকা হয়। [২৮] কারণ এই সময়ে পাথরে তৈরী যত্রপাতির ব্যবহার বাড়তে থাকে। নিওলিথিক মানে নতুন নব্য প্রস্তর যুগ। যদিও এটি লম্বা সময় ধরে হয়েছিল, কিন্তু এটি মানুষের সমাজ এবং জীবনধারা নতুন ভাবে সাজায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এ প্রমান পাওয়া যায় উর্বর জায়গায় মানুষেরা আলাদা আলাদা ঘর করে থাকত। কিন্তু এটা জানা যায় তাহলে তাদের পরিবার কীরকম ছিল, অর্থাৎ তারা কি একজন  নারী ও পুরুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে থাকত, নাকী মা এবং তাদের কন্যারা তাদের স্বামীদের নিয়ে থাকত অথবা বাবা এবং ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের নিয়ে থাকত। [২৯] তখনো সমাজে শ্রেনী বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা আসে নি, কৃষিব্যবস্থার হাজার হাজার বছর পরে এর আবির্ভাব। ৪০০০ বিসিতেও সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার কোন বড় চিহ্ন ছিল না, এমনকী ৩০০০ বিসিতেও সামাজিক শ্রেনীভেদ দেখা যায় নি।[৩০] পুরুষের কতৃত্বের চিহ্নও তখন দেখা যায় না।  কিছু কিছু প্রত্বতাত্ত্বিক ঐসময়ের মাটির তৈরী মহিলা আকৃতির ভাস্কর্যের মত বস্তুগুলি দেখে ধারনা করেছেন যে তখন মহিলাদের অবস্থান উচ্চ ছিল, তাই পুরুষেরা মহিলাদের পূজিত হবার মত ধরে নিয়েছিল।[৩১] কিন্তু এই সময়ের একটা পরিবর্তন বেশ গুরুত্বপূর্ন, এই সময়েই শিকার এবং যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের নির্মান বাড়তে থাকে।

পৃথিবীর কিছু জায়গায় বাগান চাষ ভিত্তিক সমাজ বিশ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল, এবং সেই সব সমাজের সাথে প্রাচীন এসব সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলি অনেক মিলে।[৩২]

পরিবারগুলি আলাদাভাবে এক খন্ড করে জমি চাষ করত। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে এখন আমরা যা বুঝে থাকি তার উৎপত্তি হয় নি। কোন পরিবারের সম্পদ জমানোর প্রচেষ্টাও তখন তৈরী হয় নি। পরিবারগুলি তাদের বংশানুক্রমিক আত্মীয়দের সাথে সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে আবদ্ধ ছিল তাই তারা খাবার অন্যদের সাথে ভাগ করে নিত। যাতে যেসব পরিবারে ছোট বাচ্চা বেশী অথবা তাদের ফসল খারাপ হয়েছে, তারা যেন না খেয়ে না থাকে। নিজে একা একা খাওয়াতে সম্মান ছিল না, সম্মান ছিল অন্যকে সাহায্য করার মধ্যে।

শিকার-সংগ্রহ সমাজের অনেক মূল্যবোধ তাদের মধ্যে ছিল বেশী আমাদের বর্তমান শ্রেনী সমাজে যে সব মূল্যবোধ বা নিয়মকে আমরা অবধারিত ধরে নেই তার চাইতে।  ১৮ শতকে একজন পর্যবেক্ষক ইরোকুইস বাগানচাষীদের বিষয়ে বলেছিলেন, “যদি একদল ক্ষুধার্ত ইরোকুইস তাদের খাদ্যদ্রব্য শেষ হবার পূর্বেও অন্য দলের সাথে মিলিত হত, তাহলে দ্বিতীয় দল নিজেদের অবশিষ্ট খাদ্য দিয়ে তাদের আপায়ন করত। তারা এক্ষেত্রে প্রথম দলকে জিজ্ঞেসও করত না তাদের খাদ্য আছে কি না। [৩৩] ন্যুয়ারদের নিয়ে একটি ধ্রুপদি গবেষণা মতে, “সাধারনত এটা বলা যায় যে ন্যুয়ার গ্রামে কেউ অনাহারে থাকত না, যদি না সবাই অনাহারে। [৩৪].

এই ধরনের সহযোগীতা তখন জীবন ধারনের জন্য দরকারী ছিল। যাদের বেশী শ্রম দেবার ক্ষমতা আছে তারা তাড়াতাড়ি বিপুল শস্য উৎপাদন করত। এর থেকে তারা যেসব পরিবারে বাচ্চা বেশী, অর্থাৎ শ্রম প্রদানের লোক কম তাদের ভাগ দিত।[৩৫] কারণ বাচ্চারা বড় হবে এবং ভবিষ্যতে পুরো গ্রামের শ্রমশক্তিতে তারা যুক্ত হবে।

শিকার ও সংগ্রহ সমাজে বাচ্চাকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর একটি ঝামেলা ছিল। খাদ্য সংগ্রহের সময়, কিংবা দলের এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় স্থানত্যাগ করার সময় বাচ্চাদের বয়ে নিতে হত। এর জন্য জন্মহার ছিল খুবই কম। মহিলারা একটার চাইতে বেশী বাচ্চা একসাথে বয়ে নিয়ে যাবে তা অসুবিধার। তাই বাচ্চা জন্ম নিয়ন্ত্রণে রাখা হত (যৌনকাজ থেকে দূরে থেকে, ভ্রুণহত্যা বা শিশুহত্যার মাধ্যমে)। তিন বা চার বছর পর বাচ্চা নেয়া হত। কিন্তু যখন জীবন কৃষিভিত্তিক সমাজে চলে আসল তখন মানুষের জন্য প্রচুর খাদ্য ছিল, জায়গা পরিবর্তনের ঝামেলাও ছিল না। বাচ্চা বয়ে বেড়ানোর অসুবিধা দূর হলো। তাই এই সময়ে জন্মহার বাড়তে থাকে। কারণ যত বেশী বাচ্চা হবে ত্ত বাড়বে ভবিষ্যত শ্রম। তত বেশী তারা জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষ উপযোগী করতে পারবে। তাই জনসংখ্যা বাড়তে লাগল। যদিও বর্তমানের সাপেক্ষে তা নেহায়েৎই অল্প, মাত্র ০.১ শতাংশ বছরে। [৩৬] দুই হাজার বছরের মধ্যে তা চার ভাগ বেড়ে যায়। নিওলিথিক বিপ্লবের সময়ে ছিল দশ মিলিয়ন, তা বেড়ে পুঁজিবাদের শুরুতে জনসংখ্যা দাঁড়ায় দুইশ মিলিয়ন।

শিকার-সংগ্রহ সমাজ থেকে বেশ বড় কিছু পরিবর্তন ছিল বাগান-চাষ ভিত্তিক সমাজে। আগে শিকার-সংগ্রহ সমাজে কোন ঝামেলা হলে ঝামেলাকারীদের আলাদা দলে ভাগ করে দিয়ে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা হত। কিন্তু স্থায়ী কৃষিভিত্তিক গ্রামে এই সুযোগ আর রইল না। তারা জমি পরিষ্কার করেছে, চাষ করেছে; হঠাৎ করে তাদের উঠিয়ে দেয়া যায় না। গ্রামগুলি ছিল আকারে বড়, অনেক বেশী সদস্যের এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক ও যোগাযোগের ব্যাপারটি অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে উঠল। এই সময়ে তারা বেশী ফসল জমা করে রাখত এবং জমা করে রাখত বিভিন্ন মূল্যবান শিল্প দ্রব্যাদি। এর জন্য বহিঃশত্রুর আক্রমনও হত গ্রামগুলিতে। শিকার-সংগ্রহ সমাজে যে যুদ্ধ প্রায় অপরিচিত ছিল সেই যুদ্ধ কৃষিভিত্তিক সমাজের কোন কোন জায়গায় হয়ে উঠল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সমাজের স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা রক্ষাজনিত কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য তারা বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে কাউন্সিল গঠন করতে লাগল।

পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় মানুষ আলাদাভাবেই শিকার-সংগ্রহ সমাজ থেকে গিয়েছিল কৃষিভিত্তিক সমাজে। প্রায় দশ হাজার বছর আগে মেসো-আমেরিকায় (বর্তমান মেক্সিকো এবং গুয়েতেমালা), দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিয়ান অঞ্চলে, আফ্রিকার অন্তত তিনটি ভিন্ন অঞ্চলে, ইন্দোচীনে, পাপুয়া নিউ গিনির উচ্চ উপত্যকায়, এবং চীনে। [৩৭] সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তনটা হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায় যেমন হয়েছিল সেরকম। এছাড়া, খাদ্য দ্রব্য উৎপাদনের উদ্ভিদ এবং পোষার যোগ্য প্রানী প্রাপ্তিও একটা বিষয় ছিল। কিন্তু কখনোই এই প্রমান পাওয়া যায় না যে কোন জাতি জিনগত দিক থেকে অন্য জাতির চাইতে ভালো ছিল অথবা কোন জাতির মধ্যে প্রতিভাবান আলাদা জীন ছিল এমন প্রমান পাওয়া যায় না। বরঞ্চ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেষে বিভিন্ন শিকার-সংগ্রহ সমাজের দল কৃষি ভিত্তিক সমাজে যাবার প্রয়োজন বোধ করে এবং কৃষি সমাজে প্রবেশ করে। গ্রাম ব্যবস্থায় স্থায়ী হয়। তাদের মধ্যে আত্মীয়তার শক্ত বন্ধন তৈরী হয়, তৈরী হয় সামাজিক রীতি নীতি ও আচরনের নিয়ম কানুন। তৈরী হয় বিস্তৃত ধর্মীয় প্রথা এবং পুরাণ। [৩৮]

স্বাধীনভাবে কৃষি সমাজ তৈরী হবার একটি সাধারণ উদাহরন হিসেবে পাপুয়া নিউ গিনির উচ্চ উপত্যকার কৃষি সমাজের কথা বলা যায়। এখানে লোকেরা পশুপালন এবং বিভিন্ন ধরনের শস্য চাষ শুরু করে প্রায় ৭০০০ বিসিতে। ইক্ষু, বিভিন্ন ধরনের কলা, বাদাম গাছ, খাওয়ার যোগ্য এক ধরনের ঘাস, সবুজ শাক সবজী ইত্যাদি তারা জন্মাতে থাকে। তারা শিকার-সংগ্রহের ভবঘুরে বা অর্ধ ভবঘুরে অবস্থা থেকে কৃষির মাধ্যমে স্থায়ী গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সামাজিক সংস্থাগুলি ছিল সহযোগীতামূলক এবং গ্রামের লোকেরা আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোন ধারণা ছিল না। তাদের সমাজ ব্যবস্থা ছিল সহযোগীতামূলক। লোকগুলি এভাবেই বসবাস করতে থাকে, উপত্যকা যেহেতু ছিল অনেক দূর্গম এবং উপকূল দিয়ে সেখানো পৌছানো প্রায় অসম্ভব। ফলে কোন রকম বহিঃশত্রুর আক্রমন ছাড়াই বাস করতে থাকে, এবং ১৯৩০ এর প্রথম দিকে পশ্চিমাদের নজরে আসে তারা।

কিছু প্রথমদিকের সমাজ কৃষিভিত্তিক সমাজে যেতে চায় নি। কেউ কেউ এর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে ছিল। তারা মনে করেছিল শিকার-সংগ্রহের মাধ্যমে যেহেতু খাদ্য পাওয়া যাচ্ছে তাহলে খাদ্যের জন্য চাষবাসের শ্রম করা বৃথাই।

বাকীরা এমন সব পরিবেশে থাকত যেখানে চাষবাসের জন্য উদ্ভিদ প্রজাতি পর্যাপ্ত ছিল না এবং পোষার জন্য্য প্রানী পাওয়া যেত না। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। [৩৯] এই সব অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে যেসব মানুষ বাস করে আসছিল তাদের জন্য শিকার-সংগ্রহ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, যতদিন পর্যন্ত না তারা বাইরের লোকদের কাছ থেকে চাষযোগ্য উদ্ভিদ এবং পোষার জন্য প্রানী পেয়েছিল। [৪০]

যখন পৃথিবীর কোন প্রান্তে কৃষি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, এরপর থেকেই আসলে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কখনো কখনো এক জায়গার লোকদের কৃষিতে সাফল্য অন্যদের তা গ্রহণ করতে উৎসাহ জোগায়। তাই উর্বর এলাআ হতে শস্যবীজের আমদানী নীলনদ উপকূল, সিন্ধু নদ উপকূল, এবং পশ্চিম ইউরোপে কৃষির বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করে। কখনো কখনো আবার কৃষিভিত্তিক কোন দল বড় হয়ে পড়লে তার এক অংশ ভাগ হয়ে অন্যত্র গিয়ে গ্রাম স্থাপন করে জমিজমা পরিস্কার করে চাষ শুরু করে দিত। এভাবে আফ্রিকার বান্টু ভাষাভাষী লোকেরা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ অংশেও ছড়িয়ে পড়ে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পলিনেশিয়ানরা মাদাগাস্কার হয়ে একেবারে আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত পৌছে যায়, পৌছে যায় ইস্টার দ্বীপে (দক্ষিণ আমেরিকান উপকূল থেকে মাত্র ১৫০০ মাইল দূরে) এবং নিউজিল্যান্ডে।

কৃষিভিত্তিক সমাজের সংস্পর্শে যেসব শিকার-সংগ্রহের দল আসত তাদের জীবন যাত্রার ধরনও পালটে যেত। তারা দেখতে পেত যে তারা প্রতিবেশী কৃষভিত্তিক গ্রামের বিভিন দ্রব্য আদান প্রদান করে তাদের জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত করতে পারে। তারা মাছ, পশুর চামড়া ইত্যাদি গমের বিনিময়ে, পোষাক, মদ জাতীয় পানিয় ইত্যাদি আদান প্রদান করতে পারত। এটি অনেক দলকে কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি বৈশিষ্ট্য যেমন পশুপালন গ্রহণ করতে অনেক সময়ে উৎসাহীত করত। দেখা যেত তারা শস্য উৎপাদন করছে না কিন্তু পশুপালন করছে। এই ধরনের মানুষ ইউরেশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ আন্দেস এ দেখা যেত। কৃষিভিত্তিক গ্রামগুলির মাঝখানের জায়গায় এরা ঘুরে বাস করত। মাঝে মাঝে কৃষিভিত্তিক গ্রামের সাথে ব্যবসা করত এবং তারা তৈরী করেছিল তাদের সামাজিক জীবনের আলাদা সব বৈশিষ্ট্য।

কৃষি এবং শস্য ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সামাজিক জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ন পরিবর্তন দেখা দিল। প্রথম সমাজে মানুষদের মধ্যে একটা বিভাজন তৈরী হয়। নৃতত্ত্ববিদেরা যাকে বলেন “বিগ ম্যান” বা “সর্দারবাদ”; একজন বা কিছু মানুষ অন্যদের চাইতে বেশী সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে শুরু করে। সর্দার বা নেতা এবং নেতার বংশের লোকেরা আলাদা সম্মান ও সুবিধা পেত। কিন্তু বর্তমানে আমরা যেমন শ্রেনীভাগ দেখি, এবং একশ্রেনী সব সম্পদ ও সুবিধা ভোগ করছে আর অন্যেরা শোষিত হচ্ছে, তৎকালীন অবস্থা এমন ছিল না।

পরস্পর সহযোগীতামূলক এবং সাহায্য নির্ভর যে সমাজ ছিল শিকার-সংগ্রহ সমাজে তার খুব একটা পরিবর্তন হয় নি তখনো। রিচার্ড লী বলেছেন যে তখন সকলের সম্পত্তির ধারণা ছিল। যিনি নেতা ছিলেন তার কাজ ছিল শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের জন্য বাগ বাটোয়ারার বিষয়টা দেখা। এর জন্য তিনি জনমত এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। [৪১] দক্ষিণ আমেরিকার নাম্বিকারা সমাজে উদারতা ও পরোপকারই ছিল ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য এবং নেতাকে অবশিষ্ট খাদ্য দ্রব্য, অলঙ্কার ইত্যাদি ঠিকঠাক মত ভাগ করে দিতে হত তাদের দরকার তাদের মাঝে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় সমাজের অন্যদের চাইতে নেতার ভাগে কম পড়ত। নিউ গায়ানার বুসামা নেতারা এত বেশী পরিশ্রম করত যে বলা হয় তাদের হাত কখনো ভূমি থেকে উঠত না এবং তাদের কপালের ঘাম কখনো শুকাত না। [৪৩]

নতুন প্রস্তর যুগে কৃষিব্যবস্থা তৈরী করল গ্রামভিত্তিক জীবন, এবং বাড়াল যুদ্ধ। এইদিক থেকে তা অবশ্যই বিপ্লব। কিন্তু আমাদের সমাজে যেমন শ্রেনী ভেদ, নেতা এবং শাসক শ্রেনীর সহযোগীদের অঢেল ক্ষমতা, নারীদের উপরে পুরুষের কতৃত্ব ইত্যাদি তখনো সেই সমাজে দেখা যায় নি। তা দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিবর্তন, অর্থাৎ গর্ডন চিলডে যাকে বলেছেন নগর বিপ্লব, এর আগে দেখা যাবে না। এই নগর বিপ্লব নিওলিথিক বিপ্লবের উপরে তৈরী হয়েছিল।