গতকাল ২০১৯ হলবার্গ ডিবেটে স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভোয় জিজেক এবং ইকোনমিস্ট টাইলার কোয়েন মুখোমুখি হয়েছিলেন। ডিবেটের গঠন ছিল এমন,
প্রথমে জিজেক তিনি কেন একজন কম্যিউনিস্ট এ বিষয়ে ২৫ মিনিটের বক্তব্য দেন।
এরপর টাইলার কোয়েন থাকে কিছু প্রশ্ন করেন।
এরপর অডিয়েন্সের কাছ থেকে, টুইটার থেকে ও ভিডিওর মাধ্যমে প্রশ্ন নেয়া হয়, ও জিজেক তার উত্তর দেন।
জিজেকের আগের বিতর্কটি ছিল ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট জর্ডান পিটারসনের সাথে। বলা বাহুল্য এই বিতর্কটি ঠিক বিতর্ক হিসেবে জমে নি, কারণ ফিলোসফিক্যাল বিতর্কের ধরণ যেমন হয় এটি তেমন হতে পারে নি। তার মূল কারণ ছিল পিটারসনের যেভাবে বুদ্ধিজীবী বা ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে প্রকাশিত হয়েছেন, তার যারা ওডিয়েন্স তারা ডিপ ইন্টেলেকচুয়াল বিতর্কের জন্য অনুপযুক্ত।
এছাড়া পিটারসনের ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে এই স্বক্ষমতা ছিল না জিজেকের সাথে বিতর্ক করার। সেই বিতর্কে তিনি জিজেকের অবস্থানই বুঝতে ভুল করেছিলেন।
কিন্তু টাইলার কোয়েনের ক্ষেত্রে এই কথা খাটে না। কোয়েন ওয়ান অব দ্য ব্রাইটেস্ট ইন্টেলেকচুয়াল এবং থিংকার আধুনিক দুনিয়ার। রেনেসা ম্যান বলতে যা বুঝায়, এক ব্যক্তির বিভিন্ন ফিল্ডে ডিপ নলেজ আছে বা প্রতিভা আছে, তেমন একজন হলেন টাইলার কোয়েন। লস এঞ্জেলেস টাইমস একবার তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিল, “একজন মানুষ যিনি হাইতিয়ান ভোডো ফ্লাগস, ইরানিয়ান সিনেমা, হংকং এর খাবার দাবার, এবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম, জারিয়ান মিউজিক এবং মেক্সিকান ফোক আর্ট নিয়ে একইভাবে কথা বলতে পারেন।”
টাইলার কোয়েন যেহেতু নলেজের ব্রড ফিল্ডে আগ্রহী তাই তার পলিটিক্যাল অবস্থান পিন পয়েন্ট করা খুব কঠিন। যেকোন ভালো থিংকারের ক্ষেত্রেই এটা হয়। টাইলার কোয়েন সামাজিক ইস্যুগুলিতে লিবারাল হলেও পুরোপুরি লিবারেটারিয়ান না। তিনি মনে করেন মানবজাতির জন্য সবচাইতে ভয়ংকর ধারণাটি হলো “উন্নতি” বা “প্রগ্রেস” এর ধারণা। ফলে ক্যাপিটালিস্ট বা মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক হলেও তার অবস্থান কংক্রিট না। আবার সোশ্যাল কজগুলিতে লিবারাল থাকায় তিনি পুরো ডানও না।
কোয়েনের এই পরিচিতিই বুঝিয়ে দেয় জিজেকের সাথে তার আলোচনাটি ইন্টারেস্টিং হবার কথা। ইন্টারেস্টিং হয়েছেও। জিজেকের সবচাইতে সেরা একটি আলোচনা এটিকে ধরা যায় যেখানে তার অবস্থান অনেক অনেক স্পষ্ট।
২৫ মিনিটের লেকচারে জিজেক প্রথমে স্বীকার করে নিলেন কম্যুনিজম ফেইল করেছে এটা তো ঠিকই। এবং কম্যুনিজমের মূল ভিশনে কোন ভুল ছিল না কেবল স্টালিনের মত একজন খারাপ লোক কম্যুনিজম নষ্ট করেছে এমন ধারণা প্রচলিত আছে, যেটি জিজেক মানেন না। তার কথা ভিশনেই ভুল ছিল।
তাও তিনি কেন কম্যুনিস্ট বলেন নিজেকে?
জিজেক তিনটি ক্যাটাস্ট্রফিক সমস্যার কথা বলেন, তা বর্তমান পৃথবীকে ধ্বংসের মুখে (এপোকিলিপ্টিক) নিয়ে যাবে বা যাচ্ছে।
১। ম্যাস মাইগ্রেশন – প্রচুর পরিমাণে মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া।
২। পরিবেশগত বিপর্জয় – পরিবেশ দূষণ বা নানা কারণে সম্ভাব্য বিপর্জয়।
৩। ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ – আধুনিক প্রযুক্তিগত ইনোভেশনের কারণে মানুষেড় জীবন নিয়ন্ত্রণ।
জিজেক মনে করেন এই তিন বড় সমস্যার মূল কারণ ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম। সুতরাং, এই ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম ঠিক রেখে এই সমস্যাগুলির সুরাহা করা যাবে না। আর এই সমস্যাগুলির সুরাহা না হলে মানবজাতির ধ্বংস অনিবার্য।
এমনিতে যেভাবে মনে করা হয়, বিজ্ঞান কোন একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলবে এবং সমাধান হয়ে যাবে, জিজেক এটাকে ভয়ংকর ধারণা মনে করেন। তার কথা হলো এক্ট করতে হবে। এজন্য গ্রেটা থানবার্গ যখন ফোর্সফুলি রাগান্বিত ভাবে বিশ্বনেতাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য আক্রমণ করে কথা বলছেন, জিজেক এটাকে খুবই পছন্দ করছেন।
টাইলার কোয়েন বক্তব্যের পরে মঞ্চে আসেন। তিনি আসার পরে জিজেককে একটু অপ্রস্তুত মনে হয় প্রশ্নবাণে। কারণ কোয়েনের প্রস্তুতি ছিল, এবং ঠিক পয়েন্টেই তিনি প্রশ্ন করতে পেরেছেন।
তিনি জিজেককে কম্যুনিস্ট বলতে নারাজ। তার কথা হলো পুরনো নস্টালজিয়া থেকেই জিজেক নিজেকে কম্যিউনিস্ট বলছেন। তাছাড়া কম্যুউনিজমের সাথে তার কোন মিল নেই। একই কথা জর্ডান পিটারসনও জিজেককে বলেছিলেন যে তিনি তো কম্যুনিস্ট না।
সবচাইতে ইন্টারেস্টিং দিক হলো, কোয়েন যখন প্রশ্ন করলেন এই বড় তিন সমস্যার সমাধান কী, জিজেক স্বীকার করলেন তিনি জানেন না। পরে কোয়েনরে একই প্রশ্ন করলেও তিনি জানালেন তারো আসলে জানা নেই।
এটাই এই বিতর্কের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক।
জিজেক কি বিপ্লব পছন্দ করেন, যেরকম ভি ফর ভেনডেট্টা ফিল্মে দেখানো হয়েছিল? এই প্রশ্নটা জরুরী কারণ ইয়াং রোমান্টিক অনেক বিপ্লবী আছেন, বা বিপ্লব পন্থী অনেক লোক আছেন, যাদের এই ধারণা থাকতে পারে কম্যুনিস্ট যে বলছে নিজেকে সে মনে হয় বিপ্লবই চায়।
জিজেক বিপ্লবের বিরোধী। তার কথা হলো, ভি ফর ভেনডেট্টায় যখন সকল লোক বিদ্রোহ করে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল, তখন কী হবে? তারা কীভাবে চালাবে দেশ? অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে জিজেক গিয়েছিলেন। সেই সুবাধে থাকে বিপ্লবপন্থী কেউ ভাবতে পারেন। কিন্তু এ বিষয়ে এই বিতর্কের একটা পর্যায়ে তিনি বলেছেন, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে গিয়ে তিনি দেখেছেন আসলে যারা আন্দোলন করছে তারা কেন কী করছে এ নিয়ে ডিপ কোন চিন্তা তাদের নেই।
বিপ্লব বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা এখানে শেয়ার করতে পারি। আর্টিকেল ১৫ নামে ভারতীয় একটি ভালো ফিল্ম আছে। সেই ফিল্মের যে বাস্তবতা, দেখলে মনে হয় যে এখানে মানুষের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমার মনে হয় এগুলি খুবই কনটেক্সট নির্ভর। মানে সময় ও পরিস্থিতি যা ডিমান্ড করে। কিন্তু সময় ও পরিস্থিতি কী ডিমান্ড করছে এটি কীভাবে বুঝা যাবে? মোস্টলি, এর জন্যই বড় থিংকার ও বুদ্ধিজীবীদের দরকার হয় সমাজে।
এবং আমার কনসেপ্ট হলো, বিপ্লব সমাধান না। সমাধানের স্টেপ। আমাদের গ্রামগুলিতে যে মারামারি হয় দুই গ্রামে বা দুই তিন গোষ্টিতে, এসব ক্ষেত্রে মারামারিটা সমাধান না। সমাধান কিন্তু মারামারির পরে হয়। তাহলে মারামারির উদ্দেশ্য কি? নেগোসিয়েশন পাওয়ার বাড়ানো, বা নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্র তৈরি করা।
বিপ্লবকে এভাবে দেখতে হবে।
তবে, একেবারে পরিস্থিতির ডিমান্ড না হলে, বিপ্লব বা বিদ্রোহ খারাপ, কারণ যেহেতু এটা প্রাথমিক ভাবে বিশৃঙ্খলাকে সামনে আনে। তাই পরিস্থিতির ডিমান্ড না হলে এই বিশৃঙ্খলা মানুষের ক্ষতি করবে বেশি।
এই বিতর্কের বাইরে গিয়ে কোয়েনের ইনকাম ইনেকুয়ালিটি বিষয়ক অবস্থা নিয়ে এখানে বলা যায়। তার কথা হলো হ্যাপিনেস ইনডেক্স দেখেন, ওটা বাড়ছে। তার মানে মানুষের জীবন মানের উন্নতি হচ্ছে, ফলে আধুনিক ক্যাপিটালিস্টিক ইকোনমি ভালোই করছে, যদিও তার অনেক সমস্যা রয়েছে।
জিজেক বিষয়ে আরো কিছু লেখাঃ
ইডিওলজি বিষয়ে – এটি আরো ক্লিয়ার করে আরেকটি লেখা প্রকাশ করব।