মুরাদুল ইসলাম » ক্রিটিক্যাল থিওরী » ইন্টারপ্যাসিভিটি ও সোশ্যাল মিডিয়ার ইভেন্ট প্রতিবাদ

ইন্টারপ্যাসিভিটি ও সোশ্যাল মিডিয়ার ইভেন্ট প্রতিবাদ

গ্রিক ট্রাজেডিতে বিবেকের কাজ কী, এ সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন জ্যাক লাকা। বিবেক বলতে ঐ যাত্রার বিবেক যারা একটু পর পর এসে কিছু কথা বলে যায়।

লাকার মতে ছিল, ঐ কাহিনিতে আলোড়িত হয়েছে এমন মানুষের প্রতিচ্ছবি হলো এই বিবেক। দর্শকের যে আবেগ বা অনুভূতি অনুভব করার কথা, বিবেক তার হয়ে তা অনুভব করে, এমনকী দর্শকের চাইতে বেশী পরিমাণে। এবং সেই অনুসারেই সে তার বক্তব্য দিয়ে যায়। ফলে দর্শক হিসেবে আপনার সেই অনুভূতি অনুভব না করলেও চলে।

একইব্যাপার ঘটে বিভিন্ন সিটকমে ব্যাকগ্রাউন্ড হাসির ক্ষেত্রেও। কমেডি টিভি সিরিজগুলিতে হাসির দৃশ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে হাসির শব্দ বাজানো হয়। প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে এটি দর্শকদের হাসানোর জন্য। দর্শকদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এখন হাসা আপনার দায়িত্ব।

স্ল্যাভোয় জিজেক লাকানিয়ান ধারায় চিন্তা করে বলেন, টেলিভিশন সেট বা এখানে বিগ আদার আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এখন হাসা আপনার দায়িত্ব কিন্তু আপনার আর হাসা দরকার পড়ছে না, সে নিজেই আপনার হয়ে হেসে দিচ্ছে। এতে প্রোগ্রামটি দেখার পরে দর্শকের মনে হতে থাকে সে অনেক হেসেছে। তার হাসার তৃপ্তিটা হয় না হেসেই।

এখানে দর্শকেরা খুবই প্যাসিভ, তার কিছুই করতে হচ্ছে না, এই অবস্থা ইন্টারপ্যাসিভিটি নামে উল্লেখ করেছেন রবার্ট ফ্যালার। সমাজের নানা ক্ষেত্রে এই অবস্থা বিরাজ করে।

যেমন, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর প্রতিবাদ আন্দোলনে অনেক ইভেন্ট খোলা হয়। পেইজ, গ্রুপ ইত্যাদি খোলা হয়। সেইসবে মানুষ যেভাবে অংশগ্রহণ করেন, ঠিক ঐ পরিমাণে বা তার অর্ধেকও মূল প্রতিবাদ স্থলে জড়ো হন না।

এখানে অনলাইনে আন্দোলনটি তাকে মূল স্থানে গিয়ে আন্দোলনের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেয়, তৃপ্তিবোধ এনে দেয়, ফলে প্রতিবাদ স্থলে যাবার দরকার তিনি মনে করেন না। যেমন, না হাসলেও ব্যাকগ্রাউন্ড হাসি শুনে দর্শকেরা হাসির তৃপ্তি পান।

অনেকে আছেন প্রচুর বই সংগ্রহ করেন, অন্যকে বই উপহার দেন, টিভি সিরিয়াল ইত্যাদি ডাউনলোড দেন দেখার জন্য। তার বিরাট অংশ তার দেখা হয় না বা পড়া হয় না। ডাউনলোড করার পর বা সংগ্রহ করার পর তিনি ঐ বিষয়ে ভুলে যান। এখানেও প্যাসিভিটি কাজ করে। সংগ্রহ করেই তিনি একরকম পড়ার তৃপ্তি পেয়ে যাচ্ছেন।

বই সংগ্রহ করে বা উপহার পেয়ে যখন ব্যক্তি প্যাসিভ মিডিয়ায় পরিনত হন এবং তা ফেলে রাখেন, এই অবস্থার নাম বিবিলিওম্যানিয়া, গুস্তাব ফ্লবেয়ার এই জিনিসটির ব্যাপারে উল্লেখ করেছিলেন তার লেখায়।

অনলাইনে কোন প্রোডাক্টিভ বা অভ্যাস বদলানোর লেখা ইত্যাদি পড়ার সময় লোকের যে মনোভাব থাকে, তার মনে হয় পড়েই অনেক কাজ করা হয়ে যাচ্ছে। যেমন, ধরা যাক কীভাবে ফেইসবুক আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ও সময় বাঁচানো যায়, এ নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা আছে। একজন এটি পড়লেন এবং পড়তে পড়তে তার মনে এই অনুভূতির জন্ম হলো যে তিনি অনেক কিছু জেনে গেছেন, গোপন সব ট্রিক্স, এবার তিনি ফেইসবুক আসক্তি দূর করতে পারবেন। পড়ার কিছু সময় পরে তার মনযোগ অন্যদিকে চলে গেল। তিনি আবার ফেইসবুক ব্যবহার করতে লাগলেন আগের মত।

এখানে পড়ার সময় তার যে অনুভূতি হয়েছিল, সেটি তাকে ফেইসবুক আসক্তি দূর করতে যা যা করতে হবে লেখা ছিল লেখাটিতে, তা করতে বাঁধা দিয়েছে। তিনি পড়েই ধরে নিয়েছেন তিনি করে ফেলেছেন। এই তৃপ্তি তার হয়ে গেছে। ফলে তিনি প্যাসিভ হয়ে গেছেন, এবং তার হয়ে যেন ঐ লেখাটি কাজ করে দিয়েছে। তাই, পরবর্তীতে তার ফেইসবুক আসক্তি দূরীকরনে আর কিছু করা হয় নি। আসক্তি আগের মতই বর্তমান আছে।

কোন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যযুক্ত জায়গায় গিয়ে অতি ছবি তোলাও প্যাসিভিটি। এখানে মূল চোখ উপভোগ না করে উপভোগ করে ক্যামেরা, এবং মূল মস্তিষ্কের বদলে ক্যামেরা দৃশ্য রেকর্ড রাখে। সাইকোলজির সাম্প্রতিক রিসার্চ বলছে, এটি পরীক্ষাতেও প্রমাণিত যে, যখন কোন দৃশ্যের ছবি তোলা হয় তখন তা কম মনে থাকে।

আমার মনে হয়, স্মৃতিসৌধ বানিয়ে মানুষ একইরকম একটি প্যাসিভ কাজ করে, সে স্থাপত্যকর্মটির উপরে স্মৃতি রাখার দায় নিয়ে নিজে স্মৃতি রাখার তৃপ্তি পায়। আমাদের এলাকায় পরিচত একজন নিহত হয়েছিল এক কলহের সূত্রধরে। সেই জায়গায় একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়। ভাবলে দেখা যাবে, এলাকার লোকের কাজ ছিল, এখানে ছেলেটি যে নিহত হয়েছে তার সম্পর্কে এলাকায় নতুন আসা অন্যান্যদের বলা বা নতুন প্রজন্মকে বলা। কিন্তু এই কাজটি যেহেতু তারা করতে পারবে না ব্যস্ততার কারণে বা ভুলে যাবে, তাই সহজ সমাধান হলো স্মৃতি ফলক বানিয়ে রাখা।

স্মৃতিসৌধে বছরে একবার ফুল দেয়াকে এভাবে দেখা যেতে পারে যে, যেহেতু লোকদের হয়ে সারাবছর স্মৃতি রাখার কাজ করছে সে, তাই তাকে খুশিতে ফুল দিয়ে সম্মানীত করা, এবং সাথে সাথে ঐ স্মৃতির প্রতিও সম্মান জানিয়ে বলা যে, কেবল এই জড়ো স্থাপত্যকর্মটিই নয়, এর পেছনে রক্ত মাংসের আমরাও আছি, এ আমাদের হয়েই কাজটা করছে।

 

 

রেফারেন্সঃ

ইন্টারপ্যাসিভিটি বিষয়ে – On Pleasure Principle in Culture, Robert Pfaller

ছবি তোলা ও মেমোরি বিষয়ক সাইকোলজি রিসার্চ –

Point-and-shoot memories: the influence of taking photos on memory for a museum tour.

https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/24311477

Point-and-shoot memories: the influence of taking photos on memory for a museum tour.

https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S2211368117301687

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং