সেভেন সামুরাই, মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট এবং অন্যান্য

মিঠুন চক্রবর্তী

সাম্প্রতিক কালে যেসব ফিল্ম দেখা হলোঃ

 

দি মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট (৪/৫)

কোরিয়ান যুদ্ধে আমেরিকান কিছু সৈন্যদের ধরে চীনের মাঞ্চুরিয়াতে নেয় রাশান সৈন্যরা। সেখানে তাদের ব্রেইনওয়াশ করা হয়। এরপর তাদের কাজে লাগানো হয় একজন রাশার চর আমেরিকান রাজনীতিবিদকে সাহায্য করার কাজে। রিচার্ড কন্ডনের রাজনৈতিক থ্রিলারের উপর ভিত্তি করে ১৯৬২ সালে নির্মিত ফিল্ম। এইটি দারুণ রাজনৈতিক থ্রিলার ফিল্ম হিসেবে। আরেকটি রাজনৈতিক থ্রিলার আছে, রোমান পোলানস্কির ঘোস্ট রাইটার। ওইটাও ভালো। যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশনে শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন হিলারী ক্লিনটন, তার কথা উঠলেই আমার খালি ঘোস্ট রাইটার ফিল্মের কথা মনে হয়। সাত পর্বের একটা ডকুমেন্টারী ফিল্ম আছে ক্রাইম ইঙ্ক নামে, খুবই এন্টারটেইনিং। মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেটে একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফ্র্যাংক সিনাত্রা। এই ফ্রাংক সিনাত্রা এবং হিলারী ক্লিনটন; দুইজনেরই মাফিয়া কানেকশনের উল্লেখ আছে ক্রাইম ইঙ্ক ডকুমেন্টারীতে।

ভার্টিগো (৩.৮/৫)

আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত ক্লাসিক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফিল্ম। এতে এক্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত পুলিশ ডিটেকটিভের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জেমস স্টিওয়ার্ট। এক্রোফোবিয়া হলো উচ্চতাভীতি।

জেমস স্টিওয়ার্ট একজন অসাধারন অভিনেতা। হিচককের সাথে তার আরেকটি ভালো ফিল্ম রিয়ার উইনডো। এছাড়া তার আরেকটি ফিল্ম, এবং আমার সবচাইতে প্রিয় ফিল্ম হার্ভে। হার্ভে ফিল্মে ছয়ফুট উচ্চতার একটি অদৃশ্য প্রাণীর সাথে নিয়ে ঘুরেন জেমস স্টিওয়ার্ট।

পুলিশের গোয়েন্দা জন স্কটি ফার্গুসনের (জেমস স্টিওয়ার্ট) উচ্চতাভীতির জন্ম হয় এক অপরাধীকে ধাওয়া করতে গিয়ে এক দূর্ঘটনার কারণে। ফিল্মের মূল কাহিনীর শুরু হয়, যখন ফার্গুসনের পরিচিত এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে ফলো করার দায়িত্ব তাকে দেন। ভদ্রলোকের কথা মতে এক অদ্ভুত বিপদের মধ্যে রয়েছেন তার স্ত্রী।

ক্লাসিক হিচককীয়ান থ্রিলার ফিল্ম তাই বেশী বললে, বেশীই বলা হয়ে যেতে পারে। অতএব, আর না বলাই যুক্তিযুক্ত।

 

স্ট্রেঞ্জারস অন এ ট্রেইন (৩.৮/৫)

আরেকটি হিচককীয়ান ক্লাসিক সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। প্যাট্রিসিয়া হিগস্মিথের উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে এই ফিল্মের কাহিনীর নির্মান।

দুইজন স্ট্রেঞ্জারের দেখা হয় ট্রেইনে। একজন বিখ্যাত টেনিস প্লেয়ার। আরেকজন হলো ইন্টারেস্টিং চরিত্রের সাইকোপ্যাথ। সাইকোপ্যাথ এক অদ্ভুত আইডিয়া দেয় টেনিস প্লেয়ারকে। তারা দুজনই তাদের জীবনে দুইজন ব্যক্তিকে নিয়ে সমস্যায় আছে। এর সমাধান হিসেবে একজন আরেকজনের জন্য খুন করে দিতে পারে। যেমন, টেনিস প্লেয়ার যে ব্যক্তিকে নিয়ে সমস্যায় আছে তাকে খুন করবে সাইকোপ্যাথ। আর সাইকোপ্যাথ যাকে নিয়ে সমস্যায় আছে তাকে খুন করবে টেনিস প্লেয়ার। অপরিচিত লোক খুন করলে খুনিকে ধরা পুলিশের পক্ষে সম্ভব না।

এইভাবেই শুরু স্ট্রেঞ্জার অন এ ট্রেইনের গল্প। ভালো ফিল্ম, সাসপেন্স বিদ্যমান।

 

লে ত্রউ (৪/৫)

এটি একটি ফ্রেঞ্চ ক্রাইম থ্রিলার ফিল্ম। ১৯৪৭ সালে ফ্রান্সের একটি জেলখানায় একটি ঘটনা ঘটে যার উপর ভিত্তি করে এই ফিল্মটি নির্মিত হয়েছে। এর প্রধান সব চরিত্রে পেশাদার অভিনেতা নন এমন সব লোককে ব্যবহার করেন পরিচালক। এমনকী এদের একজন ১৯৪৭ সালে ফেঞ্চ জেলখানার ঐ ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন যার উপর ভিত্তি করে ফিল্মটি নির্মিত হয়।

বন্ধুত্ব, বিশ্বাস এবং আশার গল্প লে ত্রউ বা হোল। অসম্ভবকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, একতার সাথে জয় করার দুঃসাহসের মানবিক গল্প। যেহেতু মানবিক গল্প তাই চরিত্রগুলির মধ্যে মানবিক ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। এবং তা আছেও।

লে ত্রউ ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে সাসপেন্স দিবে, এবং তার সাথে সাথে মানব চরিত্রের বেশ কিছু দিক দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম। পর্যবেক্ষনী দৃষ্টি ফিল্মের গভীর সেইসব দিক বুঝতে ব্যর্থ হবার কথা না।

 

ধুরুভাঙ্গাল পাথিনারু ( ৩.৮/৫)

একটি তামিল ক্রাইম থ্রিলার। কার্থিক নরেন এটি লিখেছেন ও পরিচালনা করেছেন। তার বয়স একুশ বছর। ফিল্মের শুরুর দৃশ্য ইতালিয়ান জাল্লো ফিল্মদের কথা মনে করিয়ে দেয়। একজন মুখোশধারীকে খুন করতে দেখা যায় শুরুতেই। ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে লেখক এবং পরিচালক কার্থিক নরেন তার প্রথম ফিল্মে সফল। শুরু থেকেই রহস্য ধরে রাখতে পেরেছেন, ঘটনার বিভিন্ন ধরনের বর্ননা এবং আস্তে আস্তে তথ্য পরিবেশন রহস্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।

কর্ম ইজ এ বুমেরাং, ফিল্মের একটি প্রধান লাইন। কর্ম, অর্থাৎ আপনি যা করবেন তাই বুমেরাং এর মত আপনার কাছে একসময় ফিরে আসবে। বুদ্ধধর্মের ধারণা কর্ম খুবই বিখ্যাত একটি ধারণা। আর বুমেরাং এক ধরনের অস্ত্র যা ঠিকভাবে নিক্ষেপ করা হলে উপবৃত্তাকার পথ ঘুরে আবার নিঃক্ষেপকারীর হাতেই ফিরে আসে।

যাদের ক্রাইম থ্রিলার/মার্ডার মিস্ট্রি ভালো লাগে তারা এই ফিল্ম খুবই উপভোগ করবেন মনে হয়। এই বিভাগে ধুরুভাঙ্গাল পাথিনারু একটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম হয়ে থাকবে।

 

টিকটিকি (৪/৫)

এতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি আর কৌশিক সেন। দু’জনের অভিনয় ভালো। কথোপকথন তথা ডায়লগ লিখেছেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি, তাও উৎকৃষ্ট। দু’জন মাত্র অভিনেতা এবং তাদের কথোপকথন, দুই ঘন্টার ফিল্ম, তাও দেখতে বিরক্তি লাগে না। এনথনি শ্যাফার এর নাটক হতে ১৯৭২ সালে নির্মিত হয় ফিল্ম স্লিউথ। টিকটিকির কাহিনী ওই ফিল্মের। স্লিউথ ২০০৭ সালে আবার নির্মান করেন হেনিং মেঙ্কলের ওয়ালান্ডার ক্যানেথ ব্রানা। সেখানে স্ক্রিনপ্লে লিখেন নোবেলবিজয়ী সাহিত্যিক হ্যারল্ড পিন্টার।

টিকটিকি ফিল্মের গল্প এমন, একজন ধনী এবং খেয়ালী ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখক সত্যসিন্ধু চৌধুরী। তার বাড়িতে অদ্ভুত সব জিনিসপাতিতে ভর্তি। তিনি মনে করেন গোয়েন্দা কাহিনী হচ্ছে মহৎ মানুষের মনের খোরাক। তার কাছে জীবনটাই একটা খেলা।

খেয়ালী বুড়ো সত্যসিন্ধু তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান বিমল নন্দীকে। বিমল নন্দীর সাথে সত্যসিন্ধুর স্ত্রী’র প্রেম চলছে। এই অবস্থায় ফিল্মের গল্প এগিয়ে যায় সত্যসিন্ধু আর বিমল নন্দী’র কথোপকথনের মাধ্যমে।

বিমল নন্দী একসময় জানায়, “ডিটেকটিভ নভেল মহৎ লোকদের মনের খোরাক নয়, অসুস্থ, বিকারগ্রস্থ এবং চিরশিশুদের মনের খোরাক।”

 

 

ট্রেজার আইল্যান্ড (৩/৫)

পাইরেটদের নিয়ে একসময় আমার আগ্রহ জন্মে। বিশেষত পাইরেটদের কাঁধে পোষা টিয়ে পাখি থাকত। জানার ইচ্ছা হয়েছিল এই পাখি তারা পুষত কী কারণে? নিতান্ত সৌখিনতার জন্য না অন্য কোন কারণ ছিল? পাইরেটদের প্রতি আগ্রহের জন্য ট্রেজার আইল্যান্ড দেখি।

লুইস স্টিভেনসনের এই উপন্যাসের এক অংশ ছোটবেলায় বাংলা সহপাঠে পড়েছিলাম। ভালো লেগেছিল। ফিল্মটি ডিজনি নির্মিত ১৯৫০ সালের।

পাইরেটদের নিয়ে একটি টিভি সিরিজ আছে ব্ল্যাক সেইল। তা প্রথম সিজন ডাউনলোড করে চার পর্ব পর্যন্ত দেখতে পেরেছি। এরপরে আর দেখার আগ্রহ থাকে নি। ট্রেজার আইল্যান্ডে কিশোর জিম হকিন্সের হাতে চলে আসে বিখ্যাত ডাকাত ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের গুপ্তধনের ম্যাপ। ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের জাহাজে কাজ করা, জন লং সিলভার এবং অন্যান্যদের সাথে নিয়ে শুরু হয় তাদের গুপ্তধন উদ্ধারের উদ্দেশ্যে যাত্রা। টিভি সিরিজ ব্ল্যাক সেইলের প্রথম সিজনে দেখানো হয়েছে সেই ক্যাপ্টেন ফ্লিন্টের কাহিনী।

পাইরেটদের টিয়ে পাখি পোষা নিয়ে, বিভিন্ন বইয়ের সূত্রে যা জানা যায় তা হলো, তারা সৌখিনতার জন্য এই পাখি পুষত না। এ ধরনের টিয়ে পাখির অনেক দাম ছিল। তাই তারা পুষত বিক্রি করার জন্য। অর্থাৎ ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে।

 

কাধালুম কাধান্তু পগুম (৩/৫)

একটি তামিল রোমান্টিক ফিল্ম। ভালো লেগেছিল।

 

জলি এলএলবি ২ (২/৫)

জলি এলএলবি১ দেখেছিলাম তাই দুইও দেখলাম। এটাতে অভিনয় করেছেন অক্ষয় কুমার। এক এর চেয়ে দুই ভালো লাগে নি। অক্ষয় কুমার অভিনীত আরেকটি রুস্তম নিয়ে পূর্বে একটি লেখা পোস্ট করেছিলাম, সেই লেখাটি পড়তে পারেন।

 

সেভেন সামুরাই (৫/৫)

সেভেন সামুরাই আকিরা কুরোসাওয়ার অন্যতম সেরা একটি ফিল্ম এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ট একটি কাজের মর্যাদা পায় ফিল্মটি। এর গল্প জাপানের সেনগকো সময়কালের, ১৫৮৬ সালের। এক গ্রামের লোকজন খবর পায় তাদের ফসল তোলার সময় হলে ডাকাতরা আক্রমণ করবে। তারা তখন কয়েকজন সামুরাইকে ভাড়া করে আনে ডাকাতদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য।

সামুরাই বলতে মাস্টার ছাড়া সামুরাই, যাদের বলা হতো রোনিন।

সেভেন সামুরাই একটি এপিক ফিল্ম। অভিনয়, ডায়লগ ও চিত্রায়ন ভালো। এই ফিল্মটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী ফিল্ম হিসেবে রয়ে আছে। যুদ্ধ, যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষের বাঁচার লড়াই, এর মাঝে তাদের আবেগ অনুভূতি ইত্যাদির সফল রূপায়ন চলচ্চিত্রটিকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদার আসন।

এই ধরনের চলচ্চিত্র দর্শকদের বুঝিয়ে দেয়, মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র কত শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

আকিরা কুরোসাওয়ার অসাধারন মার্ডার মিস্ট্রি রাশোমন নিয়ে লেখাটি দেখতে পারেন।