সুখ ও টাকার সম্পর্ক কী?

টাকা বিষয়ে অনেকে বলে থাকেন, টাকা হ্যাপিনেস বা সুখ আনতে পারে না। এই কথার পিঠে অন্য একটি প্রশ্ন করা যায়, তাহলে কি টাকা না থাকা সুখ আনতে পারে? এই প্রশ্নের মাধ্যমেই প্রথমোক্ত কথাটির এক ধরনের অর্থহীনতা বুঝা যেতে পারে।

টাকা থাকলে যেমন কারো সুখ না থাকতে পারে, তেমন টাকা না থাকলেই যে সুখ আসবে এমন নয়। ফলে সুখ বিষয়টাকে সামনে এনে টাকাকে মূল্যহীন প্রমাণ করার যুক্তি নেই।

তবে, বিষয়টাতে বেশ কিছু জটিলতা বা কিন্তু আছে। তাই, টাকার সাথে সুখের সম্পর্ক এবং সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সুখ বাড়ে কি না তা বুঝার জন্য এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষনাকর্ম হয়েছে।

কারো টাকা না থাকার মানে সে গরীব বা দরিদ্র। এই দারিদ্রতার জন্য তার কষ্টভোগ করতে হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নানা ধরনের অধিকার থেকেও সে বঞ্চিত হতে পারে। সে তার সাধারণ চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হবে। ফলে, টাকা না থাকা অবশ্যই তার জন্য অসুখকর একটি বিষয়।

আর বেরুনী তার ভারততত্ত্বে লিখেছেন একটি কবিতার কথা।

“এই পরিচ্ছেদ লিখতে বসে আমার এমন এক অবস্থার কথা মনে পড়ছে যে অবস্থা সম্বন্ধে জনৈক কবির এই কয়টি পংক্তি প্রযুক্ত হতে পারে-

অতীতের এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলেছিলেন

মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় তার দুইটি ক্ষুদ্র প্রত্যঙ্গ থেকে

(অর্থাৎ জিহবা আর হৃদয় থেকে)

আমি কিন্তু এক বিচক্ষণ লোকের উক্তি স্মরণ করি

“মানুষ মানুষ হয় দুইটি দিরহামের জোরে।”

যার কাছে দুই দিরহাম-ও নাই

তার স্ত্রীও তার দিকে ফিরে তাকায় না।

দৈন্যের জন্য যে পরিচয়হীন,

বেড়ালও তার মাথায় লাথি মারতে ছাড়ে না।”

বলাবাহুল্য, আল বেরুনী যখন এই এই কবিতার কথা লিখেন তখন তার দৈন্য বা আর্থিক দুরাবস্থা চরমে পৌছেছিল।

২০১০ সালে মনস্তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কায়নেম্যান এবং এনগাস ডিটন গ্যালাপ অর্গানাইজেশনের সংগ্রহ করা ১০০০ আমেরিকান নাগরিকের ডেইলি সার্ভে থেকে ৪৫০,০০০ উত্তর নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন।

তারা দেখতে পান যে টাকা মানুষের সুখে প্রভাব ফেলে। তবে তা নিম্ন থেকে মাঝারি আয় পর্যন্তই। একেবারেই দরিদ্র অবস্থা হতাশা, দুশ্চিন্তা, দুঃখবোধ বাড়ায়;  মোটকথা সুখ কমায়।

তাদের আয় বাড়ার সাথে সুখ বাড়ে। এবং তা বছরে ৭৫ হাজার ডলার পর্যন্তই অব্যহত থাকে। কিন্তু এর পরে আয় বাড়লে সুখ সেই অনুপাতে বাড়ে না।

টাকা
কার্টুনিস্টঃ স্টিভ কাটস

মানুষ যখন দেখে দরিদ্র অবস্থায় টাকাহীন থাকায় সুখ নেই, খালি দুঃখ; আর দরিদ্র অবস্থা থেকে আয় বাড়তে থাকলে সুখ বাড়ছে, তখন তাদের মনে হয় হয়ত অধিক সম্পদ মানে অধিক সুখ। কিন্তু, অধিক সম্পদ মানে অধিক সুখ, তা হয় না।

২০১৪ সালে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের মাইক নর্টন একটি বড় ইনভেস্টমেন্ট ফার্মের সম্পদশালী ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞেস করলেন, তারা কত সুখী এবং কত টাকা তাদের সুখী করতে পারে।

তারা সবাই যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা হলো যা আছে তার প্রায় তিনগুণ। যা আছে তার তিনগুণ হলেই তারা সুখী বোধ করবে বলে তাদের মনে হয়। যার তিন মিলিয়ন আছে সে চায় নয় মিলিয়ন। যার ছয় মিলিয়ন আছে সে চায় ১৮ মিলিয়ন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে লিখেছিলেন, “এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায়   আছে যার ভূরি ভূরি—”; এই ভূরি ভূরি চাওয়া তো তার সুখ খোঁজা, এই গবেষনা মতে তিনগুণ। রাজার হাতিশালে চল্লিশটি হাতি আছে, তিনি মনে করে একশো বিশটি হলে হবেন তিনি সুখী।

যাইহোক, টাকা আয় ও মানুষের সুখের সম্পর্ক নিয়ে উপরিউক্ত দুই গবেষনার মত হলো,

১। দরিদ্র অবস্থা থেকে মাঝামাঝি অবস্থায় যাওয়ার ক্ষেত্রে টাকা আয় সুখে ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মানুষের সুখের জন্য দরকারী।

২। মাঝারি অবস্থা থেকে আরো বেশী সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বেশী টাকা আয় সুখে বেশী ভূমিকা রাখে না।

৩। মানুষ মনে করে তার যা আছে তার প্রায় তিনগুণ হলে সে সুখী হবে।

 

গবেষনাদ্বয় বাংলাদেশের লোকদের নিয়ে নয়। তাই এদেশের লোকদের উপর তা কেমন প্রযুক্ত হবে তা হয়ত প্রশ্ন সাপেক্ষ। তিনি স্বাভাবিক মানব প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে এই গবেষনাদ্বয়কে সুখ ও টাকার সম্পর্ক বুঝার জন্য ব্যবহার করাই যায়।