মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » কুরানে বর্ণিত আদম হাওয়ার কাহিনীর মর্ম কী?

কুরানে বর্ণিত আদম হাওয়ার কাহিনীর মর্ম কী?

কুরানে আদম হাওয়ার গল্পের জিরার্দিয়ান/মিমেটিক এনালাইসিস করেছেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কলার আহমেদ আখতার, সেখান থেকে মূল আইডিয়া নেয়া। ফ্রেঞ্চ আমেরিকান তাত্ত্বিক রেনে জিরার্দের মিমেটিক তত্ত্ব/ মিমেটিক ডেজায়ার এই সাইটের আলোচনার, ওঁ আমার আগ্রহের এক প্রধান বিষয়, ফলে এই আদম হাওয়ার কাহিনীর মিমেটিক ব্যাখ্যামূলক এই লেখা, যা ধর্ম ইসলামকে, বা ইসলামের ইনসাইট/শিক্ষাকে মিমেটিক দিক থেকে বুঝার জায়গা করে দিবে।

প্রথমে, মিমেটিক তত্ত্বটা কী? এ নিয়ে বিস্তারিত লেখা আছে, মিমেটিক তত্ত্বের জগত লেখায়। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করছি।

মানুষের নিজস্ব কোন ডেজায়ার/ আকাঙ্ক্ষা নাই। অন্যের ডেজায়ার দেখে তার মধ্যে ডেজায়ারের জন্ম নেয়। সুতরাং, মানুষের যে কোন ডেজায়ার স্বাধীন ব্যক্তি হিসেবে তার মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপন্ন হয় না। বরং এখানে একটা ত্রিভুজ সম্পর্ক আছে।

একজন একটা জিনিশ চাচ্ছে, বা করছে। তাকে মডেল মনে করে অন্য আরেকজন। মডেল ওই কাজ করছে দেখে, তারও ওই কাজ করার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। এভাবে অর্থ সম্পদ খ্যাতি স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ক সকল ডেজায়ারই মিমেটিক প্রক্রিয়ায় মানুষের মধ্যে উৎপন্ন হয়।

কুরানে ১১৪ সূরার মধ্যে ১২ জায়গায় আদম ও হাওয়ার কথা আছে। মূল কাহিনীটা নিম্নরূপ,

আদম ও হাওয়াকে আল্লাহ তৈরি করলেন। তারপর সব ফেরেশতাদের বললেন সেজদা করত। সবাই করল। কিন্তু ইবলিশ করল না।

আল্লাহ আদমকে বললেন, তোমরা দুইজন এখানে থাকো, খাও, কিন্তু ঐ গাছের কাছে যাইও না, গেলে তোমরা পাপী হবে।

শয়তান আদমকে কুমন্ত্রণা দিলো, আদম, ওই গাছে আছে অমরত্ব ও অনন্ত ক্ষমতা।

আদম ও হাওয়া ওইখান থেকে ফল খেলেন।

ফল খাওয়ার পর তাদের মধ্যে কনশাসনেস আসলো। তারা বুঝতে পারলেন তারা নগ্ন। কাপড় দিয়ে গা ঢাকলেন। কিন্তু আদম বুঝতে পারলেন তিনি ভুল করে ফেলেছেন আল্লাহর আদেশ মান্য না করে। তিনি অনুতাপ করতে লাগলেন।

ডাকার মত ডাকলে খোদায় কেমনে শুনে না, একটা কথা আছে। আদম ও হাওয়ার ডাকও আল্লাহ শুনলেন। তাদের ক্ষমা গ্রহণ করলেন, এবং তাদের কাছে নিয়ে বললেন, তোমরা উভয়েই বেহেশত থেকে দুনিয়াতে যাবে, ওইখানে শয়তান ও তোমরা পরস্পর শত্রু হিশাবে বাস করবে।

আদম হাওয়াকে বললেন, তোমরা মানুষেরা আমার দেখানো পথ অনুসরণ করলে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে না।

উপরের অংশ আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবার্থে, এটা সূরা ত্ব-হা (২০), আয়াত ১১৬-১২৩ এ আছে।

সূরা আল আ’রাফ (৭) এর ১১-২৭ আয়াতে আরেকটু বিস্তারিত আছে। যেখানে শয়তান যখন সেজদাহ করল না আদমকে, আল্লাহ তাকে বহিষ্কার করলেন, তখন শয়তান বলেছিল সে আদম সন্তানকে ভালো পথ থেকে সরাতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাবে, এবং আল্লাহ দেখতে পাবেন এরা অকৃতজ্ঞ।

ছবিঃ ১৫৫০ এর মাঝামাঝি সময়কালের সাফাবিদ পিরিয়ডের পেইন্টিং, যেখানে দেখানো হচ্ছে আদম এক সাপের পিঠে, হাওয়া ময়ূরের পিঠে।

এই অংশে আছে, শয়তান আদম হাওয়াকে কুমন্ত্রণার কালে বলেছিল, তোমাদের আল্লাহ ওই গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন কারণ ওইটা খেলে তোমরা ফেরেশতাদের মত অমর হয়ে যাবে।

এবং আল্লাহ পরে আদম সন্তানদের সতর্কতা দেন, তোমার আদি পিতা মাতারে যেভাবে শয়তান বশীভূত করেছিল, তোমাদেরও করতে চাইবে, সাবধান, তারে সেই সুযোগ দিও না।

জিরার্দিয়ান দৃষ্টিকোণ থেকে যদি এই কাহিনীটাকে দেখা হয়, তাহলে প্রাধান্য দিতে হবে এইখানে উল্লেখিত দুই ডেজায়ারে।

১। অনন্ত জীবন তথা অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা

২। অনন্ত ক্ষমতা

এই দুই ডেজায়ার তাদের মধ্যে কীভাবে জন্ম নিল? তারা তাদের সামনে এমন কারে দেখেছিলেন যার মধ্যে এইরকম ক্ষমতা আছে?

স্বয়ং আল্লাহ।

আল্লাহ ছিলেন এইখানে এই দুই ডেজায়ারের মডেল।

কিন্তু তারা আল্লাহকে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছেন এমন না। তারা ওই সব কোয়ালিটি (অমরত্ব, অনন্ত ক্ষমতা) অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর মত হইতে চাইলেন, এবং এটা করতে গিয়ে তারা আল্লাহর আদেশই অমান্য করলেন।

কুরান সরাসরি বলে না আদম হাওয়া আল্লাহর মত হইতে চাইছেন কিন্তু আহমেদ আখতার তার মিমেটিক বিশ্লেষণে বলেন, তারা যে দুই জিনিশ আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন, অনন্ত ক্ষমতা ও অনন্তকাল ধরে থাকা, এি দুইটা আল্লাহরই বৈশিষ্ট্য ছিল, সুতরাং বলা যায়, সরাসরি না বললেও পরোক্ষ ভাবে কুরান এটাই বলেছে।

এখানে আদম ও হাওয়ার নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের কাজে পাপ হয়েছে তিন দিক থেকে।

এক, তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছেন। তারে পাশ কাটিয়ে, তার আরাধনা বা তারে না মেনে ওই জিনিশগুলা অর্জন করতে চেয়েছেন।

দুই , তারা আল্লাহকে অবিশ্বাস করেছেন শয়তানকে বিশ্বাস করে।

তিন, তারা নিজেদের ডেজায়ারের বশবর্তী হয়েছেন, আল্লাহকে না মেনে নিজেদের ডেজায়ারকে মেনেছেন। এটা হল, নিজেদেরকে নিজেদের গড মনে করা। ইসলামের সবচাইতে বড় অপরাধ শিরক।

কুরানে সূরা আল-ফুরকান (২৫) এর ৪৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ নিজের ডেজায়ারকে আল্লাহ হিসেবে মানা নিয়ে বলেছেন, “তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?”  

আদম ও হাওয়ার ডেজায়ারের যে দিশা হারিয়ে ফেলা, তা নিজের ডেজায়ারকে নিজের গড তথা নিজেদেরই নিজেদের গড মনে করাতে। এইরকম মানুষেরা তার ডেজায়ার দ্বারাই পরিচালিত হয়, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আল্লাহর আদেশ মানে না।

আল্লাহ কুরানে সমাধান হিসেবে উল্লেখ করেন যে, মানবজাতি যদি নিজেদের প্রবৃত্তির দাস না হয়, ও আল্লাহর দেখানো পথে চলে, তাদের ডেজায়ার দিশা হারা হবে না, এবং তারা বিপদ থেকে বেঁচে যাবে।

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম যদি হইত তাহলে কুরানে তাদের ডেজায়ারকেই কেন দোষ দেয়া হইল না প্রকাশ্যভাবে? বা কেউ বলতে পারেন, আল্লাহ নিজেই তো বলেছেন আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও। তাহলে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য চাইলে ক্ষতি কী?

কুরান আদম হাওয়ার ডেজায়ারকে সরাসরি দোষ দেয় নি, কারণ তাদের পাপ ডেজায়ারের জন্য হয় নি। বরং ডেজায়ার দ্বারা পরিচালিত হয়ে শয়তানকে বিশ্বাস, পকারান্তে আল্লাহকে অবিশ্বাস, এবং সর্বোপরি অবাধ্য হওয়াতেই ছিল পাপ। অর্থাৎ, ইসলাম স্বীকার করে মানুষের মধ্যে ডেজায়ার জন্ম নিবে, এটা স্বাভাবিক। এবং আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়াই আল্টিমেট লক্ষ্য। কিন্তু সেইটা করার পথ হিশাবে আল্লাহ তার বানী ও নবী রসূলের দেখানো পথ রেখেছেন, এটা হচ্ছে মানব ডেজায়ারের নর্থ স্টার, যা দেখে তার জীবন জাহাজ দিক দিশা পাবে। এগুলিকে বাইপাস করে নিজের প্রবৃত্তির বশে পরাস্থ হয়ে যদি কেউ কাজ করে, তাহলে হবে না।

এই কাহিনীতে যে দুই ডেজায়ার উঠে এসেছে, অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা ও অনন্ত ক্ষমতা, খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই দুইটাই মানবজাতির সবচাইতে বড় ডেজায়ার। যুদ্ধ, হানাহানি, ভূ-রাজনীতি সব কিছুর মূলে। বাকিসব ডেজায়ার এইগুলার সাথেই কানেক্টেড। যেমন, যৌনতা/সেক্সের কথা ধরলে, সেটা তো অমরত্বের আকাঙ্ক্ষাই, সন্তান জন্ম দিয়ে তাদের মাধ্যমে নিজের জেনেটিক পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখার তাড়না। এখানে পাওয়ারও জড়িত। যত বেশি সন্তান, যত বেশি বড় গোষ্টি ততো বেশি ক্ষমতা ছিল কৃষি সমাজে, এখনোও যে নেই তা নয়।

আদম হাওয়ার কাহিনী বলে, মানুষ যদি আল্লাহর উপাসনা না করে, তার দেখানো পথ ভুলে গিয়ে, এই দুই ডেজায়ার- অমরত্ব ও অনন্ত ক্ষমতার উপাসনা করে, যেটা আলটিমেটলি নিজেরই উপাসনা, সেইক্ষেত্রে কোন নৈতিকতা বা আল্লাহর জায়গাই থাকবে না তাদের লাইফে, এবং এই অবস্থায় তাদের নিরন্তর অধঃপতন ঠেকানো যাবে না।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং