আমরা ফিল্মে দেখি নায়ক কঠোর পরিশ্রম করে ধনী হয়ে যাচ্ছে। যাকে আমাদের সমাজে সফলতা বলা হয়। আমাদের ফিল্মের নায়ক কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হয়ে যায় বিজনেস ম্যাগনেট।
আমরা ফিল্মে দেখি আমাদের নায়কেরা নায়িকারা খুব ভালো, নীতিবান, দেখতে সুন্দর ইত্যাদি।
এই দেখা আমাদের ভিতরে একটি বায়াস তৈরী করে। আমরা আমাদের লাইফকেও ফিকশনের মতো করে দেখতে চাই। যাকে রবার্ট হ্যানসন নাম দিয়েছেন ফিকশন বায়াস।
বাস্তব লাইফে এই বায়াসের কারণে আমরা আমাদের কাছে আসা ফ্যাক্টগুলির একটা ফিকশনাল ব্যাখ্যা দাঁড় করাই। একটার সাথে আরেকটা মিলাই, এবং গল্প তৈরী করি।
এটা খুব বেশী হয় সফল মানুষদের গল্প বলার সময়। তাদের সম্পর্কে আমরা যেসব অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী পড়ে থাকি তা নিছকই গল্প। যেমন বাংলা ফিল্মে আমরা ঠেলাগাড়ি চালিয়ে ধনী হওয়া নায়ক জসিমের গল্প দেখতাম।
এই গল্পগুলি সত্য নয়।
বরং বিচ্ছিন্ন সত্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত এক মহামিথ্যা।
এটি তৈরী করেন যে লেখক লেখছেন তিনি। তিনি ঐ ব্যক্তির জীবনের ফ্যাক্টগুলির ব্যাখ্যা দাঁড় করান, সংযোগ স্থাপন করেন এবং এরফলে একটি মিথ্যা উৎপন্ন হয়।
এখন প্রথম প্রশ্ন এই মিথ্যা তৈরী কি লেখক ইচ্ছাকৃত ভাবে করে থাকেন?
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর হলো না। তিনি ইচ্ছে করে মিথ্যা বানান না। তিনি ভাবেন সত্যিটাই বলছেন। নির্জলা ফ্যাক্টকে বুঝার সীমাবদ্বতা আছে মানুষের। কারণ নির্জলা ফ্যাক্ট নির্ভর যে বাস্তব পৃথিবী তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু কোন কিছুর ব্যাখ্যা নেই এমন হলে আমাদের মস্তিষ্ক তা মেনে নিতে পারে না। সে ব্যাখ্যা চায়। না পেলে তৈরী করে।
সফল ব্যক্তির জীবন কাহিনীর ক্ষেত্রে যেহেতু ফ্যাক্টগুলি উপস্থিত থাকে তাই লেখকের ব্যাখ্যা তৈরী সহজ হয়।
নাসিম তালেব তার বই ব্ল্যাক সোয়ানে আমাদের বুঝার সীমাবদ্বতার ফলে উদ্ভূত এই ভ্রান্তির নাম দিয়েছেন ন্যারেটিভ ফ্যালাসি। তার কথায়ঃ
The narrative fallacy addresses our limited ability to look at sequences of facts without weaving an explanation into them, or, equivalently, forcing a logical link, an arrow of relationship upon them. Explanations bind facts together. They make them all the more easily remembered; they help them make more sense. Where this propensity can go wrong is when it increases our impression of understanding.
—Nassim Nicholas Taleb, The Black Swan
[সফল ব্যক্তির জীবন নিয়ে লেখা লেখকেরা কেবল নয়, ঐ সফল ব্যক্তিরাও নিজেদের জীবন নিয়ে বলতে গেলে ন্যারেটিভ ফ্যালাসিতে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা খুবই সম্ভব কারণ আমাদের স্মৃতি মূল বাস্তব ঘটনা মনে রাখে না। এখানে দুইটা পার্ট আছে, এক্সপেরিয়েন্সিং সেলফ ও রিমেম্বারিং সেলফ। যা ড্যানিয়েল কায়নেম্যান ব্যাখ্যা করেছেন।]
অর্থাৎ, আমরা আমাদের সহজাত প্রবণতা ও মনে রাখার জন্য বিচ্ছিন্ন ফ্যাক্টগুলিকে যৌক্তিক ভিত্তিতে সাজাই ও গল্প তৈরী করি। এই গল্পটি বাস্তবের ঐ সফল ব্যক্তির জীবন নয়, কেবলি ফিকশন হয়। কিন্তু আমরা মনে করতে থাকি যে আমরা তা ঠিকঠাক বুঝে গেছি। আমরাও জেনে গেছি সাফল্যের ফর্মূলা। এগুলি মেনে চলে আমরাও হয়ে যাবো একদিন………রাজহাঁস।
এই ন্যারেটিভ ফ্যালাসি আক্রান্ত সাফল্যের অনুপ্রেরণামূলক গল্প হলো মানুষের বুঝার সীমাবদ্বতা। এই সীমাবদ্বতা তাকে বাস্তবতা দেখতে দেয় না, ও কাল্পনিক এক ফিকশনাল বাস্তবতায় নিয়ে যায়।
মূলত, এই গল্পগুলি বাস্তব জীবনে সফল হতে একজন ব্যক্তির জন্য বাঁধাই হয়। কারণ বাস্তব জীবনটা ঐ ফিকশন থেকে ভিন্ন।
এবং এই গল্পগুলি বিশ্বাস করে মানুষেরা লং রানে হতাশই হয় বেশী।
কীভাবে এগুলি থেকে আপনি বেঁচে থাকবেন?
প্রথম কথা, সাফল্যের অনুপ্রেরণামূলক গল্পসমূহ পড়বেন না। এগুলি কিন্তু খুবই জনপ্রিয় হয়। রাখাল বালকের দেশ চালক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি গল্প। এসব থেকে নিজেকে রক্ষা করার প্রথম উপায়, এগুলি না পড়া। পড়ার সময় খুব সতর্ক হোন, কেবল ভালো জিনিসই পড়ুন, কারণ আপনার সময় মূল্যবান। এছাড়া আপনি যা পড়েন তা আপনার চিন্তাকে প্রভাবিত করে।
দ্বিতীয় কথা, যদি পড়েন তাহলে লজিক্যাল মাইন্ড নিয়ে পড়ুন। যে ফ্যাক্টগুলি আছে, যেমন, তার বাবা মারা যান যখন তিনি শিশু ছিলেন, না খেয়ে থাকতেন, তিনি একদিন চাকরির জন্য গিয়েছিলেন, বস প্রথম দেখাতেই তাকে চাকরি দেন, তিন দিনের মধ্যে প্রমোশন……ইত্যাদি; এদের সব ক’টিকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন। লেখক যেভাবে বলেছেন কেবল ঐ ব্যক্তি পরিশ্রমের কারণে এই করেছে সেই করেছে, এর প্রতিটি ফ্যাক্টকে বিশ্লেষণ করে দেখলে আপনি দেখবেন ঐ ব্যক্তির পরিশ্রম বা ড্রাইভ কেবল মাত্র একটি ব্যাখ্যা। আরো অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে।
আরো মজার ব্যাপার দেখবেন যে, এই ব্যাখ্যাগুলি আপনার এবং ঐ লেখকের বানানো, ঐ সফল ব্যক্তির জীবনের ফ্যাক্ট নয়।
নিজের ফিকশন বায়াস দূর করার চেষ্টা কিভাবে করবেন?
যখন কোন ফিকশন দেখেন, তখন বাস্তবতার সাথে যেখানে দেখবেন সংঘর্ষ হচ্ছে, বা বাস্তবতা থেকে ভিন্ন দিকে হাঁটা দিচ্ছে গল্প, তখন বাস্তব হলে কী হতো তা ভেবে নিতে পারেন। এতে ফিকশন বায়াস কমবে।
আরো যা যা পড়তে পারেনঃ
আমাদের উপর গল্পের বা ফিকশনের প্রভাব নিয়ে গল্প বলা প্রাণীটি।
ন্যারেটিভ ফ্যালাসি ও সফলতার গল্প নিয়ে আরেকটি লেখা, সাফল্যের গল্প থেকে সাবধান।