ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারিঃ “ফ্রি তথ্যের আইডিয়াটি মারাত্মক বিপদজনক”

ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারি একজন ইজরাইলি ইতিহাসবিদ। মধ্যযুগের ইতিহাস বিষয়ে তিনি কাজ করতেন মূলত। তার লেখা দুইটি ‘ব্রেইনি বুক’ প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়েছে, এবং এর মাধ্যমে বর্তমান অনিশ্চয়তা ও দূর্বোধ্যতার সময়ে মানুষের বুঝতে চাওয়ার ইচ্ছা যে তৈরী হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, সেই বিষয়টিকে বুঝিয়ে দিয়েছে। হারারির বই হোমো স্যাপিয়েন্সে তিনি মানুষের ইতিহাসের এক চিত্র এঁকেছেন, আর পরবর্তী বই হোমো দিউসে তিনি মানুষের ভবিষ্যত বা কোনদিকে আমরা যাচ্ছি তা উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।

তার নতুন বই ২১ শতকের জন্য ২১ শিক্ষা বা টুয়েনি ওয়ান লেসনস ফর টুয়েনিফার্স্ট সেঞ্চুরী প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি আমাদের বর্তমান কালের গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নসমূহ নিয়ে।

৫ আগস্ট ২০১৮ এন্ড্রু এনথনির সাথে হারারির একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় গার্ডিয়ান পত্রিকায়। এই সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ এখানে দিলাম।

ছবিঃ ইয়্যুবাল নোয়াহ হারারি।

 

আপনি এখন একজন খুবই সফল পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কীভাবে আপনাকে পরিবর্তন করেছে?

এখন আমি অনেক কম সময় পাই। দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কনফারেন্সে যাচ্ছি, ইন্টারভিউ দিচ্ছি আর যেসব জিনিস আমি আগেই জানি সেগুলি নিয়ে বার বার কথা বলছি। নতুন গবেষণার জন্য কম সময় পাচ্ছি। মাত্র কয়েক বছর আগে আমি ছিলাম মধ্যযুগের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ একজন অপরিচিত অধ্যাপক, এবং আমার পাঠক ছিলেন সারা বিশ্বে মাত্র ৫ জন, যারা আমার প্রবন্ধগুলি পড়তেন। এটা কিছুটা শকিং যে এখন আমি এমন জায়গায়, আমার লেখার মিলিয়ন মিলিয়ন পাঠক রয়েছেন। সব মিলিয়ে আমি এতে আনন্দিত। আপনি কেবল বলতে চান না, আপনি এও চান যে লোকে আপনার কথা শুনুক। তাই আমার যে এতো পাঠক বা ওডিয়েন্স আছেন এটা সুবিধাই।

 

এই সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলি কী, এ বিষয়ে আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন?

আসলে একরকম ভাবে এই বইটি লেখা ছিল সহজ কারণ এটা লেখা হয়েছে পাবলিকের সাথে কথোপকথনের স্টাইলে। বিভিন্ন ইন্টারভিউতে এবং পাবলিক জায়গাগুলিতে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন আমি হই তার মধ্য থেকেই প্রশ্নগুলি নির্বাচন করেছি বেশিরভাগ। আমার আগের দুইটি বই ছিল মানুষের লং-টার্ম অতীত এবং লং টার্ম ভবিষ্যত নিয়ে। কিন্তু আপনি তো অতীতে বা ভবিষ্যতে বাস করতে পারবেন না। আপনি বাস করতে পারবেন কেবল বর্তমানে। তাই লং টার্ম ইনসাইটগুলি নিয়ে যদি না আপনি বর্তমানের ইমিগ্রেশন ক্রাইসিস বা ব্রেক্সিট বা ফেইক নিউজ নিয়ে কিছু বলতে পারেন, তাহলে এগুলি জেনে লাভ কি?

 

আপনি কি মনে করেন লোকেরা বায়ো এবং ইনফোটেক বিপ্লব যেটি হওয়ার পথে আছে, তার প্রভাব বুঝে?

পাঁচ অছর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) সাইন্স ফিকশনের মতো শোনাত। একাডেমিক মহলে এবং প্রাইভেট বিজনেসের লোকেরা এর ক্ষমতা সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানতে পেরেছিল কিন্তু রাজনৈতিক জায়গায় এবং জনগণের কথাবার্তায় এ সম্পর্কিত কিছু প্রায় শোনা যেত না। তারপর কিছু সরকার এর ক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারে, বুঝতে পারে কী হচ্ছে। আমার মনে হয় চাইনিজ সরকার প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে পারে। এটা হয়েছে, তারা যে আগে শিল্প বিপ্লব মিস করেছিল, তখন আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে নি এবং এর জন্য মারাত্মক ভাবে ভুগতে হয়েছে, সেই ট্রমা থেকে। ওরা এবার আর ট্রেইন মিস করতে চায় না। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপ্লবের সামনে থাকতে যেকোন কিছু করতে রাজী। গত এক বছরের মধ্যে, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানরাও বুঝতে পেরেছে। এবং আমরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক তীব্র অস্ত্র প্রতিযোগিতার দিকে যাচ্ছি,  যা আমাদের জন্য খুবই, খুবই খারাপ খবর।

 

 

উদারনীতি (লিবারালিজম) বিগ ডেটার কারণে কেন এখন হুমকির মুখে?

লিবারালিজম এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো যে, আপনার  ভেতর বিশ্বের উপর একমাত্র ক্ষমতা আপনারই। আপনার অনুভূতি, আপনার চিন্তা এবং পছন্দ আপনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বাইরের অন্য কেউ আপনাকে বুঝতে পারবে না পুরোপুরি। এইজন্য আপনার অনুভূতির স্থান সর্বোচ্চ আপনার জীবনে – তা রাজনীতিতে হোক বা অর্থনীতি। ভোটার সবচাইতে ভালো জানেন কাকে ভোট দিবেন, কাস্টমার সবসময় ঠিক ইত্যাদি। যদিও নিউরোসাইন্সের গবেষণা দেখাচ্ছে যে ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বলতে কিছু নেই। ব্যবহারিক ভাবে বললে, আমরা বুঝতে পারি যে কেউ আপনাকে বুঝতে পারবে না এবং আপনার ভিতরের অনুভূতিগুলিকে তার চাহিদামত ম্যানিপুলেট বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু বর্তমানে বায়োটেক এবং ইনফোটেক নিউরোসাইন্সের সাথে মিলেমিশে এক জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। এবং এখন প্রচুর প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে ব্যক্তি সম্পর্কে এবং সেগুলি কার্যকর ভাবে প্রসেস করা যাচ্ছে। এখন এমন জায়গার দিকে যাচ্ছি যে অন্য ব্যক্তি বা বাইরের প্রতিষ্ঠান আপনার অনুভূতিকে আপনার চাইতে ভাল ভাবে বুঝে ফেলতে সক্ষম হবে। আমরা এর একটি ক্ষানিক চিত্র দেখেছি গত মহামারীতুল্য ফেইক নিউজের ব্যাপক বিস্তারের কালে।

ফেইক নিউজ আগেও ছিল। কিন্তু এবারেরটা ব্যতিক্রম এই কারণে যে আপনি কোন ব্যক্তির পূর্বধারণা সম্পর্কে জেনে তার জন্য নির্দিষ্ট ফেইক নিউজ সরবরাহ করতে পারছেন। যত বেশি মানুষ নিজের মুক্ত চিন্তা তথা ফ্রি উইলে বিশ্বাস করবে, যত সে বিশ্বাস করবে তার ভেতরের চিন্তা কোন আধ্যাত্মিক কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, ততো বেশি তাকে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব হবে। কারণ তারা কখনো ভাববে না তাদের অনুভূতিগুলি বাইরের কিছু দ্বারা ম্যানিপুলেট হচ্ছে, বা তৈরী হচ্ছে।

 

আপনি পরিস্কার ও স্বচ্ছভাবে লিখে থাকেন, কিন্তু তাও কি পাঠকেরা আপনাকে ভুল বুঝে?

হ্যা, প্রচুর হয়। এটা বোধগম্য। মাঝে মাঝে তারা বুঝতে চায় না। মাঝে মাঝে লেখার জিনিসগুলি নতুন ও জটিল তাই। আমি মনে করি না এক বই পড়ে এইসব ইস্যু বিষয়ে পরিস্কার হওয়া যাবে। এটা বিজ্ঞানিদের দায়িত্ব, তারা যখন জনসাধারনের সাথে কথা বলেন তখন যেন অবশ্যই যত সহজ করে পারা যায় বলেন। কিন্তু আমার এই বিভ্রান্তি নেই যে আমি যা লেখব, যা বুঝাতে চাইব, তা সবাই ঠিকঠাক বুঝে নিবে।

 

আপনি বলেন, যদি ভালো তথ্য চান, তাহলে এর জন্য ভালো পরিমাণ টাকা পরিশোধ করুন। সিলিকন ভ্যালির নিয়ম হলো তথ্য হবে ফ্রি, এবং কিছু ক্ষেত্রে অনলাইন পত্রিকা ইন্ড্রাস্ট্রি এটা অনুসরন করছে। এটা কি ভালো?

ফ্রি তথ্যের আইডিয়াটি নিউজ ইন্ড্রাস্ট্রির জন্য মারাত্মক বিপদজনক। যদি যত্রতত্র প্রচুর ফ্রি তথ্য থাকে তাহলে আপনি কিভাবে লোকের মনযোগ আকর্ষণ করবেন, এটাই হয়ে যায় আসল পণ্য। বর্তমানে পাঠকের মনযোগ পেলেই লাভ আছে- কারণ এতে তারা এটি বিজ্ঞাপনদাতার কাছে, রাজনীতিবিদদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। মনযোগ পাবার জন্য তারা চিত্তাকর্ষক নিউজ তৈরী করছে, সত্য মিথ্যা কেয়ার করছে না। কিছু ফেইক নিউজ এসেছে রাশান হ্যাকারদের মাধ্যমে এটা ঠিক, কিন্তু বেশিরভাগ ফেইক নিউজ তৈরী হয়েছে কারণ ভুল জায়গায় লাভ রয়েছে পত্রিকাগুলির জন্য। এই ভুল ইনসেন্টিভ স্ট্র্যাকচারই দায়ী। মিথ্যা চিত্তাকর্ষক নিউজ তৈরীর জন্য কোন শাস্তি বিধান নেই। আমরা ভালো মানের খাবারের জন্য, পোষাকের জন্য, গাড়ির জন্য টাকা দিতে পারি, তাহলে ভালো মানের তথ্যের জন্য কেন দিতে পারব না?

 

আমরা অভূতপূর্ব এক পরিবর্তনের মুহুর্তে আছি। মানুষ কি এ ধরণের দ্রুত পরিবর্তনে টিকে থাকার জন্য তৈরী?

দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমার মূল ভয় সাইকোলজিক্যাল- অর্থাৎ এমন পরিবর্তন সহ্য করার মানসিক রেজিলিয়েন্স (খারাপ অবস্থা থেকে দ্রুত সেরে উঠার ক্ষমতা, টাফনেস।) কি আমাদের কাছে। গত দুই শতকে পরিবর্তনের হার বেড়েছে। আমার দাদীর বয়স ৯৩ এবং তিনি ভালো আছেন। মোটের উপর, আমরা টিকে আছি। আমরা এটি আবার করতে পারব কি না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাদের উচিত মানুষের মানসিক রেজিলিয়েন্স বাড়াতে আরো রিসোর্স ইনভেস্ট করা।

 

আপনার কাছে মেডিটেশনের অর্থ কি এবং এটা কেন গুরুত্বপূর্ন?

আমার জন্য এটা হলো প্রথমে নিজে বুঝা এবং কল্প গল্প মিথলজি ইত্যাদি সব বাদ দিয়ে বাইরের বিশ্বকে বুঝা। কেবল দেখা যে আসলেই কী হচ্ছে। আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন হলো গল্প এবং বাস্তবতাকে আলাদা করতে পারা এবং এটির জন্যই মেডিটেশন আমার জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ন। অন্য ব্যক্তির কাছে এটি গুরুত্বপূর্ন কি না তা ঐ ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। আমার বইয়ের শেষ অধ্যায় অনেকটাই ব্যক্তিগত কারণ এই অধ্যায়টি মেডিটেশন নিয়ে। আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে লোকেরা হয়ত ভাববে যে আমি বলতে চেয়েছি যেসব সমস্যা আমি উল্লেখ করেছি এর সব কিছু মেডিটেশন সমাধান করে দিবে।  দুশ্চিন্তার সাথে যুদ্ধে সাহায্য করতে পারে কিন্তু এটি অবশ্যই এমন কোন সিলভার বুলেট নয় যে মানবজাতির সব সমস্যার সমাধান করে দিবে।

 

আপনাকে নাটালি পোর্টম্যানের সাথে আলোচনায় দেখা যাবে লন্ডনে, আগামী সেপ্টেম্মরে, কীভাবে এটি হলো?

এটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং আইডিয়া মনে হলো। তিনি কেবল একজন মুভি স্টার নন, একজন বুদ্ধিমান মানুষ, শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ড হচ্ছে বিজ্ঞান আর সাইকোলজিতে। এমন একজন, যিনি দুই ক্যাম্পে বিরাজ করেন, তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগবে। আমার মনে হয় তিনি যেখানে অবস্থান করেন সেখান থেকে অনেক কিছু ভিন্নভাবে দেখা যায়।

 

যার কাছে সব প্রশ্নের উত্তর আছে এমন একজন প্রাজ্ঞ বা দ্রষ্টা হিসেবে আপনাকে ধরে নিতে পারে লোকেরা, এ নিয়ে কোন দূর্ভাবনা কি আপনার আছে?

হ্যা, এটা উদ্বেগের বিষয়, যখন সত্যিকার অর্থে আমার কাছে উত্তর নেই, নিদেনপক্ষে বেশীরভাগ প্রশ্নের উত্তরও নেই।  এবং মানুষের এই প্রবণতার সাথে আমি খুবই পরিচিত যে তারা এমন একজন ব্যক্তি চায় যার কাছে সব উত্তর আছে এবং তার কথা মত সব কাজ করতে চায়। আমি অবশ্যই এরকম কোন ব্যক্তি না। তাই আমি আশা করব লোকেরা যেন আমার বইটিকে ২১ শতকে বাস করার জন্য অভ্রান্ত গাইড হিসেবে না নেয়, কিন্তু একটি প্রশ্নের তালিকা হিসেবে নিতে পারে। আপনি একটি বিতর্কের আগে উত্তর পেতে পারেন না। তাই আমাদের প্রথমত বিতর্কটা শুরু করা উচিত।