উত্তর কোরিয়ায় যুদ্ধের সম্ভাবনা কেমন?

কিম জং উন

উত্তর কোরিয়ার এখনো এমন কোন ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক  মিসাইল নাই যা সরাসরি আমেরিকায় গিয়ে আঘাত করতে পারে। সে পর্যন্ত যেতে তাদের বহুদিন লাগবে। আর যেতে পারলেই হবে না, ঠিকমত টার্গেটে আঘাত করার জন্য দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারও আছে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল হয় বড় রেঞ্জের, বহুদূরের লক্ষ্যবস্তুতে পরমাণু অস্ত্র বহন করে নিয়ে আঘাত করতে স্বক্ষম।

উত্তর কোরিয়ার নিউক্লিয়ার কার্যক্রম, কয়দিন পর পর মিসাইল পরীক্ষা এসব বেশী দেখানো, প্রায়ই ব্যর্থ পরীক্ষা। তাদের নিউক্লিয়ার/মিসাইল কার্যক্রম খুবই ধীর গতিতে এগুচ্ছে। আজও (২৪ এপ্রিল,২০১৭) উত্তর কোরিয়া একটি ব্যর্থ পরীক্ষা চালিয়েছে ব্যালিস্টিক মিসাইলের।

উত্তর কোরিয়ার শক্তি

উত্তর কোরিয়ার মিসাইল শক্তি উপরের ছবিতে দেখানো আছে। এর মাঝে মুসুদান মিসাইলের রেঞ্জ যা আছে, তা গুয়ামে আঘাত করতে সক্ষম। কিন্তু এটি এখনো উৎক্ষেপন করতে পারে নি উত্তর কোরিয়া। বি রেঞ্জ পর্যন্তই তারা উৎক্ষেপন করছে, এগুলির মধ্যেও সব সফল উৎক্ষেপন নয়। বাকীগুলি সফলভাবে উৎক্ষেপন দূরের কথা, কিন্তু উত্তর কোরিয়া জানাচ্ছে তাদের কাছে এসব আছে বা কাজ চলছে। চিত্রে উল্লিখিত সি, ডি এবং ই রেঞ্জের মিসাইল যদি সফলভাবে উৎক্ষেপন করে ফেলে উত্তর কোরিয়া তখনই আমেরিকা সত্যিকারের থ্রেট অনুভব করে। আমেরিকা চায় না উত্তর কোরিয়া সে পর্যন্ত যাক।

কিন্তু তাও উত্তর কোরিয়া নিউক্লিয়ার অস্ত্র আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় এবং আরো উন্নতি করতে চায় এই দিক দিয়ে। আমেরিকার আপত্তি স্বত্ত্বেও। তার কাছে দুইটা ভয়াবহ উদাহরণ ইরাক ও লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ইরাকের সাদ্দামের অবস্থা দেখে গাদ্দাফি নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেয়। পরে আরব স্প্রিং যখন শুরু হয় তখন আমেরিকা তাতে সমর্থন দিতে থাকে,  অস্ত্র দিতে থাকে এবং এরই ফলে গাদ্দাফিকে ক্ষমতা ও প্রাণ হারাতে হয়। কিম জং উন এই দুই উদাহরণ বিশেষত গাদ্দাফিকে দেখে বুঝতে পারছে যে, আমেরিকার কথামত নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম ছাড়লে হবে না।

কিম জং উন
কিম জং উন’এর পতনের মধ্য দিয়ে এই পরিবারের প্রায় শত বছরের শাসন কি শেষ হতে যাচ্ছে?

উত্তর কোরিয়া নিজ দেশে তীব্র প্রোপাগান্ডা চালায় এবং মিডিয়ার সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখে প্রায়, ফলে তাদের জনগণের মনোভাব শাসকদের ইচ্ছানুযায়ী গড়ে উঠেছে। শাসক শ্রেনী অর্থাৎ এলিটদের একটি অংশ আবার ডিক্টেটর কিম জং উনকে দূর্বল মনে করছে এবং ভবিষ্যতে এই ফ্যামিলি থেকে শাসক না নির্বাচন করার কথা ভাবছে, এবং দুই কোরিয়ার একত্র হবার কথাও ভাবছে এমন জানাচ্ছে র‍্যান্ড কর্পোরেশনের সাম্প্রতিক একটি স্টাডি। আবার সম্প্রতি (২৮ এপ্রিল,২০১৭) উত্তর কোরিয়া জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞকে এক সপ্তাহের জন্য তাদের দেশ পরিদর্শনের সুযোগ দিতে সম্মত হয়েছে এই প্রথমবারের মত। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল অভিযোগ জানিয়ে আসছে উত্তর কোরিয়ায় লংঘিত হচ্ছে মানবাধিকার এবং তাদের দাবী অনুযায়ী প্রায় এক লাখ বিশ হাজারের মত মানুষকে অন্যায়ভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

উত্তর কোরিয়ার এই পরিদর্শককে এক সপ্তাহের পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া তাদের একটি  পরাজয় হিসেবে ধরা যায় এবং তা হয়েছে সম্ভবত তিনটি কারণে।

এক চীনের চাপ। চীন চায় না যুদ্ধ লাগুক উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়ার পরমানু প্রোজেক্ট স্থাপনাগুলিতে হামলা চালায়, উত্তর কোরিয়া প্রথমেই দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানে পরমানু ও বায়োলজিক্যাল অস্ত্রের হামলা চালাবে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে নিরাপত্তা দেয়া এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কাজ। এই যুদ্ধ বেশ বড় হয়ে উঠবে যদি শুরু হয়। এবং প্রাণহানি হবে অসংখ্য সাধারণ মানুষের।

উত্তর কোরিয়া, চীন সীমান্ত
উত্তর কোরিয়া-চীন সীমান্ত

চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার ১৪০০ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। চীনের উত্তর পূর্বাংশে কোরিয়ান জাতির লোকের বাস। সুতরাং যুদ্ধ হলে সীমান্ত দিয়ে রিফিউজিরা আশ্রয় নিবে।  চীন বর্তমানে যুদ্ধ বা এ ধরনের কোন ক্রাইসিস চায় না, কারণ তার বিশাল অর্থনীতি এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

দ্বিতীয় কারণটি সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি আমেরিকার সব চাইতে বেশী আনপ্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট। তাই এই এপ্রিলের ১৩ তারিখে এনবিসি যখন রিপোর্ট প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছে, তখন আলোড়ন তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু খবরটি ভুয়া বা আমেরিকা জানায় এমন তার কোন পরিকল্পনা নেই আপাতত, কিন্তু এই অপশন তাদের হাতে আছে।

উত্তর কোরিয়ায় মেজর মেজর স্টেপ নিতে হতে পারে বলে ট্রাম্প একটি হুমকি দেন, এবং বলেন প্রথমে কূটনৈতিক পথই তিনি দেখবেন। আর এদিকে ফক্স নিউজ জনমতে দেখাচ্ছে ৫৩% ভোট পড়েছে উত্তর কোরিয়ার পরমানু প্রকল্প বন্ধ করতে আমেরিকার মিলিটারি আগ্রাসনের পক্ষে।

উত্তর কোরিয়া এটা জানে আমেরিকা কীভাবে যুদ্ধের স্বপক্ষে তার দেশে দ্রুত জনমত তৈরী করে ফেলতে পারবে। আর এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার সাথেও মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি পুন-আলোচনা অথবা বন্ধ করে দেয়ার কথা, দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার (থাড) জন্য দক্ষিন কোরিয়ার এক বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা উচিত ইত্যাদিও বলেছেন।

অর্থাৎ, ট্রাম্প নিজেকে একজন কেবলমাত্র আমেরিকার স্বার্থ দেখা, আনপ্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তাই হয়ত উত্তর কোরিয়া আপস করতে চেয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মীকে পরিদর্শনের সুযোগ দিয়ে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপন করা আমেরিকার এন্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (বা সংক্ষেপে থাড) চালুর ঘোষনা আসে কাকতালীয় ভাবে গত মার্চে (২০১৭), উত্তর কোরিয়ার জাপানের দিকে চারটি পরীক্ষামূলক ব্যালিস্টিক মিসাইল উৎক্ষেপন এবং হম্বিতম্বির কয়েকঘন্টা পরেই। এই থাডের ব্যবস্থা এমন যে এর রাডার আসতে থাকা মিসাইল শনাক্ত করতে পারবে, আর সিগনাল দিবে। তখন সাথে সাথে এদিক থেকে আরেকটি নিঃক্ষেপ করে আসতে থাকা মিসাইলকে নামতে থাকার আগে আকাশেই ধ্বংশ করা হবে।

থাড

থাড স্থাপন করার পরে উদ্বেগ জানিয়েছে চীন। থাডের রাডার অতি অবশ্যই তাক করা আছে উত্তর কোরিয়ার দিকে। আর এদিকে চীনের সীমান্ত আছে উত্তর কোরিয়ার সাথে। অর্থাৎ, রাডার চীনকেও ধরবে। চীন আশংকা প্রকাশ করছে ভবিষ্যতে যদি আমেরিকার সাথে তার যুদ্ধ হয় তাহলে এই রাডারের জন্য আমেরিকার বাড়তি সুবিধা পাবে। এজন্যই তাদের উদ্বেগ।

চীন দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে এই থাডের জন্য। ইতিমধ্যেই দক্ষিণ কোরিয়ান টিভি প্রোগ্রাম চীনে বন্ধ করা হয়েছে, চীনের জনগণ উত্তর কোরিয়ার সেলিব্রেটি, বিউটি প্রোডাক্টস বর্জনের ডাক দিয়েছেন। থাডের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সরকারকে জমি ছেড়ে দিয়েছিল লট্টে গ্রপ কোম্পানি, এবং থাড কার্যক্রম শুরু করার পরপরই চীনে লট্টে’র চল্লিশটি দোকান বন্ধ করে দিয়েছে চীনের অথরিটি ফায়ার সেইফটির কারণ দেখিয়ে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনের সাথে ব্যবসা সম্পর্ক চালু রাখা, পরিবেশগত কারণ ইত্যাদি বিবেচনা করে থাড বিরোধী প্রতিবাদও হচ্ছে অনেক।

আর তৃতীয় কারণ হতে পারে, জাতিসংঘ পরিদর্শককে পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে উত্তর কোরিয়ার এলিটদের চাপে। যারা চায় না কিম জং উন ক্ষমতায় থাকুক এবং তার পরে এই পরিবারের কেউ ক্ষমতায় আসুক। কিম জং উন সম্প্রতি তার ভাইকে খুন করিয়েছেন। এর জন্য এলিটদের একটি বড় অংশ তাকে প্যারানয়েড এবং অযোগ্য মনে করছে। এলিটদের চাপে এটা যদি করে থাকে কিম জং উন, আর সত্যিই যদি এলিটদের অনাস্থা থাকে তার উপরে তাহলে হয়ত কিম জং উনকে সরিয়ে ফেলা হতে পারে। এক্ষেত্রে আততায়ী আসতে পারে মঞ্চে। এবং এরপরে দুই কোরিয়া একত্রিত যদি হয়ে যায় তাহলে উত্তর কোরিয়ার পরমানু প্রকল্পের দরকার থাকবে না আর। এটাই আমেরিকার চাওয়া।

উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া সীমান্ত
রাশিয়ার সাথেও উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত আছে, স্থলে ১৭ কিমি, সমুদ্রে ২২ কিমি।

তবে এখানে আরো দুই বিগ প্লেয়ার চীন এবং রাশিয়াও আছে। কিম জং উনের অপসারন হলে দুই কোরিয়া এক হবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে যাবে, ইত্যাদি সহজ কথা না। উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্যের তিন ভাগের দুই ভাগই হয় চীনের সাথে। উত্তর কোরিয়ার এলিটদের উপরে তাই চীনের প্রভাব আছে।

চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া
চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া পাশাপাশি

আমেরিকা এখানে চীনকে বলে সমস্যা মেটানোর জন্য, আর চীন বলে সমস্যা মেটানো আমাদের হাতে নেই, তারা আমেরিকাকে দোষারূপ করে ‘তোমরা ওদের সাথে লাগতে যাও কেন’। এদিকে রাশিয়া মনে করছে কোন ভাবেই শক্তি প্রয়োগের চিন্তা করা ঠিক নয় কারণ তাতে ভয়াবহ অবস্থার দিকে চলে যাবে এ অঞ্চল।

সব প্লেয়ারই উত্তর কোরিয়ায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে। তাই যুদ্ধের দিকে জল গড়াতে শুরু করলে সবাই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কূটনৈতিক পদ্বতিতেই সমাধান খুঁজবে। আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসন যদিও বলেছেন, উত্তর কোরিয়া যদি সীমালঙ্গন করতে থাকে তাহলে অব অপশনই তাদের হাতে আছে তথাপি উত্তর কোরিয়ার ভূ-প্রাকৃতিক যে অবস্থা তাতে সে অঞ্চলে যুদ্ধ খুব সহজ হবে না। এছাড়া উত্তর কোরিয়া যুদ্ধের জন্য তৈরী মনোভাব নিয়ে বসে আছে। এবং আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়াতে চায় না আমেরিকা। ফলে সহসাই এই অঞ্চলে যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই বলা যায়। যুদ্ধ তখনই হবে যখন আমেরিকার কাছে কূটনৈতিক সমাধানের শেষ সুযোগটিও থাকবে না।

আপাতত কূটনৈতিক সমাধানে না গেলে আমেরিকা শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবরোধ দিতে পারে উত্তর কোরিয়াকে। এর মধ্যে ওয়েল এম্বারগো, বৈশ্বিক বিমানপথে ব্যান, কার্গো জাহাজে বাঁধা ইত্যাদি থাকতে পারে। এছাড়া চীনকে চাপ দিতে পারে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। এজন্য চীনা ব্যাংকগুলির বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সাথে ব্যবসা করছে এ জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে আমেরিকা। উল্লেখ্য যে, নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জন্য উত্তর কোরিয়ার উপরে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ জারি আছে ২০০৬ সাল থেকে।

মোটকথা, চীনকে সাথে নিয়েই উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে একটা কূটনৈতিক সমাধানে পৌছাতে চাইবে আমেরিকা। যেহেতু চীনের স্বার্থও আছে তাই ধারণা করা যায়, চীন এতে ভূমিকা রাখবে।