গল্পঃ রেড বুকের লোকেরা

রবিবার। সকাল দশটার মত বাজে।

শহরের মিরপুর ডিওএইচেসে চাঞ্চল্যকর খুন। স্ত্রীকে হত্যা করে স্বামী পলাতক।

টিভি স্ক্রিণে এই খবর ভাসছে। একজন কমবয়েসী রিপোর্টার চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলছে। কথা আর কিছুই নয়, চিরাচরিত খুনের ভাষ্য। বলার ভঙ্গিতে সাসপেন্স রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খুনির ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। এই ভাইটি স্বামী স্ত্রী’র সাথে থাকত। ভয়ার্ত মুখে ছেলেটি জানাচ্ছে, ঐদিন সে বাসাতে ছিল না।

সাইকিয়াট্রিস্ট হায়দার সাহেব বিরক্তির সাথে চোখ মুখ কুচকে নিউজটি দেখছিলেন। তার স্ত্রী আমেনা আফসার রুমে এসে ঢুকতেই তিনি টিভি রিমোর্ট চেপে অন্য চ্যানেলে নিয়ে গেলেন। সেখানে ক্রিকেট খেলা চলছে। হায়দার সাহেব ভান করতে চেষ্টা করলেন যে তিনি খেলাই দেখছিলেন।

আমেনা আফসার হায়দার সাহেবের ঠিক সামনে এসে অন্যদিকের সোফায় বসলেন। তার মুখ থমথমে। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটাই তো?

হায়দার সাহেব অবাক হওয়ার মত ভঙ্গি করে বললেন, কোন ছেলে?

বিরক্তি চেপে আমেনা আফসার বললেন, আমি টিভি রিপোর্টের ছেলেটার কথা বলছি। ঢং করবে না। এই ছেলেটা তোমার কাছে আসতো না?

হায়দার সাহেব আমতা আমতা করে বললেন, কোন ছেলের কথা বলছো?

আমেনা আফসারের গলা চড়ে গেল। রাগে তিনি ফুঁসছেন। উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, তুমি কি সবাইকে নিজের মত মনে করো? যে ছেলে তার স্ত্রীকে খুন করে পালিয়েছে সে তোমার চেম্বারে আসতো না গত কিছুদিন ধরে?

হায়দার ঢোক গিলে বললেন, হ্যা, হ্যা, সে তো আসতই। মকবুলে হুদা। কিন্তু কিন্তু…

কিন্তু কী?

বিশ্বাস করো আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি। এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। সব ঠিক ঠাক মত এগুচ্ছিল। এর মধ্যে, বিশ্বাস করো, আজকে এই খবর দেখে আমি নিজেও চমকে উঠেছি।

তোমাকে নিয়ে আমি কী করব হায়দার? তুমিই বলো? কতোবার আমি সব ঠিক করে আনি আর তুমি একটা না একটা ঝামেলা বাঁধাও। এবার আমি বাবার কাছে কী বলব? বাবা কি এটা ক্ষমা করবেন!

হায়দার সাহেব নিরব হলেন। বাবার কথা মনে হওয়ায় তার মনেও আতংক ভর করল। যদিও শুরু থেকে বাবার ভয়েই তিনি চিন্তিত ছিলেন খবরটি দেখে, কিন্তু এখন আমেনা আফসারের কথায় সেই ভয় যেন বহুগুণে বেড়ে গেল।

বাবা হচ্ছেন জামশেদ আফসার খান। একজন বিশ্বখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট। দেশ বিদেশে কাজ করে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন…

হায়দার সাহেব জামশেদ আফসারের অধীনে কাজ করেছিলেন কিছুদিন। শুরু থেকেই তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী। জামশেদ আফসারের প্রভাব প্রতিপত্তির দিকে তিনি আকৃষ্ট হন এবং এরই মোহে পড়ে তার মেয়েকে বিয়ে করেন। তার মেয়ে আমেনা আফসার নিজেও সাইকিয়াট্রিস্ট। জামশেদ আফসারের সংঘটন পিপল অব রেড বুক সাইকিয়াট্রিস্টদেরই সংঘটন।

এই সংঘটনের প্রধান হিসেবে জামশেদ আফসারের পরে তিনিই কাজ করবেন বলে মনে করেন হায়দার সাহেব, যার ভালো আলী হায়দার খান।

কিন্তু এইরকম একটা ভুল করে কি সেই স্থানে যাওয়া যাবে?

আর জামশেদ আফসার খুবই মারাত্মক লোক, কাছ থেকে দেখেছেন হায়দার সাহেব। নীতিতে তিনি অবিচল। নীতির বিরুদ্ধ কাজ করলে তিনি তার নিজের মেয়েকেও শাস্তি দিতে দুইবার ভাববেন না। এছাড়া আরেকটি খুবই ভয়ংকর কথা হলো, অন্যায় বা ভুল করে পালিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। আইন প্রশাসন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অদৃশ্য ভাবে ছড়িয়ে আছে জামশেদ আফসারের হাত। পালানোর কোন উপায় নেই।

হায়দার সাহেব নানা কথা ভাবছিলেন। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। তাছাড়া তিনি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছেন না এমন একটি ভুল তার হয়েছে।

একসময় আমেনা আফসার উঠে বললেন, আমি একটু বের হচ্ছি।

হায়দার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?

আমেনা আফসার উত্তর করলেন, বাবার ওখানে যাচ্ছি। যে কাজ করেছো এর জন্য তো আমারই কিছু করতে হবে।

আমেনা তার কালো গাড়িটা নিয়ে বের হলেন। জানলা দিয়ে গাড়িটা বের হতে দেখলেন হায়দার সাহেব। স্ত্রীর ব্যাপারে তার ধারণা খুব ভালো না। নিতান্ত লোভে পড়ে বিয়ে করেছিলেন। ক্ষমতার লোভ।

আমেনা আফসার বহুগামী প্রকৃতির মহিলা। সময়ে সময়ে তিনি সঙ্গী পালটাতে পছন্দ করেন। হায়দার সাহেব এটি সহ্য করতে পারেন না। সম্প্রতি একজন বিজনেস ম্যানের সাথে সম্পর্ক হয়েছে তিনি খবর পেয়েছেন। এটি নিয়ে কয়েকদিন আগে তাদের খারাপ ধরনের ঝগড়াও হলো। এমতাবস্থায় আমেনা কি তাকে সাহায্য করবে?

হায়দার সাহেবের অস্বস্থি হলো। তিনি যেন কিছুই ভাবতে পারছেন না।

বিকেলের দিকে ছেলেটি এলো তার বাসায়। মকবুলে হুদা। যে আজ তার স্ত্রীকে খুন করে নিরুদ্দেশ হয়েছে বলে টিভিতে দেখাচ্ছে। হায়দার সাহেবের সামনে সে মুখ কাচুমাচু করে বসল।

হায়দার সাহেব শান্তভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী করলে তুমি? এটাই কি আমি তোমাকে এতোদিন ধরে বুঝালাম? তুমি আমার সকল কিছু শেষ করে দিয়েছো মকবুল।

মকবুল চোখ বড় বড় করে তাকাল হায়দার সাহেবের দিকে। কোন কথা বলল না।

হায়দার সাহেব বলতে থাকলেন, আমি তোমাকে কী বলেছিলাম? আমি বলেছিলাম দিন দেখে কাজ করবে? আজ কি বার? আজ কি শনি মঙ্গলবার? তুমি এটা কী করলে মকবুল! এখন জামশেদ সাহেবের লোকেরা আমাকে ধরতে আসবে, তোমাকেও ধরতে আসবে।

মকবুল জিজ্ঞেস করল, কী করবে স্যার?

হায়দার সাহেব বললেন, কী করবে তারাই জানে।

মকবুল বলল, স্যার পালাইয়া যাই।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হায়দার সাহেব বললেন, জামশেদ সাহেবের হাত থেকে পালানোর কোন উপায় নাই মকবুল। আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। ওরা আসবে।

ওরা আসলো সন্ধ্যায়। কালো পোষাকধারী তিনজন লোক, একটা মাইক্রোবাস নিয়ে। দুইটি লাশ নিয়ে।

হায়দার সাহেব মকবুলকে নিয়ে বাড়ির পেছনের খোলা জায়গায় দু’টি গর্ত করে লাশগুলি মাটি চাপা দিলেন। সব কাজ শেষ হতে হতে অনেক সময় লাগল।

নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে হায়দার সাহেবের খারাপ লাগল না, খারাপ লাগার কথাও না অবশ্য। যে স্ত্রী তাকে ফাঁসানোর জন্য এমন ষড়যন্ত্র করতে পারে তার জন্য খারাপ লাগার কোন মানে হয় না।

মকবুলের কিছুটা খারাপ লাগল তার ভাইটির জন্য। তার ভাই যে এভাবে দিন তারিখের গোলমাল লাগিয়ে তাকে ভুল বুঝাবে আরেকজনের হয়ে, এটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। আর এইজন্যই ভুল দিনে সে খুন করল তার স্ত্রীকে। যে খুন কোন কাজেই লাগল না রেড বুকের লোকদের।

অন্যদিকে, মেজাজ খারাপ হয়েছে জামশেদ আফসারের। এই খুনটি ঠিকঠাক মত করার পরিকল্পনাই করেছিল আলী হায়দার। তিনি জানতেন। সব ঠিকঠাক হলে মঙ্গলবারে লাল তারকাগুলি যখন নিকঠবর্তী হতো পৃথিবীর, সেদিনই লক্ষণযুক্ত মেয়েটির আত্মা দেহ থেকে বের হয়ে যেত, আর তার রক্তপাতের সাথে সাথে খুলে কালো দুনিয়ার প্রবেশদ্বার। জামশেদ আফসার অপেক্ষা করে ছিলেন। অনেকদিনের অপেক্ষা। কিন্তু তারই মেয়ের নির্বুদ্ধিতার কারণে সব ভেস্তে গেল।

[গল্পটি রাইজিং বিডির ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত, ২০১৯ সালে।]