মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » ব্রেইন, সিমুলেশন ও আমাদের রিয়ালিটি নিয়ে প্রবন্ধ

ব্রেইন, সিমুলেশন ও আমাদের রিয়ালিটি নিয়ে প্রবন্ধ

ব্রেইন, সিমুলেশন ও আমাদের রিয়ালিটি নিয়ে প্রবন্ধ

দার্শনিক নিক বস্ট্রোমের আইডিয়া হইল যে আমরা একটা সিমুলেশনের ভেতরে আছি। সহজ কইরা বললে হয় কেউ বা কারা একটা গেইম বানাইছে, কম্পুটার গেইমের মত, আর আমরা সেই গেইমের ক্যারেক্টার। অর্থাৎ, আমরা রিয়াল বলতে যা বুঝি, তা আমরা না। কম্পুটার গেইমের চরিত্রগুলা যেমন রিয়াল না তেমনি আমরাও।

বস্ট্রোমের আইডিয়াটি নতুন না একেবারে। এই লাইনে অনেক সময়ে অনেক লোকই অনেক ভাবে ভাবছেন। যেমন চাইনিজ দার্শনিক জুয়াংজি। তার লেখায় আছে, যার বাংলারূপ,

“একদা আমি এই চুয়াং চু ঘুমাইয়াছিলাম আর স্বপ্নে দেখলাম যে আমি এক অনিন্দ্য সুন্দর প্রজাপতি, রঙবাহারী ডানা মেইলা উইড়া বেড়াই আর মনের খুশিতে উপভোগ কইরা যাই দিন। পরে আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায় আর আমি টের পাই আমি আমিই, চুয়াং চু। এখন আমি বুঝতে পারতেছি না আমি আসলে কী, আমি কি এক লোক যে ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখছিল সে প্রজাপতি হইয়া গেছে, নাকি আমি এক প্রজাপতি যে স্বপ্ন দেখতেছে এখন সে একজন মানুষ। ”

আমার এক প্রিয় গল্প রিপ ভ্যান উইঙ্কল। স্কুলে থাকতে বাংলা সহপাঠে পড়ছিলাম। অনেকবার পড়ছি, আর আমার মনে হয় আমার গল্প লেখার লাইনে হিউজ ইনফ্লুয়েন্স আছে এই গল্পের। মানে, এইরকম গল্পই আমি লেখব, এমন একটা ইচ্ছা ছিল মনের মধ্যে হয়ত।

ভ্যাগাবন্ড টাইপের চরিত্র ভ্যাং উইঙ্কল পরিবারের লোক রিপের। বউয়ের সাথে তার নিত্য ঝগড়া, কারণ পরিবারের কোন কাজে তার আগ্রহ নাই, কিন্তু এমনে অনেকের উপকার কইরা বেড়ায়। সেই রিপ একদিন তার কুকুরটা, এবং বন্দুকটা নিয়ে বাইর হইছিল শিকারে বৌয়ের চেঁচামেচি থেকে বাঁচতে।  ক্যাটস্কিল পাহাড়ে অদ্ভুত দর্শন কিছু লোকের সাথে রিপের দেখা হয়, তাদের দেয়া পানীয় পান করে সে আর পরে ক্যাটস্কিল পাহাড়ের মায়ায় রিপ ঘুমাইয়া পড়ে একসময়। ঘুম থেকে উইঠা দেখে চলে গেছে বিশ বছর।  চারপাশ বদলাইছে, নিজের এলাকায় ফিইরা আইসা দেখে আগের মানুষজনও আর নাই।

ওয়াশিংটন আর্ভিং এই গল্পটি লেখছিলেন প্রচলিত লোকমুখের গল্পের উপর ভিত্তি করে।  বিশেষত খ্রিস্টানিটিতে সাত ঘুমন্ত ব্যক্তির গল্প আছে যারা একজন রোমান সম্রাটের অত্যাচার থেকে বাঁচতে নিজেদের সব কিছু দান কইরা দিয়া একটা গুহার মধ্যে ঘুমাইয়া পড়ছিলেন।  রোমান সম্রাট গুহার মুখ বন্ধ কইরা দিলেন।

তারপর অনেক অনেক দিন পরে, যখন খ্রিস্টান ধর্মের জয় ঘোষিত হইছে, তখন একজন কী কাজে গুহার মুখ খুইলা দেখেন ভিতরে রইছেন সেই সাত ঘুমন্ত ব্যক্তি। তারা ঘুম থেকে উইঠা মনে করতে থাকেন গেছে মাত্র একদিন।

এই গল্প কুরানের সুরা কাহাফেও (৯-২৬) আছে একটু ভিন্নভাবে। এই লোকগুলারে বলা হয় আসহাবে কাহাফের লোকগুলা। কুরানের ভাষ্যমতে তাদের সাথে এক কুত্তাও ছিল। নাম কিতমির। তারা ঘুমাইছিলেন তিনশো নয় বছর।

ছয় বা সাত শতকের একজন গ্রীক দার্শনিক কবি, আধা মিথিক্যাল চরিত্র হইলেন ক্রিটের এপিমেনিডেস। তারে নিয়াও এমন গল্প আছে। তারে তার বাপ ভেড়া চড়াইতে দিছিলেন, আর তিনি এক গুহায় গিয়া ঘুমাইয়া পড়েন। গল্পে কথিত, তিনি ঘুমাইছিলেন ৫৮ বছর।

কল্কি পুরাণে আছে অনন্তমুনির কথা। সেইটাও ইন্টারেস্টিং গল্প। সাধারণ এক ব্রাহ্মণের পোলা, বাড়ি ওরিশার পুরিকায়। বিয়ে শাদী কইরা  সুখে বসবাস করতেছিলেন, এমতাবস্থায় তার বাবা মা গত হন। মা বাপ হারাইয়া দুঃখে তিনি বেশি বেশি বিষ্ণুর নাম জপ করতে থাকেন।

একদিন স্বপ্নে দেখলেন বিষ্ণু তারে বলতেছেন, কি মিয়া, মা বাপ স্ত্রী পুত্র নিয়া এত দরদ কেন তোমার? জানোনা এগুলার সবই আমার মায়ার খেলা?

অনন্ত মুনি, তখনো মুনি হন নাই। তিনি ভাবলেন এই কথাটা তো ঠিক না। স্ত্রী পুত্র বাপ মা আমি দেখতেছি স্বচক্ষে। এইগুলা মায়া হয় কেমনে! তিনি বিষ্ণুরে তার আপত্তি জানালেন।

উত্তরে বিষ্ণু বললেন, যে এই মায়ায় জড়াইব তার কপালে দুঃখ আছে।

অনন্ত মুনির মনে সংশয় ভর করল। তবুও তিনি বিষ্ণুর আরাধনা কইরা গেলে। গান, নাচ, জপে গেল বারো বছর।

একদিন সমুদ্রে স্নান করতে গিয়া তিনি পড়লেন ঝড়ের কবলে। বড় বড় ঢেউয়ে জ্ঞান হারাইলেন তিনি।

জ্ঞান ফিরার পরে দেখলেন তিনি এক ব্রাহ্মণের ঘরে। ইনি তারে বালু তটে পাইয়া ঘরে আনছেন। অনন্ত মুনি তার ঘরে থাকতে লাগলেন। তার কোন স্মৃতি ছিল না। ব্রাহ্মণ নিজের মেয়ের সাথে তার বিয়া দিলেন। অনেক দিন গেল। অনন্ত মুনির পাঁচ ছেলে হইল।

বড় ছেলের বিয়ার দিনে প্রথামত সমুদ্র স্নান করতে গিয়া ডুব দিলেন অনন্ত মুনি। আর উঠলেন সেই পুরীর ঘাটে। ত্রিশ বছর আগের সময়ে। উইঠা দেখেন সেই আগের মানুষজন, তিরিশ বছর আগের সময়!

তার তো তখন মাথা খারাপ অবস্থা।

পরিচিত লোকেরা যারা ঘাটে ছিল তারা অনন্ত মুনির রকম সকম দেইখা পাড়ে বসা এক সন্ন্যাসীর কাছে তারে নিয়া গেল। তারা বলল, বাবা পোলাটা ভালো ছিল। একটু আগে ডুব দিল। এখন উইঠা উলটা পালটা আচরণ করতেছে। মাথাটা গেছে। বদ বাতাস লাগছে মনে হয়। আপনে একটু দেখেন।

সন্ন্যাসী কয়েক মিনিট তাকাইয়া রইলেন অনন্ত মুনির দিকে। এরপর বললেন, তুমি অনন্ত না? এইখানে কি করতেছ তুমি অনন্ত? আজ না তোমার বড় পোলার বিয়া? আর তোমার বয়স কমলো কেমনে? তোমার পোলার বিয়াতে আমারো তো দাওয়াত ছিল। আমিই বা কী করতেছি এইখানে বইসা?

এইভাবে বিষ্ণু অনন্ত মুনিরে দেখাইয়া দেখান সকলই তার মায়া।  সিমুলেশন, বিষ্ণু কোডার বা সেই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বানানেওয়ালা।

বিষ্ণু বা সেই কোডার তার বানানো ক্যারেক্টারের ভিতরেই কোড মাইরা দিয়া দিছেন তার প্রতি ভক্তির বীজ, এমন ধরা যাক। এইজন্য সেই অজানা ক্রিয়েটরের প্রতি ভক্তি তৈরি হয় সকলের।  নিউ এথিস্টেরা যদিও একদিকে যুক্তি দেখাইয়া বলেন রিলিজিয়ন খারাপ কারণ সভ্যতায় ভালো কিছু তারা করে নাই, খারাপই করেছে।  কিন্তু আসলে নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায় সভ্যতার বিকাশে রিলিজিয়নের বা সেই কোডারের প্রতি ভক্তির একটা দরকার ছিল। এই দরকারটা নেপোলিয়ন যেমন বলছিলেন, রিলিজিয়ন হইল সাধারণ লোকদের  নিরব রাখার মহা ঔষধ।  রিলিজিয়নের কারণেই গরীবগুলা ধনীদের খুন করা থেকে বিরত থাকে।”

এই ফাংশনটা খুব ফালতু না, একটু ভাবলেই দেখা যায়। কারণ গরীব তো বেশিরভাগই মানুষ। এরা যদি সংখ্যায় কম ধনীদের অধীনতা না মেনে নিত তাইলে তো সভ্যতাই দাঁড়াইত না ধরায়।

দুনিয়ার ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, প্রাচীনকালে অনেক অনেক সোসাইটিতে হিউমেন স্যাক্রিফাইস তথা মানুষ বলিদানের প্রথা চালু ছিল। বলিদান করা হইত কোন দেবতারে বা পূর্বপুরুষের আত্মারে তুষ্ট করতে। ইনকা সভ্যতার মত শৈল্পিক সভ্যতাতেই এর প্রচলন ছিল। এইসব  বলিদানের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সমাজের প্রধান ব্যক্তিরা বলি দিত যাদের তাদের সামাজিক মর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান সবসময়েই নিচা থাকত।

এর কারণ নিয়া বলতে গিয়া গবেষকেরা যে ব্যাখ্যা দেন তা হইল, সমাজের উঁচা শ্রেণী সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে এইসব বলি দিয়া ভীতি তৈরি করতো, যাতে তাদের চাইতে সামাজিক অবস্থানে যারা নিচা তারা ভয়ে তাদের অধীনতা মাইনা চলে।

নৃতাত্ত্বিক হার্ভে হোয়াইটহাউজ সেশাত নামে একটা ডেটাবেইজ করছেন, গত ১০ হাজার বছরের দুনিয়াজুড়া বিস্তৃত ৪০০’র বেশি সমাজের ডেটা নিয়া, যেইখানে হিউম্যান স্যাক্রিফাইস বা বলিদানের ফাংশন নিয়া ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে গবেষণা করা হইতেছে। মূল যা পাওয়া গেল, তা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ, পলিটিক্যাল ফাংশনই সার্ভ করত এই বলিদান। বিশেষত যারা এলিটদের জন্য থ্রেট মনে হইত বা এলিটদের শুভদৃষ্টির বাইরে চলে যাইত তাদের ভাগ্যেই নাইমা আসত বলিদান।

তবে এইটাই শেষ কথা না। সোসাইটি যখন বড় হইত, বিভিন্ন জাতের মানুষ নিয়া, তখন আর বলিদান দিয়া মানুষরে কন্ট্রোল করা যাইত না। সেশাত গ্রুপ এই সংখ্যা দিছেন আনুমানিক ১০০,০০০। এর উপরে গেলে বলিদান দিয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাইত না। এই জায়গায় বিগ রিলিজিয়নের কাজের জায়গা আসে। যেমন জুদাইজম, জথোরুস্ট্রিয়ানিজম এইগুলার জন্ম রাফলি প্রথম মিলেনিয়াম বিসিতে। এইগুলা বিগ এক গডরে নিয়া আসে সেই বড় ও জটিল সমাজের জন্য, যেইখানে মানুষ বলিদান প্রথা বাতিল হইয়া যায়।

ফ্রেঞ্চ দার্শনিক রেনে জিরার্দ যে থিওরি দিছিলেন মানুষ বলিদান নিয়া, তার সাথে এই নৃতাত্ত্বিক গবেষণার ফাইন্ডিংস নিয়া, অন্য এক ব্যাখ্যা দেয়া যায়। জিরার্দের কথা ছিল, অন্য সব মিথ যেইখানে লেখা হইছে মানুষরে বলিদান করতেছে বা দানব হিসাবে মাইরা ফেলতেছে এমন মানুষদের দিক থেকে, সেইখানে বাইবেল বলে বলিদান হইতেছে যে বা যারে মারা হইতেছে তার দিকের গল্প।  জিরার্দ এইভাবে বাইবেলের ইউনিকত্ব নিয়া বলতে চাইছেন, ধর্মকেন্দ্রিক বিশেষত্ব প্রমাণ তার এক উদ্দেশ্য ছিল।

কিন্তু দুনিয়ার পুরান সমাজগুলি নিয়া গবেষণার ফল বা মানুষ বলিদানের ফাংশনের দিক থেকে দেইখা জিরার্দের বলতে চাওয়া খ্রিস্টানিটির (বা জুদাইজম বা ইসলাম) বিশেষত্বরে প্রশ্ন করতে পারি।

এইখানে বলা যায়, বিগ গডের ধর্মগুলা পরিবর্তিত বড় সমাজের জন্য, জটিল সমাজের জন্য আরেক সমাধান হাজির করে। কারণ বলিদানের সিস্টেম বা সমাধান এইখানে কাজ করতেছিল না। সমাজই তার সমাধান বাইর করছে ভিন্ন গল্প ও ব্যাখ্যা বাইর কইরা।

ফলে কোডের ভিতরে থাকা রিলিজিয়াস প্রেরণা বা রিলিজিয়নের প্রতি আকাঙ্খার একটা কার্যকরী উদ্দেশ্য সব সময়েই ছিল।

বিগ রিলিজিয়নের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হইল রীতিনীতি। রিলিজিয়ন কখনোই দুনিয়া কেমনে তৈরি হইছে বা কেমনে ফাংশন করে তা বাইর করার জন্য হয় নাই। রিলিজিয়ন গল্পাকারে একটা ব্যাখ্যা দেয়, এবং এই দিয়াই সে তার এ সংস্লিষ্ট কাজ শেষ করে। রিলিজিয়নের মূল কাজ সবসময়েই ছিল এই বড় ও জটিল সমাজে কেমনে মানুষ বাস করবে তার রীতিনীতি ঠিক করা ও তা মানুষরে মানাইয়া চলানো।

রিপ ভ্যান উইঙ্কল, অনন্ত মুনি, বা আসহাবে কাহাফ ইত্যাদি, এইসব গল্পের কমন ব্যাপারটা হইল এরা রিয়ালিটিরে, বা সময় বিষয়ক সাধারণ ধারণারে প্রশ্ন করে।

অর্থাৎ, এই যে রিয়ালিটি আমাদের এইটা নিয়া, এইটা বাস্তব কি না, বা বাস্তব হইলে কেমন বাস্তব, তার সীমা কতটুকু এইগুলা নিয়া প্রায় সময়েই প্রশ্ন তোলা হইছে।

সিমুলেশন হাইপোথিসিসের মূল ভিত্তি হইল এই ধারনা যে, প্রতিটা উন্নত সভ্যতা আরো অনেক সিমুলেশন তৈরি করে।

যেইটা আমরা নিজেদের দিকে তাকাইয়াই দেখি। আমরা উন্নত সভ্যতা। আমরা নানা ধরণের সিমুলেশন (যেমন কম্পুটার গেইম) বানাই। এবং খেয়াল করলে দেখবেন এইসব গেইমের চেহারা রাতারাতি আকাশ পাতাল চেইঞ্জ হইতেছে। মানে সাত আট বছর আগে যে আপডেটেড গেইম ছিল সেইটা এখনকার নতুন গেইমের তুলনায় একেবারে সাধারণ মনে হবে। কারণ দ্রুত উন্নত হইতেছে আমাদের সিমুলেশন তৈরি করার প্রযুক্তি তথা ক্ষমতা। এখন এমন অবস্থা হইছে যে, বানানো ভিডিও আর বাস্তব ভিডিওর মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ছে, আর ফিউচারে তা আরো কঠিন হবে।

এইজন্য ডীপ ফেইক প্রযুক্তি দ্বারা তৈরি ফেইক ভিডিও এবং আসল ভিডিওর মধ্যে পার্থক্য বাইর করার আইডিয়া আহবান করতেছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলি ও এর জন্য তারা দিতেছে অনেক বড় পুরস্কার।

লজিক্যালি আমরা যদিও এইভাবে ভাবতে পারি যে, যেহেতু উন্নত সভ্যতা আধুনিক সিমুলেশন তৈরি করতে পারবে, এবং যেহেতু পৃথিবীর বাইরে উন্নত সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি, তাই খুবই সম্ভব যে আমরা আছি অন্য কোন উন্নত সভ্যতার তৈরি সিমুলেশনে।

এই তর্কের বাইরেও আরেকটা প্রশ্ন করা যায়, সিমুলেশনে থাকলে এক প্রজাতি বা ক্যারেক্টার কীভাবে বুঝবে সে সিমুলেশনে আছে?

একটা কম্পুটার গেইমের ক্যারেক্টার নিয়াই আমরা ভাবতে পারি। কমন একটা ভিডিও গেইম, জিটিএ ভাইস সিটির মেইন ক্যারেক্টার যখন গেইমে বাস করতেছে, তখন ধরা যাক হঠাত তার মাথায় এই প্রশ্ন উদয় হইল যে, আমার যে রিয়ালিটি এই রিয়ালিটি কি আসলেই রিয়াল?

তখন, সে গেল খুঁজতে যে আসলে সে কী। কী দিয়া গঠিত সে। একেবারে মূলে তার কী আছে।

তার যেহেতু কিছু কনশাসনেস জন্মাইছে, তাই সে খুঁজতে লাগল। ধরা যাক একেবারে কণা লেভেলে চলে গেল সে। সে তখন কী পাবে, সে কী দিয়া গঠিত?

সে মাটি বা পাথর বা কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত নয়। সে আসলে যা পাবে তা আসলে কিছুই না। সে তার মূল গাঠনিক বস্তু হিসেবে কিছুই পাবে না।

আমরা যখন আমাদের মূল বস্তু হিসেবে আমরা কী দিয়া গঠিত তা খুঁজতে যাই, তাহলে আমরা কী পাই? কোয়ান্টাম লেভেলে গেলে কিছুই পাই না। পাই অদ্ভুততা ও সম্ভাব্যতা। আর কিছুই পাই না। নাথিং।

কোয়ান্টাম ফিজিক্স হইল আমাদের মূল জানার জ্ঞান, সাব এটমিক লেভেলে গিয়া দেখতে চায় আমরা কী। কিন্তু সেইখানে এতো এতো অদ্ভুততা আছে, যে মাথাপাগল দশা হয় আমাদের। কোয়ান্টাম জগতের মহাবিজ্ঞানি নীলস বোর বলছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিকস যদি আপনারে উরাধুরাভাবে শক না কইরা থাকে, তাইলে আপনে জিনিসটা আসলে বুঝেন নাই।

আমাদের কমন সেন্সে আমরা যেইভাবে বুঝি বস্তু ক্রিয়া করে, সময় ক্রিয়া করে তার অনেক কিছু কোয়ান্টাম লেভেলে গিয়া ঠিক থাকে না।

ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট নামের বিখ্যাত পরীক্ষাতে দেখানো হইছিল “আমরা বাস্তবের দিকে না তাকাইলে সেই বাস্তব আর থাকে না।”

এই কথাটা আমার না, অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী এন্ড্রু ট্রুসকটের।

ডাবল স্লিট পরীক্ষাতে দেখা হইছিল, আলোর দিকে তাকাইলে আলো কণা হিসেবে আচরণ করে, আবার না তাকাইলে আচরণ করে তরঙ্গ হিসেবে।

মানে, আপনি তাকাইলে সে এক জিনিস, না তাকাইলে সে অন্য জিনিস।

আলো বা ফোটন কী হবে কণা বা তরঙ্গ তা নির্ভর করে আপনি তার দিকে তাকাইবেন কী তাকাইবেন না তার উপর।

এই তাকানোটা ফিউচার ইভেন্ট। এই ফিউচার বা ভবিষ্যতই নির্মাণ করছে অতীতরে।

কোয়াণ্টাম লেভেলে এটা আরেক পরীক্ষিত বাস্তবতা।

এটি এক ধরণের অপটিমাইজেশন ধরা যায়। যখন ভাইস সিটি গেইম বানানো হয় বা অন্য কোন গেইম বানানো হয় তখন যিনি বা যারা গেইম বানাইতেছেন তিনি আসলে সর্ব শক্তিমান না। সর্ব শক্তিমান বলতে আসলে কিছু নাই। কিন্তু একটা পর্যায়ে আমাদের গেইমের ক্যারেক্টার ভাবতে পারে তার স্রষ্টা সর্ব শক্তিমান।

ভাইস সিটির মূল চরিত্র গাড়ি দিয়ে যাইতেছে, তার পাশের রাস্তাঘাট জনমানুষ ইত্যাদি দ্রুত বদলাইতেছে, দ্রুত নাই হইয়া যাইতেছে। আমরা বুঝতে পারি আসলে ঐ রাস্তাটা নাই যে রাস্তায় ক্যারেক্টার যাইতেছে না। ঐ জনমানুষ নাই যার দিকে সে তাকাইতেছে না।

গেইম যিনি বানাইছেন তিনি সব বানান নাই, যা দরকার নাই তা বানান নাই। কারণ রিসোর্সের সীমাবদ্ধতা আছেই। তিনি বুদ্ধিমান হইলেও অফুরন্ত না তার ক্ষমতা।

ভাইস সিটির ক্যারেক্টার এটা খেয়াল করল ধরা যাক। তখন তার সন্দেহ আরো গাঢ় হইল। কারণ এমন যেহেতু হইতেছে, তাকাইলে একরকম আর না তাকাইলে ভিন্ন, তাইলে একটা অপটিমাইজেশন করা হইছে এইখানে।

আমাদের বাস্তবতারে কোয়ান্টাম লেভেলে, অর্থাৎ কণা ও ততোধিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভাগ কইরা দেখতে গেলে আমরাও এমন জিনিস পাই।

দার্শনিক স্ল্যাভোয় জিজেক মজা কইরা বলেন, ‘এইটা হয় কারণ যে বানাইছে সে হয়ত ভাবে নাই এই মানুষগুলা অতদূর পর্যন্ত যাইতে পারবে। তাই কোন নিয়ম মাইনা করে নাই ঐ জায়গায়। উলটা পালটা কইরা রাখছে।’

কিন্তু মানুষ গেছে সেই জায়গায়। গিয়া তার মাথা হ্যাং হইয়া যাইতেছে কারণ বাস্তবতার অন্যান্য সূত্রাবলী কেন এইখানে কাজ করতেছে না এইটা সে বুঝতে পারতেছে না।

আর সবচাইতে ইন্টারেস্টিং কথা এখানে, ফিউচার নির্মাণ করতেছে অতীতরে। ফিউচারে আপনি তার দিকে তাকাইবেন কি না এর উপর নির্ভর করতেছে রিয়ালিটি কী আচরণ করবে।

এই অবস্থায় আমরা সাইকোলজিতে যাই, নিউরোসাইন্সে যাই। মানুষের ব্রেইন কিভাবে কোন ঘটনারে দেখে ও মনে রাখে সে ব্যাপারে সবচাইতে যৌক্তিক এক থিওরি হইল, যা মানুষ অভিজ্ঞতায় করে তার সবই হুবহু ব্রেইনে স্মৃতি আকারে জমা করে না।

সাইকোলজির এক্সপেরিমেন্টে দেখা গেছে মানুষের এক্সপেরিয়েন্সিং সেলফ, আর রিমেম্বারিং সেলফ আলাদা।

আপনি দিনটা আসলে কেমন কাটাইলেন তা হুবহু আপনার স্মৃতিতে জমা থাকবে না, থাকবে কিছু পিক পয়েন্ট আকারে। অর্থাৎ অতি ভালো ও অতি খারাপ পয়েন্টের হিসাবে। সাইকোলোজিস্ট ড্যানিয়েল কায়নেম্যানের টেড টক আছে এই বিষয়টা নিয়া।

স্মৃতি নিয়া নিওরোসাইন্সের আধুনিক গবেষণা আবার আরো অদ্ভুত কথা বলে। সেইটা আমি জানতে পারছি নিউরোসাইন্টিস্ট ও সাবেক হ্যাকার প্রফেসর সেরফ মোরানের লেকচার থেকে।

স্মৃতি আসলে অতীতের হুবহু স্মৃতি না বরং যতবার আমরা স্মৃতিরে মনে করি ততোবার আমরা ঘটনাটা নির্মাণ করি।

ধরা যাক, আমি আপনারে জিজ্ঞেস করলাম, ক্লাস ওয়ানে আপনার সেরা স্মৃতি কী কী।

আপনি তা মনে করার চেষ্টা করলেন। দুই একটা জিনিস মনে পড়ল। আমারে বললেন।

এরপরে আপনি আবার স্বয়ংক্রিয় ভাবে এইটা জমা করবেন। এই জমাটা কিন্তু আগের স্মৃতি না। বরং এখন যে আমারে বললেন সেই অনুমান, এই অনুমানই আপনার নয়া স্মৃতি বানাইল ঐ ঘটনার। এক সপ্তাহ পরে আপনারে একই প্রশ্ন আরেকজন জিজ্ঞাসা করলে আপনি তারে নতুন ভার্সনটাই শুনাইবেন।

এইভাবে আমরা আসলে স্মৃতি নির্মাণ করি প্রতিবার মনে কইরা, ও এইটা নিয়া কথা বইলা।

থেরাপি এই ভাবে কাজ করে। সাইকোথেরাপির জনক ফ্রয়েড এটা জানতেন কি না কে জানে। নিউরোসাইন্স তখন তো এমন আধুনিক ছিল না। হয়ত জানতেন না পরীক্ষিত ভাবে, কিন্তু তার অনুমান ছিল মনে হয়। নাইলে কথাবার্তা বইলা সুস্থ করা বা টকিং কিওরের ধারণা তিনি পাইতেন না।

ফ্রয়েডরে আমার সেরা মনে হয় কারণ গণ্ডিভাঙ্গা চিন্তা করার ক্ষমতা ও সাহস তার ছিল। একজন সাইকোথেরাপিস্ট ফ্রয়েডের গুরুত্ব কী বলতে গিয়া বলছিলেন, তিনি রোগীদের প্রাইভেসি দিছিলেন ও এমন সব কথা তারা বলতে পারত তার কাছে যেইটা তারা অন্যত্র বলতে পারত না। ইউরোপিয়ান চিকিৎসায় এর চল ছিল না। বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। তারা রেইপ হইছেন বা এবিউজের শিকার হইছেন ইত্যাদি। এইসব কথা বলার স্পেইস তৈরি কইরা গেছেন ফ্রয়েড।

এইজন্য হিউম্যান সাইকোলজি বুঝার ক্ষেত্রে বা এ সংস্লিষ্ট জ্ঞাণ দুনিয়ায় তার গুরুত্ব বজায় থাকবে, ইভেন তার থিওরিগুলা আধুনিক নিউরোসাইন্স ভুল প্রমাণ কইরা দিতে থাকলেও।

আধুনিক নিউরোসাইন্সের এই আবিষ্কার, যে অতীত স্মৃতি কী, ও আমরা কীভাবে তা আসলে বার বার নির্মাণ করে যাই, এটি সাইকোথেরাপি ক্যামনে কাজ করে তা বুঝাইয়া দেয়।

থেরাপিস্টেরা পেশেন্টরে কথা বলান। যেমন আপনারা ডনি ডার্কো, বা সপ্রানোজে দেখছেন। কথা বলতে বলতে লোকটা ঐ স্মৃতি নিয়া বলে, হয়ত তার কোন ট্রমা নিয়া। যেইটা তারে কষ্ট দিতেছে। বলতে বলতে নতুন অনুমান হয়। প্রতিবার বলাই নতুন ভিন্ন অনুমান। আর মাঝে মাঝে থেরাপিস্ট নিজের ইনপুটও দেন, যে হইতে পারে জিনিসটা এইরকম না ঐরকম। এইভাবে পেশেন্টের পুরান স্মৃতি, যা তারে অসুস্থ বানাইছিল তা সরাইয়া নতুন স্মৃতি নির্মান করে দেন।

এই আবিষ্কার এইটাও বুঝায় যে মানুষের ব্রেইন বদলায়, চিন্তা বদলায়, স্মৃতিও বদলায়। ফলে, মানুষরে বদলানো যায় না, বা যে যেমন আছে তেমনই মাইনা নিতে হবে, এমন ধারণা আসলে ভুলই হয়।  এবং নিউরোসাইন্স বলে যে, একজন তার ব্রেইনরে ট্রেইন করতে পারবেন, যেমন বডিরে জিমে ট্রেইন করে চেইঞ্জ করা যায়।

এইটা একটা সমস্যা যেইটাতে আমি দীর্ঘসময় পড়ছিলাম, যে মানুষরে চেইঞ্জ করা যায় কি না। আমি আমার এক কর্মক্ষেত্রে নলেজ শেয়ারিং সেশন শুরু করি। যেইদিন প্রথম প্রেজেন্টেশন হয় ওইদিন বিকালে একজন বুদ্ধিমান কলিগের সাথে দীর্ঘ আলাপ হয় এ নিয়া। তার কথা ছিল মানুষরে চেইঞ্জ করা যায় না তাই এগুলি করা আসলে সময় নষ্ট।

কিন্তু আমার অনুমান ছিল করা যায় মানুষরে চেইঞ্জ। কারণ আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখতে পারি চিন্তা করার ক্ষমতা ডেভলাপ হয়। ভালো বই পড়লে, ভালো লেকচার শুনলে বা কোর্স করলে এর ইম্প্যাক্ট পড়ে ও চিন্তাই চেইঞ্জ হয়। চিন্তা চেইঞ্জ হওয়া মানে ব্রেইনই বদলে যাওয়া। ব্রেইন তখন আরেকবার একটা প্রবলেমরে অন্যভাবে দেখবে।

এই কারণে ক্রিটিক্যাল জিনিসপত্র পড়তে বা বুঝতে কষ্ট হয়। কারণ ব্রেইনের জন্য তা চ্যালেঞ্জিং। আবার এগুলা করতে থাকলে অনেকদিন পরে ইজি হয়ে যায়। ঠিক জিমে মাসল ট্রেইনিং এর মত। জিমে গিয়ে কেউ পাঁচ কেজি দিয়ে বাইসেপ এক্সারসাইজ করতে থাকলে শুরুতে তার কঠিন লাগবে। একসময় ইজি হয়। কিন্তু সে যদি ওয়েট না বাড়ায় তাহলে তার মাসল চ্যালেঞ্জ নিবে না, ফলে গ্রোথও হবে না।

এইখানে আমার এক বন্ধুর কথা বলা যায়। সে একবার বলছিল, এইসব কঠিন বই কেন আমার ভালো লাগে না। হুমায়ূন আহমেদ যেমন ভালো লাগে। নাকি কেবল হুমায়ূন আহমেদই লাইফে পড়ছি বলে এইগুলা ভালো লাগে না?

যথেষ্ট স্মার্ট হবার কারণে লাস্ট লাইনে সে নিজের অবস্থার ডায়াগনোসিস নিজেই করে ফেলতে পারছে। ব্রেইন চ্যালেঞ্জ না পেলে তার থিংকিং পাওয়ার গ্রো করবে না। একইজিনিস মেন্টাল টাফনেসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

মেমোরি জিনিসটা অদ্ভুত। যদি কোন ব্যক্তি সব কিছু মনে রাখতে পারে, এইরকম আশ্চর্য ক্ষমতা যদি তার হয়, তাইলে সে একটা দুর্দশাতেই পতিত হবে। বোর্হেস তার এক গল্পে এই বিষয়টা নিয়া বলছিলেন, এক লোক ঘোড়া থেকে পইড়া গিয়া সব মনে রাখতে পারার অবস্থায় চলে যায়। এবং আসলেই দুনিয়াতে এমন কিছু কিছু লোক আছেন যারা প্রায় সকল কিছু মনে রাখতে পারেন।

বোর্হেস আসলে এক ধরণের সলিপসিস্ট ছিলেন, যে মনে করে তার কনশাসনেসই সব কিছু তৈরি করতেছে। বোর্হেসের গল্পে ফিরে ফিরে তাই এই থিমই আসে। হাছন রাজা যেমন বলছিলেন আমা হইতেই তৈরি হইল আসমান জমিন। বা রবীন্দ্রনাথ লেখলেন আমার স্পর্শে পান্না হলো সবুজ।

অর্থাৎ, আমাদের ব্রেইনের মধ্যেই ফোকাস করতেছি। আসলেই কি আমি দেখি তাই কোন বস্তু আছে? অর্থাৎ, আমার কনশাসনেসই কি তারে বানায়? কোয়ান্টাম ফিজিক্স তো এই কথাই বলতে চাইল, যে সাব এটমিক লেভেলে এইটাই সত্য।

আমাদের যে ব্রেইন তারে যদি আর্টিফিশিয়ালি ডিজাইন করা হয়ে থাকে, একটা কম্পুটার প্রোগ্রামের মত, যা একটা রিয়ালিটি তৈরি করবে ও তা বিশ্বাস কইরা বাস করবে, এটা সম্ভাবনা হিসেবে একেবারে অসম্ভব না।

আমাদের আবেগগুলা, আমাদের থিংকিং ব্রেইনের নিউরণের ভাষায় কিন্তু আলাদা না। দুইটাই নিউরণে নিউরণে ইলেক্ট্রিক সিগনাল হিসেবে প্রবাহিত হবে। আমরা পরবর্তীতে কোনটারে আবেগ ও কোনটারে নাম দিছি চিন্তা।  এইটা কালচারাল কারণে। কালচারই আমাদের বুঝাইছে কোনো সিগনাল আবেগ আর কোনো সিগনাল থিংকিং।

এই জায়গায় আসলে ব্রেইনরে নিয়া ভাবতে হয় যে, যেহেতু বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসরণের কারণে ব্রেইণের চিন্তা, আবেগ নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই এইগুলির অতি বা অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণই চিন্তার সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেইটা হয় মানসিক নানা সমস্যায়।

তবে ব্রেইন বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানের তথা মানুষের জানাশোনা খুবই কম। একটা জিনিস ড্রিম, যেমন আমরা স্বপ্নে নানা জিনিস দেখি। স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন, তার ভিতরে স্বপ্ন, যেইটা আমরা দেখছিলাম ক্রিস্টোফার নোলানের ইন্টারেকশন ফিল্মে। ড্রিম আর্কিটেকচার। নোলান এইটা নিয়া সিরিয়াসলি আগ্রহী ছিলেন। রিয়ালিটি কী, বা অস্তিত্বের প্রশ্ন এইটাই নোলানের ফিল্মোগ্রাফির মূল লাইন।

নোলান স্বপ্ন বিষয়ে একটা প্রজেক্টে কাজ করানোর জন্য যোগাযোগ করছিলেন অধ্যাপক সেরফ মোরানের সাথে। প্রজেক্টটা ছিল স্বপ্ন রেকর্ড করা বিষয়ে। মোরান একদিন সময় নিয়া চিন্তা কইরা জানাইলেন এইটা অসম্ভব। কিন্তু পরে মোরান দেখলেন, জাপানিজ একজন বিজ্ঞানী এটা নিয়া কাজ করছেন। তার ভুল ভাঙ্গে আর তিনিও কাজ শুরু করেন।

মানুষের ঘুমের সময়ে তার মেমোরির রি-এরেঞ্জ হয়। ব্রেইন কোন জিনিস গুরুত্ব দিবে তা এইসময় ঠিক করে। ফলে, ঘুমের একটা সময়ে যদি কোন মানুষরে ইন্সট্রাকশন দেয়া হয়, তাইলে সে অনুযায়ী সে কাজ করে দেখা যায় জাগনা হওয়ার পরে। যেমন, সিগারেটখোরদের নিয়া পরীক্ষায় এইভাবে ঘুমের নির্দিষ্ট উইনডোতে ঐ ব্যক্তির নাকে নিকোটিনের গন্ধ আর সাথে সাথে পচা ডিমের গন্ধ দেয়া হইল। ব্রেইন এইটা ডিটেক্ট করল। নিকোটিনের সাথে পচা ডিমরে সম্পর্কিত করে রাখল সে। পরে ঘুম থেকে জাগলে দেখা গেল ঐ লোকের সিগারেট আসক্তি অনেক কমছে।

এইভাবে কাজ করতে করতে নিউরোসাইন্স আগাইতেছে। এই লেখাতে দুই প্যারা আগে আমি নোলানের ফিল্মের নাম ইনসেপশন না লেইখা যে ইন্টারেকশন লেখছি, এটাও ব্রেইনরে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস। যাতে আপনার মনযোগ বাড়ে। কারন অভিয়াস ভুল দেখতে পাইয়া আপনার ব্রেন উদ্দীপ্ত হইয়া উঠবে, ও আরো ভুল খুজতে থাকবে। এতে মনযোগ বাড়লো।

একটা ফিল্ম আছে সোর্স কোড নামে। জ্যাক গিলেনহাল অভিনয় করছেন। এই ফিল্মটা একটা সাইন্স ফিকশন। ব্রেইন দিয়া অল্টারনেট রিয়ালিটি বা আলাদা বাস্তবতা তৈরি করার এক গল্প দেখানো হইছিল সেই ফিল্মে।

একটা ট্রেইনে বোমা হামলা হয়। অনেক লোক মারা যায়। পুলিশ ক্লু পায় যে এইটা সিরিজ বোমা হামলার প্রথম ব্লাস্ট। আগামীতে আরো হবে। এখন তারা বাইর করতে চায় পরবর্তী হামলা কই হবে।

এইজন্য তারা হামলায় মৃত লোকদের মেমোরির সাহায্য নিয়া ঐ বোমা হামলাকালীন সময়টারে পুননির্মান করে কম্পুটারে। এবং একজন আফগানিস্তানে যুদ্ধে মইরা যাওয়া সেনার ব্রেইনরে সেই ট্রেইনে পাঠায়, এক মিশনে। তার কাজ হইল হামলাকারীরে খুইজা বের করা ও সেই তথ্য জানানো। কারণ এই তথ্য পাইলেই পরবর্তী হামলা ঠেকানো যাবে।

জ্যাক গিলেনহাল এইখানে সেই মৃত সেনা ছিলেন। তার খালি ব্রেইন জীবিত। কিন্তু প্রথমদিকে এইটা নায়ক বা দর্শক কেউ বুঝতে পারে না। ট্রেইনে একটা মিশনে তারে পাঠানো হইছে এইটাই বুঝা যায়। কিন্তু একসময় নায়ক বুঝতে পারে আসলে এই বাস্তবতাটা আসলে তৈরি করা ও হামলা আসলে হইয়া গেছে আসল বাস্তবতায়। সে এইটাও জানতে পারে যে, আসলে সে আফগানিস্তানে মারা গেছে। এরিস্টটলিয়ান টার্মে এইটাই ছিল তার এনাগনোরাইসিস। যেইখানে নায়ক এমন এক সত্য আবিষ্কার করে যেইটা সে আগে জানত না।

এই এনাগনোরাইসিসই আমাদের হবে, (বা হইছে) যখন আমরা বাইর করতে পারব বা বুঝতে পারব যে আসলে আমাদের চারপাশের বাস্তবতাটা আসলে বাস্তব না, বরং তৈরি করা এক বাস্তব। যেইখানে আমাদের হয়ত বানান হইছে কোন বৃহৎ কম্পুটার গেইমের চরিত্র হিসাবে, বা অন্য কোন বিরাট ব্রেইনের মেমোরির ডেটা নিয়া।

2 thoughts on “ব্রেইন, সিমুলেশন ও আমাদের রিয়ালিটি নিয়ে প্রবন্ধ”

  1. মোঃ আরিফুল ইসলাম

    ভাই সিরিয়াসলি এইে লেখা ও মানসিকভাবে ধাক্কা দিলো।এনিওয়ে এই জিনিস আবার আইডেন্টিটিতে দেখানো হয়েছে।যেটা নোলানদের চাইতেও আগেকার সিনেমা সম্ভবত।যেখানে ছেলেটা নিজেই নিজের সাতটা রূপ তৈয়ার করে তাদের হত্যা করে নিজেই।আইডেন্টিটি আমি দেখলেও কিছু জিনিস এমন ঘোরলাগা যে কুলকিনারা করা যায় না।

  2. মেমোরিকে ধাপে ধাপে পুনর্নির্মাণ করে কিভাবে সাইকো থেরাপিস্টরা মানুষকে ট্রমা থেকে বের করে আনে, লেখার এই অংশটা দারুণ ছিল! সত্যি বলতে, পুরো লেখাটাই ভালো ছিল, বেশ থট প্রভোকিং! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ!

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং