মুরাদুল ইসলাম » ব্লগ » পারসুয়েশনের সাইকোলজিঃ কীভাবে সেরা স্লোগান?

পারসুয়েশনের সাইকোলজিঃ কীভাবে সেরা স্লোগান?

স্লোগান হচ্ছে পারসুয়েশনের একটি পাওয়ারফুল জায়গা। স্লোগানে মূলত ব্র্যান্ডিং এর কাজটা হয়, এবং খুব দ্রুত মানুষের মাথায় একটা ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করা যায় এর মাধ্যমে। বড় ছোট কোম্পানিগুলি স্লোগান ব্যবহার করে। তেমনি ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের সময় বা নির্বাচন পরবর্তীকালে দেশ শাসনের কোন কোন চ্যালেঞ্জে।

নির্বাচনে ব্যবহৃত স্লোগান কী হবে, কীভাবে এটি পার্টির ভিশনকে উপস্থাপন করবে ও অভারল ব্র্যান্ডিং করবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য প্রফেশনাল পি আর/ মার্কেটিং ফার্ম হায়ার করা হয়ে থাকে। মানুষের সাইকোলজি সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা এমন ফার্ম থেকে অসাধারণ স্লোগান তৈরি হতে পারে, যেগুলি ঐ রাজনৈতিক দলকে তাদের প্রচারণায় অনেক এগিয়ে দেয় দ্রুতই।

তবে, একটা কথা এখানে খেয়াল করা উচিত। আমি বলছি না স্লোগান এমন কোন জাদুর কাঠি যা একাই কোন দলকে জিতিয়ে দিতে পারে। এটি সম্ভব নয়। স্লোগান জাদুর কাঠি, কিন্তু তার ক্ষমতা এতোটা বেশি নয়। একটি দল জিতবে কি না তা কনটেক্সট (দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থা, দলের প্রচারণা, দলের ইশতিহার, সমাজের মনোভাব ইত্যাদি) দলের নেতাদের ক্যারিশমা, এবং দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থা কতটুকি নিরপেক্ষ ইত্যাদি বিষয়ের উপরেই নির্ভর করে বেশি।

ভারতে ১৯৬৫ সালে কংগ্রেস নেতা, দ্বিতীয় প্রধামনত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘জয় জওয়ান, জয় কিষাণ।”

পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে তখন দেশে খাদ্যের অভাব রয়েছে। এমতাবস্থায়, এই স্লোগানটি মারাত্মক শক্তিশালী হয়ে উপস্থিত হয়। এর একটি বিশ্লেষণ,

জয়ঃ খুবই শক্তিশালী একটি পজেটিব শব্দ। এটি আশা দেয়, এবং মানসিক শক্তি বাড়ায়।

জয় জওয়ানঃ অর্থাৎ, সেনাদের উদ্বুদ্ধ করেছে এই অংশ, যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ছে।

জয় কিষাণঃ এখানে কৃষকদের জয় ঘোষণা করছে। দেশের খাদ্যাভাব দূর করতে যারা কাজ করে যাচ্ছেন ও তারা যেন হতাশ না হন, এবং কাজ চালিয়ে যান।

এটি সবচাইতে অসাধারণ স্লোগানদের একটি হয়ে থাকবে, বলা যায় পৃথিবীর স্লোগানদের ইতিহাসে।

২০০৪ এর নির্বাচন থেকে ভারতে পেশাদার ফার্ম হায়ার করতে থাকে রাজনৈতিক দলগুলি স্লোগানের জন্য।

২০০৪ এর নির্বাচনে বিজেপি দ্বিতীয় দফা জেতার জন্য লড়ছে। তাদের স্লোগান ছিল, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং।’

প্রতিপক্ষ কংগ্রেস এর কাউন্টার দিতে কার্যকরী স্লোগান নির্বাচন করে, ‘আম আদমী কো কিয়া মিলা?’

বুঝলাম ইন্ডিয়া শাইন হচ্ছে, কিন্তু আম জনতার কী হলো?

ঐ ইলেকশনের বাস্তবতার সাথে এই স্লোগানটি খুব যায়। আম জনতা তথা সাধারণ ভোটারেরা হয়ত এটা অনুভব করতে পারছিলেন আসলে ইন্ডিয়া শাইন করতে পারছে না। কারণ সত্যি শাইন করে থাকলে তাদের ভাগেও কিছু মিলতো। কংগ্রেস এই জায়গাটিতে নাড়া দিতে পেরেছিল তাদের স্লোগানের মাধ্যমে।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে যিনি স্লোগান তৈরি করেন তার নাম পিযুশ পান্ডে। এই ভদ্রলোক অগলিভি নামক এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার গ্লোবাল চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার হিসেবে কাজ করেন।

মোদি গুজরাতের মূখ্যমন্ত্রী থাকতে একবার পিযুশ তার হয়ে কাজ করেছিলেন। ট্যুরিজমের এক ক্যাম্পেইনে।

তার নির্বাচনে মার্কেটিং করার অভিজ্ঞতা ছিল না।

পান্ডেই বিজেপিকে ব্রিফ দেন যে ব্র্যান্ডিং করতে হবে মোদিকে ফোকাসে রেখে। মোদিকেন্দ্রিক হবে ব্র্যান্ডিং। তার কথা ছিল, লিডার লিড করবেন, পার্টি নয়। তাই লিডারই ফোকাসে থাকবেন।

এবং পলিটিক্যাল নয়, সাধারণ ও সহজ শব্দ ব্যবহার হবে।

পারসুয়েশনের একটি শক্তিশালী রুল হলো, বক্তব্য হতে হবে সহজ। যা বলছেন বা লিখছেন তা হতে হবে সহজ। মনে রাখার মত।

এভাবেই তৈরি হল স্লোগান, ‘আব কি বার, মোদি সরকার।’

বিজেপি সরকার না বলে সরাসরি মোদি সরকার।

ছবিঃ প্রতিকী মাস্টার পারসুয়েডর।                                                                                            ছবি ক্রেডিটঃ David Cassolato

২০১৯ সালের মে’তে মোদি পুনরায় নির্বাচিত হলেন। এখানেও স্লোগান বানানো হয়েছে তাকে কেন্দ্র করেই।

‘মোদি হ্যায় তো, মুমকিন হ্যায়।’

মানে, মোদিই সম্ভব করেন।

মজার একটি ব্যাপার হলো, এই নির্বাচনে কংগ্রেস তাদের স্লোগানের কাজ দিয়েছিল পাঁচটি এজেন্সিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদের কাজ নিয়ে পার্টির দায়িত্বশীল কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। ফলে একের পর এক বাদ দিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু স্লোগান তৈরি হয় নি।

পরে ইলেকশনের আগে স্লোগান আসে, ‘আব হোগা ন্যায়’।

দূর্বল একটি স্লোগান।

এখন হবে ন্যায়, এই স্লোগানটি পার্টির নিজস্ব আশাবাদ ব্যক্ত করে। তারা আশা করছে ন্যায় হবে ও তারা জিতবে। কিন্তু মানুষের জন্য এতে কি মেসেজ আছে?

পক্ষান্তরে মোদির স্লোগানটিতে ছিল, সম্ভব করবেন তিনি অসম্ভবকে।

যেমন করেছেনও সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল করে দিয়ে!

এছাড়া তারা বিজেপিকে আক্রমণ করে যে স্লোগানটি দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছিল কংগ্রেস তা হলো, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়।’

এটি একটি আরো বাজে একটি স্লোগান ছিল।

রাহুল গান্ধী এটি শুরু করেন। কারণ মোদি নিজেকে বলেছিলেন চৌকিদার। যিনি দূর্নীতি যাতে কেউ করতে না পারে তা দেখে রাখেন। ২০০৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগই ছিল দুর্নীতির।

রাহুল গান্ধী রাফায়েল ফাইটার জেট বিমান চুক্তিতে দুর্নীতি হয়েছে এই অভিযোগে মোদিকে আক্রমণ করে বলেন, চৌকিদার চোর হ্যায়।

কংগ্রেসের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়।

কিন্তু, এটি ছিল বুমেরাং।

বিজেপির স্ট্র্যাটেজিস্টেরা সুযোগ কাজে লাগান।

মোদিকে পালটা স্লোগাণ ঘোষণা দেন যে, “ম্যায় বি চউকিদার।”

টুইটার একাউন্টের নাম বদলে রাখেন, চৌকিদার নরেন্দ্র মোদি।

অমিত শাহ সহ আরো কয়েকজন বিজেপি নেতা তাদের টুইটার নামের পাশে লাগান চৌকিদার।

কারণ তারা এখনো দেশ জোরে দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত হন নি। ফলে প্রথম অংশের চৌকিদারকে নিজেদের প্রচারণার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করে নিতে পারলেন।

তারা যে দেশের চৌকিদার তথা দেখে রাখছেন, এটি আবার প্রচার হলো, আরো জোরেসোরে।

আর, চোর হ্যায় অংশটি স্মরণ করিয়ে দিল কংগ্রেসের চুরি বা দুর্নীতির ইতিহাস।

এভাবে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন চৌকিদার ময় হয়ে উঠায় ক্ষতি হলো কংগ্রেসের। লাভ হলো বিজেপির।

যদিও স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়েছিল এবং কংগ্রেস হিউমেন সাইকোলজি না বুঝে ভেবেছিল এটি মোদিকে ধরাশায়ী করতে কাজে দিবে। মোদি দুর্নীতিবাজ বলে পরিচিত হলে হয়ত এটি কাজে আসতো। কিন্তু তা না হওয়ায়, বরং কংগ্রেসের গায়েই পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতির তকমা লেগে থাকায় তাদের ক্ষতি করলো স্লোগানটি।

কংগ্রেসের মারাত্মক বাজে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি এই দুই জিনিস দ্বারাই প্রমাণ হয়। এক, চৌকিদার স্লোগান। দুই, পাঁচ ফার্মকে দায়িত্ব দিয়ে স্লোগান ঠিক করতে সময় পেরিয়ে যাওয়া।

কংগ্রেস সম্ভবত এখনো পারসুয়েশনের সাইকোলজি বিষয়ে এক্সপার্ট কোন ব্যক্তি বা দলকে পায় নি লয়াল হিসেবে।

মোদি পেয়েছেন।  বিজেপির এই এক্সপার্ট হলেন, প্রশান্ত কিশোর। এছাড়া পিযুশ পান্ডের কথা তো উপরেই বললাম। গোপন আরো পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট থাকতে পারেন।

ধরা হয়, মোদির স্লোগান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্লোগান বানিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য কাজ করা ফার্ম। এমনকী মাস্টার পারসুয়েডর ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ নির্বাচনে ইন্ডিয়ান আমেরিকান ভোটারদের টার্গেট করে হিন্দিতে স্লোগান দিয়েছিলেন, “আব কি বার, ট্রাম্প সরকার।”

বিজেপির ২০১৪ সালে একটি স্লোগান ছিল, আচ্ছে দিন আনে ওয়ালে হ্যায়। অর্থাৎ, সুদিন আসছে। সুন্দর ভবিষ্যত আসছে।

এর মত পারসুয়েশনে শক্তিশালী স্লোগান খুবই কম আছে। এই স্লোগান মানুষের হোপ তথা ভালো দিনের আশাতে ট্রিগার করে। পারসুয়েড করার জন্য এটি একটি মূল জায়গা।

এই স্লোগানটি মোদি নিয়েছিলেন কংগ্রেসের মনমোহন সিং এর প্রেস রিলিজের বক্তব্য থেকে!

যে ঐ প্রেস রিলিজ লিখেছে সেও হয়ত বুঝতে পারেন নি এটি কেমন শক্তিশালী। মোদি বা বিজেপির স্ট্র্যাটেজিস্টেরা ধরে ফেলতে পারেন।  এক সপ্তাহ পরে তারা এটাকে স্লোগাণ হিসেবে বলতে থাকেন।

এখানেই ভালো স্ট্র্যাটেজিস্ট বা মানুষের সাইকোলজি বুঝা এক্সপার্টদের দক্ষতা।

একই জিনিস অনেক অনেক লোক দেখে ও পরে। কিন্তু প্রতিভাবান ও দক্ষরা এখান থেকে বের করে নেন অসাধারণ কিছু যা অন্যরা দেখতেই পায় নি। এই কারণে এইসব স্কিল কখনো রোবট দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে না। কারণ এগুলি উচ্চমাত্রার ক্রিয়েটিভ কাজ।

মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী স্লোগান। এটিতে যে গভীর ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে, তা সাধারণ কোন ব্যক্তি দেখলে বুঝতেই পারবেন না। তেমনি আচ্ছে দিন আনে ওয়ালে হ্যায় –এর ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝা সহজ কাজ নয়।

নিউরোফিলোসফির দিক থেকে মানুষের স্বভাব বা চরিত্রকে পরিচালিত করে পাঁচটি ফ্যাক্টর। নিউরোসাইন্টিস্ট নায়েফ আল রোদান একে বলেন নিউরো-৫। এগুলি হলো,

পাওয়ার মানে ক্ষমতা

প্লেজার মানে সুখ

প্রফিট মানে লাভ

প্রাইড মানে গর্ব

পার্মানেন্সি অর্থাৎ টিকে থাকা বা স্থায়িত্ববাসনা

স্লোগানে যদি এই পাঁচটি বা কয়েকটি শক্তভাবে প্রকাশিত হয় তাহলে মানুষেরা প্রভাবিত হবে, ধরে নেয়া যায়।

আচ্ছে দিন আনে ওয়ালে হ্যায় তে আছে আগামীর সুদিনে লাভের আশাবাদ ও পার্মানেন্সি অর্থাৎ ভালো ভাবে টিকে থাকা, সন্তান জন্ম দান, সম্পত্তি ভোগ সহ এ জাতীয় যাবতীয় জিনিসের প্রকাশ।

মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইনে কাজ করেছে,

মেইক অংশে পাওয়ার। এই শব্দটি খুবই এক্টিভ শব্দ। ফোর্স ও এনার্জিকে প্রকাশ করে।

আমেরিকা হলো প্রাইডের অংশ। এবং আত্মপরিচয়।

গ্রেট আবারো পাওয়ার, এবং প্রফিটকে প্রকাশ করে। আমেরিকা গ্রেট হলে লাভ হবে তাদের, এটা ভোটাররা জানে।

এগেইন এ বলা হলো আবারো। অর্থাৎ, আগে গ্রেট ছিল। এই সরকারের আমলে খারাপ হয়েছে। এখন আবার একে গ্রেট করার সুযোগ দিন।

পুরো স্লোগানটি আশাবাদী, শক্তিশালী এবং খুবই সহজ।

স্লোগানে নেগেটিভ শব্দ ব্যবহার বেশিরভাগ সময় ভুল হয়। কারণ মূল বাক্য যাই হোক না কেন প্রথমে বা মাঝে নেগেটিভ শব্দটি মানুষের ব্রেইন নিয়ে নেয়, এবং এর সাথে সম্পর্কিত করে জিনিসটাকে দেখে।

এটি সাথে সাথে হয় না। যখন শুনছে স্লোগান তখন তো স্লোগান শুনছে। কিন্তু পরে যখন তার ব্রেইনে এ নিয়ে স্মৃতি জমা হয় তখন যে শব্দ নিয়েছে সেটির সাথে মিলিয়েই জমা হয়। ফলে ভুল স্লোগান ভুল ইমেজ তৈরি করে।

যেমন গুগলের বিখ্যাত ট্যাগলাইন বা স্লোগান বা কোড অব কন্ডাক্ট লাইন ছিল, ডোন্ট বি ইভিল।

এই নেগেটিভ স্লোগানটি এবং ইভিল শব্দটির একটি শক্তিশালী প্রভাব আছে গুগলের বর্তমান কর্পোরেট ইভিল হিসেবে পরিচিত হবার পেছনে। ২০১৫ সালে তাই গুগল (এলফাবেট ইঙ্ক) স্লোগান বদলে রাখে পজেটিভ শব্দে, ডু দ্য রাইট থিং। স্লোগানের ক্ষমতা এতো বেশি যে, এখন আর বদলালেও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ ইতিমধ্যেই গুগল ক্রিটিকদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছে।

 

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

×
গুরুত্বপূর্ণ
Scroll to Top
বই মডেলিং